Thursday, January 19, 2012

কাদিয়ানী প্রসঙ্গ


(লেখাটি ৪দলিয় জোটের আমলে কাদিয়ানীদের নিয়ে সমস্যা সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে লিখিত হয়েছিল। পাঠকগণ এটা পড়ে কাদিয়ানীদের উন্নত!!! কোরআন ও সাহিত্য সম্পর্কে ভাল একটা ধারনা পাবেন।)

নন ইস্যুকে ইস্যু করা, মীমাংসিত বিসয়কে বিতর্কিত করা, ফরজ কাজ বাদ দিয়ে নফলের পেছনে সময় ব্যয় করা আমাদের জাতীয় অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কাদিয়ানীদের প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে সপ্প্রতি সরকার এরূপ একটি অপ্রয়োজনীয় বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। অথচ কাদিয়ানীদের প্রকাশনা নিষিদ্ধ করার কোন প্রয়োজন ছিলনা। কাদিয়ানীদের প্রকাশনা নিসিদ্ধ করে সরকার প্রকারান্তরে প্রতিপক্ষের দুটি উপকার করেছে। এক. নিসিদ্ধ জিনিসের প্রতি জনগনের আগ্রহ বৃদ্ধি করেছে। দুই. তথাকথিত পাশ্চাত্য প্রগতিশীলদের নেতিয়ে পড়া কণ্ঠকে উচ্চকিত করার সুযোগ করে দিয়েছে

পৃথিবীতে হাজারো মত ও পথ রয়েছে। এখন ও শতাধিক ধর্মমতের অনুসারী জনগোষ্ঠী রয়েছে। এতদ সত্ত্বেও নির্যাতিত, নিষ্পেষিত মজলুম মুসলমানগণ স্বধর্ম ত্যাগ করে অপরাপর ধর্ম গ্রহনে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেনা। কাদিয়ানী ধর্মমত ও উক্ত শতাধিক ধর্মমতের একটি বৈ নয়। উক্ত শতাধিক ধর্মমতের প্রকাশনা মুসলমানদের ধর্ম বিশ্বাসের ক্ষতি করতে পারেনি, কাদিয়ানী প্রকাশনাও মুসলমানদের ঈমান আমলের ক্ষতি করতে পারবে না।

বর্তমান পৃথিবীর ৪৮টি দেশ কাদিয়ানিদেরকে সরকারিভাবে অমুসলিম ঘোষণা করেছে। কিন্তু তাদের ধর্মকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়নি, তাদের প্রকাশনা বাজেয়াপ্ত করা বা নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন হয়নি। কাদিয়ানী মতবাদ অনুযায়ী তাদের ধর্ম স্বতন্ত্র, তাদের নবি আলাদা, তাদের উপসনালয়, পাঠশালা, সামাজিক রিতি-রেওয়াজ মুসলমানদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এমতাবস্থায় অন্যান্য স্বতন্ত্র ধর্মসমূহের মত কাদিয়ানী ধর্মমত ইসলামী আকিদা-বিশ্বাসের ক্ষতি করতে সক্ষম নয়। কাদিয়ানীদের সাথে মুসলমানদের মৌলিক বিরোধ এই যে, তারা অমুসলমান হয়েও নিজেদেরকে মুসলমান পরিচয় দিয়ে মুসলমানদের ধর্ম ও সমাজে বিশৃঙ্খলা ও বিভাজন সৃষ্টি করতে চায়। এমতাবস্থায় কাদিয়ানী ফেতনার অকল্যাণ থেকে রক্ষা পেতে পৃথিবীর অন্যান্য মুসলিম দেশের ন্যায় কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম ঘোষণা করাই যথেষ্ট, তাদের প্রকাশনা নিষিদ্ধ করা জরুরী নয়। কেননা তাদের প্রকাশনা নিষিদ্ধ না করলে জনগন তাদের স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে, তাদের ভণ্ডামি সম্পর্কে অবগত হতে সক্ষম হবে। সুবিশাল ও মহান ইসলামী সাহিত্যের তুলনায় কাদিয়ানীদের প্রকাশনা নিতান্তই আবরজনা বলে গণ্য হবে। তাদের সাহিত্যের বিষয়বস্তু ও মান সম্পর্কে পাথকদের ধারনা লাভের জন্য কাদিয়ানী প্রকাশনার (ওহীর) কয়েকটি নমুনা প্রদত্ত হল।
১. ‘যে ব্যক্তি তোমার অনুসরণ করিবে না, তোমার নিকট বায়াআত করিবে না এবং তোমার বিরোধিতা কারী হইবে সে আল্লাহ্‌ ও রাসুলের (গোলাম আহমদ) বিরুদ্ধচারনকারী জাহান্নামী।’
(তাবলীগে রিসালাত ৯ খঃ পৃঃ ২৭
২. ‘যে ব্যাক্তি আমার (গোলাম আহমদ কাদিয়ানী) বিরোধী, সে খ্রিষ্টান , ইয়াহুদি, মুশরিক এবং জাহান্নামী।’
(নুজুলুল মাসিহ পৃঃ ৪, তাজকিরাহ পৃঃ ২২৭, খাযাইন ১৮ খ. পৃঃ ৩৮২)
৩. ‘সকল মুসলিম আমাকে গ্রহন করিয়াছে এবং আমার দাওয়াতের সত্যতা স্বীকার করিয়াছে। কিন্তু বেশ্যার সন্তানেরা আমাকে গ্রহন করে নাই।’
৪. ‘যে ব্যাক্তি আমাদের বিজয়ের প্রবক্তা হইবে না, তাহার সম্পর্কে পরিস্কার বুঝিতে হইতে যে, তাহার ব্যাভিচার জাত সন্তান হওয়ার আকাংখা আছে।’
(আনোয়ারুল ইসলাম পৃঃ ৩০ খাযাইন ৯ খ. ৩১)
৫. ‘যে সকল মুসলমান হযরত মসীহ মওউদের (গোলাম আহমদ কাদিয়ানী) প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করে নাই- এমনকি যারা হযরত মসীহে মওউদের নাম পর্যন্ত শুনে নাই তাহারাও কাফের, ইসলামের বাইরে।’
(আইনায়ে ছাদাকত পৃঃ ৩৫)

সম্ভবতঃ উপরে উল্লিখিত ওহীর! ভয়ে ভীত হয়ে এদেশের কিছু সংখ্যক মুসলিম নামধারী প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী কাদিয়ানীদের পক্ষে জেহাদে অবতীর্ণ হয়ে লাশ ফেলার হুমকি দিচ্ছেন। সর্বোচ্চ আদালতের কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টির হুমকি দিচ্ছেন। সর্বোচ্চ আদালতের কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টির হুমকি দিচ্ছেন। সন্ত্রাসীর ভাষায় কথা বলছেন। কাদিয়ানী ধর্ম মতের বিরোধিতা করে তথাকথিত জারজ হওয়া , বেশ্যার সন্তান হওয়া, মুসরিক, কাফের ও জাহান্নামী হওয়ার চেয়ে উম্মতে মুহাম্মদির বিরোধিতা করে মুরতাদ হওয়াকে শ্রেয় মনে করছেন। এমতাবস্থায় উক্ত প্রগতিশীলদের প্রতি আক্রোশ ভাব পোষণ না করে তাদের হুমকিকে মজলুমের আর্তচিৎকার মনে করা যুক্তিযুক্ত হবে।

পাশ্চাত্য প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীগণ সাধারণত ডারউইনের বিবর্তনবাদে বিশ্বাস করেন। ফলে উক্ত বুদ্ধিজীবীগন বিবর্তনবাদী কাদিয়ানী ধর্মের পক্ষে ধর্মযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। কাদিয়ানী ধর্মমতের কালানুক্রমিক বিবর্তন সমুহ নিম্নুোক্ত উদাহরনের মাধ্যমে সুস্পষ্ট হবে।
·      **   ১৮৮০ থেকে ৮৮ সাল পর্যন্ত গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ছিলেন একজন মুসলিম ধর্ম প্রচারক ও ইসলাম বিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে একজন তুখোড় তার্কিক।
·      * *  ১৯৮৯ সন তিনি জনগনের নিকট থেকে বায়াআত গ্রহন শুরু করেন ও নিজেকে উম্মতের আওলিয়া দরবেশের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করেন। (সিরাতুল মাহদি ১ম খঃ পৃঃ ১৪, ৩১, ও ৮৯)
·      * *  ১৮৯১ খ্রিঃ থেকে তিনি নিজেকে ইমাম মাহদি বলে দাবি করেন। (হাকিকাতুল ওয়াহয়ী পৃঃ ১৪৯, সিরাতুল মাহদি পৃঃ ৩১, ৮৯)
·     *  *  ১৯০০ খ্রিঃ থেকে তার মুরিদগন তাকে নবী হিসেবে আখ্যায়িত করে। জনরোষ থেকে রক্ষা পেতে তিনি এসময় নিজেকে আংশিক নবী, ছায়া নবী, ও বুরুজি নবী হিসাবে প্রচার করেন। (কালিমাতুল ফাসল পৃঃ ১৬৭, মুনকিরিনে খিলাফত কা আনজাম পৃঃ ১৯)
·        ** ১৯০১ খ্রিঃ তিনি নিজেকে নবী ও রাসুল বলে ঘোষণা করেন এবং পূর্বেকার ঝিল্লি-বুরুজি দাবি রহিত করেন। (সিরাতুল মাহদি পৃঃ ৩১, হাকিকাতুল ওয়াহয়ি ৩৯১, খাজাইন ২২ খ। ৪০৬-৭)
·      **   ১৯০৪ সালে তিনি নিজেকে হিন্দু অবতার শ্রীকৃষ্ণ বলে দাবি করেন। (লেকচার- শিয়ালকোট, ২নভে, ১৯০৪ পৃঃ ৩৪)

লক্ষ্য উদ্দেশের ক্ষেত্রেও কাদিয়ানী ধর্মমতের সাথে ইসলামী আকিদা বিশ্বাসের কোন মিল নেই। ইসলামে প্রত্যেক মুসলমানের মূল লক্ষ্য হল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। দ্বীনদার পরহেজগার মুসলিমের ধর্ম ও জীবন পরিচালিত হয় এভাবে ‘নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার সমগ্র জীবন ও মৃত্যু একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।’ পক্ষান্তরে গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ও তার অনুসারীগণ সকল সময় সাম্রাজ্যবাদের স্বঘোষিত এজেন্ট বা দালাল। সাম্রাজ্যবাদের সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষেই তাদের জীবন ও কর্ম পরিচালিত হয়। উদাহরন স্বরপ কাদিয়ানীদের প্রকাশনার কিছু অংশ উল্লেখ করা হল।
১. “ অতএব আমার ধর্ম- যাহা আমি বরাবর প্রকাশ করি, এই যে , ইসলামের দুইটি অংশ রহিয়াছে । প্রথমত; আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য স্বীকার করা। দ্বিতীয়ত সেই রাষ্ট্রর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা, যাহা শান্তি স্থাপন করিয়াছে। অত্যাচারীদের হাত হইতে উদ্ধার করিয়া নিজের আশ্রয়ে আমাদিগকে গ্রহণ করিয়াছে। আর তাহা হইতাছে ব্রিটিশ সরকার ।’’(শাহাদাতুল কোরআন ষষ্ট মুদ্রণ- ৩য় পৃষ্ঠা)
২. তিন্তি বিষয় আমাকে ইংরেজ সরকারের হিতাকাংখায় প্রথম পর্যায়ে পৌঁছাইয়াছে। প্রথমত; মুরহুম পিতার প্রভাব, দ্বিতীয়তঃ বর্তমান সরকারের বিশেষ অনুগ্রহ, তৃতীয়ত খোদার এলহাম।(তিবয়াকুল কুলুব ৩০৯-১০ পৃঃ )
৩. ‘এবং আমি দৃঢ় বিশ্বাস করি যে, আমার মুরিদের সংখ্যা যত বৃদ্ধি পাইবে জেহাদের বিধান সমর্থনকারীর সংখ্যা তত হ্রাস পাইবে। কারন আমাকে মসীহ এবং মাহদি হিসাবে মানিয়া লওয়াই জেহাদের বিধানকে অস্বীকার করা।’ (শাহাদাতুল কোরআন ১৭ পৃঃ )
৪. ‘আমি নিজের কাজ না মক্কায় উত্তম রূপে আঞ্জান্ম দিতে পারি না মদিনায়, না তুরস্কে, না সিরিয়ায়,না ইরানে, না কাবুলে, কিন্তু এই সরকারের অধীনে যাহার সৌভাগ্যের জন্য দোয়া করিতেছি।’ (তাবলীগে রিসালাত ৬ষ্ঠ খ. পৃঃ ৬৯)
৫. ‘আমরা আশা করি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের সাথে সাথে আমাদের ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্র ক্রমশঃ
বিস্তার লাভ করিবে এবং অমুসলমানদের মুসলমান বানানোর সাথে সাথে আমরা মুসলমানদিগকে পুনরায় মুসলমান বানাইব।’ (আল ফজল, ১১ই ফেব্রুয়ারি, ১৯১০ইং)

কাদিয়ানীদের উক্তরূপ সিক্ষার আলোকে আমরা ধরে নিতে পারি যে, তারা উম্মতে মুহাম্মদিকে কাদিয়ানী মুসলমান বা সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টে রূপান্তরে সক্রিয় রয়েছে। ইতিমধ্যে কিছু সফলতাও তারা লাভ করেছে। কিন্তু তাদের সাফল্যে আমাদের বিচলিত হওয়ার কোন কারন নেই। কেননা প্রত্যেক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি স্বীয় শাসন শোষণ সম্প্রসারণে বিভিন্ন চটকদার নামে ও ব্যানারে প্রতিনিয়ত এজেন্ট রিক্রুট করছে। এসব এজেন্টগণ বংশানুক্রমিক ভাবে দালালিতে লিপ্ত থাকবে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পতনে তারা রুশ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালালি করছে। উক্ত তিন সাম্রাজ্যবাদের পতন হলে নবউত্থিত নতুন সাম্রাজ্যবাদের ছায়াতলে আশ্রয় নেবে।

কাদিয়ানিরা অমুসলিম এ বিষয়ে মুসলিম বিশ্ব একমত। বিশ্বের ১৪৪টি দেশের ইসলামী সংগঠন ‘রাবেতায়ে-আলমে-আল-ইসলামি’’ ১৯/০৪/১৯৭৪ ইং তারিখে ‘মক্কা ঘোষণায়’’ কাদিয়ানীদের ‘কাফের’ সাব্যস্ত করেছে। ও,আই,সি ১৯৮৮ সালের ‘বাগদাদ ঘোষণায়’ কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম ঘোষণা করেছে।

উপসংহারে আমি বলব, বর্তমান জোট সরকার কাদিয়ানীদের প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে বিজ্ঞতার পরিচয় দেননি। সরকার যদি কাদিয়ানী ফেতনা থেকে জনগণকে রক্ষায় আন্তরিক হন তবে পৃথিবীর অপরাপর ৪৮ টি দেশ রাবেতা ও ও,আই,সির ন্যায় কাদিয়ানীদের অমুসলিম ও স্বতন্ত্র ধর্মের অনুসারী হিসাবে ঘোষণা করাই যথেষ্ট বলে বিবেচিত হবে। কেননা প্রকাশনা নিষিদ্ধ করলে  নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি জনগনের আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে তদুপুরি বিভিন্ন ব্যানারে সক্রিয় সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টগণ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পাবে।

সম্পাদকঃ মাসিক ইতিহাস অন্বেষা
(প্রথম প্রকাশ মাসিক ইতিহাস অন্বেষা, ফেব্রুয়ারি ২০০৫ সংখ্যা)

No comments:

Post a Comment