Friday, August 17, 2012

বার্মা-আরাকানের নির্যাতিত মুসলমানঃ আমাদের দায়


কাশ্মীর, ফিলিস্তিন, বসনিয়া, চেচনিয়া ও মরো মুসলমানদের ন্যায় আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলমানরাও মজলুম মুসলমান। ধর্মনিরপেক্ষতা ও প্রগতির বুলি আওড়ানো হিন্দু-ইহুদী, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী কর্তৃক এসব মসুলমানরা শুধমুাত্র ধর্মীয় কারণেই যুগ যুগ ধরে নির্যাতনে নিঃশেষ হতে চলেছে। স্বতন্ত্র মুসলিম জাতিসত্ত্বার কারণেই এরা আজ নির্যাতিত, নিপীড়িত, উদ্বাস্তু এবং নিজদেশে পরবাসী হিসেবে জুলুমের শিকার হচ্ছে। আমরা যারা ইসলামে বিশ্বাসী অথবা যারা বিশ্বাসে মসুলিম হয়েও কর্মে মুসলিম বিদ্বেষী তাদেরও দায় রয়েছে এসব নির্যাতিত মুসলমানদের সহযোগিতা করা। কেননা এসব দেশের ঈমানদার মসুলমানদের সাথে নামকাওয়াস্তে মসুলমান বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ইসলাম বিদ্বেষী মসুলমানরাও বিধর্মীদের নির্যাতন থেকে রেহাই পাচ্ছে না। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল মুসলমান(!) হওয়া সত্ত্বেও ইয়াসির আরাফাতকে জীবন দিতে হয়েছে স্লো পয়ঃজনিংয়ের দ্বারা, সাদ্দাম হোসেন ও ময়ুাম্মার গাদ্দাফিকে ও লাঞ্ছনার মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে এবং বামপন্থী কমিউনিস্টি বাশার-আল আসাদকেও মৃত্যু গহ্বরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে প্রগতিশীল নামক বিধর্মী ক্রুসেডাররা। উপরোক্ত নির্যাতিত মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে দর্ভুাগ্যবান হলো বার্মার মুসলমানরা। কেননা অন্যদের নাগরিকত্বের পরিচয় আছে কিন্তু রোহিঙ্গা মুসলমানরা হাজার বছর ধরে আরাকানে বাস করে ও সেদেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকতৃ নয়। তারা এখন বিশ্বের দেশে দেশে এবং নিজদেশে নাগরিকত্বহীন, নাগরিক অধিকারবিহীন উদ্বাস্তুর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।

ভৌগোলিক দিক থেকে আরাকানের অবস্থান ৯২০ থেকে ৯৪.৯০ পর্বূ দ্রাঘিমাংশে এবং ২১.৯০ উত্তর অক্ষাংশের মধ্যে। আরাকানের প্রকৃত আয়তন ১৬,৫০০ বর্গমাইল, কিন্তু ১৯৭৪ সালে বার্মার সরকারি মানচিত্রে ও নথিপত্রে ১২,৬৪২ বর্গমাইল উল্লেখ করা হয়েছে। (সূত্র- বাংলা বিশ্বকোষ, ১ম খ-, পৃ- ২২৩)। ১৯৭৪ সালে বর্মী সরকার আরাকান নাম পরিবর্তন করে রাখাইন রাজ্য নামকরণ করে। ১৯৩১ সালে ব্রিটিশ সরকার পরিচালিত আদমশুমারি রিপোর্ট অনুযায়ী বার্মার মোট জনসংখ্যা ১,৪৬,৫৩,৯৭৭ জন; তন্মধ্যে মুসলিম ৫,৮৪,৮৩৯ জন। আরাকানের মসুলমানদের সংখ্যা এখানে উল্লেখিত হয়নি। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ড. আবদলু করিম তাঁর ‘রোহিঙ্গাদের হাজার বছরের ইতিহাস’ নামক প্রবন্ধে লিখেছেন, “আরাকানের লোকসংখ্যা আনমুানিক ৪০ লক্ষ। তন্মধ্যে বৌদ্ধ ২০ লাখ, মসুলমান ১০ লাখ, জড়বাদী ৮ লাখ, হিন্দু ও খ্রিস্টান ২ লাখ। বৌদ্ধরা আরাকানে মগ নামে পরিচিত এবং মুসলমানরা রোহিঙ্গা নামে পরিচিত।” ২২-০৬-১২ তারিখে জাতিসংঘ প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী আরাকানে বর্তমানে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা আট লাখ। মসুলমানদেরকে হত্যা ও বহিষ্কার করে এবং বার্মার বৌদ্ধদেরকে পুনর্বাসন করে বার্মা সরকার আরাকানের মুসলমানদের অবস্থান প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে।


আরাকানের সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক ইতিহাস-

খ্রিস্টপর্বূ ২৬৬৬ সাল থেকে ১৪০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আরাকান মোটামুটি স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল বলে ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন।১ বেশিরভাগ সময়ে আরাকান উত্তর ও দক্ষিণে ২টি রাজ্যে বিভক্ত ছিল। খ্রিস্টপর্বূ ২২০০ থেকে ২০০০ খ্রিস্টপর্বূ  শতাব্দীতে উত্তর বিহারের মগধ থেকে আগত অনেক হিন্দু-বৌদ্ধ ও জৈন বঙ্গে, আরাকানে ও বার্মায় ধর্মপ্রচার ও উপনিবেশ স্থাপন করতে আসে। তখন থেকে আরাকান ও বার্মার শাসকগণ নিজেদেরকে মগধ রাজবংশীয় হিসেবে পরিচিত করার জন্য মহৎচন্দ্র, সুলতচন্দ্র, নরপতিগী, চন্দ্রসুধর্মা, শ্রীসুধর্মা খেতাব গ্রহণ করতো এবং রাজধানীর নাম ভারতীয় নামে বৈসালী, ধন্যাবতী, চম্পাবতী রেখেছিল।২ অপর ঐতিহাসিক তথ্য হলো- সম্রাট অশোকের মগধ বিজয়কালীন মগধ থেকে বিতাড়িত হয়ে যারা আরাকানে আশ্রয় গ্রহণ করেন তারাই আরাকানের মলূ মগ  জনগোষ্ঠী। খ্রিস্টীয় ২য় শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত চন্দ্র-সর্যূ ও কোলসিংহ চন্দ্রবংশ আরাকান শাসন করেছে।

দশম শতাব্দীতে সান উপজাতি কিছুদিনের জন্য আরাকান দখল করেছিল। দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বার্মার প্যাগান বংশ (1044- 1287) উত্তর আরাকানকে সাময়িকভাবে সামন্তরাজ্যে পরিণত করেছিল। (G.E Harvey, History of Barma, P.138)

বার্মার আক্রমণে টিকতে না পেরে ১৪০৬ খ্রিস্টাব্দে আরাকানরাজ নরমিখলা সদলবলে গৌড়ের সলুতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের দরবারে আশ্রয় লাভ করেন। ১৪০৬ সাল থেকে ১৪৩০ সাল পর্যন্ত আরাকান বার্মার অধীনে ছিল। ১৪৩০ সালে গৌড়ের সুলতান জালালদ্দুীন মহুাম্মদ শাহ (যদু) দুই পর্যায়ে ৫০ হাজার সেনা সহায়তা দিয়ে তাঁকে আরাকানের সিংহাসনে পনুঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। ১৪৩০ সাল থেকে ১৫৩০ সাল পর্যন্ত ১০০ বছর আরাকান গৌড়ের করদরাজ্য ছিল। (সত্রূ- আরাকান, রাজসভা, ড. মহুম্মদ এনামলু হক/আবদলু করিম সাহিত্য বিশারদ, তৎসূত্র-J.A.S.B vol-13, Part-1, 1844, P-46)

১৫৫৪ সালে দিল্লীর সম্রাট শের শাহের জ্ঞাতি শামসদ্দুীন মোহাম্মদ শাহ গাজী সমগ্র চট্টগ্রাম ও উত্তর আরাকান জয় করেন। ১৫৮০ সালে সমগ্র চট্টগ্রাম আরাকানের অধীনে যায় এবং মোগল বিজয় পর্যন্ত (২৭-০১-১৬৬৬ইং) চট্টগ্রাম আরাকানের অধীনে ছিল। ১৭৮৫ সালে বার্মার রাজা বোধপায়া আরাকান দখল করে অবর্ণনীয় জলুমু শুরু করেন। তাঁর অত্যাচারে আরাকানের মগ ও রাখাইনরা পালিয়ে বাংলাদেশে এসে স্থায়ীভাবে থেকে যায়। কক্সবাজার ও বাকেরগঞ্জের রাখাইন সম্প্রদায় এবং বান্দবানের মারমা (মগ) সম্প্রদায় উক্ত সময়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

১৪০৬ সাল থেকে ১৪৩০-এর মধ্যে আরাকানের অনেক মগ  বা রাখাইন বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় এবং ১৬৬৬ সাল থেকে ১৭৮৫ সালের মধ্যে আরাকানের করদরাজ্য ‘চকোমা’ (বর্তমান মিজোরাম) থেকে বর্তমান চাকমা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে এসে বসতি স্থাপন করে। মোগল প্রশাসকদের বদান্যতায় চাকমারা দলে দলে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে বসতি স্থাপন করে। ১৭৮৫ সাল থেকে ১৮২৫ সাল পর্যন্ত আরাকানে বার্মার শাসন, ১৮২৬ সাল থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসন, ১৯৪২ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জাপানি শাসন এবং পনুরায় ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসন এবং ১৯৪৮ সাল থেকে অদ্যাবধি পর্যন্ত বর্মী শাসনের কাল।

আরাকানের জাতিগত (নৃতাত্ত্বিক) ইতিহাস

আরাকানের প্রাচীন জনগোষ্ঠী The southern মঙ্গোল বা দক্ষিণী মোঙ্গল শ্রেণীর। তিব্বতের মালভূমিতে এদের উদ্ভব ও বিকাশ। আরাকানের মধ্যবর্তী জনগোষ্ঠী হলো- বিহারের মগধ এলাকার বৌদ্ধ, হিন্দু ও জৈন আগন্তুকগণ। এদের কেউ কেউ মঙ্গোলয়েড এবং কেউ কেউ আলপাইন শাখার মানষু। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতক থেকে আরাকানে ব্যবসা- বাণিজ্য উপলক্ষে বিপলুসংখ্যক আরবী, ইরানী, তর্কুী, ভারতীয় ও বাংলাদেশী বসতি স্থাপন করেছে। এদের বেশিরভাগ ককেসয়েড মানবধারার আলপাইন শাখার মানুষ। বর্তমানে আরাকানের জনগোষ্ঠী প্রধানত ২ ভাগে বিভক্ত। প্রথমোক্তরা হলো রাখাইন বা মগ দ্বিতীয়াক্তরা হলো রোহিঙ্গা বা মসুলমান। আরবীয়, ইরানী, ভারতীয় ও বাংলাদেশী মানুষের সাথে স্থানীয় মগদের মিশ্রণে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে। রাখাইনদের ভাষা চীন-তিব্বতি ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত, রোহিঙ্গাদের ভাষা আরবী- ফার্সী, উর্দু ও বাংলা ভাষার মিশ্রণে গঠিত হয়েছে। অধিকাংশ রাখাইনের ধর্ম হলো থেরবাদী বৌদ্ধধর্ম। এই ধর্ম হীনযানী বৌদ্ধ ধর্মের একটি শাখা। হীনযানী বৌদ্ধ ধর্মের গ্রন্থসমূহ পালিভাষায় লিখিত। ইসলামধর্ম যেরূপ আরাকানে বহিরাগত ঠিক তদ্রুপ বৌদ্ধ, হিন্দু ও খ্রিস্টানধর্ম বহিরাগত।

আরাকান ও বার্মায় মসুলমানদের আগমনের ধারা-

বার্মা ও আরাকানে মসুলমানদের প্রথম আগমন ঝড়ের কবলে পড়ে আরব মুসলমানদের বাণিজ্যতরী আরাকান উপকূলে ডুবে যাওয়ার মাধ্যমে শুরু হয়। মূলতঃ ইসলামের আবির্ভাবকালে আরব ব্যবসায়ীগণ লোহিত সাগর থেকে চীনা উপকলূ পর্যন্ত বিস্তৃত বাণিজ্য পথের নিয়ন্ত্রণ করতো। ইসলামের আবির্ভাবের পরে আরবীয় ও ইরানী মসুলিম ব্যবসায়ীরা তাদের যাত্রাপথে অসংখ্য মসুলমান ব্যবসায়ী কলোনি স্থাপন করে। ৮ম শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত বার্মা ও আরাকানে মসুলমানদের বেশ কয়েকটি বাণিজ্য কলোনি স্থাপিত হয়। এ বিষয়ক কয়েকটি ঐতিহাসিক তথ্য নিম্নরূপ-
 (১) মসুলমান নাবিকগণ নবম শতাব্দীতে বার্মায় অবতরণ করে। তাদের নিকট বার্মা নামে যে এলাকাটা পরিচিত ছিল তা ছিল নিম্ন বার্মার উপকলূীয় অঞ্চল ও আরাকান। (সূত্র-G.E. Harvay,History of Burma,P. 10)

(২) চীনা পরিব্রাজকগণ ৮৬০ খ্রিস্টব্দের দিকে বার্মা ও ইউনান সীমান্তে পারস্য দেশীয়দের কলোনি দেখতে পেয়েছিলেন। ... এ তথ্য সত্রূগুলোতে যে পেগু (নিম্নবার্মার রাজধানী) নাবিকদের উল্লেখ রয়েছে তারা ছিল আরব এবং পারস্য দেশীয়। এরা পেগু শহরে বসতি স্থাপন করেছিল অথবা তারা ছিল এদের বংশধর। মুসলমান বাণিজ্য কলোনিগুলো নবম শতাব্দীনাগাদ পেগুতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং আরবদের বাণিজ্যতরী প্রায়ই এখানে ভিড়ত। (সূত্র- সিদ্দিক খান, Muslim Inter-cource in Burma. P.417)

(৩) রাশিয়ান ব্যবসায়ী আথানাসিয়াস নিচি যিনি ১৪৭০ সালে এশিয়া ভ্রমণ করেন। তিনি পেগু বন্দরটিকে “ভারতীয় দরবেশদের একটি উপনিবেশ” বলে বর্ণনা করেছেন। [সূত্র- কোর্টিনে লক সম্পাদিত The first Englishman in India (London,Jorge Rutlage 1903) P. 121]

(৪) ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারত ভ্রমণরত পর্তুগীজ পরিব্রাজত দূয়ার্তে বারবারোসা উল্লেখ করেছেন- “পেগুতে অনেক মসুলমান বাস করে। মরুীয় (মুসলমান) বাণিজ্য জাহাজগুলো পেগু থেকে চিনি, রন্ত্যক দ্রব্যাদি ও পদ্মরাগমনি রপ্তানি করে এবং কার্পাস, রেশম, আফিম, তামা, রূপা, ঔষধী ভেষজদ্রব্য ইত্যাদি আমদানি করে। পেগুর অধীনস্থ মার্তাবান এমন একটি শহর যেখানে মসুলমানরা বাস করে। (সূত্র- J.S. Farnival,Europians in Burma: The Early Porfuguse থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন ইসরাইলী গবেষক ও কূটনীতিক মোসে ইগার)।

(৫) সপ্তদশ শতাব্দীতে শ্যামরাজ্য শাসিত মারগুই ছিল মসুলমানদের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র। ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে মারগুই এ অবস্থানেরও জনৈক ব্রিটিশ বণিক বলেন, “মুসলমানরা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতো। গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদগুলোই মসুলমানদের দখলে ছিল। মারগুই-এর গভর্নর, টেনাসসেরিম প্রদেশের ভাইসরয় এবং টেনাসসেরিম থেকে অযোধ্যা পর্যন্ত বিস্তৃত স্থলপথের উপর অবস্থিত প্রধান শহরগুলোর গভর্নরেরা ছিল ভারতীয় এবং পারস্য দেশীয় মসুলমান। ....সপ্তদশ শতাব্দীর শেষেরদিকে ব্রিটিশ এবং ফরাসীরা এতদাঞ্চলে প্রভাবশালী হলে অধিকাংশ মসুলমানকে পদচ্যুত করা হয় এবং অনেককে হত্যা করা হয়। [সূত্র-Moris Colis, Siamse white(London Favaur & Favour-1936)P-36-39]।

বিজেতা হিসেবে মুসলমানদের বার্মায় ও আরাকানে আগমন-

(১) দিগ্বিজয়ী সম্রাট চেঙ্গিস খানের পৌত্র চীন সম্রাট কবুলাই খানের আমলে তাঁর ইউনান প্রদেশের শাসনকর্তার ছেলে সেনাপতি নাসির উদ্দীন ১২০০০ অশ্বারোহী ও তীরন্দাজ সৈন্য নিয়ে বার্মা অধিকার করেন। এ বাহিনীতে বিপলুসংখ্যক মুসলমান ও তাতার ছিল। তখন বার্মার রাজবংশকে প্যাগান রাজবংশ বলা হতো। (সত্রূ- Yule রচিত The book of Sir Marko Polo. P-11, 99)।

(২) ১৪৩০ সালে গৌড়ের সলুতান জালালুদ্দীন মহুাম্মদ শাহ (যদু) দইু পর্যায়ে ৫০,০০০ সেনা সাহায্য দিয়ে গৌড়ে আশ্রিত আরাকানরাজ নরমিখলা ওরফে সোলায়মান শাহকে আরাকানের রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। বার্মার আক্রমণ প্রতিহত করতে এ পঞ্চাশ হাজার পাঠান ও তুর্কী সৈন্য আরাকানে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে। এরাই বর্তমানে রোহিঙ্গা জাতি গঠনের মূল নিয়ামক।

(৩) ১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীর সম্রাট শেরশাহ- এর জ্ঞাতি শামসদ্দুীন মোহাম্মদ শাহ গাজী সমগ্র চট্টগ্রাম ও উত্তর আরাকান জয় করেন।

বার্মায় ও আরাকানে প্রধান প্রধান মসুলিম বসতিসমূহ-

ব্যবসায়ী হিসেবে, ভাড়াটিয়া সৈন্য হিসেবে, যদ্ধুবন্দী হিসেবে, বিজেতা হিসেবে বার্মা ও আরাকান সরকারের কর্মচারী-কর্মকর্তা হিসেবে মুসলমানরা বার্মা ও আরাকান সরকারের অনমুতি সাপেক্ষে উক্ত দুই দেশে বসতি স্থাপন করেন। মুসলিম ব্যবসায়ীরাই বার্মা ও আরাকানকে ব্যবসা সফল দেশ হিসেবে গড়ে তোলেন মসুলমান রাজনীতিক ও সেনাবাহিনীর লোকেরাই শক্তিশালী এবং আধুনিক দেশ হিসেবে গড়ে তলুতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। উভয় সরকারের অশ্বারোহী বাহিনী, নৌবাহিনী ও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার মুসলমানরাই প্রতিষ্ঠা করেছিল। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি ঐতিহাসিক তথ্য নিম্নরূপ-

(১) বার্মা রাজা আনরঠার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সলু (Sawlu) (১০৭৭-১০৮৪) বার্মার রাজা হন। সলুর গৃহশিক্ষক ছিলেন একজন মসুলমান। উক্ত গহৃশিক্ষকের পত্রু রহমান খান এবং সলু দুধভাই ছিলেন। ক্ষমতালাভের পর সলু তাঁর দধুভাইকে উসসা (USSA) নগরীর শাসনকর্তা নিযক্তু করেন। সলরু পর তাঁর সৎভাই সানজিথা বার্মার রাজা হন। তাঁর আমলে বার্মার কয়েকটি এলাকায় মুসলিম উপনিবেশ গড়ে উঠে। (G.E. Harvay,History of Burma,P. 24/27/31)।

(২) গৌড়ের সলুতান জালালুদ্দীন মোহাম্মদ শাহ (যদ)ু ১৪৩০ সালে ৫০ হাজার সেনা সাহায্য দিয়ে আরাকানকে বার্মার দখল থেকে মক্তু করেন এবং বিতাড়িত আরাকানে রাজা নরমিখলাকে আরাকানের সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। নরমিখলা ওরফে সোলায়মান শাহ্ ম্রোহং নামক স্থানে নতনু রাজধানী স্থাপন করেন। উক্ত রাজধানীর নিরাপত্তার জন্য নরমিখলা রাজধানীর চারপাশে মসুলিম বসতি স্থাপন করেন। উক্ত মুসলিম জনপদসমূহ হলোÑ রওয়াম নেদানপাড়া,  মোয়াল্লেমপাড়া, সাম্নুরিক, কুয়িপাড়া, কামারপাড়া প্রভৃতি। নিরাপত্তার জন্য নরমিখলা আরাকান-বার্মা সীমান্তেও মসুলিম বসতি স্থাপন করেন। (সত্রূ- আরাকানে মুসলমান : ইতিহাস ও ঐতিহ্য; সামিউল আহমদ খান, রোহিঙ্গা মসুলমান, পৃ.-২৭৬) একই সূত্রে বলা হয়েছে, এসব এলাকায় এখনো ৭টি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। যেগুলো বর্মীরাজ ও তাদের লেলিয়ে দেয়া মগদের দ্বারা লুণ্ঠিত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

(৩) আরাকানের ৫টি নদী লেম্রা, মিঙ্গান, কালাডন, মায়ু ও নাফ নদীর উভয় তীরে গড়ে উঠেছিল মসুলিম জনপদ। প্রধানতঃ চট্টগ্রামের মসুলমান বংশোদ্ভতু রোহিঙ্গা সম্প্রদায় অধ্যুষিত ছিল এ সকল জনপদ ও শত শত গ্রাম। এখনো মংডু, বুচিডং, রাসিডং প্রভৃতি মহকুমার অধিকাংশ গ্রাম বিশেষ করে নাফ, লেম্রা ও মিঙ্গান নদীর তীরঘেঁষে যতো জনপদ লক্ষ্য করা যায় সেসব জনপদে অর্ধেকেরও বেশিসংখ্যক বাসিন্দা রোহিঙ্গা মুসলমান। আগে এসব এলাকায় শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ, কোথাও কোথাও শতকরা ৯৮ ভাগ ছিল মসুলমান। কালাডান ও মায়ু নদীর তীরবর্তী চন্দনা, মিউরকলু, কাইনি পেরাং, কাইম পেরাং, সোলিং পেরাং, টংফরু, ডবে আফকচান, কেরী, কাজীপাড়া, কেওদা, রোহিঙ্গাপাড়া, রমজপুাড়া, আমবাড়ী, বাহারপাড়া, লখনৌপাড়া, টংটং মিরং, ফলুওয়ারী পালওয়ানপাড়া, মেয়কটং, মচ্ছারী আংপেরাং, রাজারবিল, রৌশন পেরাং, জোপেরাং, ছমিলা, রোহিঙ্গাডং, আলীখং মিন জং, ছুয়েক্রংডং, মরুছং, খোয়াংছং, লোয়াডং প্রভৃতি এলাকাগুলোতে রোহিঙ্গা মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। (সূত্র- আরাকানের মুসলমান : ইতিহাস ও ঐতিহ্য, সম্পাদনা- ড. মুহিব উল্লাহ সিদ্দিকী, প্রবন্ধকার- সামিউল আহমদ খান, প্রবন্ধ-‘রোহিঙ্গা মসুলমান’, পৃ.-২৮১)

এছাড়াও আরাকানের প্রধান প্রধান শহর ও বন্দরসমূহে বিপলুসংখ্যক মসুলিম বসতি দশম শতাব্দী থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়। উপকূলীয় এলাকায় কয়েকটি মুসলিম উপনিবেশ ছিল। এ সংক্রান্ত তথ্য হলো-

(১) বর্মী নারীগণ বিদেশিদের প্রতি ভদ্র ও সহানুভূতিশীল ছিল। বার্মায় বসবাসে লিপ্ত প্রায় অধিকাংশ ব্যবসায়ী বর্মী স্ত্রী গ্রহণ করতো। (সূত্র- Hamilton. Hall-Early English Inter-cource in Burma,P.984)

(২) Hamilton আরো লিখেন, “আরবীয় ফারসী এবং ভারতীয় মসুলমানদের বংশধররাই বার্মার মসুলিম জাতি। বর্মী ভাষায় ইহাদের ‘পথি’ বলা হয়। দ্রুত বংশবৃিদ্ধ এবং নতনু নতনু মুসলিম বণিকের আগমনের ফলে বার্মায় মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বার্মায় মসুলমান জাতির কিয়দংশ বার্মায় আগত প্রথম মুসলমান বণিকদের উত্তর-পুরুষ এবং অবশিষ্টাংশ মসুলিম বণিক ও বর্মী রমণীর বিবাহজাত সন্তান। বার্মায় ধর্মপ্রচারের দ্বারা ইসলাম বিস্ততৃ হয়নি। এই কৃতিত্ব ঐ আমলে বিভিন্ন দেশ হতে আগত মসুলিম নাবিক ও ব্যবসায়ীদের প্রাপ্য। (সূত্র- ঐ)।

বার্মা ও আরাকানে মসুলমানদের প্রভাব ও অবদান-

আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রচলন, বহির্বাণিজ্য, নৌবাহিনী গঠন, অশ্বারোহী বাহিনী গঠন, যুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার, আধুনিক মুদ্রাব্যবস্থাসহ সকল ক্ষেত্রে মসুলমানরাই বার্মা ও আরাকানকে প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক যুগে পদার্পণে প্রধান ভূমিকা পালন করে। এজন্য হাজার বছর ধরে মুসলমানদের সাথে আরাকানী ও বর্মীদের সৌহার্দ্যপর্ণূ সম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার বন্ধন অব্যাহত ছিল। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে বার্মায় ইউরোপীয়দের আগমন এবং পরবর্তীতে ইউরোপে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের পর থেকে ইউরোপীয়রা মসুলমানদেরকে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ও শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে। এ পর্যায়ে ব্রিটিশ ষড়যন্ত্র  ও Devide Rule পরিস্থিতির শিকার হয়ে মসুলমানরা অত্যাচার ও নিগ্রহের শিকারে পরিণত হয়। এতদসংক্রান্ত কয়েকটি ঐতিহাসিক তথ্য নিম্নরূপ-

(১) আরাকান রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ। তাদের মুদ্রায় ৭৯২ মথি (১৪৩০ খ্রি:) থেকে ১০০০ মথি (১৬৩৮ খ্রি:) পর্যন্ত মোট ১৫ জন রাজার বৌদ্ধ নামের সঙ্গে মসুলমান নাম পাওয়া যায়। (সূত্র- M. Robinson & L.A. Shaw: The coins of Banknote of Burma,Manchaster,1980.P.44-45)।

(২) ১৪৩০ সালের পূর্বে আরাকানের কোনো আধুনিক মুদ্রা ছিল না। আধুনিক মুদ্রা তৈরি করার জন্য আরাকানে কোনো কারিগর ছিল না। তাই আরাকানের রাজা বাংলা থেকে অভিজ্ঞ কারিগর নিয়োগ করে। মদ্রুায় আরবি ও বাংলা ভাষা এবং অক্ষরের উপস্থিতি প্রমাণ করে বাংলা থেকেই মুদ্রার কারিগররা আরাকানের টাকশালে নিযক্তু হয়। টাকশালের কর্মকর্তা- কর্মচারী ছাড়াও বিভিন্ন রকমের মুসলমান কর্মচারী, চিকিৎসক (হাকিম বা তবিব), কাজী, অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য, বণিক, ব্যবসায়ী ও কর্মজীবীগণ বাংলা থেকে আরাকান গমন করে। ড. আবদলু করিম, রোসাঙ্গে বাংলা সাহিত্য)।

(৩) ১৫০১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারত ভ্রমণরত পর্তুগীজ পরিব্রাজক দয়ূার্তে বারবারোসা উল্লেখ করেছেন, “অনেক মসুলমান পেগুতে (বার্মার তৎকালীন রাজধানী) বাস করে। মরুীয় দ্রব্যাদি ও পদ্মরাগমনি রপ্তানি করে এবং কার্পাস, রেশম, আফিম, তামা, রূপা, ঔষুিধ, ভেষজদ্রব্য ইত্যাদি আমদানি করে। পেগুর অধীন ‘মার্তাবান’ শহরে ও অনেক মসুলমান বাস করতো। [সূত্রÑ ঞযব উবষঃর ঝঁষঃধহধঃব (বোম্বাই, ভারতীয় বিদ্যাভবন, ১৯৬০) পৃ.-৬৫১, তৎসূত্র- J.S. Furnival, Eurupians in Barma, The early Portugese)।

(৪) পঞ্চদশ ও ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে টেনাসসেরিম ও মারগুই বন্দর ইউরোপীয় নাবিকদের নিকট সপুরিচিত ছিল। তারা বর্ণনা করেছেন যে, এগুলো মসুলিমপ্রধান শহর যার সাথে মালাক্কা, বাংলা ও মক্কার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। (সূত্র-D.C. Dcot “O” conor Mandalaya and Other cities of past in Barma(London, Hanchinchos, 1407, P.-405)।

(৫) ব্রিটিশ দূত মাইকেল সাইমন্স যিনি ১৭৯৫-৯৬ সালে এবং ১৮০২ সালে বার্মার রাজার সাথে আলোচনা করতে আসেন। তিনি তাঁর স্মৃতিগাথায় উল্লেখ করেন যে, “প্রচুরসংখ্যক বিদেশি যাদের মধ্যে মসুলমানদের সংখ্যা ছিল অত্যধিক এবং যারা বার্মায় স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেছিল তাদের সাথে লেনদেনের ব্যাপারে ক্রমবর্ধমান প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ এবং বিদেশীদের সাথে সংযোগ রক্ষা সম্পর্কিত পদগুলোতে এসব সম্প্রদায়ের বাছাইকতৃ লোকদের নিয়োগ করতে সরকার বাধ্য হয়। (সূত্র- M. Siddik Khan,Muslim Intercource with Barma,Islamic culture,P.-261.) তথ্যসূত্র Michel Simons, Second Embassy to Ava-P.198।


সেনাবাহিনীতে মসুলমান-

১। বার্মার উপকূলীয় শহরগুলোতে অনুপ্রবেশের সমান্তরালে মুসলমানেরা রাজ্যের অভ্যন্তরেও বসতি গেঁড়ে বসে। বর্মী রাজাদের এবং স্থানীয় জমিদারদের অধীনে ভাড়াটে সৈন্য অথবা যদ্ধুবন্দী হিসেবে বার্মায় এদের আগমন ঘটে। একাদশ শতাব্দীতেই রাজা অনহরথের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত ভারতীয় সেনা ইউনিট এবং দেহরক্ষীগণ গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। স্পষ্টতই তাদের সবাই ছিল মসুলমান। (এইচ, আর স্পীয়ারম্যান, British Barma Gazzete,Vol-1, রেঙ্গুন, ১৮৮০ পৃ.-২৬২)।

২। ১৫৪১ খ্রিস্টাব্দে তাবিন সোয়েডি (১৫৩১- ১৫৫০) মার্তবান বন্দর অধিকার করেন। শহরের অনেক মসুলমান বাসিন্দা তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৫৬৪ খ্রি:।

৩। ১৭৫৬ খ্রি: রাজা আলংপায়া (১৭৫২-১৭৬০) আরাকানের নৌবন্দর সিরিয়াম (পার্সী-সির-ই-আম অর্থাৎ সমুদ্রের কিনারা) অধিকার করেন। তাঁর বন্দীদের মধ্যে অনেক মুসলমান ছিল। ইউরোপীয়দের অধীনস্থ সেনাবাহিনীতে চাকরি করার জন্য তাদেরকে বাধ্য করা হয়। (G.E Harvey History of Barma,P.-241)।

(৪) বর্মী রাজা মিনডং (১৮৫৩-১৮৮৭)-এর শাসনামলে সেনাবাহিনীতে হাজার হাজার মসুলমান অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং তারা বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে নিয়োজিত ছিল। মসুলমান পদাতিক ও গোলন্দাজ বাহিনীর সৈন্যরা মিনহলা যুদ্ধে (১৮৮৫) ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে শৌর্যের পরিচয় দেয়। এর পরপরই বৌদ্ধ সান্দালয়ের পতন ঘটে। (উবাউ এর Mendalay Centenary: History of Burmese Muslims থেকে উদ্বৃতি দিয়েছেন ইসরাইলী গবেষক মোসে ইগার, ভাষান্তর মোসতাক আহমদ...... রাজতন্ত্রের আমলে বার্মায় মসুলমানদের অবস্থা)।

আরাকান ও বার্মা সরকারে মসুলমান-

কবি কাজী দৌলত ও আলাওল রচিত কাব্যসমহূ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ২৫৪ বছর আরাকানের বৌদ্ধ রাজাদের দরবারে প্রধানত চট্টগ্রামের মসুলমান সভাসদদের প্রভাব ছিল। আরাকানের রাজারা চট্টগ্রামের মসুলমানদের মধ্য হতে প্রধানমন্ত্রী, সমরসচিব, উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও নিম্ন শ্রেণীর কর্মচারী নিযক্তু করতেন। সিলেটবাসী এক ব্যক্তিও আরাকান রাজার সমরসচিব বা প্রধান সেনাপতি নিযক্তু হয়েছিলেন। এ সময় আরাকানের সমর বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল লস্কর উজির খ্যাত মন্ত্রীর হাতে। আরাকানের সমর বিভাগে অশ্বারোহী বাহিনী গঠন করেন লস্কর উজির। শাসন বিভাগের প্রধান পদেও মসুলমান কর্মচারী নিযক্তু করা হতো। বিচার বিভাগ পরিচালনা করতেন মসুলমান কাজী। এরূপ কয়েকজনের পদবী ও সময়কাল নিম্নে উল্লেখ করা হলো-

(১) লস্কর উজির আশরাফ খাঁ- তিনি আরাকানরাজ থিরি থধুম্মার (১৬২২-১৬৩৮) লস্কর উজির ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানার অন্তর্গত চাবিয়া গ্রামের অধিবাসী ছিলেন।

(২) লস্কর উজির বড়ঠাকুর- তিনি আরাকানরাজ নরপতিগ্যির (১৬৩৮-১৬৪৫) সমরসচিব ছিলেন। বড়ঠাকুর আরাকানরাজ প্রদত্ত উপাধি। তাঁর পিতামহ গৌড় থেকে এসে চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার চক্রশালায় বসতি স্থাপন করেছিলেন।

(৩) প্রধানমন্ত্রী মাগর ঠাকুর- তিনি আরাকানরাজ নরপতিগ্যি (১৬৩৮-১৬৪৫) থদোমিন্তা (১৬৪৫-১৬৫২) এবং সান্দথঠুম্মা (১৬৫২-১৬৮৪) আরাকানের এই তিন রাজার আমলে প্রথমে মন্ত্রী ও পরে প্রধানমন্ত্রী নিযক্তু ছিলেন। তিনি লস্কর উজির বড়ঠাকুরের পুত্র ছিলেন।

(৪) প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ মসুা- ১৬৫৮ খ্রি: মাগন ঠাকুরের মৃত্যু হলে সিলেটের বাসিন্দা সৈয়দ মুসা আরাকানরাজ সান্দথুঠম্মার (১৬৫২-১৬৮৪) প্রধানমন্ত্রী নিযক্তু হন। তিনি সিলেট বিজয়ী সৈয়দ নাসির উদ্দীন সিপাহসালারের বংশধর এবং হবিগঞ্জের তরফ পরগনার লস্করপুর গ্রামের অধিবাসী।

(৫) প্রধানমন্ত্রী নবরাজ মজলিশ- সৈয়দ মসুার পর তিনি আরাকানে রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।

(৬) প্রধান সেনাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ খান- তিনি আরাকানেরাজ সান্দথুঠম্মার প্রধান সেনাপতি ছিলেন। (৭) অর্থমন্ত্রী সোলায়মান- তিনি রাজা সান্দথঠুম্মার অর্থমন্ত্রী ছিলেন।

(৮) লস্কর উজির বোরহানউদ্দীন- তিনি আরাকানরাজ থদোমিন্তার এর সমরসচিব বা মন্ত্রী ছিলেন। তিনি প্রথম আরাকানের অশ্বারোহী বাহিনী গঠন করেন। চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানার জলদি গ্রামে তাঁর বংশধররা বর্তমানে বসবাস করেন।

(৯) বিশিষ্ট মুসলিম ব্যবসায়ী উ-জী সওদাগরকে বার্মারাজ বোধপায়া (১৭৮২-১৮১৯) সোনার তাজ উপহার দেন। এটি পরে তিনি বিনা বাধায় রাজসভায় ঢকুতে পারতেন। চট্টগ্রাম, ঢাকা, কলকাতা, পেগু, মান্দালয়, আভা, ব্যাংকক প্রভৃতি স্থানে তিনি বাণিজ্য করতেন। সাফাপাড়ায় তাঁর নামে পুল এখনো বর্তমান।

(১০) ১৭০০ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আরাকানের আরো তিনজন সেনাপতির নাম জানা যায়। তাঁরা হলেন,
(১) ক্বাইসের হ্রেলা (২) বলদিপাডার বুসিং (৩) বন্দরের আলীয়া বাইং। আলীয়া বাইং-এর পাকা মসজিদ এখনো বর্তমান।
(তথ্য সূত্র- আরাকানের মুসলমান : ইতিহাস ও ঐতিহ্য, সম্পাদনা- ড. মোহাম্মদ মুহিব উল্ল্যাহ ছিদ্দিকী, প্রবন্ধ- আবদলু হক চৌধুরী, আরাকান রাজসভায় মসুলমান সভাসদ, পৃ-১৮৮-২০৭)।

(১১) ব্রিটিশ নাগরিক হেনরি জবুসিনি ১৮৫৫ সালে বার্মা ভ্রমণ করেন। তিনি বর্ণনা করেছেন যে, পাগানের গভর্নর ছিলেন একজন মসুলমান যাকে পরে হত্যা করা হয়। (সূত্র- ক্যাপ্টেন হেনরী জলু, A narrative of the mission sent by the Govornor General of India to the court of Ava in1855, P.-228)।

(১২) ব্রিটিশ কর্তকৃ বার্মা অধিকারের কিছুকাল পূর্বে অর্থাৎ ১৭৯৫ থেকে ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ব্রিটিশ এবং বর্মী রাজাদের মধ্যকার যাবতীয় রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে মসুলমানরা বার্মার পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। (সূত্র- পূর্বোক্ত মোসে ঈগর-এর প্রবন্ধ, পৃ.-১৭৬)।

(১৩) প্রথম এংলো-বার্মিজ যুদ্ধের পর সিংহাসনচ্যুত রাজা বার্গিদ তাঁর সিংহাসন পুনরুদ্ধারের জন্য সাহায্যের অনুরোধ জানিয়ে ব্রিটিশদের নিকট জনৈক মুসলমান দূতকে প্রেরণ করেন। রাজা বোধপায়ার আইন উপদেষ্টা যিনি ছিলেন উল্লেখিত দূতের পর্বূসূরি তিনি সেই একই মসুলমানকে এক গোপন মিশনে দিল্লীতে প্রেরণ করেছিলেন। (পূর্বোক্ত তথ্যপঞ্জী-৫২, পৃ-১৮৫)।

আরাকানের সংস্কৃতিতে মুসলমান প্রভাব-

আরাকানের লোকেরা নিজেদেরকে রক্ষইং বা রাক্ষস হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতো। উক্ত রক্ষইং থেকে রাখাইন শব্দটি এসেছে। সভ্য মানুষের চাল-চলন, আচার-ব্যবহার তাদের মধ্যে  ছিল না। এতদসংক্রান্ত প্রামাণ্য তথ্য নিম্নরূপ-
(১) প্রাচীনকালে আরাকানীরা ছিল বন্যস্বভাবের। মাথার চলু কাটা বা হাত-পায়ের নখ কাটার ব্যাপারে তারা ছিল উদাসীন। রাজা নরমিখলার সিংহাসন পুনরুদ্ধারকালে আরাকানে আগত গৌড়ের মুসলমান সেনাদের সংস্পর্শে এসে আরাকানীরা চুল ও নখের যত্ন নিতে শিখে। মুসলিম-পূর্ব আমলে আরাকানীরা রান্না করা খাবার খাওয়া জানতো না। মসুলিম সেনারা আরাকানে খাদ্য রন্ধন প্রণালী প্রবর্তন করে এবং মশলা, তৈল, ঘির প্রচলন করে। মসুলমানদের সাধ্য নেই আরাকানীরা কোরমা, পোলাও, বিরিয়ানীর স্বাদ পায়। পোশাকের ব্যাপারেও তারা আদিম অবস্থানে ছিল। গৌড়ের রাজদরবারে ২৪ বছর নির্বাসন জীবনযাপনকারী রাজা নরমিখলা গৌড়ের অনুকরণে আরাকানের রাজদরবারে আমির-ওমরা, জেনানামহল, পর্দাপ্রথা, জল্লাদ ও ক্রীতদাসপ্রথা প্রচলন করেন। (পূর্বোক্ত- আবদুল হক চৌধরুী লিখিত প্রবন্ধ, পৃ-২০০)।

(২) বিদেশের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বর্মী রাজারা ফারসী ভাষা ব্যবহার করতেন। ফারসী ভাষায় বুৎপত্তিসম্পন্ন মুসলমানদেরকে তারা রাজধানী, বড়শহর ও বন্দরগুলোতে দোভাষী হিসেবে নিয়োগ করেছিল। প্রতিবেশী দেশ সফরে বর্মী সরকার কর্তকৃ প্রেরিত প্রতিনিধি দলের সফরসঙ্গীরূপে দোভাষীরা সঙ্গে থাকতো।১ প্রথম ইঙ্গ-বার্মিজ যুদ্ধের সময় (১৮২৪-১৮২৬) ব্রিটিশ এবং বর্মীদের মধ্যে একইভাবে ফারসী ভাষায় চিঠি আদান-প্রদান করা হতো।২
তথ্যসূত্র- ১. মাইকেল সাইমন্স, journal of his second embassy to the court of Ava in  1802 সম্পাদনা ভি.জি.ই হল (লন্ডন, জর্জ এলন এন্ড আনউইন, ১৯৫৫) পৃ-৪০৩।
২. দেশাই, A Pagent of Burmese History, P.- 247।
৩. A Phayre, History of Burma, (London-1984) P.17
৪.সত্যেন্দ্রনাথ ঘোষাল, কাজী দৌলত বিরচিত ‘সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী’ পৃ-৭।(চলবে)

লেখক : সম্পাদক, মাসিক ইতিহাস-অন্বেষা

No comments:

Post a Comment