Friday, August 17, 2012

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাফল্যগাথা : বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা

অন্যায়-অত্যাচার, জুলুম-নির্যাতন, আগ্রাসন ব্যক্তি প্রতিভা ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জনের স্বাধীনতা না থাকায় এবং কমিউনিস্ট আদর্শের দেউলিয়াপনায় ১৯৯০ সালে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়লে সমগ্র পূর্ব ইউরোপ অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। এতদিন কমিউনিস্ট বিশ্বের জনগণ সম্পর্কে মুক্তবিশ্ব খুব কমই জানতো। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে দেখল- কমিউনিস্টরা প্রগতিশীলতার নামে সমগ্র পূর্ব ইউরোপকে অশেষ দুর্গতির মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। মুষ্টিমেয় কিছু পার্টি কমরেড ব্যতীত সমগ্র জনগোষ্ঠী তখন ভিখারী ও শ্রমদাস মাত্র। বন্ধ দয়ুার খোলার পর দেখা গেল রুশ তরুণীরা শুধমুাত্র পেটের দায়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়ে দেহব্যবসায় লিপ্ত হয়েছে। পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়ার সাধারণ লোকজন দারিদ্র্য থেকে বাঁচতে সংশ্লিষ্ট দেশের মেশিনারী পার্টস, হরেক রকমের অস্ত্রশস্ত্র এমনকি পারমাণবিক জ্বালানিও চুরি করে বিক্রি করছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার নেপথ্য চক্রান্তকারী পাশ্চাত্য শক্তি তখন মনের আনন্দে পর্বূ ইউরোপের দেশগুলোর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে এবং রাশিয়া যাতে আর কখনো বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে তার জন্য চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তীব্র বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি, সামাজিক-রাজনৈতিক অরাজকতা, রাশিয়াকে তখন পতনের চূড়ান্ত পর্বে উপনীত করেছে। এরূপ অবস্থা প্রেসিডেন্ট পুতিনের ক্ষমতাগ্রহণের পর্বূ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ভ্লাদিমির পুতিনের সফলতা ও কৃতিত্বের আলোচনা সম্পন্ন করতে হলে তাই পাঠককে পুতিন-পূর্ব রাশিয়ার অবস্থা ও পুতিন-পরবর্তী রাশিয়ার তুলনামূলক অবস্থা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে। উভয়দিক পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে পুতিন বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে জ্ঞানী ও যোগ্য প্রেসিডেন্ট। তাঁর পাশে আর যাদের নাম আসতে পারে তাঁরা হলেন মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদ ও তুর্কী প্রধানমন্ত্রী রজব তাইয়েব এরদোগান। এতদসত্ত্বেও আন্তর্জাতিক জ্ঞান ও কার্যক্রম বিচার করলে প্রেসিডেন্ট পুতিনই বর্তমান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ প্রেসিডেন্ট ও দেশনায়ক হিসেবে বিবেচিত হবেন। প্রেসিডেন্ট পুতিন সম্পর্কে সম্যক অবহিত হওয়ার জন্য তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবন-বৃত্তান্ত উল্লেখ করা হলো-

ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন
জন্ম : ৭-১০-১৯৫২, স্থান-লেলিনগ্রাদ (বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গ) পিতা-U.S.S.R নেভীর সাবমেরিন ইউনিটের চাকুরে, মা কারখানা শ্রমিক। দাদা- লেলিন, লেনিনের স্ত্রী ও স্টালিনের বাবুির্চ ছিলেন। পুতিনের বংশ মধ্যযুগের রাজকীয় Tverskov familyর সাথে সংযক্তু। Putin বংশীয় খেতাব।

শিক্ষা : ১৯৭৫ সালে লেনিনগ্রাদ এস্টেট ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক আইন শাখা থেকে গ্রাজুয়েট। তাঁর ডক্টরেট থিসিস ছিল The Strategic Planning of Regional Resources Under the Formation of Market Relations. তাঁর ব্যবসায়ীক আইনের শিক্ষক আনাতোলী Sobchak তাঁর ক্যারিয়ার গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।

রাজনীতি : বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি U.S.S.R পর একমাত্র দল কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। ১৯৯১ সাল উক্ত পাটি বিলপ্তু হওয়া পর্যন্ত সদস্য ছিলেন। ১৯৯৭ সালে সরকারপন্থী রাজনৈতিক দল Our Home is Russia পার্টিতে যোগ দেন এবং Saint Petersburg শাখার নেততৃ¡ গ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তিনি The United Russia পার্টি গঠন করে বর্তমানে এর নেততৃ¡ দিচ্ছেন।

কৃতিত্ব : রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক অগ্রগতি, ১৯৯০-এর সমস্যা সামলে দেয়া, প্রথম প্রেসিডেন্সির সময় GDP প্রবৃদ্ধি ছিল ৭৩%, ম্যাক্রো ইকোনমিক ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন, পুঁজিপ্রবাহ বৃদ্ধি, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ, নতুন তেল- গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন। তাঁর জ্বালানি নীতি রাশিয়াকে জ্বালানী সুপারপাওয়ার করেছে, স্যাটেলাইট নেভিগেশন System স্থাপন, আন্তর্জাতিকমানের অবকাঠামো নির্মাণ।

সংস্কার :সেনা ও পুলিশ বাহিনী, জ্বালানিনীতি, উচ্চ প্রযুক্তির শিল্প স্থাপন, আধুনিক নিউক্লিয়ার Plant, প্রতিরক্ষা শিল্প।

চাকরি : গ্রাজুয়েশনের পর তিনি কেজিবিতে ভর্তি হন। ট্রেনিঙের পর প্রথমে তিনি Counter Intelligence-এ এবং পরে বিদেশীদের Monitoring শাখায় কাজ করেন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত তিনি পর্বূ জার্মানিতে KGB’র দায়িত্ব পালন করেন। ঔঁহব ১৯৯০ থেকে তিনি লেনিনগ্রাদ State Universityর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শাখায় যোগ দেন এবং ২০ আগস্ট ১৯৯১ তিনি লে. কর্নেল অবস্থায় কেজিবির চাকরিতে ইস্তফা দেন।

পিটারসবার্গ প্রশাসনে পুতিন
১. পিটারসবার্গ মেয়রের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা (১৯৯০-৯১)
২. মেয়র অফিসের বহিঃসম্পর্ক বিভাগের প্রধান (১৯৯১-৯৬)
৩. সিটি প্রশাসনের উপপ্রধান।
৪. JSC News Paperএর উপদেষ্টা পরিষদ প্রধান।
৫. সরকারপন্থী Our Home is Russia পার্টির পিটার্সবার্গ প্রধান।

মস্কোয় পুতিন
১. ১৯৯৬-৯৮ প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলেৎসিনের সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা বিভাগের ডেপুটি চিফ হন। এ সময় তিনি দেশে-বিদেশে থাকা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পদ ও কমিউনিস্ট পার্টির সম্পদ রুশ ফেডারেশনে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন।
২. ২৬-০৩-১৯৯৭ থেকে মে ১৯৯৮ পর্যন্ত ইয়েলিৎসিনের প্রেসিডেন্সিয়াল স্টাফ উপপ্রধান পদে কাজ করেন। তিনি ১৯৯৮ পর্যন্ত এর  প্রেসিডেন্টের সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান ছিলেন।
৩. ২৫-৫-১৯৯৮ তারিখে তিনি প্রেসিডেন্সিয়াল স্টাফ-এর প্রথম ডেপুটি প্রধান পদে নিযুক্ত হন এবং দেশকে অনেক অপ্রয়োজনীয় ও অবাঞ্চিত চুক্তি থেকে রক্ষা করেন।
৪. ২৫-৭-১৯৯৮ থেকে আগস্ট ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি KGB সংশ্লিষ্ট এজেন্সী FSB-এর প্রধান নিযক্তু হন। ০১-১০-১৯৯৮ তারিখে তাঁকে রুশ ফেডারেশনের নিরাপত্তা কাউন্সিলের স্থায়ী সদস্য নিয়োগ করা হয়। মার্চ ১৯৯৯ সালে তিনি এ কাউন্সিলের সেক্রেটারী নির্বাচিত হন।

প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্ব
১. ৯-৮-১৯৯৯ সালে তাঁকে তিনজন উপ-প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে প্রথম উপ-প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়। একইদিন সংসদের (ডমুা) ভোটে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়।
২. চেচনিয়াভিত্তিক আন্তর্জাতিক ইসলামী ব্রিগেড দাগেস্তান আক্রমন করলে পুিতন তা যথাযথভাবে সামাল দেন, ফলে দেশব্যাপী তাঁর জনপ্রিয় ভাবমূর্তি তৈরি হয়।
৩. ডিসেম্বর ১৯৯৯-এ অনুিষ্ঠত সংসদ (ডমুা) নির্বাচনের পূের্ব নতনুভাবে গঠিত Unity Party পুিতন সমর্থন দেন।  তাঁর এই সমর্থন ডমুা নির্বাচনে ২৩.৩% ভোট সংগ্রহে সমর্থ্য হয়।

ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট পুতিন
১. ৩১/১২ ১৯৯৯ তারিখে প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন অপ্রত্যাশিতভাবে পদত্যাগ করলে পুতিন সংবিধান মোতাবেক রুশ ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।

প্রেসিডেন্ট পুতিন (১ম মেয়াদ) ২০০০-২০০৪
২৬-০৩-২০০০ তারিখে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পুতিন ১ম রাউন্ডের নির্বাচনে ৫৩% ভোট পেয়ে বিজয়ী হন এবং ০৭-০৫-২০০০ তারিখে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। দায়িত্ব গ্রহণের পরই তিনি কমিউনিস্ট আমলের ভূমি আইন, আয়কর আইন, শ্রম, প্রশাসন, বাণিজ্যিক, সিভিল ও ক্রিমিনাল আইনকে সংস্কার করে যুগোপযোগী করেন। তিনি জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করেন,চেচেন সমস্যার সমাধান করেন।

দ্বিতীয় মেয়াদ (২০০৪-২০০৮) ১৪-০৩-২০০৪ তারিখে তিনি ৭১% ভোট পেয়ে ২য় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এই মেয়াদে তিনি স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, আবাসন ও কৃষিকে অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় আনেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে উৎসাহ ও সহযোগিতা প্রদান করেন। তিনি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্টের দায়ে রাশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি মিখাইল Khodorkvoskyকে গ্রেফতার করে শাস্তির ব্যবস্থা করেন এবং পশ্চিমা মদদপষ্টু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে কঠোরভাবে দমন করেন। শিল্পোন্নয়নে তিনি ইতিবাচক সরকারি হস্তক্ষেপ প্রথা চালু করেন।
*০৮-০২-২০০৮ তারিখে পুতিন State Council-এর বর্ধিত সভায় “On the strategy of Russia’s development until 2020”  শিরোনামে ভাষণ দেন। উক্ত ভাষণে ২০২০ সালের মধ্যে রাশিয়াকে উন্নতির শিখরে নেয়ার পথ, পন্থা ও প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

২য় প্রধানমন্ত্রিত্ব (২০০৮-২০১২)
৮-৫-২০০৮ পুতিনকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভ।
১. ২০০৮-এর  দ. ওসেটিয়া যুদ্ধে পুতিনের রাশিয়া ই-ইউ এবং মার্কিন মিত্র জর্জিয়াকে হারিয়ে দেয়।
২. ইউরোপ-আমেরিকায় মন্দা শুরু হলে রাশিয়ার পর্বূবর্তী সরকারের বিপলু আর্থিক রিজার্ভ এবং শক্তিশালী ব্যবস্থাপনা রাশিয়াকে মন্দার হাত থেকে রক্ষা করে শক্তিশালী ও স্থিতিশীল অর্থনীতির দেশে পরিণত করে।

ততৃীয় প্রেসিডেন্সী ৪-৩-২০১২
প্রথম রাউন্ডের ভোটে ৬৩.৬% ভোট পেয়ে পুতিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ৭-৫-২০১২ তারিখে পুতিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন।

পুতিনের কৃতিত্ব
১. তাঁর ৮ বছরে প্রেসিডেন্সীর সময় শিল্পে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭৬%, বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে ১২৫%, কৃষি উৎপাদন ও নির্মাণ শিল্প বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুণ, গড়ে মাথাপিছু মাসিক বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে ৮০ ডলার থেকে ৬৪০ ডলারে। ২০০০ সাল থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের জনসংখ্যা ৮ মিলিয়ন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৫৫ মিলিয়নে উপনীত হয়েছে। ২০০৮ সালনাগাদ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা জনগণের হার ৩০% শতাংশ থেকে কমে ১৪% হয়েছে।

শিল্পোন্নয়ন
১. তাঁর শাসনামলে পৃথিবীর সব বড় বড় অটোমেটিভ শিল্পোদ্যোক্তারা রাশিয়ায় নিজেদের কারখানা স্থাপন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে Ford motor company, Toyota, General motors, Nissan, Hyunai motor, Suzuki, Magna International, Scania and MAN SE. প্রভৃতি।

এনার্জি পলিসি
পুতিনের গৃহীত Energy Policy রাশিয়াকে ২০০৫ সালনাগাদ এনার্জি সুপারপাওয়ারে পরিণত করেছে। তিনি কষ্ণৃসাগরের তলদেশ দিয়ে ‘ব্লু স্ট্রিম’ নামক রাশিয়া-তুরস্ক গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন করেছেন, তিনি বাল্টিক সাগরের তলদেশ দিয়ে পৃথিবীর এযাবতকালের বৃহত্তম পাইপলাইন স্থাপন করেছেন যার নাম ‘নর্ড স্ট্রিম’ যা রাশিয়ার সাথে জার্মানিকে সংযক্তু করেছে। তিনি কষ্ণৃসাগরের তলদেশ দিয়ে বলকানের রাজ্যসমূহ ও ইতালীর সাথে ‘সাউদার্ন স্ট্রিম’ নামক পাইপলাইন স্থাপনের কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন। তিনি তুর্কমেনিস্থানের গ্যাস ক্রয় করে রুশ পাইপলাইনের সাথে সংযক্তু করার জন্য ‘Nabukko’ নামক প্রকল্পের ব্যাপারে কার্যক্রম শুরু করেছেন। এভাবে সমগ্র ইউরোপ ও মধ্য এশিয়া পর্যন্ত রাশিয়ার জ্বালানি আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
অন্যদিকে চীন, জাপান ও কোরিয়ায় তেল সরবরাহের জন্য পুতিন Trans Siberian oil pipeline প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যে (Far East) গ্যাস সরবরাহের জন্য শাখালীন-খবরোঙস্ক- ভ্লাডিভষ্টক গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহের জন্য শাখালীনে LNG প্লান্ট স্থাপন করেছেন। বান্টিক পাইপলাইন-২-এর সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য ফিনল্যান্ড  উপসাগরে Ust-Luga পোর্ট নির্মাণ করা হয়েছে। তাতারস্থানসহ রাশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে বড় বড় তেল রিফাইনারি স্থাপন করা হয়েছে। ২০১৫ সালের মধ্যে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ও শিল্পোন্নয়নের লক্ষ্যে ফেডারেল বাজেটে ৪২.৭ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় Rosatom কর্পোরেশন বর্তমানে দেশে-বিদেশে অনেকগুলো পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করছে।

জাতীয় ধর্মনীতি : অর্থডক্স খ্রিস্টানিটি, ইসলাম, বৌদ্ধধর্ম ও ইহুদীধর্মকে পুতিনের রাশিয়া নিজেদের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার হিসেবে স্বীকৃিত দিয়েছে। চার্চ, মসজিদ, ইহুদী উপাসনালয় নির্মাণ, প্যাগোডা নির্মাণ এবং ধর্মচর্চা ও ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণকে আইনানগু বৈধতা দিয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে। উত্তর ককেসাস ও অন্যান্য মসুলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে পুতিনের United Russia পার্টি বিপলু সমর্থন পেয়েছে। রাশিয়ার ইহুদী কমিউনিটি পুতিনকে ও তার দলকে স্থিতিশীল রাশিয়ার অপরিহার্য শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

সামরিক সংস্কার :২০০০ সাল থেকে রাশিয়া সামরিক খাতে অধিকতর ব্যয় করা শুরু করেছে। ২০০৮ সাল থেকে পর্ণূ মাত্রায় সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন শুরু করা হয়েছে। সামরিক বাহিনীকে বড় না করে গুণগত মান বৃদ্ধি করে অধিকতর কার্যকর করার লক্ষ্যে এর সদস্য সংখ্যা ১০ লাখে নামিয়ে আনা হয়েছে। অফিসারের সংখ্যা কমানো হয়েছে। সেন্ট্রাল কমান্ডের আকার ছোট করা হয়েছে। সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য ইতিপূর্বেকার ৬৫টি স্কুলের পরিবর্তে বর্তমানে ১০টি কৌশলগত সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। সামরিক বাহিনীর পরিবহন ও অন্যান্য বেসামরিক কাজে বেসামরিক ব্যক্তিদের নিয়োগ বৃদ্ধি করা হয়েছে। রিজার্ভ বাহিনী পুনর্গঠন করা হয়েছে। পূর্বের পদ্ধতি বাদ দিয়ে আর্মিকে ব্রিগেড Syastem-এ পনুর্গঠিত করা হয়েছে। বিমানবাহিনীর রেজিমেন্ট পদ্ধতি পরিবর্তন করে Air Base System-এ পনুর্গঠিত করা হয়েছে। মিলিটারি ডিস্ট্রিক্ট-এর সংখ্যা কমিয়ে চারটি করা হয়েছে। অত্যাধুিনক অস্ত্রশস্ত্র, বিমান ও যুদ্ধজাহাজ দিয়ে সেনাবাহিনীকে সাজানো হয়েছে। ১ ডিসেম্বর ২০১১ থেকে রাশিয়ান স্পেস ফোর্সেসকে পরিবর্তন করে Russian Aerospace Defence System করা হয়েছে।

পুতিনের কৃতিত্বের স্বীকৃতি
১. সেপ্টেম্বর ২০০৬ সালে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জ্যাঁক শিরাক পুতিনকে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ খেতাব ‘Grand Cross’ প্রদান করেন। উভয় দেশের মধ্যে স্থাপিত বন্ধুত্বের নির্দশনস্বরূপ এই পদক প্রদান করা হয়।
২. বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন ২০০৭ সালে পুিতনকে Person of the year নির্বাচিত করে সম্মানিত করেন।
৩. ১২ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ সালে সৌদি বাদশাহ আবদলুøাহ পুতিনকে সে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক King Abdul Aziz Award প্রদান করেন।
৪. ১০ সেপ্টেম্বর ২০০৭ সালে সংযক্তু আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট খলিফা বিন যায়েদ আল-নাহিয়ান সে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদ Order of Zayed প্রদান করেন।
৫. রাশিয়ার  Business weekly ‘এক্সপার্ট ম্যাগাজিন’ ডিসেম্বর ২০০৭ সালে পুিতনকে Person of the year নির্বাচিত করে সম্মানিত করেন।
৬. চেচেন প্রেসিডেন্ট রমজান কাদিরভ চেচনিয়ার রাজধানী গ্রোজনীর কেন্দ্রীয় সড়ক Victory Avenue-এর নাম পরিবর্তন করে Vladimir Putin Avenue নামকরণ করেন।
৭. ফেব্রুয়ারি ২০১১ সালে কিরগিজিস্থানের পার্লামেন্ট সে দেশের তিয়ানসান পর্বতের চূড়ার নাম রাখেন Vladimir Putin peak.
৮. ১৫ নভেম্বর ২০১১ সালে চীনের International Peace Research Centre পুতিনকে Confucius Peace Prize প্রদান করে।
৯. ২০১১ সালে সার্বিয়ার University of Balgrade পুতিনকে অনারারী ডক্টরেট ডিগ্রী দিয়ে সম্মানিত করেন।
১০. ২৫-০৬-২০১২ তারিখে প্রেসিডেন্ট পুতিনের জেরুজালেম সফরকালে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস যীশুখ্রিস্টের জন্মস্থান বেথলেহেমের একটি সড়ক প্রেসিডেন্ট পুতিনের নামে নামকরণ করার আদেশ প্রদান করেন।
উপরোক্ত তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, ব্যক্তি প্রতিভা অস্বীকারকারী বা দমনকারী সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট সরকার বিলুপ্ত না হলে আমরা ভ্লাদিমির পুতিনের ন্যায় বিশ্বমানের প্রতিভা কখনও খুঁজে পেতাম না। তাঁর শিক্ষাজীবন, চাকরিজীবন ও রাজনৈতিকজীবন পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, তিনি একজন মেধাবী অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ, চাকরিজীবন থেকে তিনি শিখেছেন, কিভাবে জায়নিজম প্রতিহত করতে হয় এবং শত্রুর ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে হয়। রাজনৈতিকজীবনে তিনি শিখেছেন কিভাবে দেশপ্রেমিক হতে হয়, দেশপ্রেমিক সৃিষ্ট করা যায়, কিভাবে একটি দেশ ও জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও সমৃদ্ধ করতে হয়। শিক্ষা- অভিজ্ঞতা ও সৃষ্টিশীলতা তাঁকে একজন প্রথমশ্রেণীর রাষ্ট্রনায়ক ও জাতীয় নেতায় পরিণত করেছে। তাঁর এই যোগ্যতা কাজে লাগিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক বিশ্বকে বর্তমান ইউনিপোলার System-এর জুলুম-অত্যাচার ও স্বেচ্ছাচারিতা থেকে রক্ষা করে Multipolar বিশ্বে পরিণত করতে সক্ষম হবেন।

বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা : মাল্টিপোলার বিশ্বব্যবস্থা
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাক্ষাৎকার, বক্ততৃা, রচিত প্রবন্ধ ও কার্যক্রমে এককেন্দ্রিক বিশ্বমোড়লের স্বেচ্ছাচারিতা ও অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে বিশ্বের নির্যাতিত মানবগোষ্ঠী আশাবাদী হয়ে উঠেছে। তাদের এই প্রত্যাশার কারণসমহূ নিম্নরূপ-
 (১) জানয়ুারি ২০০৭ সালে এক সাক্ষাৎকারে পুতিন বলেছেন, “রাশিয়া গণতান্ত্রিক Multipolar বিশ্ব দেখতে চায় এবং শক্তিশালী আন্তর্জাতিক আইন ও এর প্রয়োগ দেখতে চায়।
(২) ১৬ অক্টোবর ২০০৭ সালে ইরান ভ্রমণের সময় তিনি সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, “সকল কাম্পিয়ান রাষ্ট্রসমূহের অধিকার রয়েছে বিনা প্রতিবন্ধকতায় শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূিচ পরিচালনা করার।”
(৩) ১০  ফেব্রুয়ারি ২০০৭ সালে জার্মানির মিউনিখে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল- “Munich Confarrence of Security Policy”. উক্ত সম্মেলনে তিনি যে ভাষণ দেন তাকে পর্যবেক্ষকগণ ও গণমাধ্যমসমূহ “The turrning point of Russian forign policy ” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর মিউনিখ ভাষণের মলূ কথা ছিল-
ক. তিনি যক্তুরাষ্ট্র ও ন্যাটো নেতৃত্বাধীন এককেন্দ্রিক বিশ্বের নৈতিকতাহীন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সমালোচনা করে বলেন, “Security for everyone is Security for all”.
খ. তিনি পশ্চিমাবিশ্ব কর্তৃক রাশিয়াকে গণতন্ত্র শিক্ষাদানের  প্রচেষ্টাকে হিপোক্রেসি হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
গ. তিনি আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘকে পাশ কাটিয়ে অথবা উপেক্ষা করে ন্যাটো ও ইইউ’র বিভিন্ন দেশে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগকে বেআইনি সাব্যস্ত করেন।
ঘ. তিনি ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্র কর্তকৃ মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম গড়ে তোলাকে নতনু অস্ত্র প্রতিযোগিতায় উস্কানি প্রদান সাব্যস্ত করেন।
ঙ. তিনি যক্তুরাষ্ট্র ও ন্যাটো কর্তৃক রাশিয়াকে সামরিকভাবে ঘিরে ফেলার দায়ে অভিযক্তু করেন।
পুতিন রচিত প্রবন্ধ :২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পূর্বে ভ্লাদিমির পুতিন রুশ সংবাদপত্রে কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। তন্মধ্যে একটির শিরোনাম ছিল- “New Integration Project of Euroasia- A future that is being Born Today ” এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি আন্তর্জাতিক বিষয়ক প্রবন্ধ যা পরের আলোচনায় বঝুা যাবে।
চ. G-20 সম্মেলন উপলক্ষে ওবামার প্রতি পুতিনের মন্তব্য-
 জুন-২০১২ সালে অনুষ্ঠিত G-20 সম্মেলনের অবকাশে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার সাথে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে পুতিন ওবামাকে এই মর্মে সতর্ক করেন যে, কোনো দেশকে কে শাসন করবে তা নির্ধারণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট দেশের জনগণের বাইরের কোনো শক্তির নয়।”
ছ. ২৫-০৬-২০১২ তারিখে তেল আবিব সফরকালে ইসরাইলি প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেজকে এই মর্মে হুঁশিয়ারি প্রদান করেন যে, ‘ইরানে হামলা চালালে ইসরাইলকে অনুতপ্ত হতে হবে। কারোরই খামখেয়ালিপূর্ণ কিছু করা উচিত হবে না।’


Multipolar World গঠনের প্রত্যাশা পূরণে বাধাসমূহ


(১) জায়নবাদ- জায়নবাদী ইহুদীরা বিশ্বশাসন করতে চায়। তাদের লক্ষ্য পরূণে তারা ইতোমধ্যে অনেকদূর অগ্রসর হয়েছে। তাদের মলূ কথা হলো- একজন ইহুদী বাদশাহ সমগ্র পৃথিবী শাসন করবে। এজন্য তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে, পরিবারপ্রথা ভেঙে, মানুষের চরিত্র নষ্ট করে, জাতিসমূহকে নিস্তেজ করে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বর্তমান আমেরিকা ও ন্যাটো নিজ দেশ ও জনগণের ক্ষতি করে জায়নবাদীদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। পর্যবেক্ষকদের দঢ়ৃ সিদ্ধান্ত এই যে, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযদ্ধু-পরবর্তী লীগ অব নেশন্স্ ও জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা জায়নবাদীদের বিশ্বশাসনের প্রাথমিক মডেল। আমার দঢ়ৃবিশ্বাস সোভিয়েত আমলে  কেজিবিতে চাকরি করার সবুাদে মি. পুতিন জায়নবাদ সম্পর্কে, এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে পরিপর্ণূ ওয়াকেবহাল। এমতাবস্থায় জায়নবাদ প্রভাবিত Unipolar বিশ্বকে Multipolar বিশ্বে পরিণত করার জন্য মি. পুতিনই সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি।

(২) The Great game plan- উনবিংশ শতাব্দীতে রচিত এ চষধহটি কার্যকরের মাধ্যমে ব্রিটেন এবং পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বশক্তি হিসেবে টিকে আছে। গঁষঃরঢ়ড়ষধৎ বিশ্ব গড়তে হলে এই প্লানকে অবশ্যই অকার্যকর করতে হবে। সংক্ষেপে এই Planটি নিম্নরূপ-
ক. ইউরোয়েশিয়ান হার্টল্যান্ড (উত্তরে রাশিয়া, দক্ষিণে ইরান, পূর্বে চীন ও পশ্চিমে পর্বূ ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকা এলাকাকে ইউরোয়েশিয়ান হার্টল্যান্ড বলে) হিসেবে পরিচিত ভূভাগের ঐক্যকে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের ন্যায় সমুদ্রে আধিপত্য বিস্তারকারী শক্তিসমহূ একটি ব্যাপক হুমকি হিসেবে দেখে থাকে। এ জন্য এ এলাকার দেশগুলোকে ছিন্নভিন্ন করা, ভেঙে দেয়া ও টকুরো করা আমেরিকা ব্রিটেন ও ফ্রান্সের স্থায়ী অনুসতৃ নীতি। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন যৌথভাবে এ এলাকার দেশগুলোকে টকুরা করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
পূর্ব ইউরোপকে রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করা, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যকে রাশিয়া থেকে বিছিন্ন রাখা ব্রিটেনের দীর্ঘস্থায়ী নীতি। বিংশ শতকের শুরুতে দার্শনিক Mackinder ব্রিটেনকে এই মর্মে সতর্ক করেন যে, “অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে রাশিয়া-চিন-ইরান ও ভারত যদি একটি একক অবস্থানে উন্নীত হয় তবে সাগরের কর্ততৃ যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও জাপানের হাত থেকে চলে যাবে। ম্যাফাইন্ডার আরো সতর্ক করেন যে, “সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব জনসংখ্যার আধিক্যের উপর নির্ভরশীল। সেক্ষেত্রে অধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত ইউরোয়েশিয়াকে বিভক্তকরণ, গ্রাসকরণ ও শাসন করার নীতি অবলম্বন না করলে কম জনসংখ্যা অধ্যুষিত পশ্চিম ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে দীর্ঘদিন আধিপত্য বজায় রাখা সম্ভব হবে না। ম্যাকাইন্ডার এবং অন্যান্য পশ্চিমা চিন্তাবিদরা আরো লক্ষ্য করেছেন যে, ইউরোয়েশিয়ান হার্ট ল্যান্ডে অবস্থিত দেশগুলোতে প্রায়ই ঐক্যের প্রবণতা দেখা যায়। এই স্বাভাবিক প্রবণতাকে প্রতিহত না করলে বিশ্ব আধিপত্য বজায় রাখা যাবে না। এ জন্যই ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেন জোট মধ্যপ্রাচ্য, মধ্যএশিয়া, পূর্ব ইউরোপ, ভারত ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় অনেকগুলো জাতিসত্ত্বাকে স্বাধীন হওয়ার সুেযাগ দিয়ে বিভক্ত করেছে।

(৩) Rimland Theory- নিকোলাস স্পাইক্স্ম্যানের রিমল্যান্ড থিওরি হার্বাট স্পেন্সার মতবাদ এবং হেনরি পাইরেনির থিওরি প্রায় একই কথার পনুরাবৃত্তি করেছে। স্নায়ুযুদ্ধের (Cold War) অবসানের পর Huntington সভ্যতার সংঘাতের যে তত্ত্ব হাজির করেছেন তাও মূলত ইউরোয়েশিয়ান হার্টল্যান্ডভিত্তিক পশ্চিমাদের দীর্ঘদিনের ভাবনার ফসল। তিনি মলূ ধারণাকে আড়াল করার জন্য সভ্যতার সংঘাতের আবরণ পরিয়েছেন মাত্র। Huntington তত্ত্বের মূলকথা হলো- ইউরোয়েশিয়ান হার্টল্যান্ডে নয়টি ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতা অবস্থান করছে। এদের পরস্পরের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি করে এদের নিয়ন্ত্রণ ও গ্রাস করার জন্য ক্ষদ্রু ক্ষুদ্র ন্যাশন স্টেট স্থাপন করলে পশ্চিমা আধিপত্য অক্ষুন্ন থাকবে।

(৪) গুরুত্বপর্ণূ করিডোর ও প্রণালী সংলগ্ন দেশের পাশ্চাত্যপন্থী সরকার-
 ক. ওয়াখান Corridoor-চীন, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও মধ্যএশিয়ার সংযোগস্থল Wakhan Corridoor দখলে রাখার প্রচেষ্টা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের দীর্ঘদিনের আকাংখা। এ লক্ষেই আধিপত্যবাদী ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকা বারবার আফগানিস্তানে প্রবেশ করেছে এবং পরাজিত হয়ে ফিরে গেছে। এমতাবস্থায় আফগানিস্তান দখল না করে তথায় যুক্তরাষ্ট্র-ন্যাটো বিরোধী সরকার প্রতিষ্ঠাই এ সমস্যা সমাধানে সহায়ক হবে।
খ. প্রণালীসমহূ সংলগ্ন দেশ- বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক প্রণালীসমূহ হলো- সুয়েজ খাল, জিব্রাল্টার প্রণালী, এডেন উপসাগর, হরমজু প্রণালী ও মালাক্কা প্রণালী। পশ্চিমা শক্তি সুেয়জ খাল নিয়ন্ত্রণে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে এবং মিসরে সবসময় তাঁবেদার শক্তি প্রতিষ্ঠা করেছে। জিব্রাল্টার প্রণালীর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য স্পেন ও মরক্কোয় মিত্রশক্তি বা তাঁবেদার সরকারকে ক্ষমতাসীন রেখেছে। এডেন উপসাগরকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সোভিয়েত আমলে ইয়েমেনকে দুইভাগে বিভক্ত করেছিল, সোভিয়েত পতনের পর ইয়েমেনকে একীভতূ করা হয়েছে এবং ইয়েমেনে তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষায় সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে এবং সোমালিয়াকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। হরমজু প্রণালীর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ তৎলগ্ন ওমান ও ইরানে তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। বর্তমানে ইরানে পাশ্চাত্যবিরোধী শক্তি প্রতিষ্ঠিত থাকায় পশ্চিমা শক্তি ইরানকে ধ্বংস করার জন্যে সকল প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে এবং বেলুিচস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। মালাক্কা প্রণালীর উপর পশ্চিমা আধিপত্য বজায় রাখার জন্য প্রথমে ইন্দোনেশিয়া থেকে মালয়েশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন করেছে। পরবর্তীতে সিঙ্গাপরুকে মালয়েশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন করেছে এবং পূর্বতিমুরকে ইন্দোনেশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে।

*প্রত্যাশা পূরণে করণীয়
উপরোক্ত আলোচনা তথ্য-উপাত্ত ও থিওরির মাধ্যমে আমরা এই সত্যটি উপলব্ধি করেছি যে, Unipolar বিশ্বকে Multipolar বিশ্বে পরিণত করতে হলে বেশকিছু বাধা অপসারণ করতে হবে। তবে বর্তমান রুশ প্রেসিডেন্ট মি. পুতিনের ন্যায় যোগ্য ও বিজ্ঞ নেততৃ¡ এই বাধাসমূহ অপসারণে সক্ষম হবেন বলে আমরা আশাবাদী। প্রত্যাশা পরূণে করণীয় নিম্নরূপ-
১. ঐতিহাসিক শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া- যেহেতু  রাশিয়া এ কাজে নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকবে, সেহেতু সর্বপ্রথম রাশিয়ার ঐতিহাসিক শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। ইউরোপে রাশিয়ার প্রধান ঐতিহাসিক শত্রু হলো ব্রিটেন। জার্মানি সাময়িক শত্রু কিন্তু জার্মানি থেকে বন্ধুত্ব আশা করা যেতে পারে।
২. Zionism প্রতিহত করা- যেসব দেশ ও দেশের জনগণ এককেন্দ্রিক বিশ্বের স্বেচ্ছাচারিতা ও জলুমু থেকে মুিক্ত চায় তাদের অবশ্য কর্তব্য হবে জায়নীজম সম্পর্কে জানা ও বুঝা এবং বিজ্ঞ ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিদেরকে নিজ নিজ দেশ পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান।

৩. ইউরোয়েশিয়ান হার্টল্যান্ডের ঐক্য প্রতিষ্ঠা- SCO, Euroasian Union,Euroasian Trade জোন গঠনের মাধ্যমে ইতোমধ্যে এ কাজটি শুরু করা হয়েছে। তবে তুরস্ক ও ভারতকে এ প্রচেষ্টায় সামিল করা গেলে প্রচেষ্টাটি পরিপর্ণূতা পাবে। তবে ভারতে যতদিন পর্যন্ত বর্ণবাদী-ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকবৃন্দ ক্ষমতায় থাকবে, ততোদিন পর্যন্ত ভারত বর্ণবাদী ইসরাইল থেকে আলাদা হবে না। এ জন্য ভারতের শাসনক্ষমতা থেকে সংখ্যালঘু উগ্র বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক শাসকগোষ্ঠীকে অপসারণ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ হরিজন, দলিত, মসুলিম ও অনার্য গোষ্ঠীকে ক্ষমতাসীন করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে এবং ১৯৪৭-পরবর্তী ভারত কর্তৃক জবরদখলকৃত দেশীয় রাজ্যসমূহের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন ও বেগবান করতে হবে। মূলত ভারতের বর্ণবাদী সংখ্যালঘু (৯%) উচ্চবর্ণের হিন্দুরা (৯১%) সংখ্যাগুরু ভারতীয়দের উপর নিজেদের আধিপত্য অব্যাহত রাখার জন্য বর্ণবাদী ইসরাইলের নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে জোটবদ্ধহয়েছে। সঠিক প্রচেষ্টা গ্রহণ করলে তরুস্ককে ইউরোপিয়ান হার্টল্যান্ডের ঐক্যপ্রতিষ্ঠায় কাজে লাগানো সহজ হবে। মধ্যএশিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী জাতিগতভাবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তুর্কী জাতির সাথে সম্পর্কিত।

৪. Wakhan Corridor কে কাজে লাগাতে হলে বর্তমান মার্কিন দখলদারিত্বের দ্রুত অবসান ঘটাতে হবে এবং আফগানিস্তানে পাশ্চাত্যবিরোধী শক্তিকে ক্ষমতাসীন করতে হবে। সুেয়জ খালের কর্ততৃ¡ থেকে পশ্চিমা শক্তিকে সরাতে হলে মিসরের ব্রাদারহুডকে শক্তিশালী করতে হবে, সহযোগিতা করতে হবে যাতে তাঁবেদার কোনো শক্তি পুনরায় মিসরে ক্ষমতাসীন হতে না পারে এবং ইসরাইলের ব্যাপারে যথাযথ ভূিমকা গ্রহণ করতে হবে। জিব্রাল্টার প্রণালীর কর্ততৃ¡ গ্রহণের জন্য মরক্কো এবং স্পেনে শক্তিশালী ও স্বাধীনচেতা সরকার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে হবে। এডেন উপসাগরে যক্তুরাষ্ট্রের কর্র্ততৃ খর্ব করার জন্য ইয়েমেনের জনগণের সরকার গঠনে সহায়তা করতে হবে এবং সোমালিয়ায় স্বাধীনচেতা ও শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে হবে। হরমজু প্রণালীকে আধিপত্যবাদীদের হাত থেকে নিরাপদ করতে হলে শক্তিশালী ইরানকে সর্বশক্তি দিয়ে রক্ষা করতে হবে এবং পাকিস্তানের স্থিতিশীলতা আনয়নে সহায়তা করতে হবে, মধ্যপ্রাচ্যের রাজতান্ত্রিক শাসকদের সাথে ঘনিষ্ঠতা বৃিদ্ধ করে তাদেরকে মার্কিনবলয় থেকে বের করে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। মালাক্কা প্রণালীর উপর পাশ্চাত্য শক্তির একাধিপত্য খর্ব করার জন্য বঙ্গোপসাগরে পাশ্চাত্যের আধিপত্য কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে। বার্মা ও বাংলাদেশে শক্তিশালী ও আধিপত্যবাদবিরোধী সরকার প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করতে হবে।
উপরোক্ত আলোচনা ও তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই, একাকেন্দ্রিক বিশ্বের অবসান করে মাল্টিপোলার বিশ্ব গড়তে হলে যে কাজগুলো করা দরকার তার জন্য মসুলিম বিশ্বের সহায়তা প্রয়োজন। Cold War-এর সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন মুসলিম বিশ্বের বিপরীতে অবস্থান করেছিল। ফলে অনেক মুসলিম দেশ হয়তো সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রুশ ফেডারেশনকে একই চরিত্রের মনে করতে পারে। এই ভ্রান্তি নিরসনের জন্য প্রেসিডেন্ট পুতিনের আশু কর্তব্য হচ্ছে মুসলিম বিশ্বের বাছাই করা কিছসুংখ্যক বুদ্ধিজীবী নিয়ে একটি Think Tank গঠন করা। যে Think Tank মসুলমানদের মন থেকে ভুল ধারণা দূর করবে এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে মসুলমানদের শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করে জাতিকে জানাবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

সম্পাদকীয়ঃ মাসিক ইতিহাস অন্বেষা জুলাই ২০১২

No comments:

Post a Comment