Friday, August 17, 2012

বার্মা-আরাকানের নির্যাতিত মুসলমানঃ আমাদের দায়


কাশ্মীর, ফিলিস্তিন, বসনিয়া, চেচনিয়া ও মরো মুসলমানদের ন্যায় আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলমানরাও মজলুম মুসলমান। ধর্মনিরপেক্ষতা ও প্রগতির বুলি আওড়ানো হিন্দু-ইহুদী, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী কর্তৃক এসব মসুলমানরা শুধমুাত্র ধর্মীয় কারণেই যুগ যুগ ধরে নির্যাতনে নিঃশেষ হতে চলেছে। স্বতন্ত্র মুসলিম জাতিসত্ত্বার কারণেই এরা আজ নির্যাতিত, নিপীড়িত, উদ্বাস্তু এবং নিজদেশে পরবাসী হিসেবে জুলুমের শিকার হচ্ছে। আমরা যারা ইসলামে বিশ্বাসী অথবা যারা বিশ্বাসে মসুলিম হয়েও কর্মে মুসলিম বিদ্বেষী তাদেরও দায় রয়েছে এসব নির্যাতিত মুসলমানদের সহযোগিতা করা। কেননা এসব দেশের ঈমানদার মসুলমানদের সাথে নামকাওয়াস্তে মসুলমান বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ইসলাম বিদ্বেষী মসুলমানরাও বিধর্মীদের নির্যাতন থেকে রেহাই পাচ্ছে না। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল মুসলমান(!) হওয়া সত্ত্বেও ইয়াসির আরাফাতকে জীবন দিতে হয়েছে স্লো পয়ঃজনিংয়ের দ্বারা, সাদ্দাম হোসেন ও ময়ুাম্মার গাদ্দাফিকে ও লাঞ্ছনার মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে এবং বামপন্থী কমিউনিস্টি বাশার-আল আসাদকেও মৃত্যু গহ্বরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে প্রগতিশীল নামক বিধর্মী ক্রুসেডাররা। উপরোক্ত নির্যাতিত মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে দর্ভুাগ্যবান হলো বার্মার মুসলমানরা। কেননা অন্যদের নাগরিকত্বের পরিচয় আছে কিন্তু রোহিঙ্গা মুসলমানরা হাজার বছর ধরে আরাকানে বাস করে ও সেদেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকতৃ নয়। তারা এখন বিশ্বের দেশে দেশে এবং নিজদেশে নাগরিকত্বহীন, নাগরিক অধিকারবিহীন উদ্বাস্তুর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।

ভৌগোলিক দিক থেকে আরাকানের অবস্থান ৯২০ থেকে ৯৪.৯০ পর্বূ দ্রাঘিমাংশে এবং ২১.৯০ উত্তর অক্ষাংশের মধ্যে। আরাকানের প্রকৃত আয়তন ১৬,৫০০ বর্গমাইল, কিন্তু ১৯৭৪ সালে বার্মার সরকারি মানচিত্রে ও নথিপত্রে ১২,৬৪২ বর্গমাইল উল্লেখ করা হয়েছে। (সূত্র- বাংলা বিশ্বকোষ, ১ম খ-, পৃ- ২২৩)। ১৯৭৪ সালে বর্মী সরকার আরাকান নাম পরিবর্তন করে রাখাইন রাজ্য নামকরণ করে। ১৯৩১ সালে ব্রিটিশ সরকার পরিচালিত আদমশুমারি রিপোর্ট অনুযায়ী বার্মার মোট জনসংখ্যা ১,৪৬,৫৩,৯৭৭ জন; তন্মধ্যে মুসলিম ৫,৮৪,৮৩৯ জন। আরাকানের মসুলমানদের সংখ্যা এখানে উল্লেখিত হয়নি। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ড. আবদলু করিম তাঁর ‘রোহিঙ্গাদের হাজার বছরের ইতিহাস’ নামক প্রবন্ধে লিখেছেন, “আরাকানের লোকসংখ্যা আনমুানিক ৪০ লক্ষ। তন্মধ্যে বৌদ্ধ ২০ লাখ, মসুলমান ১০ লাখ, জড়বাদী ৮ লাখ, হিন্দু ও খ্রিস্টান ২ লাখ। বৌদ্ধরা আরাকানে মগ নামে পরিচিত এবং মুসলমানরা রোহিঙ্গা নামে পরিচিত।” ২২-০৬-১২ তারিখে জাতিসংঘ প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী আরাকানে বর্তমানে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা আট লাখ। মসুলমানদেরকে হত্যা ও বহিষ্কার করে এবং বার্মার বৌদ্ধদেরকে পুনর্বাসন করে বার্মা সরকার আরাকানের মুসলমানদের অবস্থান প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে।


আরাকানের সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক ইতিহাস-

খ্রিস্টপর্বূ ২৬৬৬ সাল থেকে ১৪০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আরাকান মোটামুটি স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল বলে ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন।১ বেশিরভাগ সময়ে আরাকান উত্তর ও দক্ষিণে ২টি রাজ্যে বিভক্ত ছিল। খ্রিস্টপর্বূ ২২০০ থেকে ২০০০ খ্রিস্টপর্বূ  শতাব্দীতে উত্তর বিহারের মগধ থেকে আগত অনেক হিন্দু-বৌদ্ধ ও জৈন বঙ্গে, আরাকানে ও বার্মায় ধর্মপ্রচার ও উপনিবেশ স্থাপন করতে আসে। তখন থেকে আরাকান ও বার্মার শাসকগণ নিজেদেরকে মগধ রাজবংশীয় হিসেবে পরিচিত করার জন্য মহৎচন্দ্র, সুলতচন্দ্র, নরপতিগী, চন্দ্রসুধর্মা, শ্রীসুধর্মা খেতাব গ্রহণ করতো এবং রাজধানীর নাম ভারতীয় নামে বৈসালী, ধন্যাবতী, চম্পাবতী রেখেছিল।২ অপর ঐতিহাসিক তথ্য হলো- সম্রাট অশোকের মগধ বিজয়কালীন মগধ থেকে বিতাড়িত হয়ে যারা আরাকানে আশ্রয় গ্রহণ করেন তারাই আরাকানের মলূ মগ  জনগোষ্ঠী। খ্রিস্টীয় ২য় শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত চন্দ্র-সর্যূ ও কোলসিংহ চন্দ্রবংশ আরাকান শাসন করেছে।

দশম শতাব্দীতে সান উপজাতি কিছুদিনের জন্য আরাকান দখল করেছিল। দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বার্মার প্যাগান বংশ (1044- 1287) উত্তর আরাকানকে সাময়িকভাবে সামন্তরাজ্যে পরিণত করেছিল। (G.E Harvey, History of Barma, P.138)

বার্মার আক্রমণে টিকতে না পেরে ১৪০৬ খ্রিস্টাব্দে আরাকানরাজ নরমিখলা সদলবলে গৌড়ের সলুতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের দরবারে আশ্রয় লাভ করেন। ১৪০৬ সাল থেকে ১৪৩০ সাল পর্যন্ত আরাকান বার্মার অধীনে ছিল। ১৪৩০ সালে গৌড়ের সুলতান জালালদ্দুীন মহুাম্মদ শাহ (যদু) দুই পর্যায়ে ৫০ হাজার সেনা সহায়তা দিয়ে তাঁকে আরাকানের সিংহাসনে পনুঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। ১৪৩০ সাল থেকে ১৫৩০ সাল পর্যন্ত ১০০ বছর আরাকান গৌড়ের করদরাজ্য ছিল। (সত্রূ- আরাকান, রাজসভা, ড. মহুম্মদ এনামলু হক/আবদলু করিম সাহিত্য বিশারদ, তৎসূত্র-J.A.S.B vol-13, Part-1, 1844, P-46)

১৫৫৪ সালে দিল্লীর সম্রাট শের শাহের জ্ঞাতি শামসদ্দুীন মোহাম্মদ শাহ গাজী সমগ্র চট্টগ্রাম ও উত্তর আরাকান জয় করেন। ১৫৮০ সালে সমগ্র চট্টগ্রাম আরাকানের অধীনে যায় এবং মোগল বিজয় পর্যন্ত (২৭-০১-১৬৬৬ইং) চট্টগ্রাম আরাকানের অধীনে ছিল। ১৭৮৫ সালে বার্মার রাজা বোধপায়া আরাকান দখল করে অবর্ণনীয় জলুমু শুরু করেন। তাঁর অত্যাচারে আরাকানের মগ ও রাখাইনরা পালিয়ে বাংলাদেশে এসে স্থায়ীভাবে থেকে যায়। কক্সবাজার ও বাকেরগঞ্জের রাখাইন সম্প্রদায় এবং বান্দবানের মারমা (মগ) সম্প্রদায় উক্ত সময়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

১৪০৬ সাল থেকে ১৪৩০-এর মধ্যে আরাকানের অনেক মগ  বা রাখাইন বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় এবং ১৬৬৬ সাল থেকে ১৭৮৫ সালের মধ্যে আরাকানের করদরাজ্য ‘চকোমা’ (বর্তমান মিজোরাম) থেকে বর্তমান চাকমা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে এসে বসতি স্থাপন করে। মোগল প্রশাসকদের বদান্যতায় চাকমারা দলে দলে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে বসতি স্থাপন করে। ১৭৮৫ সাল থেকে ১৮২৫ সাল পর্যন্ত আরাকানে বার্মার শাসন, ১৮২৬ সাল থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসন, ১৯৪২ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জাপানি শাসন এবং পনুরায় ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসন এবং ১৯৪৮ সাল থেকে অদ্যাবধি পর্যন্ত বর্মী শাসনের কাল।

আরাকানের জাতিগত (নৃতাত্ত্বিক) ইতিহাস

আরাকানের প্রাচীন জনগোষ্ঠী The southern মঙ্গোল বা দক্ষিণী মোঙ্গল শ্রেণীর। তিব্বতের মালভূমিতে এদের উদ্ভব ও বিকাশ। আরাকানের মধ্যবর্তী জনগোষ্ঠী হলো- বিহারের মগধ এলাকার বৌদ্ধ, হিন্দু ও জৈন আগন্তুকগণ। এদের কেউ কেউ মঙ্গোলয়েড এবং কেউ কেউ আলপাইন শাখার মানষু। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতক থেকে আরাকানে ব্যবসা- বাণিজ্য উপলক্ষে বিপলুসংখ্যক আরবী, ইরানী, তর্কুী, ভারতীয় ও বাংলাদেশী বসতি স্থাপন করেছে। এদের বেশিরভাগ ককেসয়েড মানবধারার আলপাইন শাখার মানুষ। বর্তমানে আরাকানের জনগোষ্ঠী প্রধানত ২ ভাগে বিভক্ত। প্রথমোক্তরা হলো রাখাইন বা মগ দ্বিতীয়াক্তরা হলো রোহিঙ্গা বা মসুলমান। আরবীয়, ইরানী, ভারতীয় ও বাংলাদেশী মানুষের সাথে স্থানীয় মগদের মিশ্রণে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে। রাখাইনদের ভাষা চীন-তিব্বতি ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত, রোহিঙ্গাদের ভাষা আরবী- ফার্সী, উর্দু ও বাংলা ভাষার মিশ্রণে গঠিত হয়েছে। অধিকাংশ রাখাইনের ধর্ম হলো থেরবাদী বৌদ্ধধর্ম। এই ধর্ম হীনযানী বৌদ্ধ ধর্মের একটি শাখা। হীনযানী বৌদ্ধ ধর্মের গ্রন্থসমূহ পালিভাষায় লিখিত। ইসলামধর্ম যেরূপ আরাকানে বহিরাগত ঠিক তদ্রুপ বৌদ্ধ, হিন্দু ও খ্রিস্টানধর্ম বহিরাগত।

আরাকান ও বার্মায় মসুলমানদের আগমনের ধারা-

বার্মা ও আরাকানে মসুলমানদের প্রথম আগমন ঝড়ের কবলে পড়ে আরব মুসলমানদের বাণিজ্যতরী আরাকান উপকূলে ডুবে যাওয়ার মাধ্যমে শুরু হয়। মূলতঃ ইসলামের আবির্ভাবকালে আরব ব্যবসায়ীগণ লোহিত সাগর থেকে চীনা উপকলূ পর্যন্ত বিস্তৃত বাণিজ্য পথের নিয়ন্ত্রণ করতো। ইসলামের আবির্ভাবের পরে আরবীয় ও ইরানী মসুলিম ব্যবসায়ীরা তাদের যাত্রাপথে অসংখ্য মসুলমান ব্যবসায়ী কলোনি স্থাপন করে। ৮ম শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত বার্মা ও আরাকানে মসুলমানদের বেশ কয়েকটি বাণিজ্য কলোনি স্থাপিত হয়। এ বিষয়ক কয়েকটি ঐতিহাসিক তথ্য নিম্নরূপ-
 (১) মসুলমান নাবিকগণ নবম শতাব্দীতে বার্মায় অবতরণ করে। তাদের নিকট বার্মা নামে যে এলাকাটা পরিচিত ছিল তা ছিল নিম্ন বার্মার উপকলূীয় অঞ্চল ও আরাকান। (সূত্র-G.E. Harvay,History of Burma,P. 10)

(২) চীনা পরিব্রাজকগণ ৮৬০ খ্রিস্টব্দের দিকে বার্মা ও ইউনান সীমান্তে পারস্য দেশীয়দের কলোনি দেখতে পেয়েছিলেন। ... এ তথ্য সত্রূগুলোতে যে পেগু (নিম্নবার্মার রাজধানী) নাবিকদের উল্লেখ রয়েছে তারা ছিল আরব এবং পারস্য দেশীয়। এরা পেগু শহরে বসতি স্থাপন করেছিল অথবা তারা ছিল এদের বংশধর। মুসলমান বাণিজ্য কলোনিগুলো নবম শতাব্দীনাগাদ পেগুতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং আরবদের বাণিজ্যতরী প্রায়ই এখানে ভিড়ত। (সূত্র- সিদ্দিক খান, Muslim Inter-cource in Burma. P.417)

(৩) রাশিয়ান ব্যবসায়ী আথানাসিয়াস নিচি যিনি ১৪৭০ সালে এশিয়া ভ্রমণ করেন। তিনি পেগু বন্দরটিকে “ভারতীয় দরবেশদের একটি উপনিবেশ” বলে বর্ণনা করেছেন। [সূত্র- কোর্টিনে লক সম্পাদিত The first Englishman in India (London,Jorge Rutlage 1903) P. 121]

(৪) ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারত ভ্রমণরত পর্তুগীজ পরিব্রাজত দূয়ার্তে বারবারোসা উল্লেখ করেছেন- “পেগুতে অনেক মসুলমান বাস করে। মরুীয় (মুসলমান) বাণিজ্য জাহাজগুলো পেগু থেকে চিনি, রন্ত্যক দ্রব্যাদি ও পদ্মরাগমনি রপ্তানি করে এবং কার্পাস, রেশম, আফিম, তামা, রূপা, ঔষধী ভেষজদ্রব্য ইত্যাদি আমদানি করে। পেগুর অধীনস্থ মার্তাবান এমন একটি শহর যেখানে মসুলমানরা বাস করে। (সূত্র- J.S. Farnival,Europians in Burma: The Early Porfuguse থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন ইসরাইলী গবেষক ও কূটনীতিক মোসে ইগার)।

(৫) সপ্তদশ শতাব্দীতে শ্যামরাজ্য শাসিত মারগুই ছিল মসুলমানদের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র। ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে মারগুই এ অবস্থানেরও জনৈক ব্রিটিশ বণিক বলেন, “মুসলমানরা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতো। গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদগুলোই মসুলমানদের দখলে ছিল। মারগুই-এর গভর্নর, টেনাসসেরিম প্রদেশের ভাইসরয় এবং টেনাসসেরিম থেকে অযোধ্যা পর্যন্ত বিস্তৃত স্থলপথের উপর অবস্থিত প্রধান শহরগুলোর গভর্নরেরা ছিল ভারতীয় এবং পারস্য দেশীয় মসুলমান। ....সপ্তদশ শতাব্দীর শেষেরদিকে ব্রিটিশ এবং ফরাসীরা এতদাঞ্চলে প্রভাবশালী হলে অধিকাংশ মসুলমানকে পদচ্যুত করা হয় এবং অনেককে হত্যা করা হয়। [সূত্র-Moris Colis, Siamse white(London Favaur & Favour-1936)P-36-39]।

বিজেতা হিসেবে মুসলমানদের বার্মায় ও আরাকানে আগমন-

(১) দিগ্বিজয়ী সম্রাট চেঙ্গিস খানের পৌত্র চীন সম্রাট কবুলাই খানের আমলে তাঁর ইউনান প্রদেশের শাসনকর্তার ছেলে সেনাপতি নাসির উদ্দীন ১২০০০ অশ্বারোহী ও তীরন্দাজ সৈন্য নিয়ে বার্মা অধিকার করেন। এ বাহিনীতে বিপলুসংখ্যক মুসলমান ও তাতার ছিল। তখন বার্মার রাজবংশকে প্যাগান রাজবংশ বলা হতো। (সত্রূ- Yule রচিত The book of Sir Marko Polo. P-11, 99)।

(২) ১৪৩০ সালে গৌড়ের সলুতান জালালুদ্দীন মহুাম্মদ শাহ (যদু) দইু পর্যায়ে ৫০,০০০ সেনা সাহায্য দিয়ে গৌড়ে আশ্রিত আরাকানরাজ নরমিখলা ওরফে সোলায়মান শাহকে আরাকানের রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। বার্মার আক্রমণ প্রতিহত করতে এ পঞ্চাশ হাজার পাঠান ও তুর্কী সৈন্য আরাকানে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে। এরাই বর্তমানে রোহিঙ্গা জাতি গঠনের মূল নিয়ামক।

(৩) ১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীর সম্রাট শেরশাহ- এর জ্ঞাতি শামসদ্দুীন মোহাম্মদ শাহ গাজী সমগ্র চট্টগ্রাম ও উত্তর আরাকান জয় করেন।

বার্মায় ও আরাকানে প্রধান প্রধান মসুলিম বসতিসমূহ-

ব্যবসায়ী হিসেবে, ভাড়াটিয়া সৈন্য হিসেবে, যদ্ধুবন্দী হিসেবে, বিজেতা হিসেবে বার্মা ও আরাকান সরকারের কর্মচারী-কর্মকর্তা হিসেবে মুসলমানরা বার্মা ও আরাকান সরকারের অনমুতি সাপেক্ষে উক্ত দুই দেশে বসতি স্থাপন করেন। মুসলিম ব্যবসায়ীরাই বার্মা ও আরাকানকে ব্যবসা সফল দেশ হিসেবে গড়ে তোলেন মসুলমান রাজনীতিক ও সেনাবাহিনীর লোকেরাই শক্তিশালী এবং আধুনিক দেশ হিসেবে গড়ে তলুতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। উভয় সরকারের অশ্বারোহী বাহিনী, নৌবাহিনী ও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার মুসলমানরাই প্রতিষ্ঠা করেছিল। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি ঐতিহাসিক তথ্য নিম্নরূপ-

(১) বার্মা রাজা আনরঠার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সলু (Sawlu) (১০৭৭-১০৮৪) বার্মার রাজা হন। সলুর গৃহশিক্ষক ছিলেন একজন মসুলমান। উক্ত গহৃশিক্ষকের পত্রু রহমান খান এবং সলু দুধভাই ছিলেন। ক্ষমতালাভের পর সলু তাঁর দধুভাইকে উসসা (USSA) নগরীর শাসনকর্তা নিযক্তু করেন। সলরু পর তাঁর সৎভাই সানজিথা বার্মার রাজা হন। তাঁর আমলে বার্মার কয়েকটি এলাকায় মুসলিম উপনিবেশ গড়ে উঠে। (G.E. Harvay,History of Burma,P. 24/27/31)।

(২) গৌড়ের সলুতান জালালুদ্দীন মোহাম্মদ শাহ (যদ)ু ১৪৩০ সালে ৫০ হাজার সেনা সাহায্য দিয়ে আরাকানকে বার্মার দখল থেকে মক্তু করেন এবং বিতাড়িত আরাকানে রাজা নরমিখলাকে আরাকানের সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। নরমিখলা ওরফে সোলায়মান শাহ্ ম্রোহং নামক স্থানে নতনু রাজধানী স্থাপন করেন। উক্ত রাজধানীর নিরাপত্তার জন্য নরমিখলা রাজধানীর চারপাশে মসুলিম বসতি স্থাপন করেন। উক্ত মুসলিম জনপদসমূহ হলোÑ রওয়াম নেদানপাড়া,  মোয়াল্লেমপাড়া, সাম্নুরিক, কুয়িপাড়া, কামারপাড়া প্রভৃতি। নিরাপত্তার জন্য নরমিখলা আরাকান-বার্মা সীমান্তেও মসুলিম বসতি স্থাপন করেন। (সত্রূ- আরাকানে মুসলমান : ইতিহাস ও ঐতিহ্য; সামিউল আহমদ খান, রোহিঙ্গা মসুলমান, পৃ.-২৭৬) একই সূত্রে বলা হয়েছে, এসব এলাকায় এখনো ৭টি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। যেগুলো বর্মীরাজ ও তাদের লেলিয়ে দেয়া মগদের দ্বারা লুণ্ঠিত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

(৩) আরাকানের ৫টি নদী লেম্রা, মিঙ্গান, কালাডন, মায়ু ও নাফ নদীর উভয় তীরে গড়ে উঠেছিল মসুলিম জনপদ। প্রধানতঃ চট্টগ্রামের মসুলমান বংশোদ্ভতু রোহিঙ্গা সম্প্রদায় অধ্যুষিত ছিল এ সকল জনপদ ও শত শত গ্রাম। এখনো মংডু, বুচিডং, রাসিডং প্রভৃতি মহকুমার অধিকাংশ গ্রাম বিশেষ করে নাফ, লেম্রা ও মিঙ্গান নদীর তীরঘেঁষে যতো জনপদ লক্ষ্য করা যায় সেসব জনপদে অর্ধেকেরও বেশিসংখ্যক বাসিন্দা রোহিঙ্গা মুসলমান। আগে এসব এলাকায় শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ, কোথাও কোথাও শতকরা ৯৮ ভাগ ছিল মসুলমান। কালাডান ও মায়ু নদীর তীরবর্তী চন্দনা, মিউরকলু, কাইনি পেরাং, কাইম পেরাং, সোলিং পেরাং, টংফরু, ডবে আফকচান, কেরী, কাজীপাড়া, কেওদা, রোহিঙ্গাপাড়া, রমজপুাড়া, আমবাড়ী, বাহারপাড়া, লখনৌপাড়া, টংটং মিরং, ফলুওয়ারী পালওয়ানপাড়া, মেয়কটং, মচ্ছারী আংপেরাং, রাজারবিল, রৌশন পেরাং, জোপেরাং, ছমিলা, রোহিঙ্গাডং, আলীখং মিন জং, ছুয়েক্রংডং, মরুছং, খোয়াংছং, লোয়াডং প্রভৃতি এলাকাগুলোতে রোহিঙ্গা মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। (সূত্র- আরাকানের মুসলমান : ইতিহাস ও ঐতিহ্য, সম্পাদনা- ড. মুহিব উল্লাহ সিদ্দিকী, প্রবন্ধকার- সামিউল আহমদ খান, প্রবন্ধ-‘রোহিঙ্গা মসুলমান’, পৃ.-২৮১)

এছাড়াও আরাকানের প্রধান প্রধান শহর ও বন্দরসমূহে বিপলুসংখ্যক মসুলিম বসতি দশম শতাব্দী থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়। উপকূলীয় এলাকায় কয়েকটি মুসলিম উপনিবেশ ছিল। এ সংক্রান্ত তথ্য হলো-

(১) বর্মী নারীগণ বিদেশিদের প্রতি ভদ্র ও সহানুভূতিশীল ছিল। বার্মায় বসবাসে লিপ্ত প্রায় অধিকাংশ ব্যবসায়ী বর্মী স্ত্রী গ্রহণ করতো। (সূত্র- Hamilton. Hall-Early English Inter-cource in Burma,P.984)

(২) Hamilton আরো লিখেন, “আরবীয় ফারসী এবং ভারতীয় মসুলমানদের বংশধররাই বার্মার মসুলিম জাতি। বর্মী ভাষায় ইহাদের ‘পথি’ বলা হয়। দ্রুত বংশবৃিদ্ধ এবং নতনু নতনু মুসলিম বণিকের আগমনের ফলে বার্মায় মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বার্মায় মসুলমান জাতির কিয়দংশ বার্মায় আগত প্রথম মুসলমান বণিকদের উত্তর-পুরুষ এবং অবশিষ্টাংশ মসুলিম বণিক ও বর্মী রমণীর বিবাহজাত সন্তান। বার্মায় ধর্মপ্রচারের দ্বারা ইসলাম বিস্ততৃ হয়নি। এই কৃতিত্ব ঐ আমলে বিভিন্ন দেশ হতে আগত মসুলিম নাবিক ও ব্যবসায়ীদের প্রাপ্য। (সূত্র- ঐ)।

বার্মা ও আরাকানে মসুলমানদের প্রভাব ও অবদান-

আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রচলন, বহির্বাণিজ্য, নৌবাহিনী গঠন, অশ্বারোহী বাহিনী গঠন, যুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার, আধুনিক মুদ্রাব্যবস্থাসহ সকল ক্ষেত্রে মসুলমানরাই বার্মা ও আরাকানকে প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক যুগে পদার্পণে প্রধান ভূমিকা পালন করে। এজন্য হাজার বছর ধরে মুসলমানদের সাথে আরাকানী ও বর্মীদের সৌহার্দ্যপর্ণূ সম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার বন্ধন অব্যাহত ছিল। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে বার্মায় ইউরোপীয়দের আগমন এবং পরবর্তীতে ইউরোপে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের পর থেকে ইউরোপীয়রা মসুলমানদেরকে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ও শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে। এ পর্যায়ে ব্রিটিশ ষড়যন্ত্র  ও Devide Rule পরিস্থিতির শিকার হয়ে মসুলমানরা অত্যাচার ও নিগ্রহের শিকারে পরিণত হয়। এতদসংক্রান্ত কয়েকটি ঐতিহাসিক তথ্য নিম্নরূপ-

(১) আরাকান রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ। তাদের মুদ্রায় ৭৯২ মথি (১৪৩০ খ্রি:) থেকে ১০০০ মথি (১৬৩৮ খ্রি:) পর্যন্ত মোট ১৫ জন রাজার বৌদ্ধ নামের সঙ্গে মসুলমান নাম পাওয়া যায়। (সূত্র- M. Robinson & L.A. Shaw: The coins of Banknote of Burma,Manchaster,1980.P.44-45)।

(২) ১৪৩০ সালের পূর্বে আরাকানের কোনো আধুনিক মুদ্রা ছিল না। আধুনিক মুদ্রা তৈরি করার জন্য আরাকানে কোনো কারিগর ছিল না। তাই আরাকানের রাজা বাংলা থেকে অভিজ্ঞ কারিগর নিয়োগ করে। মদ্রুায় আরবি ও বাংলা ভাষা এবং অক্ষরের উপস্থিতি প্রমাণ করে বাংলা থেকেই মুদ্রার কারিগররা আরাকানের টাকশালে নিযক্তু হয়। টাকশালের কর্মকর্তা- কর্মচারী ছাড়াও বিভিন্ন রকমের মুসলমান কর্মচারী, চিকিৎসক (হাকিম বা তবিব), কাজী, অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য, বণিক, ব্যবসায়ী ও কর্মজীবীগণ বাংলা থেকে আরাকান গমন করে। ড. আবদলু করিম, রোসাঙ্গে বাংলা সাহিত্য)।

(৩) ১৫০১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারত ভ্রমণরত পর্তুগীজ পরিব্রাজক দয়ূার্তে বারবারোসা উল্লেখ করেছেন, “অনেক মসুলমান পেগুতে (বার্মার তৎকালীন রাজধানী) বাস করে। মরুীয় দ্রব্যাদি ও পদ্মরাগমনি রপ্তানি করে এবং কার্পাস, রেশম, আফিম, তামা, রূপা, ঔষুিধ, ভেষজদ্রব্য ইত্যাদি আমদানি করে। পেগুর অধীন ‘মার্তাবান’ শহরে ও অনেক মসুলমান বাস করতো। [সূত্রÑ ঞযব উবষঃর ঝঁষঃধহধঃব (বোম্বাই, ভারতীয় বিদ্যাভবন, ১৯৬০) পৃ.-৬৫১, তৎসূত্র- J.S. Furnival, Eurupians in Barma, The early Portugese)।

(৪) পঞ্চদশ ও ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে টেনাসসেরিম ও মারগুই বন্দর ইউরোপীয় নাবিকদের নিকট সপুরিচিত ছিল। তারা বর্ণনা করেছেন যে, এগুলো মসুলিমপ্রধান শহর যার সাথে মালাক্কা, বাংলা ও মক্কার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। (সূত্র-D.C. Dcot “O” conor Mandalaya and Other cities of past in Barma(London, Hanchinchos, 1407, P.-405)।

(৫) ব্রিটিশ দূত মাইকেল সাইমন্স যিনি ১৭৯৫-৯৬ সালে এবং ১৮০২ সালে বার্মার রাজার সাথে আলোচনা করতে আসেন। তিনি তাঁর স্মৃতিগাথায় উল্লেখ করেন যে, “প্রচুরসংখ্যক বিদেশি যাদের মধ্যে মসুলমানদের সংখ্যা ছিল অত্যধিক এবং যারা বার্মায় স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেছিল তাদের সাথে লেনদেনের ব্যাপারে ক্রমবর্ধমান প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ এবং বিদেশীদের সাথে সংযোগ রক্ষা সম্পর্কিত পদগুলোতে এসব সম্প্রদায়ের বাছাইকতৃ লোকদের নিয়োগ করতে সরকার বাধ্য হয়। (সূত্র- M. Siddik Khan,Muslim Intercource with Barma,Islamic culture,P.-261.) তথ্যসূত্র Michel Simons, Second Embassy to Ava-P.198।


সেনাবাহিনীতে মসুলমান-

১। বার্মার উপকূলীয় শহরগুলোতে অনুপ্রবেশের সমান্তরালে মুসলমানেরা রাজ্যের অভ্যন্তরেও বসতি গেঁড়ে বসে। বর্মী রাজাদের এবং স্থানীয় জমিদারদের অধীনে ভাড়াটে সৈন্য অথবা যদ্ধুবন্দী হিসেবে বার্মায় এদের আগমন ঘটে। একাদশ শতাব্দীতেই রাজা অনহরথের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত ভারতীয় সেনা ইউনিট এবং দেহরক্ষীগণ গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। স্পষ্টতই তাদের সবাই ছিল মসুলমান। (এইচ, আর স্পীয়ারম্যান, British Barma Gazzete,Vol-1, রেঙ্গুন, ১৮৮০ পৃ.-২৬২)।

২। ১৫৪১ খ্রিস্টাব্দে তাবিন সোয়েডি (১৫৩১- ১৫৫০) মার্তবান বন্দর অধিকার করেন। শহরের অনেক মসুলমান বাসিন্দা তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৫৬৪ খ্রি:।

৩। ১৭৫৬ খ্রি: রাজা আলংপায়া (১৭৫২-১৭৬০) আরাকানের নৌবন্দর সিরিয়াম (পার্সী-সির-ই-আম অর্থাৎ সমুদ্রের কিনারা) অধিকার করেন। তাঁর বন্দীদের মধ্যে অনেক মুসলমান ছিল। ইউরোপীয়দের অধীনস্থ সেনাবাহিনীতে চাকরি করার জন্য তাদেরকে বাধ্য করা হয়। (G.E Harvey History of Barma,P.-241)।

(৪) বর্মী রাজা মিনডং (১৮৫৩-১৮৮৭)-এর শাসনামলে সেনাবাহিনীতে হাজার হাজার মসুলমান অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং তারা বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে নিয়োজিত ছিল। মসুলমান পদাতিক ও গোলন্দাজ বাহিনীর সৈন্যরা মিনহলা যুদ্ধে (১৮৮৫) ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে শৌর্যের পরিচয় দেয়। এর পরপরই বৌদ্ধ সান্দালয়ের পতন ঘটে। (উবাউ এর Mendalay Centenary: History of Burmese Muslims থেকে উদ্বৃতি দিয়েছেন ইসরাইলী গবেষক মোসে ইগার, ভাষান্তর মোসতাক আহমদ...... রাজতন্ত্রের আমলে বার্মায় মসুলমানদের অবস্থা)।

আরাকান ও বার্মা সরকারে মসুলমান-

কবি কাজী দৌলত ও আলাওল রচিত কাব্যসমহূ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ২৫৪ বছর আরাকানের বৌদ্ধ রাজাদের দরবারে প্রধানত চট্টগ্রামের মসুলমান সভাসদদের প্রভাব ছিল। আরাকানের রাজারা চট্টগ্রামের মসুলমানদের মধ্য হতে প্রধানমন্ত্রী, সমরসচিব, উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও নিম্ন শ্রেণীর কর্মচারী নিযক্তু করতেন। সিলেটবাসী এক ব্যক্তিও আরাকান রাজার সমরসচিব বা প্রধান সেনাপতি নিযক্তু হয়েছিলেন। এ সময় আরাকানের সমর বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল লস্কর উজির খ্যাত মন্ত্রীর হাতে। আরাকানের সমর বিভাগে অশ্বারোহী বাহিনী গঠন করেন লস্কর উজির। শাসন বিভাগের প্রধান পদেও মসুলমান কর্মচারী নিযক্তু করা হতো। বিচার বিভাগ পরিচালনা করতেন মসুলমান কাজী। এরূপ কয়েকজনের পদবী ও সময়কাল নিম্নে উল্লেখ করা হলো-

(১) লস্কর উজির আশরাফ খাঁ- তিনি আরাকানরাজ থিরি থধুম্মার (১৬২২-১৬৩৮) লস্কর উজির ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানার অন্তর্গত চাবিয়া গ্রামের অধিবাসী ছিলেন।

(২) লস্কর উজির বড়ঠাকুর- তিনি আরাকানরাজ নরপতিগ্যির (১৬৩৮-১৬৪৫) সমরসচিব ছিলেন। বড়ঠাকুর আরাকানরাজ প্রদত্ত উপাধি। তাঁর পিতামহ গৌড় থেকে এসে চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার চক্রশালায় বসতি স্থাপন করেছিলেন।

(৩) প্রধানমন্ত্রী মাগর ঠাকুর- তিনি আরাকানরাজ নরপতিগ্যি (১৬৩৮-১৬৪৫) থদোমিন্তা (১৬৪৫-১৬৫২) এবং সান্দথঠুম্মা (১৬৫২-১৬৮৪) আরাকানের এই তিন রাজার আমলে প্রথমে মন্ত্রী ও পরে প্রধানমন্ত্রী নিযক্তু ছিলেন। তিনি লস্কর উজির বড়ঠাকুরের পুত্র ছিলেন।

(৪) প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ মসুা- ১৬৫৮ খ্রি: মাগন ঠাকুরের মৃত্যু হলে সিলেটের বাসিন্দা সৈয়দ মুসা আরাকানরাজ সান্দথুঠম্মার (১৬৫২-১৬৮৪) প্রধানমন্ত্রী নিযক্তু হন। তিনি সিলেট বিজয়ী সৈয়দ নাসির উদ্দীন সিপাহসালারের বংশধর এবং হবিগঞ্জের তরফ পরগনার লস্করপুর গ্রামের অধিবাসী।

(৫) প্রধানমন্ত্রী নবরাজ মজলিশ- সৈয়দ মসুার পর তিনি আরাকানে রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।

(৬) প্রধান সেনাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ খান- তিনি আরাকানেরাজ সান্দথুঠম্মার প্রধান সেনাপতি ছিলেন। (৭) অর্থমন্ত্রী সোলায়মান- তিনি রাজা সান্দথঠুম্মার অর্থমন্ত্রী ছিলেন।

(৮) লস্কর উজির বোরহানউদ্দীন- তিনি আরাকানরাজ থদোমিন্তার এর সমরসচিব বা মন্ত্রী ছিলেন। তিনি প্রথম আরাকানের অশ্বারোহী বাহিনী গঠন করেন। চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানার জলদি গ্রামে তাঁর বংশধররা বর্তমানে বসবাস করেন।

(৯) বিশিষ্ট মুসলিম ব্যবসায়ী উ-জী সওদাগরকে বার্মারাজ বোধপায়া (১৭৮২-১৮১৯) সোনার তাজ উপহার দেন। এটি পরে তিনি বিনা বাধায় রাজসভায় ঢকুতে পারতেন। চট্টগ্রাম, ঢাকা, কলকাতা, পেগু, মান্দালয়, আভা, ব্যাংকক প্রভৃতি স্থানে তিনি বাণিজ্য করতেন। সাফাপাড়ায় তাঁর নামে পুল এখনো বর্তমান।

(১০) ১৭০০ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আরাকানের আরো তিনজন সেনাপতির নাম জানা যায়। তাঁরা হলেন,
(১) ক্বাইসের হ্রেলা (২) বলদিপাডার বুসিং (৩) বন্দরের আলীয়া বাইং। আলীয়া বাইং-এর পাকা মসজিদ এখনো বর্তমান।
(তথ্য সূত্র- আরাকানের মুসলমান : ইতিহাস ও ঐতিহ্য, সম্পাদনা- ড. মোহাম্মদ মুহিব উল্ল্যাহ ছিদ্দিকী, প্রবন্ধ- আবদলু হক চৌধুরী, আরাকান রাজসভায় মসুলমান সভাসদ, পৃ-১৮৮-২০৭)।

(১১) ব্রিটিশ নাগরিক হেনরি জবুসিনি ১৮৫৫ সালে বার্মা ভ্রমণ করেন। তিনি বর্ণনা করেছেন যে, পাগানের গভর্নর ছিলেন একজন মসুলমান যাকে পরে হত্যা করা হয়। (সূত্র- ক্যাপ্টেন হেনরী জলু, A narrative of the mission sent by the Govornor General of India to the court of Ava in1855, P.-228)।

(১২) ব্রিটিশ কর্তকৃ বার্মা অধিকারের কিছুকাল পূর্বে অর্থাৎ ১৭৯৫ থেকে ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ব্রিটিশ এবং বর্মী রাজাদের মধ্যকার যাবতীয় রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে মসুলমানরা বার্মার পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। (সূত্র- পূর্বোক্ত মোসে ঈগর-এর প্রবন্ধ, পৃ.-১৭৬)।

(১৩) প্রথম এংলো-বার্মিজ যুদ্ধের পর সিংহাসনচ্যুত রাজা বার্গিদ তাঁর সিংহাসন পুনরুদ্ধারের জন্য সাহায্যের অনুরোধ জানিয়ে ব্রিটিশদের নিকট জনৈক মুসলমান দূতকে প্রেরণ করেন। রাজা বোধপায়ার আইন উপদেষ্টা যিনি ছিলেন উল্লেখিত দূতের পর্বূসূরি তিনি সেই একই মসুলমানকে এক গোপন মিশনে দিল্লীতে প্রেরণ করেছিলেন। (পূর্বোক্ত তথ্যপঞ্জী-৫২, পৃ-১৮৫)।

আরাকানের সংস্কৃতিতে মুসলমান প্রভাব-

আরাকানের লোকেরা নিজেদেরকে রক্ষইং বা রাক্ষস হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতো। উক্ত রক্ষইং থেকে রাখাইন শব্দটি এসেছে। সভ্য মানুষের চাল-চলন, আচার-ব্যবহার তাদের মধ্যে  ছিল না। এতদসংক্রান্ত প্রামাণ্য তথ্য নিম্নরূপ-
(১) প্রাচীনকালে আরাকানীরা ছিল বন্যস্বভাবের। মাথার চলু কাটা বা হাত-পায়ের নখ কাটার ব্যাপারে তারা ছিল উদাসীন। রাজা নরমিখলার সিংহাসন পুনরুদ্ধারকালে আরাকানে আগত গৌড়ের মুসলমান সেনাদের সংস্পর্শে এসে আরাকানীরা চুল ও নখের যত্ন নিতে শিখে। মুসলিম-পূর্ব আমলে আরাকানীরা রান্না করা খাবার খাওয়া জানতো না। মসুলিম সেনারা আরাকানে খাদ্য রন্ধন প্রণালী প্রবর্তন করে এবং মশলা, তৈল, ঘির প্রচলন করে। মসুলমানদের সাধ্য নেই আরাকানীরা কোরমা, পোলাও, বিরিয়ানীর স্বাদ পায়। পোশাকের ব্যাপারেও তারা আদিম অবস্থানে ছিল। গৌড়ের রাজদরবারে ২৪ বছর নির্বাসন জীবনযাপনকারী রাজা নরমিখলা গৌড়ের অনুকরণে আরাকানের রাজদরবারে আমির-ওমরা, জেনানামহল, পর্দাপ্রথা, জল্লাদ ও ক্রীতদাসপ্রথা প্রচলন করেন। (পূর্বোক্ত- আবদুল হক চৌধরুী লিখিত প্রবন্ধ, পৃ-২০০)।

(২) বিদেশের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বর্মী রাজারা ফারসী ভাষা ব্যবহার করতেন। ফারসী ভাষায় বুৎপত্তিসম্পন্ন মুসলমানদেরকে তারা রাজধানী, বড়শহর ও বন্দরগুলোতে দোভাষী হিসেবে নিয়োগ করেছিল। প্রতিবেশী দেশ সফরে বর্মী সরকার কর্তকৃ প্রেরিত প্রতিনিধি দলের সফরসঙ্গীরূপে দোভাষীরা সঙ্গে থাকতো।১ প্রথম ইঙ্গ-বার্মিজ যুদ্ধের সময় (১৮২৪-১৮২৬) ব্রিটিশ এবং বর্মীদের মধ্যে একইভাবে ফারসী ভাষায় চিঠি আদান-প্রদান করা হতো।২
তথ্যসূত্র- ১. মাইকেল সাইমন্স, journal of his second embassy to the court of Ava in  1802 সম্পাদনা ভি.জি.ই হল (লন্ডন, জর্জ এলন এন্ড আনউইন, ১৯৫৫) পৃ-৪০৩।
২. দেশাই, A Pagent of Burmese History, P.- 247।
৩. A Phayre, History of Burma, (London-1984) P.17
৪.সত্যেন্দ্রনাথ ঘোষাল, কাজী দৌলত বিরচিত ‘সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী’ পৃ-৭।(চলবে)

লেখক : সম্পাদক, মাসিক ইতিহাস-অন্বেষা

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাফল্যগাথা : বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা

অন্যায়-অত্যাচার, জুলুম-নির্যাতন, আগ্রাসন ব্যক্তি প্রতিভা ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জনের স্বাধীনতা না থাকায় এবং কমিউনিস্ট আদর্শের দেউলিয়াপনায় ১৯৯০ সালে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়লে সমগ্র পূর্ব ইউরোপ অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। এতদিন কমিউনিস্ট বিশ্বের জনগণ সম্পর্কে মুক্তবিশ্ব খুব কমই জানতো। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে দেখল- কমিউনিস্টরা প্রগতিশীলতার নামে সমগ্র পূর্ব ইউরোপকে অশেষ দুর্গতির মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। মুষ্টিমেয় কিছু পার্টি কমরেড ব্যতীত সমগ্র জনগোষ্ঠী তখন ভিখারী ও শ্রমদাস মাত্র। বন্ধ দয়ুার খোলার পর দেখা গেল রুশ তরুণীরা শুধমুাত্র পেটের দায়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়ে দেহব্যবসায় লিপ্ত হয়েছে। পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়ার সাধারণ লোকজন দারিদ্র্য থেকে বাঁচতে সংশ্লিষ্ট দেশের মেশিনারী পার্টস, হরেক রকমের অস্ত্রশস্ত্র এমনকি পারমাণবিক জ্বালানিও চুরি করে বিক্রি করছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার নেপথ্য চক্রান্তকারী পাশ্চাত্য শক্তি তখন মনের আনন্দে পর্বূ ইউরোপের দেশগুলোর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে এবং রাশিয়া যাতে আর কখনো বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে তার জন্য চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তীব্র বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি, সামাজিক-রাজনৈতিক অরাজকতা, রাশিয়াকে তখন পতনের চূড়ান্ত পর্বে উপনীত করেছে। এরূপ অবস্থা প্রেসিডেন্ট পুতিনের ক্ষমতাগ্রহণের পর্বূ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ভ্লাদিমির পুতিনের সফলতা ও কৃতিত্বের আলোচনা সম্পন্ন করতে হলে তাই পাঠককে পুতিন-পূর্ব রাশিয়ার অবস্থা ও পুতিন-পরবর্তী রাশিয়ার তুলনামূলক অবস্থা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে। উভয়দিক পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে পুতিন বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে জ্ঞানী ও যোগ্য প্রেসিডেন্ট। তাঁর পাশে আর যাদের নাম আসতে পারে তাঁরা হলেন মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদ ও তুর্কী প্রধানমন্ত্রী রজব তাইয়েব এরদোগান। এতদসত্ত্বেও আন্তর্জাতিক জ্ঞান ও কার্যক্রম বিচার করলে প্রেসিডেন্ট পুতিনই বর্তমান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ প্রেসিডেন্ট ও দেশনায়ক হিসেবে বিবেচিত হবেন। প্রেসিডেন্ট পুতিন সম্পর্কে সম্যক অবহিত হওয়ার জন্য তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবন-বৃত্তান্ত উল্লেখ করা হলো-

ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন
জন্ম : ৭-১০-১৯৫২, স্থান-লেলিনগ্রাদ (বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গ) পিতা-U.S.S.R নেভীর সাবমেরিন ইউনিটের চাকুরে, মা কারখানা শ্রমিক। দাদা- লেলিন, লেনিনের স্ত্রী ও স্টালিনের বাবুির্চ ছিলেন। পুতিনের বংশ মধ্যযুগের রাজকীয় Tverskov familyর সাথে সংযক্তু। Putin বংশীয় খেতাব।

শিক্ষা : ১৯৭৫ সালে লেনিনগ্রাদ এস্টেট ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক আইন শাখা থেকে গ্রাজুয়েট। তাঁর ডক্টরেট থিসিস ছিল The Strategic Planning of Regional Resources Under the Formation of Market Relations. তাঁর ব্যবসায়ীক আইনের শিক্ষক আনাতোলী Sobchak তাঁর ক্যারিয়ার গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।

রাজনীতি : বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি U.S.S.R পর একমাত্র দল কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। ১৯৯১ সাল উক্ত পাটি বিলপ্তু হওয়া পর্যন্ত সদস্য ছিলেন। ১৯৯৭ সালে সরকারপন্থী রাজনৈতিক দল Our Home is Russia পার্টিতে যোগ দেন এবং Saint Petersburg শাখার নেততৃ¡ গ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তিনি The United Russia পার্টি গঠন করে বর্তমানে এর নেততৃ¡ দিচ্ছেন।

কৃতিত্ব : রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক অগ্রগতি, ১৯৯০-এর সমস্যা সামলে দেয়া, প্রথম প্রেসিডেন্সির সময় GDP প্রবৃদ্ধি ছিল ৭৩%, ম্যাক্রো ইকোনমিক ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন, পুঁজিপ্রবাহ বৃদ্ধি, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ, নতুন তেল- গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন। তাঁর জ্বালানি নীতি রাশিয়াকে জ্বালানী সুপারপাওয়ার করেছে, স্যাটেলাইট নেভিগেশন System স্থাপন, আন্তর্জাতিকমানের অবকাঠামো নির্মাণ।

সংস্কার :সেনা ও পুলিশ বাহিনী, জ্বালানিনীতি, উচ্চ প্রযুক্তির শিল্প স্থাপন, আধুনিক নিউক্লিয়ার Plant, প্রতিরক্ষা শিল্প।

চাকরি : গ্রাজুয়েশনের পর তিনি কেজিবিতে ভর্তি হন। ট্রেনিঙের পর প্রথমে তিনি Counter Intelligence-এ এবং পরে বিদেশীদের Monitoring শাখায় কাজ করেন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত তিনি পর্বূ জার্মানিতে KGB’র দায়িত্ব পালন করেন। ঔঁহব ১৯৯০ থেকে তিনি লেনিনগ্রাদ State Universityর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শাখায় যোগ দেন এবং ২০ আগস্ট ১৯৯১ তিনি লে. কর্নেল অবস্থায় কেজিবির চাকরিতে ইস্তফা দেন।

পিটারসবার্গ প্রশাসনে পুতিন
১. পিটারসবার্গ মেয়রের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা (১৯৯০-৯১)
২. মেয়র অফিসের বহিঃসম্পর্ক বিভাগের প্রধান (১৯৯১-৯৬)
৩. সিটি প্রশাসনের উপপ্রধান।
৪. JSC News Paperএর উপদেষ্টা পরিষদ প্রধান।
৫. সরকারপন্থী Our Home is Russia পার্টির পিটার্সবার্গ প্রধান।

মস্কোয় পুতিন
১. ১৯৯৬-৯৮ প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলেৎসিনের সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা বিভাগের ডেপুটি চিফ হন। এ সময় তিনি দেশে-বিদেশে থাকা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পদ ও কমিউনিস্ট পার্টির সম্পদ রুশ ফেডারেশনে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন।
২. ২৬-০৩-১৯৯৭ থেকে মে ১৯৯৮ পর্যন্ত ইয়েলিৎসিনের প্রেসিডেন্সিয়াল স্টাফ উপপ্রধান পদে কাজ করেন। তিনি ১৯৯৮ পর্যন্ত এর  প্রেসিডেন্টের সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান ছিলেন।
৩. ২৫-৫-১৯৯৮ তারিখে তিনি প্রেসিডেন্সিয়াল স্টাফ-এর প্রথম ডেপুটি প্রধান পদে নিযুক্ত হন এবং দেশকে অনেক অপ্রয়োজনীয় ও অবাঞ্চিত চুক্তি থেকে রক্ষা করেন।
৪. ২৫-৭-১৯৯৮ থেকে আগস্ট ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি KGB সংশ্লিষ্ট এজেন্সী FSB-এর প্রধান নিযক্তু হন। ০১-১০-১৯৯৮ তারিখে তাঁকে রুশ ফেডারেশনের নিরাপত্তা কাউন্সিলের স্থায়ী সদস্য নিয়োগ করা হয়। মার্চ ১৯৯৯ সালে তিনি এ কাউন্সিলের সেক্রেটারী নির্বাচিত হন।

প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্ব
১. ৯-৮-১৯৯৯ সালে তাঁকে তিনজন উপ-প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে প্রথম উপ-প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়। একইদিন সংসদের (ডমুা) ভোটে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়।
২. চেচনিয়াভিত্তিক আন্তর্জাতিক ইসলামী ব্রিগেড দাগেস্তান আক্রমন করলে পুিতন তা যথাযথভাবে সামাল দেন, ফলে দেশব্যাপী তাঁর জনপ্রিয় ভাবমূর্তি তৈরি হয়।
৩. ডিসেম্বর ১৯৯৯-এ অনুিষ্ঠত সংসদ (ডমুা) নির্বাচনের পূের্ব নতনুভাবে গঠিত Unity Party পুিতন সমর্থন দেন।  তাঁর এই সমর্থন ডমুা নির্বাচনে ২৩.৩% ভোট সংগ্রহে সমর্থ্য হয়।

ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট পুতিন
১. ৩১/১২ ১৯৯৯ তারিখে প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন অপ্রত্যাশিতভাবে পদত্যাগ করলে পুতিন সংবিধান মোতাবেক রুশ ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।

প্রেসিডেন্ট পুতিন (১ম মেয়াদ) ২০০০-২০০৪
২৬-০৩-২০০০ তারিখে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পুতিন ১ম রাউন্ডের নির্বাচনে ৫৩% ভোট পেয়ে বিজয়ী হন এবং ০৭-০৫-২০০০ তারিখে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। দায়িত্ব গ্রহণের পরই তিনি কমিউনিস্ট আমলের ভূমি আইন, আয়কর আইন, শ্রম, প্রশাসন, বাণিজ্যিক, সিভিল ও ক্রিমিনাল আইনকে সংস্কার করে যুগোপযোগী করেন। তিনি জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করেন,চেচেন সমস্যার সমাধান করেন।

দ্বিতীয় মেয়াদ (২০০৪-২০০৮) ১৪-০৩-২০০৪ তারিখে তিনি ৭১% ভোট পেয়ে ২য় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এই মেয়াদে তিনি স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, আবাসন ও কৃষিকে অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় আনেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে উৎসাহ ও সহযোগিতা প্রদান করেন। তিনি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্টের দায়ে রাশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি মিখাইল Khodorkvoskyকে গ্রেফতার করে শাস্তির ব্যবস্থা করেন এবং পশ্চিমা মদদপষ্টু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে কঠোরভাবে দমন করেন। শিল্পোন্নয়নে তিনি ইতিবাচক সরকারি হস্তক্ষেপ প্রথা চালু করেন।
*০৮-০২-২০০৮ তারিখে পুতিন State Council-এর বর্ধিত সভায় “On the strategy of Russia’s development until 2020”  শিরোনামে ভাষণ দেন। উক্ত ভাষণে ২০২০ সালের মধ্যে রাশিয়াকে উন্নতির শিখরে নেয়ার পথ, পন্থা ও প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

২য় প্রধানমন্ত্রিত্ব (২০০৮-২০১২)
৮-৫-২০০৮ পুতিনকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভ।
১. ২০০৮-এর  দ. ওসেটিয়া যুদ্ধে পুতিনের রাশিয়া ই-ইউ এবং মার্কিন মিত্র জর্জিয়াকে হারিয়ে দেয়।
২. ইউরোপ-আমেরিকায় মন্দা শুরু হলে রাশিয়ার পর্বূবর্তী সরকারের বিপলু আর্থিক রিজার্ভ এবং শক্তিশালী ব্যবস্থাপনা রাশিয়াকে মন্দার হাত থেকে রক্ষা করে শক্তিশালী ও স্থিতিশীল অর্থনীতির দেশে পরিণত করে।

ততৃীয় প্রেসিডেন্সী ৪-৩-২০১২
প্রথম রাউন্ডের ভোটে ৬৩.৬% ভোট পেয়ে পুতিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ৭-৫-২০১২ তারিখে পুতিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন।

পুতিনের কৃতিত্ব
১. তাঁর ৮ বছরে প্রেসিডেন্সীর সময় শিল্পে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭৬%, বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে ১২৫%, কৃষি উৎপাদন ও নির্মাণ শিল্প বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুণ, গড়ে মাথাপিছু মাসিক বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে ৮০ ডলার থেকে ৬৪০ ডলারে। ২০০০ সাল থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের জনসংখ্যা ৮ মিলিয়ন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৫৫ মিলিয়নে উপনীত হয়েছে। ২০০৮ সালনাগাদ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা জনগণের হার ৩০% শতাংশ থেকে কমে ১৪% হয়েছে।

শিল্পোন্নয়ন
১. তাঁর শাসনামলে পৃথিবীর সব বড় বড় অটোমেটিভ শিল্পোদ্যোক্তারা রাশিয়ায় নিজেদের কারখানা স্থাপন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে Ford motor company, Toyota, General motors, Nissan, Hyunai motor, Suzuki, Magna International, Scania and MAN SE. প্রভৃতি।

এনার্জি পলিসি
পুতিনের গৃহীত Energy Policy রাশিয়াকে ২০০৫ সালনাগাদ এনার্জি সুপারপাওয়ারে পরিণত করেছে। তিনি কষ্ণৃসাগরের তলদেশ দিয়ে ‘ব্লু স্ট্রিম’ নামক রাশিয়া-তুরস্ক গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন করেছেন, তিনি বাল্টিক সাগরের তলদেশ দিয়ে পৃথিবীর এযাবতকালের বৃহত্তম পাইপলাইন স্থাপন করেছেন যার নাম ‘নর্ড স্ট্রিম’ যা রাশিয়ার সাথে জার্মানিকে সংযক্তু করেছে। তিনি কষ্ণৃসাগরের তলদেশ দিয়ে বলকানের রাজ্যসমূহ ও ইতালীর সাথে ‘সাউদার্ন স্ট্রিম’ নামক পাইপলাইন স্থাপনের কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন। তিনি তুর্কমেনিস্থানের গ্যাস ক্রয় করে রুশ পাইপলাইনের সাথে সংযক্তু করার জন্য ‘Nabukko’ নামক প্রকল্পের ব্যাপারে কার্যক্রম শুরু করেছেন। এভাবে সমগ্র ইউরোপ ও মধ্য এশিয়া পর্যন্ত রাশিয়ার জ্বালানি আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
অন্যদিকে চীন, জাপান ও কোরিয়ায় তেল সরবরাহের জন্য পুতিন Trans Siberian oil pipeline প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যে (Far East) গ্যাস সরবরাহের জন্য শাখালীন-খবরোঙস্ক- ভ্লাডিভষ্টক গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহের জন্য শাখালীনে LNG প্লান্ট স্থাপন করেছেন। বান্টিক পাইপলাইন-২-এর সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য ফিনল্যান্ড  উপসাগরে Ust-Luga পোর্ট নির্মাণ করা হয়েছে। তাতারস্থানসহ রাশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে বড় বড় তেল রিফাইনারি স্থাপন করা হয়েছে। ২০১৫ সালের মধ্যে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ও শিল্পোন্নয়নের লক্ষ্যে ফেডারেল বাজেটে ৪২.৭ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় Rosatom কর্পোরেশন বর্তমানে দেশে-বিদেশে অনেকগুলো পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করছে।

জাতীয় ধর্মনীতি : অর্থডক্স খ্রিস্টানিটি, ইসলাম, বৌদ্ধধর্ম ও ইহুদীধর্মকে পুতিনের রাশিয়া নিজেদের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার হিসেবে স্বীকৃিত দিয়েছে। চার্চ, মসজিদ, ইহুদী উপাসনালয় নির্মাণ, প্যাগোডা নির্মাণ এবং ধর্মচর্চা ও ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণকে আইনানগু বৈধতা দিয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে। উত্তর ককেসাস ও অন্যান্য মসুলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে পুতিনের United Russia পার্টি বিপলু সমর্থন পেয়েছে। রাশিয়ার ইহুদী কমিউনিটি পুতিনকে ও তার দলকে স্থিতিশীল রাশিয়ার অপরিহার্য শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

সামরিক সংস্কার :২০০০ সাল থেকে রাশিয়া সামরিক খাতে অধিকতর ব্যয় করা শুরু করেছে। ২০০৮ সাল থেকে পর্ণূ মাত্রায় সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন শুরু করা হয়েছে। সামরিক বাহিনীকে বড় না করে গুণগত মান বৃদ্ধি করে অধিকতর কার্যকর করার লক্ষ্যে এর সদস্য সংখ্যা ১০ লাখে নামিয়ে আনা হয়েছে। অফিসারের সংখ্যা কমানো হয়েছে। সেন্ট্রাল কমান্ডের আকার ছোট করা হয়েছে। সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য ইতিপূর্বেকার ৬৫টি স্কুলের পরিবর্তে বর্তমানে ১০টি কৌশলগত সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। সামরিক বাহিনীর পরিবহন ও অন্যান্য বেসামরিক কাজে বেসামরিক ব্যক্তিদের নিয়োগ বৃদ্ধি করা হয়েছে। রিজার্ভ বাহিনী পুনর্গঠন করা হয়েছে। পূর্বের পদ্ধতি বাদ দিয়ে আর্মিকে ব্রিগেড Syastem-এ পনুর্গঠিত করা হয়েছে। বিমানবাহিনীর রেজিমেন্ট পদ্ধতি পরিবর্তন করে Air Base System-এ পনুর্গঠিত করা হয়েছে। মিলিটারি ডিস্ট্রিক্ট-এর সংখ্যা কমিয়ে চারটি করা হয়েছে। অত্যাধুিনক অস্ত্রশস্ত্র, বিমান ও যুদ্ধজাহাজ দিয়ে সেনাবাহিনীকে সাজানো হয়েছে। ১ ডিসেম্বর ২০১১ থেকে রাশিয়ান স্পেস ফোর্সেসকে পরিবর্তন করে Russian Aerospace Defence System করা হয়েছে।

পুতিনের কৃতিত্বের স্বীকৃতি
১. সেপ্টেম্বর ২০০৬ সালে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জ্যাঁক শিরাক পুতিনকে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ খেতাব ‘Grand Cross’ প্রদান করেন। উভয় দেশের মধ্যে স্থাপিত বন্ধুত্বের নির্দশনস্বরূপ এই পদক প্রদান করা হয়।
২. বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন ২০০৭ সালে পুিতনকে Person of the year নির্বাচিত করে সম্মানিত করেন।
৩. ১২ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ সালে সৌদি বাদশাহ আবদলুøাহ পুতিনকে সে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক King Abdul Aziz Award প্রদান করেন।
৪. ১০ সেপ্টেম্বর ২০০৭ সালে সংযক্তু আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট খলিফা বিন যায়েদ আল-নাহিয়ান সে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদ Order of Zayed প্রদান করেন।
৫. রাশিয়ার  Business weekly ‘এক্সপার্ট ম্যাগাজিন’ ডিসেম্বর ২০০৭ সালে পুিতনকে Person of the year নির্বাচিত করে সম্মানিত করেন।
৬. চেচেন প্রেসিডেন্ট রমজান কাদিরভ চেচনিয়ার রাজধানী গ্রোজনীর কেন্দ্রীয় সড়ক Victory Avenue-এর নাম পরিবর্তন করে Vladimir Putin Avenue নামকরণ করেন।
৭. ফেব্রুয়ারি ২০১১ সালে কিরগিজিস্থানের পার্লামেন্ট সে দেশের তিয়ানসান পর্বতের চূড়ার নাম রাখেন Vladimir Putin peak.
৮. ১৫ নভেম্বর ২০১১ সালে চীনের International Peace Research Centre পুতিনকে Confucius Peace Prize প্রদান করে।
৯. ২০১১ সালে সার্বিয়ার University of Balgrade পুতিনকে অনারারী ডক্টরেট ডিগ্রী দিয়ে সম্মানিত করেন।
১০. ২৫-০৬-২০১২ তারিখে প্রেসিডেন্ট পুতিনের জেরুজালেম সফরকালে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস যীশুখ্রিস্টের জন্মস্থান বেথলেহেমের একটি সড়ক প্রেসিডেন্ট পুতিনের নামে নামকরণ করার আদেশ প্রদান করেন।
উপরোক্ত তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, ব্যক্তি প্রতিভা অস্বীকারকারী বা দমনকারী সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট সরকার বিলুপ্ত না হলে আমরা ভ্লাদিমির পুতিনের ন্যায় বিশ্বমানের প্রতিভা কখনও খুঁজে পেতাম না। তাঁর শিক্ষাজীবন, চাকরিজীবন ও রাজনৈতিকজীবন পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, তিনি একজন মেধাবী অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ, চাকরিজীবন থেকে তিনি শিখেছেন, কিভাবে জায়নিজম প্রতিহত করতে হয় এবং শত্রুর ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে হয়। রাজনৈতিকজীবনে তিনি শিখেছেন কিভাবে দেশপ্রেমিক হতে হয়, দেশপ্রেমিক সৃিষ্ট করা যায়, কিভাবে একটি দেশ ও জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও সমৃদ্ধ করতে হয়। শিক্ষা- অভিজ্ঞতা ও সৃষ্টিশীলতা তাঁকে একজন প্রথমশ্রেণীর রাষ্ট্রনায়ক ও জাতীয় নেতায় পরিণত করেছে। তাঁর এই যোগ্যতা কাজে লাগিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক বিশ্বকে বর্তমান ইউনিপোলার System-এর জুলুম-অত্যাচার ও স্বেচ্ছাচারিতা থেকে রক্ষা করে Multipolar বিশ্বে পরিণত করতে সক্ষম হবেন।

বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা : মাল্টিপোলার বিশ্বব্যবস্থা
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাক্ষাৎকার, বক্ততৃা, রচিত প্রবন্ধ ও কার্যক্রমে এককেন্দ্রিক বিশ্বমোড়লের স্বেচ্ছাচারিতা ও অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে বিশ্বের নির্যাতিত মানবগোষ্ঠী আশাবাদী হয়ে উঠেছে। তাদের এই প্রত্যাশার কারণসমহূ নিম্নরূপ-
 (১) জানয়ুারি ২০০৭ সালে এক সাক্ষাৎকারে পুতিন বলেছেন, “রাশিয়া গণতান্ত্রিক Multipolar বিশ্ব দেখতে চায় এবং শক্তিশালী আন্তর্জাতিক আইন ও এর প্রয়োগ দেখতে চায়।
(২) ১৬ অক্টোবর ২০০৭ সালে ইরান ভ্রমণের সময় তিনি সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, “সকল কাম্পিয়ান রাষ্ট্রসমূহের অধিকার রয়েছে বিনা প্রতিবন্ধকতায় শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূিচ পরিচালনা করার।”
(৩) ১০  ফেব্রুয়ারি ২০০৭ সালে জার্মানির মিউনিখে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল- “Munich Confarrence of Security Policy”. উক্ত সম্মেলনে তিনি যে ভাষণ দেন তাকে পর্যবেক্ষকগণ ও গণমাধ্যমসমূহ “The turrning point of Russian forign policy ” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর মিউনিখ ভাষণের মলূ কথা ছিল-
ক. তিনি যক্তুরাষ্ট্র ও ন্যাটো নেতৃত্বাধীন এককেন্দ্রিক বিশ্বের নৈতিকতাহীন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সমালোচনা করে বলেন, “Security for everyone is Security for all”.
খ. তিনি পশ্চিমাবিশ্ব কর্তৃক রাশিয়াকে গণতন্ত্র শিক্ষাদানের  প্রচেষ্টাকে হিপোক্রেসি হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
গ. তিনি আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘকে পাশ কাটিয়ে অথবা উপেক্ষা করে ন্যাটো ও ইইউ’র বিভিন্ন দেশে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগকে বেআইনি সাব্যস্ত করেন।
ঘ. তিনি ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্র কর্তকৃ মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম গড়ে তোলাকে নতনু অস্ত্র প্রতিযোগিতায় উস্কানি প্রদান সাব্যস্ত করেন।
ঙ. তিনি যক্তুরাষ্ট্র ও ন্যাটো কর্তৃক রাশিয়াকে সামরিকভাবে ঘিরে ফেলার দায়ে অভিযক্তু করেন।
পুতিন রচিত প্রবন্ধ :২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পূর্বে ভ্লাদিমির পুতিন রুশ সংবাদপত্রে কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। তন্মধ্যে একটির শিরোনাম ছিল- “New Integration Project of Euroasia- A future that is being Born Today ” এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি আন্তর্জাতিক বিষয়ক প্রবন্ধ যা পরের আলোচনায় বঝুা যাবে।
চ. G-20 সম্মেলন উপলক্ষে ওবামার প্রতি পুতিনের মন্তব্য-
 জুন-২০১২ সালে অনুষ্ঠিত G-20 সম্মেলনের অবকাশে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার সাথে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে পুতিন ওবামাকে এই মর্মে সতর্ক করেন যে, কোনো দেশকে কে শাসন করবে তা নির্ধারণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট দেশের জনগণের বাইরের কোনো শক্তির নয়।”
ছ. ২৫-০৬-২০১২ তারিখে তেল আবিব সফরকালে ইসরাইলি প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেজকে এই মর্মে হুঁশিয়ারি প্রদান করেন যে, ‘ইরানে হামলা চালালে ইসরাইলকে অনুতপ্ত হতে হবে। কারোরই খামখেয়ালিপূর্ণ কিছু করা উচিত হবে না।’


Multipolar World গঠনের প্রত্যাশা পূরণে বাধাসমূহ


(১) জায়নবাদ- জায়নবাদী ইহুদীরা বিশ্বশাসন করতে চায়। তাদের লক্ষ্য পরূণে তারা ইতোমধ্যে অনেকদূর অগ্রসর হয়েছে। তাদের মলূ কথা হলো- একজন ইহুদী বাদশাহ সমগ্র পৃথিবী শাসন করবে। এজন্য তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে, পরিবারপ্রথা ভেঙে, মানুষের চরিত্র নষ্ট করে, জাতিসমূহকে নিস্তেজ করে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বর্তমান আমেরিকা ও ন্যাটো নিজ দেশ ও জনগণের ক্ষতি করে জায়নবাদীদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। পর্যবেক্ষকদের দঢ়ৃ সিদ্ধান্ত এই যে, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযদ্ধু-পরবর্তী লীগ অব নেশন্স্ ও জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা জায়নবাদীদের বিশ্বশাসনের প্রাথমিক মডেল। আমার দঢ়ৃবিশ্বাস সোভিয়েত আমলে  কেজিবিতে চাকরি করার সবুাদে মি. পুতিন জায়নবাদ সম্পর্কে, এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে পরিপর্ণূ ওয়াকেবহাল। এমতাবস্থায় জায়নবাদ প্রভাবিত Unipolar বিশ্বকে Multipolar বিশ্বে পরিণত করার জন্য মি. পুতিনই সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি।

(২) The Great game plan- উনবিংশ শতাব্দীতে রচিত এ চষধহটি কার্যকরের মাধ্যমে ব্রিটেন এবং পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বশক্তি হিসেবে টিকে আছে। গঁষঃরঢ়ড়ষধৎ বিশ্ব গড়তে হলে এই প্লানকে অবশ্যই অকার্যকর করতে হবে। সংক্ষেপে এই Planটি নিম্নরূপ-
ক. ইউরোয়েশিয়ান হার্টল্যান্ড (উত্তরে রাশিয়া, দক্ষিণে ইরান, পূর্বে চীন ও পশ্চিমে পর্বূ ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকা এলাকাকে ইউরোয়েশিয়ান হার্টল্যান্ড বলে) হিসেবে পরিচিত ভূভাগের ঐক্যকে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের ন্যায় সমুদ্রে আধিপত্য বিস্তারকারী শক্তিসমহূ একটি ব্যাপক হুমকি হিসেবে দেখে থাকে। এ জন্য এ এলাকার দেশগুলোকে ছিন্নভিন্ন করা, ভেঙে দেয়া ও টকুরো করা আমেরিকা ব্রিটেন ও ফ্রান্সের স্থায়ী অনুসতৃ নীতি। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন যৌথভাবে এ এলাকার দেশগুলোকে টকুরা করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
পূর্ব ইউরোপকে রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করা, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যকে রাশিয়া থেকে বিছিন্ন রাখা ব্রিটেনের দীর্ঘস্থায়ী নীতি। বিংশ শতকের শুরুতে দার্শনিক Mackinder ব্রিটেনকে এই মর্মে সতর্ক করেন যে, “অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে রাশিয়া-চিন-ইরান ও ভারত যদি একটি একক অবস্থানে উন্নীত হয় তবে সাগরের কর্ততৃ যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও জাপানের হাত থেকে চলে যাবে। ম্যাফাইন্ডার আরো সতর্ক করেন যে, “সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব জনসংখ্যার আধিক্যের উপর নির্ভরশীল। সেক্ষেত্রে অধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত ইউরোয়েশিয়াকে বিভক্তকরণ, গ্রাসকরণ ও শাসন করার নীতি অবলম্বন না করলে কম জনসংখ্যা অধ্যুষিত পশ্চিম ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে দীর্ঘদিন আধিপত্য বজায় রাখা সম্ভব হবে না। ম্যাকাইন্ডার এবং অন্যান্য পশ্চিমা চিন্তাবিদরা আরো লক্ষ্য করেছেন যে, ইউরোয়েশিয়ান হার্ট ল্যান্ডে অবস্থিত দেশগুলোতে প্রায়ই ঐক্যের প্রবণতা দেখা যায়। এই স্বাভাবিক প্রবণতাকে প্রতিহত না করলে বিশ্ব আধিপত্য বজায় রাখা যাবে না। এ জন্যই ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেন জোট মধ্যপ্রাচ্য, মধ্যএশিয়া, পূর্ব ইউরোপ, ভারত ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় অনেকগুলো জাতিসত্ত্বাকে স্বাধীন হওয়ার সুেযাগ দিয়ে বিভক্ত করেছে।

(৩) Rimland Theory- নিকোলাস স্পাইক্স্ম্যানের রিমল্যান্ড থিওরি হার্বাট স্পেন্সার মতবাদ এবং হেনরি পাইরেনির থিওরি প্রায় একই কথার পনুরাবৃত্তি করেছে। স্নায়ুযুদ্ধের (Cold War) অবসানের পর Huntington সভ্যতার সংঘাতের যে তত্ত্ব হাজির করেছেন তাও মূলত ইউরোয়েশিয়ান হার্টল্যান্ডভিত্তিক পশ্চিমাদের দীর্ঘদিনের ভাবনার ফসল। তিনি মলূ ধারণাকে আড়াল করার জন্য সভ্যতার সংঘাতের আবরণ পরিয়েছেন মাত্র। Huntington তত্ত্বের মূলকথা হলো- ইউরোয়েশিয়ান হার্টল্যান্ডে নয়টি ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতা অবস্থান করছে। এদের পরস্পরের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি করে এদের নিয়ন্ত্রণ ও গ্রাস করার জন্য ক্ষদ্রু ক্ষুদ্র ন্যাশন স্টেট স্থাপন করলে পশ্চিমা আধিপত্য অক্ষুন্ন থাকবে।

(৪) গুরুত্বপর্ণূ করিডোর ও প্রণালী সংলগ্ন দেশের পাশ্চাত্যপন্থী সরকার-
 ক. ওয়াখান Corridoor-চীন, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও মধ্যএশিয়ার সংযোগস্থল Wakhan Corridoor দখলে রাখার প্রচেষ্টা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের দীর্ঘদিনের আকাংখা। এ লক্ষেই আধিপত্যবাদী ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকা বারবার আফগানিস্তানে প্রবেশ করেছে এবং পরাজিত হয়ে ফিরে গেছে। এমতাবস্থায় আফগানিস্তান দখল না করে তথায় যুক্তরাষ্ট্র-ন্যাটো বিরোধী সরকার প্রতিষ্ঠাই এ সমস্যা সমাধানে সহায়ক হবে।
খ. প্রণালীসমহূ সংলগ্ন দেশ- বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক প্রণালীসমূহ হলো- সুয়েজ খাল, জিব্রাল্টার প্রণালী, এডেন উপসাগর, হরমজু প্রণালী ও মালাক্কা প্রণালী। পশ্চিমা শক্তি সুেয়জ খাল নিয়ন্ত্রণে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে এবং মিসরে সবসময় তাঁবেদার শক্তি প্রতিষ্ঠা করেছে। জিব্রাল্টার প্রণালীর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য স্পেন ও মরক্কোয় মিত্রশক্তি বা তাঁবেদার সরকারকে ক্ষমতাসীন রেখেছে। এডেন উপসাগরকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সোভিয়েত আমলে ইয়েমেনকে দুইভাগে বিভক্ত করেছিল, সোভিয়েত পতনের পর ইয়েমেনকে একীভতূ করা হয়েছে এবং ইয়েমেনে তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষায় সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে এবং সোমালিয়াকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। হরমজু প্রণালীর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ তৎলগ্ন ওমান ও ইরানে তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। বর্তমানে ইরানে পাশ্চাত্যবিরোধী শক্তি প্রতিষ্ঠিত থাকায় পশ্চিমা শক্তি ইরানকে ধ্বংস করার জন্যে সকল প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে এবং বেলুিচস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। মালাক্কা প্রণালীর উপর পশ্চিমা আধিপত্য বজায় রাখার জন্য প্রথমে ইন্দোনেশিয়া থেকে মালয়েশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন করেছে। পরবর্তীতে সিঙ্গাপরুকে মালয়েশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন করেছে এবং পূর্বতিমুরকে ইন্দোনেশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে।

*প্রত্যাশা পূরণে করণীয়
উপরোক্ত আলোচনা তথ্য-উপাত্ত ও থিওরির মাধ্যমে আমরা এই সত্যটি উপলব্ধি করেছি যে, Unipolar বিশ্বকে Multipolar বিশ্বে পরিণত করতে হলে বেশকিছু বাধা অপসারণ করতে হবে। তবে বর্তমান রুশ প্রেসিডেন্ট মি. পুতিনের ন্যায় যোগ্য ও বিজ্ঞ নেততৃ¡ এই বাধাসমূহ অপসারণে সক্ষম হবেন বলে আমরা আশাবাদী। প্রত্যাশা পরূণে করণীয় নিম্নরূপ-
১. ঐতিহাসিক শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া- যেহেতু  রাশিয়া এ কাজে নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকবে, সেহেতু সর্বপ্রথম রাশিয়ার ঐতিহাসিক শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। ইউরোপে রাশিয়ার প্রধান ঐতিহাসিক শত্রু হলো ব্রিটেন। জার্মানি সাময়িক শত্রু কিন্তু জার্মানি থেকে বন্ধুত্ব আশা করা যেতে পারে।
২. Zionism প্রতিহত করা- যেসব দেশ ও দেশের জনগণ এককেন্দ্রিক বিশ্বের স্বেচ্ছাচারিতা ও জলুমু থেকে মুিক্ত চায় তাদের অবশ্য কর্তব্য হবে জায়নীজম সম্পর্কে জানা ও বুঝা এবং বিজ্ঞ ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিদেরকে নিজ নিজ দেশ পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান।

৩. ইউরোয়েশিয়ান হার্টল্যান্ডের ঐক্য প্রতিষ্ঠা- SCO, Euroasian Union,Euroasian Trade জোন গঠনের মাধ্যমে ইতোমধ্যে এ কাজটি শুরু করা হয়েছে। তবে তুরস্ক ও ভারতকে এ প্রচেষ্টায় সামিল করা গেলে প্রচেষ্টাটি পরিপর্ণূতা পাবে। তবে ভারতে যতদিন পর্যন্ত বর্ণবাদী-ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকবৃন্দ ক্ষমতায় থাকবে, ততোদিন পর্যন্ত ভারত বর্ণবাদী ইসরাইল থেকে আলাদা হবে না। এ জন্য ভারতের শাসনক্ষমতা থেকে সংখ্যালঘু উগ্র বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক শাসকগোষ্ঠীকে অপসারণ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ হরিজন, দলিত, মসুলিম ও অনার্য গোষ্ঠীকে ক্ষমতাসীন করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে এবং ১৯৪৭-পরবর্তী ভারত কর্তৃক জবরদখলকৃত দেশীয় রাজ্যসমূহের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন ও বেগবান করতে হবে। মূলত ভারতের বর্ণবাদী সংখ্যালঘু (৯%) উচ্চবর্ণের হিন্দুরা (৯১%) সংখ্যাগুরু ভারতীয়দের উপর নিজেদের আধিপত্য অব্যাহত রাখার জন্য বর্ণবাদী ইসরাইলের নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে জোটবদ্ধহয়েছে। সঠিক প্রচেষ্টা গ্রহণ করলে তরুস্ককে ইউরোপিয়ান হার্টল্যান্ডের ঐক্যপ্রতিষ্ঠায় কাজে লাগানো সহজ হবে। মধ্যএশিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী জাতিগতভাবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তুর্কী জাতির সাথে সম্পর্কিত।

৪. Wakhan Corridor কে কাজে লাগাতে হলে বর্তমান মার্কিন দখলদারিত্বের দ্রুত অবসান ঘটাতে হবে এবং আফগানিস্তানে পাশ্চাত্যবিরোধী শক্তিকে ক্ষমতাসীন করতে হবে। সুেয়জ খালের কর্ততৃ¡ থেকে পশ্চিমা শক্তিকে সরাতে হলে মিসরের ব্রাদারহুডকে শক্তিশালী করতে হবে, সহযোগিতা করতে হবে যাতে তাঁবেদার কোনো শক্তি পুনরায় মিসরে ক্ষমতাসীন হতে না পারে এবং ইসরাইলের ব্যাপারে যথাযথ ভূিমকা গ্রহণ করতে হবে। জিব্রাল্টার প্রণালীর কর্ততৃ¡ গ্রহণের জন্য মরক্কো এবং স্পেনে শক্তিশালী ও স্বাধীনচেতা সরকার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে হবে। এডেন উপসাগরে যক্তুরাষ্ট্রের কর্র্ততৃ খর্ব করার জন্য ইয়েমেনের জনগণের সরকার গঠনে সহায়তা করতে হবে এবং সোমালিয়ায় স্বাধীনচেতা ও শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে হবে। হরমজু প্রণালীকে আধিপত্যবাদীদের হাত থেকে নিরাপদ করতে হলে শক্তিশালী ইরানকে সর্বশক্তি দিয়ে রক্ষা করতে হবে এবং পাকিস্তানের স্থিতিশীলতা আনয়নে সহায়তা করতে হবে, মধ্যপ্রাচ্যের রাজতান্ত্রিক শাসকদের সাথে ঘনিষ্ঠতা বৃিদ্ধ করে তাদেরকে মার্কিনবলয় থেকে বের করে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। মালাক্কা প্রণালীর উপর পাশ্চাত্য শক্তির একাধিপত্য খর্ব করার জন্য বঙ্গোপসাগরে পাশ্চাত্যের আধিপত্য কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে। বার্মা ও বাংলাদেশে শক্তিশালী ও আধিপত্যবাদবিরোধী সরকার প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করতে হবে।
উপরোক্ত আলোচনা ও তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই, একাকেন্দ্রিক বিশ্বের অবসান করে মাল্টিপোলার বিশ্ব গড়তে হলে যে কাজগুলো করা দরকার তার জন্য মসুলিম বিশ্বের সহায়তা প্রয়োজন। Cold War-এর সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন মুসলিম বিশ্বের বিপরীতে অবস্থান করেছিল। ফলে অনেক মুসলিম দেশ হয়তো সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রুশ ফেডারেশনকে একই চরিত্রের মনে করতে পারে। এই ভ্রান্তি নিরসনের জন্য প্রেসিডেন্ট পুতিনের আশু কর্তব্য হচ্ছে মুসলিম বিশ্বের বাছাই করা কিছসুংখ্যক বুদ্ধিজীবী নিয়ে একটি Think Tank গঠন করা। যে Think Tank মসুলমানদের মন থেকে ভুল ধারণা দূর করবে এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে মসুলমানদের শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করে জাতিকে জানাবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

সম্পাদকীয়ঃ মাসিক ইতিহাস অন্বেষা জুলাই ২০১২

Tuesday, July 3, 2012

মুজাদ্দেদে আলফে-সানীর সংস্কার আন্দোলন


আহম্মদ সারহিন্দী (র.) ৯৭৫ হিজরীতে (১৫৬৩ খ্রি.) পাঞ্জাবের তৎকালীন পাতিয়ালা রাজ্যের বিখ্যাত সারহিন্দ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক (র.)-এর ২৮তম অধঃস্তন বংশধর। তাঁর বয়সকাল ছিল রাসূল (স.)-এর ন্যায় ৬৩ বছর। তাঁর জীবন ও কর্ম তাঁকে সত্যিকারের ওয়ারাছাতুল আম্বিয়ার মর্যাদা দান করেছে। তিনি হানাফী মাজহাবের অনুসারী ছিলেন, তবে ইমাম শাফেয়ীকে তিনি অত্যন্ত ভক্তি শ্রদ্ধা করতেন এবং কোনো কোনো আমল ইমাম শাফেয়ীর তরীকায় সম্পাদন করতেন।


ফসলের ক্ষেতে যেরূপ আগাছা জন্মায় এবং উক্ত আগাছা যথাযথরূপে উৎপাটন না করলে যেভাবে ফসলের মাঠ আগাছার মাঠে পরিণত হয় ঠিক তদ্রুপ ইসলাম নামক শস্যক্ষেত্রেও শিরক, বেদাত, কুফরীসহ বিভিন্ন আগন্তুক মতবাদের আগাছা জন্মায় অথবা উদ্দেশ্যমূলকভাবে আগাছার বীজ ছড়িয়ে দেয়া হয়, যাতে ইসলামের বাগান বাতিলের বাগানে পরিণত হয়।
এমতাবস্থায় যে ধর্মনেতা পরিপূর্ণভাবে আল্লাহ ও রাসূল (স.)কে অনুসরণ করে ইসলামের বাগানকে আগাছামুক্ত করার দায়িত্ব পালন করেন তাঁকে বলা হয় মুজাদ্দেদ বা সংস্কার কর্তা।


মুজাদ্দেদ কোনো দাবি করার জিনিস নয়- করে দেখানোর জিনিস। শতাব্দীব্যাপী কুসংস্কার ও অনাচারে ইসলামের সত্য-সুন্দর রূপ আচ্ছন্ন হয়ে বিকৃত হয়ে পড়লে যে মনীষী তাঁর অনুপম পাণ্ডিত্য, অতুলনীয় শাস্ত্রজ্ঞান, বিপুল কর্মশক্তি, দুর্জয় সাহস, তেজোদ্দীপ্ত কণ্ঠ এবং ক্ষুরধার লেখনীর সাহায্যে ইসলামকে জঞ্জাল, আবর্জনা ও আগাছা মুক্ত করে ইসলামের সত্য-সুন্দর রূপের বিকাশ ঘটাবেন এবং যুগের চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হবেন তিনিই মুজাদ্দিদ বলে পরিগণিত হন। তাঁর কার্যসীমা মাদ্রাসা কিংবা খানকার চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। তাঁর জীবন কেবল আনুষ্ঠানিক ইবাদাত-বন্দেগী, মুরাকাবা-মুশাহাদাতে ব্যয় হবে না বরং তাঁর কাজের ধরন হবে ভিন্নতর। এ প্রসঙ্গে তিনি তাঁর প্রিয় পুত্রকে চিঠির মাধ্যমে বলেছিলেন, “বৎস, আমাকে সৃষ্টি করার পিছনে যে উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে- তা সত্ত্বেও আর একটি বিশাল কারখানা আমার জিম্মায় দেয়া হয়েছে। পীর-মুরিদী করার জন্য আমাকে সৃষ্টি করা হয়নি। মুরীদদের তারবিয়ত এবং মানুষের ইরশাদও এর উদ্দেশ্য নয়। সেটা ভিন্ন এক ব্যাপার এবং অন্য এক কারখানা। এর সাথে যে সম্পর্ক রাখবে সে উপকৃত হবে। অন্যথায় নয়। আমার উপর যে কারখানাটির দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে- তার মোকাবিলায় তারবিয়ত ও ইরশাদ এমন একটি ব্যাপার- যেমন রাস্তায় পতিত কোনো বস্তু।” (পত্র নং-৬, ২য় খ-)


শেখ আহমদ সারহিন্দী ছিলেন একজন যুগনায়ক, মরদে মুজাদ্দিদ ও মুজাহিদ। ইসলাম ও মুসলিম মিল্লাতের এক মহাসংকটকালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং স্বীয় সাধনা ও কর্মশক্তি গুণে জাতির ইতিহাসে মুজাদ্দিদে আলফেসানী (দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মুজাদ্দিদ) নামে পরিচিত হন। এ প্রসঙ্গে রাসুল (স.) বলেন- “আল্লাহ এই উম্মতের জন্য প্রতি শতাব্দীর অবসানকালে এমন একজন ব্যক্তিকে পাঠাবেন, যিনি উম্মতের স্বার্থে তাঁর দ্বীনের সংস্কার সাধন করবেন।”


মুজাদ্দিদ সাহেবের উপলব্ধি ও শিক্ষা
সম্রাট আকবর রাজত্ব করেন ১৫৫৬ থেকে ১৬০৬ খ্রি. পর্যন্ত। আহমদ সারহিন্দের জন্ম ১৫৬৩ খ্রি. এবং ইন্তেকাল ১৬২৪ খ্রি.। সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬০৬ খ্রি. সিংহাসনারোহণ করেন। সুতরাং আহমদ সারহিন্দ এই উভয় প্রবল প্রতাপান্বিত মোগল সম্রাটদের রাজত্ব প্রত্যক্ষ করেন। মুজাদ্দেদ (র.) যখন সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন তখন সম্রাট আকবরের চূড়ান্ত উন্নতি, সমৃদ্ধি ও শানশওকতের কাল। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য আকবর তখন ইরানী শিয়া ও ব্রাহ্মণ্যবাদী ঠাকুর-পুরোহিতদের পরামর্শে সঠিক ইসলামকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দ্বীনে ইলাহী নামক কুফরী ধর্ম প্রচারে ব্যস্ত। এমতাবস্থায় শেখ আহমদ সারহিন্দ অভিজ্ঞ ডাক্তারের মতো প্রথমে রোগীর রোগের কারণ নির্ণয় করেন এবং অতঃপর রোগমুক্তির দাওয়াই সংগ্রহ করে প্রয়োগ করা শুরু করেন। ক্রমান্বয়ে তাঁর চিকিৎসা পদ্ধতি সফলতার দিকে এগিয়ে যায় এবং মুরতাদ আকবর শেষ জীবনে তওবা করে নিজ ধর্মে ফিরে আসেন এবং সম্রাট জাহাঙ্গীর পর্যায়ক্রমে সংশোধিত হয়ে এক পর্যায়ে শেখ আহমদ সারহিন্দের মাধ্যমে ইসলামের নিকট আত্মসমর্পণ করেন ও শরীয়া আইন জারি করেন।


মুজাদ্দিদ (র.) রোগের কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে দেখতে পান তৎকালীন ভারতবর্ষের বেশির ভাগ মুসলমান মূল ইসলাম থেকে দূরে সরে গিয়ে মনগড়া ইসলাম অনুসরণ করছে। জাতির আলেমগণ তখন দুনিয়াদারীর লোভে পথভ্রষ্ট ও বিপদগামী। বেদায়াত, পীরবাদ, সুফীবাদ আলেম ও জনসাধারণকে ইসলাম থেকে দূরে নিয়ে গেছে। আল্লাহর খলিফারা তখন পীরের খলিফা ও বাদশাহর মোসাহেবে পরিণত হয়েছে। দুনিয়াদার দরবারী আলেম, বিকৃত শিয়া মতবাদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদী কূটচালে সম্রাট আকবর তখন পথভ্রষ্ট হয়ে ইসলাম বিরোধী ‘দ্বীনে ইলাহী’ ধর্ম চালু করেছেন। এক আল্লাহকে বাদ দিয়ে সূর্য পূজা, নক্ষত্র পূজা ও শক্তি পূজায় ব্যস্ত। ইসলামের সকল স্তম্ভের উপর আকবর প্রচণ্ড হামলা করে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। অগণিত মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে, অনেকগুলোকে মন্দিরে পরিণত করা হয়েছে। ইসলামের সকল হুকুম-আহকাম পালন আকবরী শাসনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। এমতাবস্থায় মুজাদ্দেদ (র.) এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, সকল রোগ, দুঃখ-দুর্দশা ও অধঃপতন থেকে রক্ষা পাওয়ার মহৌষধ একটাই- আর তাহলো মূল ইসলামের দিকে ফিরে আসা। কেবল এর মাধ্যমেই মুসলমানগণ পুনরায় জেগে উঠবে এবং বিজয়ী জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে।


১. মূল ইসলামের দিকে ফিরে আসতে হবে-
তিনি লিখেন, একটি বৃক্ষ যত বড়ই হোক মূলের সাথে তাকে সংযোগ বজায় রাখতেই হবে। তাহলেই সে মূল থেকে রস/জীবনীশক্তি টেনে নিতে সক্ষম হবে এবং উর্ধ্বাকাশ ও প্রকৃতি থেকে সূর্যালোক ও নাইট্রোজেন গ্রহণ করে সতেজ থাকতে পারবে। সুস্থ সতেজ অবস্থায় গাছ কখনো উর্ধ্বাকাশ ও প্রকৃতি থেকে ক্ষতিকর কোনো জিনিস গ্রহণ করে না। এভাবেই একটি গাছ বেঁচে থাকে এবং ফলে-ফুলে সুশোভিত হয়। কিন্তু মূলের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন বৃক্ষ উর্ধ্বাকাশ থেকে যত খাদ্যই গ্রহণ করুক না কেন তার মৃত্যু অনিবার্য।
ইসলাম ও মুসলমানদের মূল হলো কুরআন ও রাসূল (স.)-এর সুন্নাহ। ইসলাম রূপ বৃক্ষটির সাথে যদি এর মূলের নিবিড় সংযোগ থাকে তবে সে এই মূল থেকেই রস/জীবনী শক্তি আহরণ করবে এবং প্রয়োজনবোধে পৃথিবীর অন্যান্য মতবাদ থেকে প্রয়োজনীয় অংশ গ্রহণ করবে, অপ্রয়োজনীয় অংশ পরিত্যাগ করবে। এভাবেই সে নিজেকে জীবন্ত, সতেজ ও পরিপূর্ণ রাখবে। মুসলমানদের অনুকরণীয় আদর্শ হলো ইসলাম। তাদের ব্যক্তিক, সামষ্টিক, জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় ভাবধারা এবং কার্যক্রম এই আদর্শের উপরই নির্ভরশীল। যতদিন তারা এই আদর্শের উপর কায়েম থাকবে ততদিন তারা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে বেঁচে থাকবে। বিশ্বের নেতৃত্ব তারাই দিবে, কর্তৃত্ব তারাই করবে। কিন্তু মূল থেকে সরে গেলে তারা আর জীবন্ত জাতি হিসেবে টিকে থাকতে সক্ষম হবে না। মূলের সাথে সংযোগহীন বৃক্ষের ন্যায় অন্য জাতির জ্বালানি কাঠে পরিণত হবে। বিশ্বে তারা একটি নিকৃষ্ট, নিপীড়িত, নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত জাতিতে পরিণত হবে। জ্বালানি কাঠের ন্যায় অন্যের কাজে, অন্যের উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহৃত হবে। নিজ জাতির কোনো কাজে আসবে না। এমনকি কুঠারের হাতল হয়ে স্বজাতির ধ্বংস সাধনে ব্যবহৃত হবে।


২. মূল ইসলামের জন্য ক্ষতিকর মতবাদসমূহ পরিত্যাগ করা-
তিনি মূল ইসলামের জন্য ক্ষতিকর মতবাদসমূহকে চিহ্নিত করেন। এগুলো হলো- বিদা’ত, পীরবাদ, সুফীবাদ ও বিজাতীয় মতবাদ। এসকল বিষয়ে তার বক্তব্য হলো-
(ক) বিদা’ত : ইসলামে যদি কেউ নতুন কোনো কিছুর উদ্ভাবন বা সংযোজন করে যা তাতে (ইসলামে) নেই তবে তা বিদআত। এ প্রসঙ্গে তিনি রাসূল (র.)-এর বিদায় হজ্বের ভাষণের সময় নাজিল হওয়া পবিত্র কুরআনের সর্বশেষ নাজিলকৃত আয়াত- (“আল্ইয়াত্তমু আক্মালতু লাকুম দ্বীনুকুম ওয়া আতমামতু আলাইকুম নে’মাতা, ওয়ারাদীতু লাকুমুল ইসলামা দ্বীনা”; যার অর্থ আজ আমি দ্বীনকে তোমাদের জন্য পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং আমার নেয়ামতকে তোমাদের উপর সম্পূর্ণ করে দিলাম। আর দ্বীন (জীবন বিধান) হিসেবে ইসলামকেই তোমাদের জন্য মনোনীত করলাম।) উল্লেখ করে বলেন, যে বস্তু পরিপূর্ণ হয়ে আছে তাতে বাইরের কোনো বস্তুর জন্য সামান্য কোনো স্থান থাকতে পারে না। যদি স্থান থাকে তবে সে পূর্ণ নয়- অপূর্ণ। আর পূর্ণ পানির গ্লাসে বাইরের কিছু প্রবেশ করালে সেখান থেকে মূল পানি বাইরে বেরিয়ে যাবে এবং অবশিষ্ট পানি ভেজালে পরিপূর্ণ হবে। তিনি আরো বলেন, ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান। আল্লাহর কিতাব এবং রাসূল (স.)-এর হাদীসে বর্ণিত আদেশ-নিষেধ কিংবা আমল ও আকীদা ছাড়া অন্য কোনো উদ্ভাবিত বিষয়ের স্থান ইসলামে নেই। কুরআন সুন্নাহর সাথে সামঞ্জস্যহীন কোনো কিছু ইসলামে অনুপ্রবিষ্ট হলে, কিংবা করানো হলে তা হবে সম্পূর্ণ বেদআত- স্থান বিশেষে শিরক ও কুফর।
(খ) বেদআতে হাসানা ও সাইয়্যাহ্
মুজাদ্দেদ (র.) বেদআতে হাসানা ও সাইয়্যাহ্ নামক বিভাজনকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, সকল বেদআতই অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাবে। এ প্রসঙ্গে তিনি ৩টি হাদীসের উল্লেখ করেছেন। যার অনুবাদ হলো-
১. ইসলামে যদি কেউ নতুন কোনো কিছুর উদ্ভাবন করে, যা তাতে (ইসলামে) নেই তবে তা পরিত্যাজ্য।
২. রাসূল (স.) বলেছেন- তোমাদের উপর অবশ্য কর্তব্য- আমার ও হেদায়াতপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শ অনুযায়ী  চলা। তা থেকেই দলিল প্রমাণ নিবে এবং তাকেই দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবে। নব-উদ্ভাবিত আমল বেদআত, প্রত্যেক বেদআতই গোমরাহী ও ভ্রান্তি।
৩. হযরত হাস্সান (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (স.) বলেছেন, জাতি যদি নিজের দ্বীনে কোনো বেদাআত সৃষ্টি করে তাহলে আল্লাহ তাদের থেকে ঠিক অনুরূপ একটি সুন্নাতকে ছিনিয়ে নেন। এরপর সেই সুন্নাত কেয়ামত পর্যন্ত আর তাদের কাছে ফেরত আসে না।


(গ) সুন্নাত ও বেদআতের প্রকারভেদ
মুজাদ্দেদ (র.) বলেছেন, রাসূল (স.)-এর সব আমল দুই ধরনের ছিল। (১) ইবাদাতের পর্যায়ভুক্ত, (২) অভ্যাসের অন্তর্ভুক্ত।
(১) রাসূল (স.) যেসব আমল ইবাদাত হিসেবে করেছিলেন তার বিপরীত আমলই বেদআত-ই-মুনকার (অবশ্যই নিষিদ্ধ)। এর প্রতিরোধ ও গতিরোধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো সাচ্চা উম্মতের কর্তব্য।
(২) রাসূল (স.) যেসব কাজ দেশপ্রথা ও অভ্যাস হিসেবে করতেন তার বিপরীত কাজকে আমি (মুজাদ্দেদ) বেদআতে মুনকার মনে করি না। এর প্রতিরোধ ও গতিরোধে অপ্রয়োজনীয় প্রয়াসও চালাই না। কেননা, দ্বীনের সাথে এ কাজের কোনো সম্পর্ক নেই। তার উদ্ভব প্রচলিত প্রথার কারণেই হয়েছিল- দ্বীন ও মিল্লাতের কারণে নয়।
তিনি (মুজাদ্দেদ) আরো বলেছেন, প্রত্যেক বেদআতী ও বিভ্রান্ত ব্যক্তি স্বীয় বাতিল আকিদার যথাযোগ্যতা প্রমাণের জন্য কুরআন ও সুন্নারই আশ্রয় নিয়ে থাকে ও দোহাই পাড়ে। অথচ নিঃসন্দেহে তা নিস্ফল ও নিরর্থক। এজন্য সর্বাগ্রে আকায়েদ পরিশোধন নেহায়েত জরুরি। এরপর হালাল-হারাম, ফরজ-ওয়াজিব প্রভৃতি শরীয়তের হুকুম আহকাম সম্পর্কে জ্ঞানর্জন, তারপর তদানুযায়ী আমল এবং এরপরেই তাজকিয়ার (আত্মার বিশুদ্ধকরণ) স্থান।
(ঘ) পীরবাদ : এ সম্পর্কে মুজাদ্দেদ (র.) বলেছেন, পীরবাদ দ্বারা আল্লাহর খলিফারা মানুষের খলিফা হয়ে যায়। আলাদা হয়ে যায় শরীয়ত থেকে তরীকত। শরীয়তের অধীনে না হলে যে কোনো তরীকতই সুস্পষ্ট গোমরাহী। পীরবাদীরা রাসুলুল্লাহ (স.)-এর অনুসরণের পরিবর্তে পীরের অনুসরণ করে গোমরাহ হয়।
(ঙ) সুফীবাদ : এ সম্পর্কে মুজাদ্দেদ (র.)-এর বক্তব্যের সারকথা হলো, পথভ্রষ্ট সুফীবাদের মাধ্যমে মহাবিপ্লবী মুসলমানেরা হয়ে যায় মহাধ্যানী, মহাযোগী বা বৈরাগীতে। বনের রাজা সিংহরা পরিণত হয় গৃহপালিত বিড়ালে।
মূল ইসলামে উপরোক্ত ক্ষতিকর মতবাদসমূহের অনুপ্রবেশের ফলে সম্রাট আকবরের আমলে ভারতবর্ষের আলেম সমাজ ও মুসলমানদের বেশির ভাগ সদস্যই ঈমান ও আমল হারিয়ে গোমরাহীতে নিমজ্জিত হয়েছিল। আকবর এ সকল গোমরাহ সুফী (বিড়াল)দেরকে শুঁটকী দিয়ে, পীরদেরকে শিরনী দিয়ে, বেদাআতীদেরকে অপকর্মের লাইসেন্স দিয়ে নিজের ইসলামবিরোধী কার্যকলাপের সহযোগীতে পরিণত করেছিল। এ জন্যই সম্রাট আকবরের আমলে ভারতবর্ষের পীর-সুফী বেদআতীরা আকবরের ইসলামবিরোধী অপকর্মের প্রতিবাদ করেনি এবং সঠিক ইসলামপন্থীদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য আকবরের সহযোগী হয়েছিল।


মুজাদ্দেদ (র.) সাহেবের আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণকারী ও তৃতীয় পুত্র খাজা মাসুম বলেছেন-
তিন ব্যক্তির সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকবে-
১. দায়িত্বে অবহেলাকারী আলেম।
২. শরীয়তবিরোধী দরবেশ।
৩. মূর্খ সুফী।
তিনি আরো বলেছেন-
যে ব্যক্তি আধ্যাত্মিক দীক্ষা দানকারী পীরের আসনে আসীন হয়েছে অথচ রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সুন্নাতের অনুসারী নয় এবং শরীয়তের অলঙ্কারে সুসজ্জিত নয়Ñ তার থেকে দূরে অবস্থান করিও... সে আত্মগোপনকারী চোর এবং শয়তানের এজেন্ট।


৩. শরীয়ত, তরীকত ও হাকিকত সম্পর্কে মুজাদ্দেদ (র.)-এর বক্তব্য
শরীয়তের তিন অংশ- জ্ঞান (ইলম), কর্ম (আমল) ও একাগ্রতা বা নিষ্ঠা (ইখলাস)। যতক্ষণ পর্যন্ত এ তিনটির সম্মিলন না হলো ততক্ষণ শরীয়ত হলো না। যখন শরীয়ত প্রমাণিত ও বাস্তবায়িত হয়ে গেল, আল্লাহর সন্তুষ্টিও হাসিল হয়ে গেল। ইহকালীন ও পরকালীন যাবতীয় সৌভাগ্যের চাবিকাঠি একমাত্র শরীয়ত।
তরীকত ও হাকিকত (আধ্যাত্মিকতা) সুফীদের বৈশিষ্ট্য গুণ। কিন্তু এ দুটি জিনিস শরীয়তের তৃতীয় অংশ অর্থাৎ ইসলাম এর পূর্ণতার জন্য শরীয়তের খাদেম বিশেষ। শরীয়তের পূর্ণতা বিধানই হচ্ছে তরীকত ও হাকিকতের একমাত্র উদ্দেশ্য।


৪. কেয়াস ও ইজতিহাদ
এ প্রসঙ্গে মুজাদ্দিদ (র.)-এর বক্তব্যের মূল কথা হলো- কেয়াস (অনুমান) ও ইজতিহাদের কোনো সম্পর্ক বেদআতের সঙ্গে নেই। কেয়াস ও ইজতিহাদ অতিরিক্ত কোনো কিছুর সৃষ্টি করে না। বরং তা একমাত্র কুরআন ও হাদীসের উদ্দেশ্য ও মর্মার্থকে প্রকাশ করে থাকে।


শেখ আহমদ সারহিন্দীর সংস্কার কর্মসূচি
তিনি সহজ-সরল-বোধগম্য ভাষায় তাঁর উপলব্ধি ও সিদ্ধান্ত মৌখিক ও লিখিত আকারে জাতির সামনে তুলে ধরেন। তিনি বুঝেছিলেন মূল ইসলাম ধর্মে অন্যান্য বিষয় অনুপ্রবেশের ধারাবাহিকতায় ধর্মনেতাদের বেশির ভাগ অংশ বিপদগামী এবং মাতৃভাষায় ইসলামকে না বুঝার কারণে জনগণ গোমরাহীতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। তাঁর সমকালীন উপলব্ধি ছিল- শাসকগোষ্ঠীই সকল অনাচারের মূল। আরবীতে একটি প্রবচন আছে যার অর্থ হলো- “জনগণ শাসকদেরই অনুসারী হয়ে থাকে।” এ প্রসঙ্গে পত্র নং-৪৭, (১ম খ-)-এর ৬৫ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, “সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাদশাহর সম্পর্ক ঠিক তেমন- যেমন সম্পর্ক দেহের সাথে মনের। মন যদি ঠিক থাকে তবে দেহও ঠিক থাকে। যদি মন বিগড়ে যায় তবে দেহ বিপথগামী হয়। সুতরাং বাদশাহর সংশোধন সাম্রাজ্যেরই সংশোধন। বাদশাহর বিপর্যয় সমগ্র সাম্রাজ্যের ধ্বংসের নামান্তর। এ জন্য তিনি শাসক পরিবর্তনের চাইতে শাসকের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তনকেই অগ্রাধিকার দেন। এর আলোকে তাঁর কর্মসূচি ছিল-
(ক) বেসরকারি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংশোধন।
(খ) উচ্চপদস্থ সরকারি আমলাদের সংশোধন।
(গ) বাদশাহর সংশোধন।
(ঘ) দুনিয়াদার ও দরবারী আলেমদের সংশোধন।
উক্ত কর্মসূচি বাস্তবায়নের পদ্ধতি ও পন্থা ছিল নিম্নরূপ-
তিনি তাঁর কর্মসূচি বাস্তবায়নে তরবারির আশ্রয় নেননি। তিনি ভারতের নেতৃস্থানীয় সামরিক-বেসামরিক, সরকারি-বেসরকারি গুরত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের এবং জনগণের মনোজগতে বিপ্লব সৃষ্টির পন্থা অনুসরণ করেন। উক্ত বিপ্লব তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষের চিন্তায় ও দৃষ্টিভঙ্গীতে, নৈতিকতা ও তামাদ্দুনে, রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থায়, সমাজ ও অর্থনীতিতে। তাঁর একমাত্র পাথেয় ছিল- আল্লাহর উপর নির্ভরশীলতা, আল্লাহর সাহায্য এবং দৃঢ় মনোবল। এ লক্ষ্যে তাঁর কার্যক্রম ছিল নিম্নরূপ-
১. তিনি প্রথমত লোকদের সামনে দ্বীনের সঠিক রূপটি তুলে ধরেন, যারা তা গ্রহণ করে তাদেরকে সংঘবদ্ধ করেন এবং তাদের চারিত্রিক দিক অর্থাৎ ঈমান, আকীদা ও আচার-আচরণ সংশোধন করতে সচেষ্ট হন।
২. তিনি বেদআতের প্রকাশ্য বিরোধিতায় না গিয়ে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সুন্নাত অনুসরণের নির্দেশ দিতেন। আর এটাকেই সফলতা ও সৌভাগ্যের একমাত্র পথ বলে ঘোষণা করতেন। তাঁর বক্তব্য ছিল- “বন্দেগীর সকল প্রকার হক আদায় করা এবং আল্লাহর প্রতি সর্বদা ও সব সময় দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখাই মানব সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য। এই অবস্থা ঠিক তখনি সৃষ্টি হবে- মানুষ যখন দুনিয়া ও আখেরাতের মহান নেতার আদর্শকে প্রকাশ্যে ও গোপনে সর্বাবস্থায় পূর্ণরূপে অনুসরণ করবে।”
পার্থিব শান্তি ও উন্নতি এবং পরকালীন মুক্তি একমাত্র নবী (স.)-এর আদর্শের অনুসরণের উপরই নির্ভলশীল। একজন মুসলমান যখন পূর্ণভাবে নবী (স.)-এর আদর্শের অনুসরণ করে তখনিই সে আল্লাহর সত্যিকার বান্দায় পরিণত হয়। উন্নীত হয় আল্লাহর প্রেমাষ্পদের পর্যায়ে, লাভ করে সফলতা ও পূর্ণতা। এই সফলতা লাভকারী ও পূর্ণতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ বনী ইসরাইলের নবীগণের সমপর্যায়ে উন্নীত হয়।
৩. তিনি আগ্রা, সারহিন্দ ও লাহোরে উচ্চ মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন এবং ছাত্রদেরকে স্বীয় লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের অনুকূলে প্রস্তুত করেন।
৪. তিনি ভারতের বিশিষ্ট বেসরকারি ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করেন এবং অনেককে স্বীয় মতে দীক্ষিত করেন।
৫. তিনি সম্রাট আকবরের ঘনিষ্ঠ সুন্নী মতাবলম্বী সভাসদদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের অনেককে স্বীয় মতাদর্শে দীক্ষিত করেন। এ সকল সভাসদদের তৎপরতায় সম্রাট আকবর শেষ জীবনে তওবা করে আপন ধর্মে ফিরে আসেন।
৬. আকবরের মৃত্যুর পর ১০১৪ হিজরীতে সম্রাট জাহাঙ্গীর সিংহাসনারোহণ করলে তিনি চূড়ান্ত লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। তিনি স্বমতে দীক্ষিত দরবারের সভাসদদের দ্বারা জাহাঙ্গীরের মনোভাবকে ইসলামের অনুকূলে আনতে সক্ষম হন এবং এক পর্যায়ে সম্রাট জাহাঙ্গীর মুজাদ্দেদ (র.)-এর দাবিগুলো মেনে নেন। অবশ্য দাবি মানার পূর্বে সম্রাট জাহাঙ্গীর মুজাদ্দিদকে স্বীয় সিংহাসনের জন্য হুমকি মনে করে কুখ্যাত গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দী করেন। দুর্গাধিপতি এক সময় সম্রাটের নিকট এই মর্মে রিপোর্ট প্রেরণ করেন যে, “আহমদ সারহিন্দ এর সংস্পর্শে থেকে গোয়ালিয়র দুর্গের পশুসুলভ বন্দীরা মানুষে পরিণত হয়েছে এবং মানুষগুলো ফেরেশতায় পরিণত হয়েছে।” এরূপ রিপোর্ট পাওয়ার পর সম্রাট জাহাঙ্গীর নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং মুজাদ্দেদকে মুক্তি দান করে তাঁর সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। সাক্ষাতে মুজাদ্দিদ (র.) সম্রাটের নিকট স্বীয় দাবিনামা পেশ করেন। তাঁর দাবিগুলো ছিল-
(ক) সম্রাটকে সেজদা করার রীতি সম্পূর্ণভাবে রহিত করতে হবে।
(খ) মুসলমানদেরকে গরু জবেহ করার অনুমতি দিতে হবে।
(গ) বাদশাহ ও তাঁর দরবারীদের জামায়াতে নামাজ আদায় করতে হবে।
(ঘ) কাজীর পদ ও শরীয়ত বিভাগ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
(ঙ) সমস্ত বেদায়াত ও ইসলামবিরোধী অনাচারকে সমূলে উৎখাত করতে হবে।
(চ) ইসলামবিরোধী যাবতীয় আইন রহিত করতে হবে।
(ছ) ভগ্ন ও বিধ্বস্ত মসজিদগুলোকে পুনরায় আবাদ করতে হবে।
(উল্লেখ্য, সম্রাট আকবরের আমলে হিন্দুরা ভারতের অনেক মসজিদকে ধ্বংস করেছিল এবং অনেকগুলোকে মন্দিরে পরিণত করেছিল।)
সম্রাট জাহাঙ্গীর মুজাদ্দেদ (র.)-এর দাবিসমূহ সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেন এবং শাহী ফরমান জারি করে তা কার্যকর করেন।
মুজাদ্দেদ (র.)-এর দাবির সারকথা ছিলÑ নির্ভেজাল ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা। অপর কোনো ধর্ম বা ফেরকার বিরোধিতা করা বা ব্যক্তিগত লাভের কোনো ব্যাপার এতে ছিল না।
৭. প্রত্যেক শহর ও পল্লীতে মুজাদ্দেদ (র.) সাহেবের একজন করে প্রতিনিধি ছিলেন যারা নিজেদের উদ্দেশ্যের প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান, একাগ্রচিত্ত ও বজ্রকঠোর।


মুজাদ্দেদে আলফেসানী (র.) কেন সশস্ত্র যুদ্ধের পথে যাননি?
রোগ বুঝে চিকিৎসা করা মুজাদ্দেদ (র.)-এর নীতি ছিল। তিনি জানতেন, একশ্রেণীর দুনিয়াদার দরবারী আলেম, পীর ও সুফী সম্রাট আকবরকে ইসলামবিমুখ করেছে। তার সাথে যোগ হয়েছিল শিয়া মূলহেদ সম্প্রদায় ও হিন্দুরা। অথচ প্রথম জীবনে আকবর ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন। এমতাবস্থায় তিনি প্রথমে আকবরের সভাসদদের শুদ্ধ করেন এবং অতঃপর উক্ত সভাসদদের মাধ্যমে আকবরের মানসিক পরিবর্তনের প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন। এছাড়া আরো যেসব কারণ অনুমান করা যায় তা হলো-
১. হাদীসের নির্দেশ অনুযায়ী কোনো মুসলিম শাসনকর্তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লব ঠিক তখনই জায়েজ, যখন প্রমাণিত হবে যে, তিনি প্রকাশ্যে কুফরীতে ও ইসলামদ্রোহীতায় লিপ্ত রয়েছেন। মুশরেকী ও কাফেরী কার্যকলাপ সংগঠিত হওয়া যদিও হারাম তবুও কোনো ব্যক্তিকে ঠিক তখনই কাফের ঘোষণা করা যায়, যখন তাকে মুসলমান বলার মতো আর কোনো কারণই বিদ্যমান থাকে না। সম্ভবত আকবরের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদে অবতীর্ণ হওয়ার শক্তি মুজাদ্দিদ সাহেব তখনও অর্জন করতে পারেননি। অথচ শরীয়তের দৃষ্টিতে জেহাদ ঘোষণার জন্য শর্ত হলো- এতটুকু বৈষয়িক শক্তি অর্জিত হতে হবে, যা দ্বারা বিজয়ী ও সফল হওয়ার কিছুটা আশা করা যায়। তাছাড়া আকবরের জীবনে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসাটাও সশস্ত্র যুদ্ধ না করার কারণ হতে পারে।
২. মুজাদ্দেদ সাহেব আকবরকে স্বার্থপর ও ফাসেক মুসলমান বলতেন। অসাধু চাটুকার ও স্বার্থপর লোকদের দ্বারা আকবর পরিবেষ্টিত ছিলেন। এ জন্য আকবরের তুলনায় তিনি এসব স্বার্থপর আলেম, বিলাসপ্রিয় সভাসদ এবং চাটুকারদের সমালোচনাই বেশি করেছিলেন। সম্রাটের সংশোধনের জন্য তাঁর পারিষদদের সংশোধনকেই তিনি অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন।
৩. সরকারের সংস্কার ও সংশোধনই যার একমাত্র লক্ষ্য সে রক্তাক্ত সংগ্রামকে ঠিক তখনই জরুরি মনে করেন যখন এ ছাড়া আর গত্যন্তর থাকে না। ক্ষমতাসীনদের সংশোধনই মুজাদ্দিদ সাহেবের উদ্দেশ্য ছিল। এ লক্ষ্যেই তিনি কাজ করেছেন। শরীয়তের হুকুম-আহকাম কায়েম করাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। এ জন্য নিজেকেই ক্ষমতাসীন হতে হবে এমন বিষয়কে তিনি জরুরি মনে করেননি। 
৪. মুসলমান রাজা-বাদশাহরা তখন গৃহযুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। প্রত্যেকেই অন্যের বিরুদ্ধে অযোগ্যতা, দুর্নীতিপরায়ণতা ও বিলাসিতার দোহাই পাড়তেন এবং সংশোধনের দাবি জানিয়েই যুদ্ধ ঘোষণা করতেন। ঠিক এই অবস্থায় মুজাদ্দিদ সাহেবও যদি সশস্ত্র যুদ্ধের ডাক দিতেন তবে জনগণ বিষয়টিকে ক্ষমতার লড়াই হিসেবে মনে করতেন। এমতাবস্থায় ক্ষমতার হাতবদল হলেও ভিতর থেকে সংশোধন ও সংস্কার সাধিত হতো না বরং মুসলমানদের রক্ত ঝরত।
তদুপরি আকবরের অনুসৃত ধ্বংসাত্মক নীতির ফলে সাম্রাজ্যের উপর হিন্দু ও শিয়ারা বিশেষ আধিপত্য বিস্তার করে ফেলেছিল। তারা একটি আত্মঘাতি যুদ্ধ লাগার অথবা লাগানোর অপেক্ষায় ছিল। মুজাদ্দিদ সাহেব যুদ্ধ ঘোষণা করলে তারা সে সুযোগটি পেয়ে যেত এবং ভারতবর্ষের মুসলমানরা আত্মঘাতি যুদ্ধে নিঃশেষ হয়ে যেত।
এ সকল কারণে মুজাদ্দেদ (র.) সমস্যার সমাধান ও কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে অহিংস নীতি অবলম্বন করেছিলেন।


তথ্যসূত্র : মুজাদ্দিদ-ই-আলফেসানীর সংস্কার আন্দোলন, মোহাম্মদ রুহুল আমিন, ১ম প্রকাশ, ইফাবা প্রকাশনী


লেখক : সম্পাদক, মাসিক ইতিহাস-অন্বেষা

Wednesday, June 13, 2012

আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারের স্বরূপ


একটি দেশ স্বাধীন হওয়ার শর্তাদি হলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড- ও সীমান্ত, সংশ্লিষ্ট ভূখণ্ডের অধিবাসীদের স্বাধীন থাকার ইচ্ছা ও মানসিকতা, উক্ত ভূখণ্ডে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন সরকার বা শাসক, উক্ত দেশের থাকবে স্বাধীন বিচার বিভাগ, প্রতিরক্ষানীতি, পররাষ্ট্রনীতি ও অর্থনীতি। উক্ত শর্তাদি বাস্তবে পূরণ হলেই একটি দেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে মর্যাদালাভ করে। পক্ষান্তরে একটি দেশের যদি শুধুমাত্র নির্দিষ্ট ভূখণ্ড থাকে কিন্তু সীমান্ত হয় অরক্ষিত, সরকার যদি হয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তাঁবেদার, প্রতিরক্ষানীতি হয় পরনির্ভরশীল, পররাষ্ট্রনীতি হয় নতজানু এবং অর্থনীতি হয় ভঙ্গুর ও শোষণের শিকার তবে উক্ত দেশকে কখনও স্বাধীন-সার্বভৌম বলা যায় না।


একটি দেশের জনগণকে তখনই স্বাধীন বলা যায়, যখন উক্ত দেশের সরকার হয় স্বাধীন ও সার্বভৌম, নাগরিকদের যদি থাকে ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাক্ স্বাধীনতা, বৈধ পথে সম্পদ অর্জন ও ব্যয়ের স্বাধীনতা, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার, ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার, সংখ্যাগরিষ্ঠের পছন্দমাফিক সরকার গঠন ও পরিবর্তনের অধিকার, মেধা ও যোগ্যতা অনুসারে চাকরি পাওয়ার ও ব্যবসা-বাণিজ্য করার অধিকার এবং ধর্মীয়, রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ ও চর্চা করার অধিকার। দেশের নাগরিকগণ যদি উক্ত অধিকারসমূহের একটি থেকেও বঞ্চিত হয় তবে সে নাগরিক তার দেশে পরিপূর্ণ স্বাধীন তা বলা যাবে না।


উপরোক্ত মৌলিক শর্তাদির আলোকে আমরা যদি বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থাকে পর্যালোচনা করি তবে আমরা দেখতে পাই-
১. ভূখণ্ড ও সীমান্ত : ১৯৪৭ সালের ভূখণ্ড ও সীমান্ত নিয়েই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ গঠিত হয়। ১৯৭১-পরবর্তী শাসক আমাদের বেরুবাড়ি ভারতকে প্রদান করেছে; কিন্তু বিনিময়ে প্রাপ্য আমাদের ছিটমহল ও করিডোরে আমরা এখনও সার্বভৌমত্ব অর্জন করতে পারিনি। প্রতিবেশী ভারতের দাবির কারণে আমাদের সমুদ্রসীমা এখনও চিহ্নিত হয়নি। তদুপরি আমাদের সরকার প্রতিবেশী ভারতের মদদপুষ্ট শান্তিবাহিনীর নিকট দেশের এক-দশমাংশ ভূমি তুলে দেওয়ার আয়োজন করেছে। একতরফা কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ বর্তমানে ভারতের একক নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে, আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে বাঘ থেকে বিড়ালের স্তরে নামিয়ে আনা হয়েছে। আমাদের ৫৪টি নদী পানির অভাবে মরা খালে পরিণত হতে চলেছে। এই হলো আমাদের ভূখণ্ড ও সীমান্তের হাল-হকিকত।


২. স্বাধীন থাকার ইচ্ছা ও মানসিকতা : বর্তমান সরকার সচেতনভাবে দেশের জনগণের স্বাধীন থাকার ইচ্ছা ও মানসিকতাকে ধ্বংস ও অবনমিত করার কর্মসূচি পালন করছে। স্বাধীন থাকার জন্য সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র বজায় রাখা অপরিহার্য। আমাদের সরকার আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির বিপরীত সংস্কৃতি লালন-পালন করছে যাতে জনগণের স্বাতন্ত্রবোধ বিলুপ্ত হয়।


৩. স্বাধীন সরকার ও শাসক : দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী গঠিত সরকারই স্বাধীন সরকার হওয়ার পূর্বশর্ত। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির চাপিয়ে দেয়া সরকারকে স্বাধীন সরকার বলা হয় না; বরং তাঁবেদার সরকার বলা হয়। বর্তমান সরকারটি তথাকথিত ১/১১-এর ফসল। আর ১/১১ সংগঠিত করেছিল সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা, ইসরাইল, ইউরোপ ও ভারত। এমতাবস্থায় সাম্রাজ্যবাদের চাপিয়ে দেয়া সরকার স্বাধীন সরকার নয়- সরকার প্রধানও স্বাধীন শাসক নয়। তাই সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নই এ সরকারের প্রধান কাজ।


৪. স্বাধীন বিচার বিভাগ : স্বাধীন বিচার বিভাগের পূর্বশর্ত হলো সৎ, যোগ্য, নীতিবান ও নিরপেক্ষ আইনমন্ত্রী ও বিচারক। বাংলাদেশের বর্তমান আইনমন্ত্রী নৈরাজ্যবাদী গণআদালতের সমন্বয়কারী ছিলেন, আইন প্রতিমন্ত্রী যখন এপিপি ছিলেন তখন হাইকোর্ট সুয়োমোটো রুল জারি করে তাঁকে এপিপি পদ থেকে অসততার দায়ে পদত্যাগে বাধ্য করেছিলেন। আর এই সরকার বিচার বিভাগে দলীয় ক্যাডার, খুনের আসামি ও প্রধান বিচারপতির এজলাসে লাথি মারার দায়ে দোষী ব্যক্তিকে পর্যন্ত বিচারক নিয়োগ করে বিচার বিভাগকে পক্ষপাতদুষ্ট ও চরম বিতর্কিত করেছে। ফলে বর্তমানে বিচার বিভাগ নৈরাজ্য সৃষ্টিতে ও অবিচার করার ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছে।


৫. প্রতিরক্ষানীতি : আমাদের প্রতিরক্ষা সামর্থ্যকে বিগত সাড়ে তিন বছরে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছে। দলীয়করণ, আত্মীয়করণ, গোপালগঞ্জীকরণ ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সৎ, যোগ্য, মেধাবী ও দেশপ্রেমিক কর্মকর্তাদেরকে হত্যা, নির্যাতন, বরখাস্ত ও চাকরিচ্যুত করে বিশ্বমানের এ বাহিনীকে পর্যুদস্ত করা হয়েছে। প্রতিরক্ষা ক্রয়ের ব্যাপারে সম্ভাব্য প্রতিপক্ষের উপর নির্ভরশীলতা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রতিরক্ষা সামর্থ্যকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে।


৬. পররাষ্ট্রনীতি : আধুনিক সরকারে প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর পর যে গুরুত্বপূর্ণ পদ রয়েছে সেটি হলো পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বর্তমান সরকার পররাষ্ট্র বিষয়ে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ ব্যক্তিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করেছে, বিদেশের বাংলাদেশ মিশনগুলোতে অযোগ্য, দুর্নীতিবাজ ও অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের পদায়ন করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলী দিয়েছে। একদেশ নির্ভর পররাষ্ট্রনীতির কারণে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে। বিপদের দিনে বন্ধুহীন ব্যক্তির ক্ষেত্রে যা হয় বাংলাদেশের বেলায়ও তাই হবে।


৭. অর্থনীতি : সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তার টার্গেটকৃত দেশের অর্থনীতি ধ্বংসকে প্রধান কর্তব্যকর্ম হিসেবে নির্ধারণ করে। দেশ ও জনগণ যদি অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী থাকে তবে তারা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন মোকাবেলায় দৃঢ় অবস্থান নেয়। অপরদিকে ভুখা-নাঙ্গা জনগণ সামান্য খুঁদ-কুড়ার লোভে সাম্রাজ্যবাদের নিকট আত্মসমর্পণ করে। এ জন্যই অতীতে আমরা দেখেছি ১৭৫৭ সালের ২৩ জুনের পলাশী ষড়যন্ত্রের মাত্র ১৯ বছরে সমৃদ্ধ বাংলাকে দুর্ভিক্ষের বাংলায় পরিণত করে এক-তৃতীয়াংশ জনগণকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছিল, ১৯৭১ সাল-পরবর্তী তিন বছরে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে লাখ লাখ লোককে মেরে ফেলা হয় এবং বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করা হয়। একই লক্ষ্যে ২০০৭ সালের ১/১১-এর পর থেকে অদ্যাবধি এদেশের ব্যক্তি পর্যায়ে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অর্থনীতি ধ্বংসের অব্যাহত প্রক্রিয়া চালু রাখা হয়েছে। অর্থনীতির প্রধান প্রধান সেক্টরসমূহ ধ্বংস করে সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন নিয়ম-কানুন তৈরি করে, ড্যাব, পরিবেশের অজুহাতে এবং নতুন গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে এদেশের সমৃদ্ধ আবাসন খাতকে ধ্বংস করে বর্তমানে ভারতের সাহারা গ্রুপের নিকট আবাসন খাতকে তুলে দেয়া হচ্ছে। শেয়ারবাজার, ইউনি-পে-টু ইউ, স্পীক এশিয়ার মাধ্যমে এদেশের জনগণকে সর্বস্বান্ত করা হয়েছে। কৃত্রিম গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট তৈরি করে শিল্প-কারখানাকে ধ্বংস করে ভারতীয়দের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে, সম্ভাবনাময় গার্মেন্টস খাতে বিশৃঙ্খলা জিইয়ে রেখে ধ্বংস করা হচ্ছে, ভ্রান্ত ও উদ্দেশ্যমূলক পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে জনশক্তি রফতানি খাতকে সংকুচিত করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথ বন্ধ করা হচ্ছে, মৎস্য, পোলট্রিশিল্পসহ সকল ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পকে ধ্বংস করে ভারতের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। এই হলো আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক স্বাধীনতা।


উপরোক্ত অবস্থার আলোকে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, বর্তমানে আমাদের দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের মান দ্রুত নিম্নমুখী হচ্ছে এবং আমরা পরাধীনতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হচ্ছি।


পূর্বেই বলা হয়েছে, সার্বভৌম দেশ ও স্বাধীন সরকারই কেবলমাত্র জনগণের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারে। পক্ষান্তরে আধা স্বাধীন, আধা সার্বভৌম অথবা তাঁবেদার দেশ ও সরকার সাম্রাজ্যবাদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে জনগণের স্বাধীনতা হরণ করে। এরূপ সরকার সাম্রাজ্যবাদীদের চোখ দিয়ে জনগণকে দেখে। এমতাবস্থায় তাঁবেদার সরকারের দৃষ্টিতে গোলামী মানসিকতার নাগরিকগণ হয় সরকারের বন্ধু এবং স্বাধীনচেতা নাগরিকগণ হয় সরকারের শত্রু। এরূপ সরকার প্রভুরাষ্ট্রকে খুশি করার জন্য স্বাধীনতাকামী জনগণের অধিকার হরণে সদাসর্বদা তৎপর থাকে এবং একপর্যায়ে সাম্রাজ্যবাদের মদদে নিজ দেশের জনগণের উপর হত্যা, নির্যাতন, গুম, খুন চাপিয়ে দেয় এবং দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।


বর্তমান বাস্তবতায় আমাদের নাগরিক স্বাধীনতার স্বরূপ
১. ব্যক্তি স্বাধীনতা : আমি একজন ব্যক্তি। আমি আমার যোগ্যতা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাই। কিন্তু আমার সে পথ বন্ধ। কেননা আমি সরকারি দল করি না, সরকারি দলের ক্যাডারদেরকে চাঁদা দিতেও রাজি নই। সুতরাং ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া আমার কপালে জুটবে না, কোনোভাবে ভর্তি হতে সক্ষম হলেও চাঁদা ব্যতীত হলে সিট পাবো না, চাঁদা না দিলে জানমালের নিরাপত্তা থাকবে না। এভাবে সরকারি, দল দলীয়কৃত প্রশাসন ও বিচার বিভাগ আমার নাগরিক স্বাধীনতাকে টুঁটি চেপে ধরছে।


২. বাক্ স্বাধীনতা : আমি আমার মনের কথাটা সমাজ ও রাষ্ট্রকে জানাতে চাই। কিন্তু উক্ত কথাটা যদি সরকারি লোকদের পছন্দ না হয় তবে আমাকে শারীরিক-মানসিকভাবে লাঞ্ছিত হতে হবে, মিথ্যা মামলা, হামলা, রিমান্ডের শিকার হতে হবে। সুতরাং আমাকে হয় বোকার মতো থাকতে হবে অথবা জুলুমের শিকার হতে হবে।


৩. বৈধ পথে সম্পদ অর্জন : আমি একজন দোকানদার বা ঠিকাদার। আমি সরকারি দলকে চাঁদা দেয়া ব্যতীত ব্যবসা করতে পারি না, টেন্ডারবাক্সে টেন্ডার জমা দিতে পারি না। কেননা ঠিকাদারীর কাজ পেতে হলে আমাকে সরকারি দলের ক্যাডার হতে হবে অন্যথায় ক্যাডারদের হাতে প্রাণ হারাতে হবে। সুতরাং বৈধ পথে সম্পদ অর্জনেও আমি স্বাধীন নই।


৪. চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার : আমি কঠিন রোগগ্রস্থ। প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নাই। সরকারি হাসপাতালই একমাত্র ভরসা। হাসপাতালে ভর্তি হতে হলে ঘুষ দিতে হবে, সিট পেতেও ঘুষ লাগবে, চিকিৎসার জন্য অভিজ্ঞ ডাক্তার নেই হাসপাতালে। তারা হয় অনুপস্থিত অথবা বসে আড্ডা দিচ্ছে। আমি এর প্রতিবাদ করলে স্বাধীনতা চিকিৎসা পরিষদের নেতাকর্মীদের দ্বারা হেনস্থা হতে পারি, অনভিজ্ঞ স্বাচিপ চিকিৎসকদের অবহেলা ও অপচিকিৎসায় মারা যেতে পারি। সুতরাং আমার চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার নেই।


৫. ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার : আমার বসতবাড়ি একব্যক্তি জোরপূর্বক দখল করে নিলো। আমি থানায় মামলা করতে গেলাম। দখলকারী যদি বিত্তশালী হয় অথবা সরকারি দলের লোক হয় তবে পুলিশ আমার মামলা গ্রহণ করবে না, মামলা নিলেও সঠিকভাবে চার্জশিট দেবে না, চার্জশিট দিলেও প্রতিপক্ষের ভয়ে সাক্ষীরা আদালতে গেল না, সাক্ষী যদিও যায় তবে দেখা গেল বিচারক ঘুষ খেয়ে আমার বিরুদ্ধে রায় দিলো অথবা আমার জীবদ্দশায় রায় দিলো না। এমতাবস্থায় আমার ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার কোথায়?


৬. পছন্দসই সরকার গঠনের অধিকার : আমি চাই আমার পছন্দের দল সরকার গঠন করুক। আমার দলকে আমি ভোটে বিজয়ী করতে চাই। আমি সরকারি দলের নজরে পড়লাম। ভোটের আগেই আমাকে মিথ্যা মামলায় জেলে নিয়ে গেল অথবা ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দিলো। এমতাবস্থায় আমার পছন্দসই সরকার গঠনের অধিকার থাকলো না।


৭. ধর্মচর্চা করার অধিকার : আমি একজন মুসলমান। আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে চাই। আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নামাজ আদায় করলে সরকারি দল মৌলবাদী বলে আমার উপর হামলা করলো। আমি সরকারি চাকরিজীবী, নামাজ-রোজা করার অপরাধে বরখাস্ত হওয়া, ওএসডি হওয়া এখন স্বাভাবিক ব্যাপার। আমি একজন সাধারণ নাগরিক। নামাজের সময় হওয়ায় বায়তুল মোকাররম মসজিদে প্রবেশ করতে চাই। কিন্তু সহজে তা সম্ভব নয়। এদেশের মন্দির-গীর্জা-প্যাগোডা পাহারায় কোনো পুলিশ না থাকলেও বায়তুল মোকাররম মসজিদ গেটে সারি সারি পুলিশ, রায়টকার, জলকামান সদা তৎপর। দুরু দুরু মনে মসজিদের গেটে ঢুকতে চাইলে দেখা গেল পুলিশ যন্ত্র দিয়ে, হাত দিয়ে আমার জামার নিচে লাদেন খুঁজছে। সুতরাং ছেড়ে দে মা-কেঁদে বাঁচি।


৮. জান-মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার : বর্তমান বাংলাদেশে জান-মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা চরম হুমকির সম্মুখীন। বেডরুমের নিরাপত্তা দেয়া সরকারের কাজ নয়- এ কথাটি প্রধানমন্ত্রী নিজেই জাতিতে জানিয়ে দিয়েছেন। প্রতিদিন ২০-২৫টি খুন, সড়ক দুর্ঘটনায় ১৫-২০ জনের মৃত্যু এবং একাধিক গুমের ঘটনা ঘটছে। সুতরাং এখানে প্রত্যেকেই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তদুপরি খালে, নদীতে, পাটক্ষেতে, ম্যানহোলে, পানির ট্যাংকে, ডোবায় প্রতিদিন বেওয়ারিশ লাশ পড়ে থাকে। যা ইতিপূর্বের কোনো সরকারের আমলে এত ব্যাপকভাবে দেখা যায়নি। একইভাবে পাড়াগাঁ থেকে রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত কোথাও আপনার মালের-সম্পদের নিরাপত্তা নেই। সরকারি দলের ক্যাডার, একশ্রেণীর পুলিশ স্বতন্ত্রভাবে ও ক্ষেত্রবিশেষে যৌথভাবে নাগরিকদের মাল-সম্পদ আত্মসাতে লিপ্ত রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে নির্দলীয়  বিরোধী দলীয় জনগণের বাগানের গাছ, পুকুরের মাছ, ক্ষেতের ফসল অহরহ লুটপাটের শিকার হচ্ছে। শহরাঞ্চলে চাঁদাবাজি, ছিনতাইয়ের মাধ্যমে নাগরিকদের সম্পদ লুটে নেয়া হচ্ছে। আর ইজ্জত! তার অবস্থা আরও করুণ। সরকারি দলের ক্যাডার, সন্ত্রাসী, মাস্তান- এমনকি শিক্ষকরাও মা-বোনদের ইজ্জত আবরু লুণ্ঠন করছে, তথাকথিত ইভটিজিং বা যৌন হয়রানি এ সরকারের আমলে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে।


৯. পরিবেশের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকার : সরকারের তাবেদারী মনোভাব এবং নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে প্রতিবেশী দেশ নদীর পানি আটকে দিয়ে, আমাদের সমুদ্র এলাকায় বিষাক্ত বর্জ্য ফেলে এদেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। সরকারি দলের নেতাকর্মীরা সরকারি রাস্তার গাছ, পাহাড়ের গাছ, উপকূলীয় বনভূমির গাছ কেটে অবাধে পরিবেশ ও সম্পদের ধ্বংস করছে। নদীর পাড়, নদীর পাড়ের পাবলিকের জমি ডেজার দিয়ে কেটে মাটি বিক্রি করছে। পাহাড় কেটে পাহাড়ের মাটিও বিক্রি করছে। ফলে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে, নদী ভাঙনে ফসলি জমি-বসতবাড়ি বিলীন হচ্ছে, উপকূলীয় জনগণের নিরাপত্তা চরম হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। সাধারণ জনগণের উপায় নেই এসবের প্রতিকার চাওয়ার- ন্যায় বিচার পাওয়ার।


এই হলো আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারের বর্তমান বাস্তবতা। আমরা কি এরূপ অবস্থা অব্যাহতভাবে চলতে দিয়ে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হবো- নাকি জান দেবো, তবু স্বাধীনতা ও অধিকার বিসর্জন দেবো না। আমাদের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করবে আমাদের ভবিষ্যৎ।

Saturday, May 19, 2012

আমাদের Aim in life আছে- Aim of Nation নাই



সম্ভবতঃ ৩য় বা ৪র্থ শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে আমার এক শিক্ষক ক্লাসে প্রশ্ন করেছিলেন, তোমরা বড় হলে কে কি হতে চাও? উপস্থিত অনেকেই, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করে। আমি বলেছিলাম, বিমানের পাইলট হবো। কিন্তু বাস্তবে বিমানের পাইলট হওয়া দূরের কথা- নিজের গাড়ি চালাতেই ভয় পাই। পরবর্তীতে বহু পরীক্ষায় ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য’ বা ‘Your Aim in Life’ রচনার উপর লিখেছি, পাসও করেছি। রচনা বইয়ের অনুকরণে কখনও ডাক্তার হয়ে দেশসেবা করার কথা, কখনও বিজ্ঞানী হয়ে নতুন নতুন আবিষ্কার করার কথা, উকিল হয়ে জনগণকে আইনী সহায়তা প্রদানের কথা লিখেছিলাম। কিন্তু বাস্তব জীবনে এসে এর কোনো কিছু করার সুযোগ হয় নাই। এর কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, পরিবারের অর্থনৈতিক সচ্ছলতার অভাব, স্বশিক্ষিত ও আদর্শ নাগরিক হওয়ার শিক্ষানীতির অভাব, জাতীয় পর্যায়ে প্রয়োজনীয় নীতিমালার অভাবের জন্যই আমাদের কিশোর বয়সের সুন্দর-সুন্দর সপ্নগুলো নিজের অজান্তে বিলীন হয়ে গেছে। পারিপার্শ্বিক, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির শিকার হয়ে আমরা যা হতে চাই, তা হতে পারি না, আমাদের মহৎ ও সৃষ্টিশীল চিন্তাসমূহ বাস্তব জীবনের দূষিত পরিবেশে এসে এইড্স রোগীর ন্যায় নিঃশেষ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, আমাদের যেসব সহপাঠী তাদের কাংখিত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হওয়ার সুযোগ পেয়েছে তাদের অনেকে বাস্তব জীবনে এসে শুধুমাত্র অধিক অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণের পর স্বনামধন্য পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছে।


আমাদের Aim in life-এর এই দুরবস্থার কারণ সম্ভবত এই যে : ১. আমরা আবেগের বশবর্তী হয়ে Aim ঠিক করেছিলাম। অথবা রচনা বইয়ে লিখিত Aim-কে নিজের Aim হিসেবে উল্লেখ করে পরীক্ষা পাসের চেষ্টা করেছিলাম। ২. আমাদের Aim-কে আমাদের অভিভাবক সমাজ ও রাষ্ট্র জানার চেষ্টা করেনি এবং গুরুত্ব দেয়নি। ৩. লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য যে সাপোর্ট প্রয়োজন ছিল তা আমরা পাইনি। ৪. লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য যে দৃঢ় মনোবল সৃষ্টির দরকার ছিল, মনোবল সৃষ্টির জন্য যেরূপ নৈতিক শিক্ষার দরকার ছিল আমরা তা অর্জন করার সুযোগ পাইনি।
৫. আমাদের পাঠ্যপুস্তকে আদর্শ মানব সৃষ্টির সিলেবাস অনুপস্থিত ছিল বরং খারাপ হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা আমাদের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত ছিল। দু-একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি বোধগম্য হবে।
ক. আমরা অংক করেছি এক সের দুধের সাথে কি পরিমাণ পানি মিশ্রিত করলে কত টাকা লাভ হবে। সুতরাং বর্তমানে আমরা ভেজাল মিশানোয় বিশ্বচ্যাম্পিয়নে পরিণত হয়েছি।
খ. আমরা টোনা-টুনির গল্পে পড়েছি, টোনা এবং টুনি কিভাবে বনের পশুদেরকে দাওয়াত দিয়ে নিজেরা পালিয়ে গিয়ে গাছের ডালে অবস্থান নিয়ে আনন্দ করছে এবং উক্ত গল্পে সরল বিশ্বাসে দাওয়াতে আগমনকারী পশুদেরকে বোকা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই গল্পের মাধ্যমে প্রতারক টোনা-টুনিকে বুদ্ধিমান সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং প্রতারিত পশুকুলকে বোকা আখ্যায়িত করা হয়েছে। সম্ভবত এইরূপ গল্পের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমাদের সমাজে প্রতারকগণ বাহবা পায় আর প্রতারিত জনগণ বোকা সাব্যস্ত হয়।
গ. একটি গল্পের শিরোনাম ছিল ‘বাঘ ও বক’। উক্ত গল্পের সারকথা হলো- বাঘের গলায় হাঁড় বিদ্ধ হয়েছিল। বক পুরস্কারের প্রতিশ্র“তিতে বাঘের গলা থেকে উক্ত হাঁড় বের করে বাঘকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। বিপদ থেকে উদ্ধারের পর বক প্রতিশ্র“ত পুরস্কার দাবি করায় বাঘ পুরস্কারের পরিবর্তে বককে মৃত্যুর হুমকি প্রদান করেছিল। পাঠকবৃন্দ একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন, আমাদের দেশের বেশিরভাগ রাজনীতিকের আচরণ উক্ত বাঘের ন্যায় আর জনগণ হচ্ছে উক্ত বকের ন্যায়।


সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষা পদ্ধতি ও সিলেবাসের করুণ শিকারে পরিণত হচ্ছে সমগ্র জাতি। এই শিক্ষা ব্যবস্থাই কাউকে তৈরি করছে ভেজাল মিশ্রণকারী হিসেবে, কাউকে প্রতারক হিসেবে আর কাউকে অকৃতজ্ঞ হিংস্র জানোয়ার হিসেবে। হয়তো এজন্যই ব্যবসায়ী ঠকাচ্ছে দেশ ও জনগণকে, রাজনীতিকগণ জনগণকে, উকিল মক্কেলকে, ডাক্তার রোগীকে, শিক্ষক ছাত্রকে, হাকিম ন্যায়বিচার প্রার্থীকে, পুলিশ নির্যাতিতকে, আমলা নাগরিককে, আলেম ভক্তদেরকে, পীর মুরীদদেরকে। ফলে যে যত বেশি ঠক বিদ্যায় পারদর্শী সে এদেশে ততো বেশি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।


এদেশের ১৪ কোটি লোকের ১৪ কোটি Aim in life আছে। প্রকাশ্যে উক্ত Aim in life-এ দোষণীয় কোনো উপাদান নেই। উক্ত Aim in life-এর ফলে আমরা ডাক্তার, কবিরাজ, প্রফেসর, অফিসার, দেশ নেতা, দেশ নেত্রী হচ্ছি, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী হচ্ছি, আলেম-উলামাসহ অনেক কিছু হচ্ছি কিন্তু আমাদের সবকিছুই পরিচালিত হচ্ছে ব্যক্তিস্বার্থে- জাতীয় স্বার্থে নয়। কারণ আমাদের Aim in life শিখানো হয়েছে Aim of Nation নয়।


জাতীয় স্বার্থে নয় কেনো? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যাবে আমরা স্বাধীনতার এত বছর পরও জাতীয় লক্ষ্য নির্ধারণ করিনি, লক্ষ্য নির্ধারণের প্রয়োজন মনে করিনি। প্রত্যেকেই আমরা ব্যক্তিস্বার্থে/ দলীয় স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছি- জাতীয় স্বার্থ আমরা এখনও নির্ধারণ করিনি। পৃথিবীর সকল মহান এবং শক্তিশালী জাতি তাদের জাতীয় স্বার্থ নির্ধারণ করেছে, জাতীয় লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, লক্ষ্যে পৌঁছার একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে এবং একটি সময়সীমা নির্ধারণ করেছে। ফলে উক্ত জাতির সদস্যগণ তাদের সকল ব্যক্তিস্বার্থকে জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে বিন্যস্ত করেছে। তাদের ব্যক্তিস্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থ সমান্তরালভাবে প্রবাহিত হয়ে জাতিকে সমৃদ্ধ করছে, জাতীয় স্বার্থ ব্যক্তিস্বার্থের উপরে প্রাধান্য পাচ্ছে। কয়েকটি দেশের উদাহরণই এ ব্যাপারে যথেষ্ট বিবেচিত হবে।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে আমেরিকা নিজেকে বিশ্বশক্তির কাতারে দাঁড় করানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করে। লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হওয়ার পর সে তার প্রতিপক্ষ সোভিয়েত ইউনিয়নকে শক্তিহীন করতে সচেষ্ট হয় এবং বিভিন্নমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভাঙ্গার ব্যবস্থা করে সে বিশ্বের একক পরাশক্তিতে পরিণত হয়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় লক্ষ্য হলো- পৃথিবীর অপর কোনো শক্তি যাতে তার সমকক্ষ হতে না পারে তার ব্যবস্থা করা এবং নিজেকে আরও শক্তিশালী করা। এ লক্ষ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থা, মিডিয়াসমূহ ও সকল জাতীয় সংস্থাসমূহ, সরকারি ও বিরোধীদলসমূহ কাজ করে যাচ্ছে। ফলে জাতীয় স্বার্থে তারা একই টেবিলে সমবেত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর জাপান ও জার্মানী ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। মিত্রশক্তির সাথে গোলামী চুক্তি করতে বাধ্য হয়েও তারা জাতীয় অগ্রগতির অভিন্ন লক্ষ্য নির্ধারণ করে। চুক্তির কারণে সামরিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার পথ রুদ্ধ হওয়ায় উভয় দেশ নিজেকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করার ব্রত গ্রহণ করে। মাত্র কয়েক দশকের প্রচেষ্টায় তারা প্রত্যেকে বিশ্ব অর্থনীতির নীতি নির্ধারকের ক্ষমতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় বর্তমানে তারা নিজেদেরকে সামরিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে নিরলসভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।


১৯৬২ সালে বর্তমান মালয়েশিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ইন্দোনেশিয়ার শাসন থেকে মুক্ত হয়। উপযুক্ত নেতৃত্বের বাস্তবধর্মী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে মালয়েশিয়া বর্তমানে মধ্যম সারির অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। তারা তাদের জাতীয় লক্ষ্য বা Aim of Nation নির্ধারণ করেছে। লক্ষ্যে পৌঁছার সময়সীমা নির্ধারণ করেছে ২০২০ সাল। এর সুন্দর নাম দিয়েছে ভিশন টুয়েন্টি-টুয়েন্টি। তাদের অগ্রগতি পর্যালোচনা করলে তাদের সাফল্যের ব্যাপারে কোনো প্রকার সংশয়ের সম্ভাবনা দৃষ্টিগোচর হবে না।


১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হয়। ভারতের নেতা পণ্ডিত নেহেরু অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী পারমাণবিক শক্তিধর ভারত গড়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে এবং ব্রিটিশ শাসিত সমগ্র উপমহাদেশকে ভারতের শাসনাধীন করার ব্রত গ্রহণ করে। ইতিমধ্যে ভারত নেহেরু ঘোষিত শক্তিশালী অর্থনীতির দেশে, পারমাণবিক শক্তিধর দেশে পরিণত হয়েছে। হায়দরাবাদ, কাশ্মীর, সিকিম, গোয়া-দমন-দিউসহ শতাধিক ছোট-বড় দেশীয় রাজ্য দখল করে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করেছে। শক্তিশালী প্রতিপক্ষ পাকিস্তানকে দুই টুকরা করেছে। নিজের প্রভাব বলয় সৃষ্টি করে নেহেরু-ডকট্রিনের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার লক্ষ্যে প্রতিবেশী সকল দেশে অশান্তি সৃষ্টির মাধ্যমে তাবেদার সরকার, তাবেদার দল, গোষ্ঠী সৃষ্টি করে লক্ষ্যপানে এগিয়ে চলেছে। প্রতিবেশীদের জন্য ভারতের এহেন নীতি যতই ক্ষতিকর হোক না কেনো, জাতীয় লক্ষ্য অর্জনের দিক থেকে ভারতীয়দের দৃষ্টিতে এই নীতি তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার কর্মসূচি মাত্র। এজন্যই জাতীয় লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে ভারতের সকল প্রকার বিরোধী মতাদর্শের দলসমূহ একযোগে কাজ করে।


পক্ষান্তরে আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী কারো জাতীয় লক্ষ্য নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে চিন্তা করার সময় পর্যন্ত নেই। জাতির কর্ণধারগণ যদি এ ব্যাপারে সজাগ-সচেতন হতেন তবে অবশ্যই ভারতের মতো না হলেও মালয়েশিয়ার মতো সমন্বিত জাতীয় লক্ষ্য নির্ধারণে সক্ষম হতেন। এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের অভাবে এদেশের জনগণ হয়েছে মাঝিবিহীন নৌকার যাত্রীর ন্যায়, যেখানে দাঁড়িরা অর্থের বিনিময়ে দাঁড় টানে কিন্তু মাঝি না থাকায়, নৌকার গন্তব্য নির্ধারিত না হওয়ায় ডানদিকের দাঁড়িদের টানে আমরা ডানদিকে যাই আর বামদিকের দাঁড়িদের টানে বামদিকে যাই। অথবা কখনও সামনে যাই, কখনও যাই পিছনে। এমতাবস্থায় কখনও যদি সত্যিকারের হ্যারিকেন-টর্নেডো উক্ত নৌকায় আঘাত হানে তবে আমরা ১৭৫৭ সালের পলাশী বিপর্যয়ের ন্যায় সমুদ্রের গভীরে তলিয়ে যাব। আমাদের মহান পূর্বপুরুষদের বিগত ২৫০ বছরের সমস্ত ত্যাগ ও অর্জন বিলুপ্ত হবে।


আমাদের করণীয়-
১. Aim of Nation নির্ধারণ- ঐকমত্যের ভিত্তিতে সমন্বিত জাতীয় লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। সৎ এবং অসৎ এর মধ্যে ঐকমত্য হবে না। তাই সৎ ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা যাতে রাজনৈতিক নেতৃত্বে আসীন হতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। এ লক্ষ্যে প্রথমত দলীয় সংসদ সদস্য প্রার্থী মনোনয়নে ক্রয়-বিক্রয় নীতি পরিহার করতে হবে। সরকার গঠনের পর মন্ত্রীত্ব বেচা-কেনার সংস্কৃতি, স্বজনপ্রীতি কঠোরভাবে পরিহার করতে হবে।
২. শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার সাধন- শিক্ষা ব্যবস্থাকে, পাঠক্রমকে, পাঠ্যসূচিকে জাতীয় লক্ষ্য নির্ধারণের অনুকূলে বিন্যস্ত করতে হবে। সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক সৃষ্টির সিলেবাস প্রণয়ন করতে হবে। জাতীয় চেতনা বিরোধী প্রবন্ধকার/ সাহিত্যিকদের লেখা পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দিতে হবে। ধর্মীয় ও জাগতিক শিক্ষার সমন্বয় সাধন করে একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন করতে হবে। কর্মহীন ধর্ম নয়- কর্মের মাধ্যমে ধর্ম পালনের শিক্ষা প্রদান করতে হবে।
৩. জাতীয় সংস্কৃতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন- আমার বিশ্বাস, বর্তমান বাংলাদেশে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের চেয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের গুরুত্ব অনেক বেশি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় জাতির মানস গঠন করতে পারে, দেশপ্রেমিক ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন নাগরিক সৃষ্টিতে প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারে। আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও স্বাতন্ত্র্য সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে জাতীয় সংস্কৃতির রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে। উক্ত রূপরেখা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সক্ষম এমন ব্যক্তিকে উক্ত মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রী পদে মনোনীত করতে হবে। সংস্কৃতির সাথে জড়িত সকল গুরুত্বপূর্ণ পদে উপযুক্ত ব্যক্তি নিয়োগ করতে হবে। সর্বোপরি সকল উপজেলায় উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ‘উপজেলা সংস্কৃতি বিষয়ক কর্মকর্তা’র পদ সৃষ্টি করতে হবে।
জাতীয় সংস্কৃতির রূপরেখার অনুপস্থিতিতে বর্তমানে বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন চলছে। আমাদের জাতীয় নীতি-আদর্শ ও মূল্যবোধের বিরোধী নাটক, সিনেমা, সাহিত্য প্রচারিত হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী শক্তিসমূহ জাতির মন-মানসকে কলুষিত-বিভ্রান্ত করে জাতিকে আদর্শহীন ও নিস্তেজ করছে, জাতির প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস করছে।


পরিশেষে আমি আমাদের জাতির বর্তমান কর্ণধারগণের নিকট এই সতর্ক বার্তা পৌঁছাতে চাই যে, উন্নত তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে ২৮ কোটি চক্ষু আপনাদের কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করছে। জনগণ দেখছে, আপনারা জাতীয় স্বার্থকে বাদ দিয়ে নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ নিয়ে কাড়াকাড়ি করছেন। আপনারা জনগণের সমস্যার কথা জাতীয় সংসদে তুলে ধরার জন্য জনগণের নিকট ভোটভিক্ষা চেয়েছেন, জনগণ আপনাদেরকে সংসদে যাওয়ার টিকেট দিয়েছে। আপনারা উক্ত টিকেট লাভ করে সংসদে না গিয়ে জনগণের গাড়ি ভাংচুর করছেন, জাতীয় স্বার্থে আপনারা ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেন না, অথচ আপনাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির বিলের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছেন, জনগণের টাকায় বিলাসবহুল শুল্কমুক্ত পোরশে, বিএমডব্লিউ, ক্যাডিলাক, ল্যাক্সাস গাড়ি প্রাপ্তির ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছেন। ব্যক্তিস্বার্থে রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা এক হতে পারেন- জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আপনারা দুই দলের দুই মুক্তিযোদ্ধাও এক হতে পারেন না। জাতীয় স্বার্থেই আপনাদেরকে এমপি নির্বাচিত করা হয়েছিল। অচিরেই আপনারা আপনাদের এ সকল কর্মকাণ্ডের উপযুক্ত প্রতিফল ভোগ করবেন।


সম্পাদকীয়ঃ মে ২০১২(মাসিক ইতিহাস অন্বেষা)