Monday, January 16, 2012

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী মতবাদ- মুসলিম বিশ্বের মরণফাঁদ(প্রথম প্রকাশ মাসিক ইতিহাস অন্বেষা, অক্টোবর ২০০৭)


বাস্তবে বর্তমান বিশ্বে ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদী চার প্রকার। যথা খ্রিস্টান ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, হিন্দু ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদী, বৌদ্ধ ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদী ও মুসলিম ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদী। খ্রিস্টান ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীরা খ্রিস্টান বিশ্ব বাদ দিয়ে বিশ্বের অন্যান্য ধর্মের অনুসারী জাতিসমূহের সর্বনাশ সাধন করার জন্য সদা সর্বদা তৎপর থাকে। অপর দেশ গ্রাস করার লক্ষ্যে এরা প্রমে নিজেদের ধর্মযাজকগণকে সংশ্লিষ্ট দেশে ধর্ম প্রচারে পাঠায়। উক্ত যাজকগণ ধর্মনিরপেক্ষ স্বদেশের স্বার্থে ভিন জাতির মধ্যে অনুপ্রবেশ করে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে উক্ত জাতিকে হীনবল করে। এমতাবস্থায় ধর্মনিরপেক্ষতার আলখেল্লাপরা খ্রিস্টান শাসকগণ যাজকদের সহায়তায় অন্য জাতিসমূহের ঘাড় মটকিয়ে রক্ত পান করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে খ্রিস্টান ধর্মযাজকগণ ভিন জাতির লোকদেরকে সম্মোহিত করে খ্রিস্টান ধর্মনিরপেক্ষ বলে ঘোষিত সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের পাইপলাইন হিসেবে কাজ করে।

বৌদ্ধ ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীরা সাধারণত অপর ধর্ম ও জাতির ক্ষতি করার চেষ্টা করে না তবে অপর কোনো জাতি বৌদ্ধ বা বৌদ্ধ ধর্মের ক্ষতি করুক এটাও তারা চায় না বরং দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধ করে। এ নিয়ম অবলম্বন করার কালে উত্তর কোরিয়া ও বার্মা অদ্যাবধি নিজেদের স্বাধীন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে এবং বামিয়ানের বৌদ্ধ মূর্তি ধ্বংসের জন্য আফগানিস্তানের তালেবান শাসকগণ সমাজতন্ত্রী ও ধর্মনিরপেক্ষ বৌদ্ধ বিশ্বের রক্তচক্ষু হজম করতে বাধ্য হয়েছে।
হিন্দু ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী শুধুমাত্র মুখেই ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে। বাস্তবে হিন্দু ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, হিন্দু কম্যুনিস্টরা-হিন্দু মৌলবাদী দলসমূহ অন্যান্য ধর্ম ও ধর্মের অনুসারীদের অস্তিত্ব পর্যন্ত সহ্য করতে রাজি নয়। এ জন্য ভারতে মসজিদ, গীর্জা ও প্যাগাডোর ওপর নিয়মিত হামলা করা হয়। ভিন্ন ধর্মের জনগণ ও নিম্নবর্ণের হরিজনদের ভারতে নিয়মিত কচুকাটা করা হয় এবং সংশ্লিষ্ট অপরাধীরা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে অবস্থান করে ধর্মনিরপেক্ষতার অমীয় বাণী প্রচার করতে থাকেন। তদুপরি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, কম্যুনিস্ট, সমাজবাদী বা মৌলবাদী নির্বিশেষে সকল হিন্দু ঘটা করে হরেক রকমের মূর্তিপূজায় নিষ্ঠার সাথে অংশগ্রহণ করেন।

উপরোক্ত তিন প্রকারের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের কমন বৈশিষ্ট্য হলো, তারা সবাই দেশপ্রেমিক। তারা নিজেদের ধর্ম বা জাতির ওপর অন্য ধর্ম বা জাতির আগ্রাসন বরদাস্ত করে না, নিজ জাতির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বও আত্মমর্যাদাবোধ রক্ষায় সদা-সর্বদা সচেষ্ট থাকে।

আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষবাদের আজব সৃষ্টি হলো মুসলমান নামধারী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা। তারা নিজেদের ধর্মকে কটাক্ষ করে, ধর্ম নেতাদেরকে বিদ্রপ করে নিজ ধর্মের লোকজনকে বিশ্বাস না করে অপর সংখ্যালঘু ধর্মবিশ্বাসীদের মাঝে নিজেদের নিরাপত্তা খোঁজে। তারা নিজেদের ধর্মের বিরুদ্ধে, নিজের জাতির বিরুদ্ধে এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পক্ষে অবস্থান করে নিজের জাতীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আত্মমর্যাদাবোধকে বৈষয়িক স্বার্থের বিনিময়ে বিকিয়ে দেয়। নিজ ধর্মের প্রচারপ্রসার বাধা দেয়। ধর্মীয় নেতাদের ওপর জুলুম, নির্যাতন চালায়। ধর্মীয় শিক্ষা, সংস্কৃতি ও চেতনাকে ধ্বংস করতে সদাসবর্দা সচেষ্ট থাকে। বিদেশী প্রভুদের স্বার্থে তারা স্বদেশের উনড়বতি, অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করে এবং গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে স্বৈরাচারের সাথে, সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে আঁতাত করে দেশের সর্বনাশ সাধন করে। সর্বোপরি শুধুমাত্র নিজেদের ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থে তারা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে ডেকে এনে স্বদেশ দখলে ও লুঠতরাজে সাহায্য করে। লক্ষ কোটি স্বদেশবাসীর লাশ মাড়িয়ে তারা সাম্রাজ্যবাদের পুতুল সরকারে অংশ নিয়ে স্বদেশী হত্যায় অংশ নেয় ও গর্ববোধ করে।
তাদের উপরোক্ত অপকর্মের দুএকটি সাম্প্রতিক উদাহরণ নিম্নরূপ :
১. ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী তুর্কী সেনাবাহিনী, আলজেরিয় সেনাবাহিনী, পাকিস্তান সেনাবাহিনী সাম্রাজ্যবাদী (ধর্মনিরপেক্ষ!)- দের স্বার্থে নিজ দেশের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছে এবং দেশবাসীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ করেছে।
২. তারা ইরাকে, আফগানিস্তানে, সোমালিয়ায় ও সুদানে খ্রিস্টান ধর্মনিরপেক্ষ, সেনাবাহিনী ডেকে এনে তাদেরকে দিয়ে নিজেদের মা-বোনকে ধর্ষণ করাচ্ছে, ভাইবোন, মা-বাপ, আত্মীয়-স্বজনকে জুলুম, নির্যাতন ও হত্যার ব্যবস্থা করেছে এবং নিজ দেশের মূল্যবান সম্পদ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের অভিভাবকদের দেশে পাচার করে দেশকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে।

ফিলিস্তিনের দিকে তাকিয়ে দেখুন। সেখানে দুটি দল। একটি হলো ধর্মীয় দল হামাস অপরটি হলো ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী দল ফাতাহ। নির্বাচনে ধর্মীয় দল হামাস বিজয়ী হলে ফাতাহতার ধর্মনিরপেক্ষতা-বাদী অভিভাবক আমেরিকা ও ইহুদী ইসরাইলের বরকন্দাজের ভূমিকায় অবস্থান নিয়ে স্বদেশবাসীকে হত্যা করছে এবং স্বদেশের স্বাধীনতার সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করছে। অথচ পার্শ্ববর্তী ভারতে যখন ধর্মীয় দল বিজেপি ক্ষমতায় এল তখন কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী হিন্দুরা বিদেশীদের নিজেদের দেশে ডেকে আনেনি। পাকিস্তানের দিকে তাকিয়ে দেখুন। ধর্মনিরপেক্ষ পারভেজ মোশাররফ স্বীয় দেশের প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রকে সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু করেছে, এতদসত্ত্বেও তার পতন আসন্ন হওয়ায় অপর দুর্নীতিবাজ ধর্মনিরপেক্ষ নেত্রী বেনজীর, মোশাররফের সাথে হাত মিলিয়ে নিজ দেশকে সাম্রাজ্যবাদের হাতে সমর্পণের ব্যবস্থা করছে

মুসলিম ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের বাস্তব অবস্থা অনেকটা ঢাকার এডিস মশার ন্যায়, যে মশা ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণু বহন করে মানুষকে রোগগ্রস্ত করে ও মৃত্যু ঘটায়। আর মুসলিম ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা সাম্রাজ্যবাদী জীবাণু বহন করে স্বদেশে ছড়িয়ে দিয়ে জাতিকে ডেঙ্গু রোগীতে পরিণত করে। পাঠকবৃন্দ যদি আমার বক্তব্যের সাথে একমত হন তবে কালবিলম্ব না করে সকল এডিস মশা ও তাদের ভাবশিষ্যদের নির্মূলে এগিয়ে আসুন। অন্যথায় সাম্রাজ্যবাদের জীবাণুবাহী ধর্মনিরপেক্ষ এডিস মশা আপনার দেশকে ইরাক ও আফগানিস্তান বানিয়ে ছাড়বে।

অদূর ভবিষ্যতে (আল্লাহ না করুন) যদি ইরান বা আমার প্রিয় মাতৃভূমিতে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন হয় তবে আমি নিশ্চিত, সংশ্লিষ্ট দেশের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও সমাজতন্ত্রীরাই সাম্রাজ্যবাদের বাহন হবে আর স্বদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রাণ দেবে ধর্মের পক্ষের জনগণ। সকলের অবগতির জন্য এ মতবাদের অতীত বর্তমান সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করছি।
তত্ত্বগতভাবে ধর্মীয় প্রবণতাকে মানুষের ব্যক্তিজীবনে সীমাবদ্ধ রেখে সমাজ জীবনের সকল দিক ও বিভাগকে আল্লাহ ও রাসুলের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার নামই ধর্মনিরপেক্ষতা। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ধর্মকে পরিত্যাগ করাই এর লক্ষ্য।

তাদের মতে, আল্লাহ এ বিশ্বটা শুধু সৃষ্টি করেছেন, বড়জোর তিনি এ জড়জগতের নিয়ম-কানুন (প্রাকৃতিক নিয়ম) রচয়িতা, মানুষকেও না হয় তিনি পয়দা করেছেন। তাঁকে পূজা-আর্চনা করলে মৃত্যুর পর কোনো কাজে লাগলেও লাগতে পারে। কিন্তু দুনিয়ার জীবনে উন্নতি শান্তি ও প্রগতির জন্য আল্লাহ বা রাসুলের কোনো প্রয়োজন নেই। এটাই আল্লাহ সম্পর্কে বিশুদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা। তাদের মতে, ধর্ম নিতান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। দুই বা ততোধিক মানুষের সকল প্রকার পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণে ধর্মকে অনধিকার প্রবেশ করতে দেয়া যায় না। কেননা সমাজ জীবনে ধর্মের প্রভাব সম্পূর্ণ প্রগতিবিরোধী এবং প্রতিক্রিয়াশীলতার পরিচায়ক।

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের আর একটি আপাত সুন্দর যুক্তি হলো, একটি দেশে ও পৃথিবীতে বহু ধর্মের লোক বাস করে এছাড়াও রয়েছে বহু উপ-ধর্ম সম্প্রদায় ও নাস্তিক। এমতাবস্থায় ধর্মীয় মতবাদের শাসনে পৃথিবীর দেশে দেশে ধর্মীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় কর্তৃক ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় শোষিত, নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হবে। সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষতা মতবাদ সকল আস্তিক ও নাস্তিকের প্রতি সমআচরণের ব্যবস্থা করতে পারে।

বাস্তবে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ হলো, আল্লাহর ইনসাফপূর্ণ বিধানকে দূরে সরিয়ে রেখে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের লোভ,স্বেচ্ছাচারিতা ও বেআইনি কার্যকলাপের পথে প্রতিবন্ধক কল্যাণকর নীতি-আদর্শ থেকে পলায়নের মনোবৃত্তি। সত্যিকারভাবে কোনো মানুষ কখনো ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে না, কেননা প্রম মানব হযরত আদম (আ.) থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত মানুষের সাথে, মানব সভ্যতার সাথে কোনো না কোনো ধর্ম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এমনকি ইতিহাসে যাদেরকে আমরা কাফের হিসেবে জানি তারাও কোনো না কোনো প্রকার ধর্মকে বা মাবুদকে মান্য করতো। উদাহারণ স্বরূপ ফেরআউন-নমরুদের দরবারেও প্রধান ধর্মীয় পুরোহিত ছিল এবং আবু জেহেল, আবু লাহাবের আরাধ্য দেবতা ছিল লাত, উজজা, হুবল ও মানাত। আর যে বৌদ্ধদের মাঝে আল্লাহর ধারণা নাই তারা গৌতমবুদ্ধকে আল্লাহর আসনে প্রতিষ্ঠা করে পূজা-আর্চনা করছে। বর্তমান পৃথিবীতেও এমন কোনো দেশ-জাতি বা সভ্যতা নাই যারা কোনো না কোনো ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত নয়। এ প্রসঙ্গে স্বনামধন্য মনীষীদের অভিমত নিম্নরূপ:
১। ঐতিহাসিক টয়েনবির মতে, মানুষের ইতিহাস হলো একাধিক সভ্যতার ইতিহাস। এক একটি সভ্যতা গড়ে উঠেছে এক একটি ধর্ম চেতনাকে নির্ভর করে। মিসর ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় ইহুদি ধর্মের প্রভাব, গ্রিক-রোমান সভ্যতায় খ্রিস্টধর্মের প্রভাব ভারতীয় সভ্যতায় হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, ইসলাম ধর্মের প্রভাব, চৈনিক সভ্যতায় কনফুসিয়াস ও লাও ধর্মের প্রভাব, পারস্য সভ্যতায় যরদুস্তর ধর্মের প্রভাব আর ইসলামী সভ্যতায় ইসলাম ধর্মের প্রভাব অস্বীকার করা মানে ইতিহাসকে অস্বীকার করা। (সূত্র : জাতির উত্থান-পতন, সূত্র : প্রবন্ধকার, পৃ. ১৭২)
২। আইনের ইতিহাসের প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ স্যার হ্যানরি মান লিখেছেন, ‘সুষ্ঠুভাবে লিখিত এমন কোনো আইনব্যবস্থা চীন থেকে পেরু পর্যন্ত কোথাও পাওয়া যাবে না, যা তার সূচনাকাল থেকেই ধর্মীয় বিধিব্যবস্থা ও উপাসনারীতির সাথে সম্পৃক্ত নয়। (সূত্র : , পৃ. ১৭২)।
৩। ড. ফ্রাউডম্যান বলেছেন, ‘ন্যায়বিচারর সত্যিকার মাপকাঠি নির্ধারণের জন্য ধর্মের দিকনির্দেশনা ছাড়া অন্যকিছু পাওয়া যাবে না। আর ন্যায়-বিচারের দৃষ্টান্ত মূলক ধারণাকে বাস্তবরূপ দেয়ার জন্য ধর্ম প্রদত্ত ভিত্তিই হচ্ছে সবচেয়ে স্বাভাবিক ও অকৃত্রিম ভিত্তি। (সূত্র : ঐ, পৃ. ১৭২)।

ধর্মনিরপেক্ষতা মতবাদের উদ্ভব ও বিকাশ:
এই মতবাদ নতুন আবিষ্কৃত কোনো বিষয় নয়মানব সভ্যতার শুরু থেকে বিভিন্ন লোভী, স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী ধর্মীয় আইনের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যথেচ্ছাচার করার মানসে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কেননা প্রাচীনকাল থেকে অদ্যাবধি কোনো শক্তিশালী শাসক স্রষ্টাকে অস্বীকার করার দুঃসাহস করেনি। তবে কেউ কেউ নিজেকে খোদা বা খোদার ছায়া দাবি করে নিজের সৃষ্ট ধর্ম জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। অপরদিকে বিভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় নেতা কর্তৃক ধর্মগ্রন্থসমূহ বিকৃত হয়ে ঐশ্বরিক স্পিরিটশূন্য হওয়ায় চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গ অনেক ক্ষেত্রে উক্ত বিকৃত কাল্পনিক ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা বা ধর্মবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। আলোচনার সুবিধার্থে আমরা এই মতবাদের উদ্ভব ও বিকাশের ২টি পর্ব উল্লেখ করছি।
(ক) গ্রিক বা হেলেনীয় যুগ : বিকৃত ধর্মগ্রন্থের ফলে অসংখ্য দেবদেবীর উপসনাকারী গ্রীকগণ শতধা বিচ্ছিন্ন হয়ে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়। সমগ্র গ্রীসে অসংখ্য ক্ষুদ্র রাজ্য স্থাপিত হয়। কল্পনাবিলাসী গ্রীকগণ চরম ভোগবিলাস ও যৌন উচ্ছৃঙ্খলতায় নিমজ্জিত হয়। এ সময় থেন্সে জন্ম নেয় পৃথিবীর সেরা তিনজন দার্শনিক এবং উক্ত দর্শন পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দেন দিগবিজয়ী আলেকজান্ডার। নীতি-নৈতিকতাহীন অধঃপতিত গ্রিক সভ্যতার ধ্বংস¯তূপে আবির্ভাব হয় ক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল ও আলেকজান্ডারের। বস্তুত উক্ত তিন দার্শনিকের চিন্তাধারাই বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের মূলভিত্তি। উক্ত তিন দার্শনিকের চিন্তাধারা ও মতবাদ সংক্ষেপে নিম্নরূপ :

সক্রেটিসঃ
(ক) তিনি অসংখ্য ঈশ্বরের স্থলে এক ঈশ্বর চিন্তার সূত্রপাত করেন। প্রমে তিনি ভালো ও মন্দের স্বরূপ নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেন। তার দৃষ্টিতে ভালো ও মন্দের পার্থক্য একটি দার্শনিক পার্থক্য মাত্র। মানুষ তার সঙ্কীর্ণ দৃষ্টি ও জ্ঞানের দরুন কোন উচ্চতর অথচ দূরতম মঙ্গলকে নিম্নতর অথচ নিকটতম মঙ্গলের জন্য বিসর্জন দেবে এটিই হচ্ছে মন্দ। তার দৃষ্টিতে ভালো ও মন্দ মানুষের পার্থক্য হচ্ছে প্রমোক্ত ব্যক্তি তার কাজের শেষ পরিণতির কথা চিন্তা করে আর পরবর্তী ব্যক্তি উপস্থিত লাভ-ক্ষতির বিবেচনায় নিজেকে পরিচালিত করে।
(খ) তার দৃষ্টিতে পুণ্য হচ্ছে জ্ঞান আর পাপ হলো অজ্ঞতা। তার মতে, একটি উত্তম নৈতিকতা সৃষ্টির জন্য মানুষকে তার সামাজিক রীতিনীতি থেকে সরে এসে নিছক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্ত বিষয়-আশয় সম্পর্কে চিন্তা করা উচিত।

প্লেটো
তিনি ভাবজগত বা আধ্যাত্মিক জগৎকে জড়জগৎ থেকে সম্পূর্ণ পৃক করে এক কঠোর দ্বৈতবাদের সূচনা করেন। প্লেটোর দর্শনে আল্লাহ এবং জড়জগৎ উভয়ই নিজ নিজ স্থানে দুটি স্বতন্ত্র সত্য। প্লেটো ধারণামূলক সত্য বা আল্লাহকে জগৎ থেকে পৃক বা ভিন্ন সাব্যস্ত করেন। তিনি আত্মার পুনর্জন্মবাদের ধারণা সৃষ্টি করেন। প্লেটো এই দুটি ধারণাকে এতই যুক্তিপূর্ণ ও শক্তিশালীভাবে উপস্থাপন করেন যে, যার ফলে বিভিন্ন ধর্মের দার্শনিকগণ পরবর্তীকালে প্লেটোর দর্শনের বেড়াজালে পতিত হয়ে নিজেদের ঐশী জ্ঞানকে বিকৃত করে ফেলেন।

এরিস্টটল
তার মতে, আল্লাহ জগতের স্রষ্টা নন। কেননা জগৎ-পূর্ব থেকেই বিদ্যমান ছিল। তিনি আল্লাহকে জগতের গতিদানকারী সাব্যস্ত করেন। তবে একবার গতিদানের পর তিনি জগৎ সম্পর্কে নিস্পৃহ এবং বেখবর। এরিস্টটলের দর্শনে জগৎ আল্লাহর সাথে সংযুক্ত ও সম্পর্কিত কিন্তু আল্লাহ জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন ও সম্পর্কহীন। উক্ত তিন দার্শনিকের চিন্তাধারা ও যুক্তিসমূহ স্রষ্টা কর্তৃক প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত না হয়েও অনুসন্ধিৎসু মানুষকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। ফলে তারা ঐশী ধর্মের বিপরীতে এক শক্তিশালী শিরকপূর্ণ ও বস্তুবাদী মতবাদের প্রতিষ্ঠা করেন। উক্ত মতবাদসমূহের বিষময় ফল হলো :
(১) ধর্ম সাধারণ মানুষের চিন্তার অতীত বিষয়।
(২) আল্লাহ এবং জড়জগৎ যেহেতু স্বতন্ত্র সেহেতু দুনিয়ার জীবনে আল্লাহর প্রয়োজন হবে কেন।
(৩) আল্লাহ যেহেতু জগৎকে একবার গতিদানের পর সম্পূর্ণ বেখবর সুতরাং আল্লাহকে বা ঈশ্বরকে পূজা না করে মানুষ পরবর্তীকালে আল্লাহর ছায়া, প্রতিনিধি, কাল্পনিক মূর্তিকে, দেবতাকে পূজা করা শুরু করে। আর যারা এসবে আকৃষ্ট হননি তারা কেউ পরবর্তী সময়ে বৈরাগ্যবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, সমাজতন্ত্র বা নৈরাজ্যবাদের কবলে পতিত হয়।

আধুনিক যুগ : ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের আধুনিক সংস্করণ প্রায় আড়াইশবছর পূর্বে ইউরোপে প্রম প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পনের শতকে এর জন্ম এবং আঠার শতকের শুরুতে তা বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। যে সকল কারণে প্রাচীন গ্রিসে এ মতবাদ চালু হয় প্রায় একই রূপ কারণে ইউরোপে এর উদ্ভব ও বিকাশ হয়। এর উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা পেতে এর জন্মস্থান ইউরোপ, বিশেষ করে ফ্রান্সের সমকালীন ধর্মীয় অবস্থা, ধর্মযাজক, শাসক সম্প্রদায়, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণের সমকালীন অবস্থা অবহিত হতে হবে।

ধর্মীয় অবস্থা : তৎকালে সমগ্র ইউরোপে বিকৃত খ্রিস্টান ধর্ম চালু ছিল এবং এখনো চালু রয়েছে। হযরত ঈসা (আ.)-এর অন্তর্ধানের পর থেকেই মূলত তাঁর অনুসারীগণ কর্তৃক ধর্ম বিকৃতি শুরু হয়। পবিত্র কুরআন ষষ্ঠ শতাব্দীতেই এই ধর্মের বিকৃতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ঘোষণা প্রদান করেছে। এ সংক্রান্ত ঐতিহাসিক তথ্যাদি সংক্ষেপে নিম্নরূপ :
(১) খ্রিস্ট্রীয় গির্জার প্রম শত বছরে যে মতবাদ লিখিত ও চালু ছিল তা ছিল জুডিও খ্রিস্টান মতবাদ সংবলিত রচনা।
(২) জুডিও খ্রিস্টানিটি ও পৌলিও খ্রিস্টানিটি নিয়ে দ্বন্দ্ব চলাকালীন সময়ে লিখিত হয়েছিল মার্ক, মথি, লুক, যোহনের সুসমাচারসমূহ।
(৩) ৩২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মিসর ও আলেকজান্দ্রিয়ার গির্জাসমূহে বার্নাবাস লিখিত সুসমাচার আইনসম্মত ধর্মগ্রন্থ হিসেবে চালু ছিল। ৩২৫ সালে Nicen Council আইন করে মূল হিব্রভাষার বাইবেল ধ্বংস করে এবং সেসব গ্রন্থের সংরক্ষণকারীদের মৃত্যুদণ্ডের বিধান দেয়। পাশ্চাত্য গির্জাসমূহের ৩৮২ খ্রিস্টাব্দের ডিক্রি বলে পোপ ইনোসেন্ট ৪৬৫ সালে বার্নাবাসের সুসমাচার নিষিদ্ধ করেন। সর্বশেষ Glesian Decree of 496-এর মাধ্যমে অসংখ্য গসপেলের সাথে ইভানজেলিজম বার্নাবিও নিষিদ্ধ করা হয়। এভাবে পৌলিও খ্রিস্টানগণ কর্তৃক মূল ইঞ্জিল কিতাবের পরিবর্তে গ্রিক দর্শন ও রোমান পৌত্তলিকতাসমৃদ্ধ বর্তমান বাইবেলের বিজয় নিশ্চিত করা হয়।
(৪) এছাড়াও রয়েছে আলেকজান্দ্রিয়ার ইহুদিগণ কর্তৃক রচিত সেপ্টোজিস্ট (পুরাতন নিয়ম) নামক বাইবেল যার ভিত্তিতে পরবর্তীতে রচিত হয় বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট
(৫) এছাড়াও রয়েছে বাইবেলের Codex Vaticanus, Codex Sinaiticus, Vulget I walton Bibel London (1657) নামক সংস্করণসমূহ

খ্রিস্টানদের গির্জার যেমন বিভিন্নতা রয়েছে, তেমনি গির্জাভিত্তিক বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা বাইবেল। পর্যায়ক্রমে ২ হাজার বছর যাবৎ খ্রিস্টান পাদ্রি-পুরোহিতগণ নিজেদের ভোগবাদী স্বার্থের অনুকূলে ধর্মগ্রন্থকে বারবার পরিবর্তন করে ঐশী স্পিরিট শূন্য করেছে। আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের উদ্ভবের সময় ইউরোপে এবং ফ্রান্সে পাদ্রি-পুরোহিতদের বৈষয়িক স্বার্থে উক্ত বিকৃত ধর্মগ্রন্থগুলো অনুসরণ করা হতো এবং ধর্মের নামে জনগণকে পৈচাশিক শাসন, শোষণ, নিষ্পেষণ করা হতো।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ফরাসি বিপ্লবের সময়ে ফ্রান্সে ধর্মযাজকদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ লাখ ৩০ হজার। তন্মধ্যে ১৩৯ জন ছিল বিশপ, বাকিরা ছিল পাদ্রি। বিশপরা ছিল অভিজাত বংশের, পাদ্রিরা ছিল তৃতীয় শ্রেণীর জনসমাজ থেকে আগত। জনগণ গির্জাকে ধর্মকর, মৃত্যুকর, বিবাহকর ও অন্যান্য পার্বন উপলক্ষে কর দিতে হতো। গির্জার বার্ষিক আয় ছিল প্রায় ১৩ কোটি লিভ্র। এর অধিকাংশই বিশপরা ভোগ করতো। নিম্নশ্রেণীর পাদ্রিরা খুব সামান্য ভাগ পেতো। যা দিয়ে তারা অতি কষ্টে দিনাতিপাত করতো। বিপ্লবের সময় এ সকল পাদ্রি বিপ্লবের পক্ষে ছিল।

অভিজাত শ্রেণী বা শাসক সম্প্রদায় : তখন ফ্রান্সের মোট লোকসংখ্যা ছিল ২৫ লাখ। ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম নেতা অ্যাবেসিয়েসের মতে, তখন ফ্রান্সে অভিজাতদের মোট সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১০ হাজার। দেশের মোট জমির তিন ভাগের এক অংশ ছিল তাদের মালিকানাধীন। রাজার সভাসদ, সেনাপতি, বিচার বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তা, মন্ত্রী, রাজদূত, প্রাদেশিক শাসনকর্তা, প্রশাসক, আইনবিদ, জমিদার ও ইন্টেনডেন্টগণ এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। তারা নামের পূর্বে লর্ড, ব্যারন ও মার্কুইস খেতাব ব্যবহার করতো। দার্শনিক মন্টেস্কুর ভাষায় : যারা রাজার সাথে সাক্ষাৎ করতে পারে, মন্ত্রীর সাথে বাক্যালাপ করতে পারে, যাদের বংশ কৌলিন্য আছে, ঋণ ও পেনশন আছে তারাই অভিজাত।

তৃতীয় শ্রেণী : ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, কৃষক, ভূমিহীন ও ভবঘুরে শ্রেণী ছিল তৃতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এরা ছিল দেশের ৯৩ শতাংশ জনগোষ্ঠী। যাজকশ্রেণী ও অভিজাত শ্রেণীর শাসন, শোষণ, নিপীড়ন এদেরকেই সহ্য করতে হতো। এ শ্রেণীর ব্যবসায়ী ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীই ছিল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ফরাসি বিপ্লবের চালিকাশক্তি। এদের আহ্বানে ও নেতৃত্বে কৃষক, ভূমিহীন ও ভবঘুরে শ্রেণী ঐক্যবদ্ধ হয়ে ফরাসি বিপ্লব সংগঠিত করে। ধর্মের নামে চরম অধার্মিক শাসন-শোষণ এদেরকে প্রমে অভিজাত শ্রেণীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহে অনুপ্রাণিত করে এবং পরবর্তীতে অভিজাত শ্রেণীর ছত্রছায়া দানকারী যাজক ও গির্জার বিরুদ্ধে এবং প্রকারান্তরে ধর্মের বিরুদ্ধে তৃতীয় শ্রেণীর জনগণ বিদ্রোহ করে। গির্জার নেতৃত্বে শাসকশ্রেণী যতোই বিদ্রোহ দমনে সচেষ্ট হয় ততোই জনগণ ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এক পর্যায়ে ধর্মবিরোধী শক্তিতে পরিণত হয়।

গির্জাকেন্দ্রিক যাজক সম্প্রদায় ও অভিজাতদের বিরুদ্ধে ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব বিজয়ী হওয়ার পর সমগ্র ইউরোপে ধর্মবিরোধী বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে। উভয়পক্ষ প্রচণ্ড সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। অবশেষে আপোষ প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসেন মার্টিন লুথা কিং। তার আন্দোলন ইতিহাসে আপোষ আন্দোলন নামে খ্যাত। এ আন্দোলনের প্রস্তাব ছিল, ‘ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে সীমাবদ্ধ থাকুক এবং মানুষের ধর্মীয় জীবনের পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকবে চার্চের হাতে। কিন্তু সমাজের পার্থিব জীবনে সকল দিকের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব রাষ্ট্রের ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং পার্থিব কোনো বিষয়েই চার্চের কোনো কর্তৃত্ব থাকবে না। অবশ্য রাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দকে চার্চের নিকটেই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের শপথ নিতে হবে। এ প্রস্তাব উভয়পক্ষ মেনে নিলো। ধর্মনেতাদের সান্তনা ছিল, রাষ্ট্র পরিচালকদের চার্চের নিকট শপথ গ্রহণ করার বাধ্যবাধকতায় পাদ্রিদের সম্মান রক্ষা পেল। আর বিদ্রোহীরা চিন্তা করলো পার্থিব জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই যদি ধর্ম ও গির্জা প্রাধান্য না পায় তবে বিষদাঁতহীন এ সাপকে ভয় করার কোনো কারণ নেই। এভাবে ফরাসি বিপ্লবে ভোগবাদী যাজক ও অভিজাত শ্রেণীকে উদীয়মান বুদ্ধিজীবী ও ব্যবসায়ী শ্রেণী ক্ষমতাচ্যুত করে। ঐতিহাসিক লেফেভার বলেন, ফরাসি বিপ্লব শেষ পর্যন্ত প্যাট্রিসিয়ান বা অভিজাত শ্রেণীকে ক্ষমতাচ্যুত করে বুর্জোয়া শ্রেণীর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।

ফরাসি বিপ্লবের মনস্তাত্ত্বিক কারণ : ফরাসিবিপ্লবের এবং ইউরোপীয় রেনেসাঁর প্রধান কারণগুলো ছিল বিকৃত ধর্মগ্রন্থের মাধ্যমে যাজকতন্ত্রের ধর্মের নামে অধার্মিক শাসন-শোষণ, খ্রিস্টান শাসকদের জনগণের খোদার অবস্থানে আসন গ্রহণ, বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর উত্থান, অবৈজ্ঞানিক ধর্মের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব ও নতুন ব্যবসায়ী শ্রেণীর উত্থান। তবে এসবের মধ্যে সর্বপ্রধান কারণ নিঃসন্দেহে সভ্যতার আলোকপ্রাপ্ত বুদ্ধিজীবীগণ। উক্ত বুদ্ধিজীবীদের যুক্তিপূর্ণ মতবাদসমূহই মূলত সর্বস্তরের জনগণকে গির্জাতান্ত্রিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে অনুপ্রেরণা দেয়। আমার মতে, ইউরোপীয় মুক্তি সংগ্রাম কখনো ধর্মবিরোধী হতো না যদি তখনকার ইউরোপীয় ধর্ম যুক্তি ও বিজ্ঞানবিরোধী না হতো।

এখন প্রশ্ন হলো যে মহাদেশের ধর্মযাজকগণ অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত, যে মহাদেশের শাসকগণের নিকট মানবীয় মূল্যবোধ সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল, সে মহাদেশে আলোকিত বুদ্ধিজীবী এলো কোত্থেকে? প্রশ্নের সদুত্তরও রয়েছে ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবীদের স্বীকারোক্তিতে। উক্ত স্বীকারোক্তির কয়েকটি নিম্নরূপ :
১। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন, ‘আরবরাই ৮ম শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ১৩ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত সমগ্র বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তি ও সভ্যতার আলোকবর্তিকাবাহী, যাদের মাধ্যমে প্রাচীন বিজ্ঞান ও দর্শন হয়েছিল পুনরুজ্জীবিত, সংযোজিত ও সম্প্রসারিত।(History of the Arabs, Page 557)
২। দার্শনিক রজার বেকন তার ছাত্রদেরকে বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে জ্ঞান আহরণের একমাত্র উপায় হলো, আরবি ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন।’ (সূত্র : জর্জ সার্টন, An Introduction to the History of Science, Vol.-1 Baltimore, 1927,Page-17|
৩। During the Darkest Period of European History the Arabs for five hundred years held up the torch of Learning to humanity. (সূত্র : Revernd Boswath Smith,Mohammad and Mohamedanism)
৪। বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদানশীর্ষক প্রবন্ধে ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশের সাবেক মহাপরিচালক সৈয়দ আশরাফ আলী লিখেছেন, ‘পোপ জারাবার্তের (১০৯৯- ১১০৩) ন্যায় বিখ্যাত ধর্ম সংস্কারক ও শিক্ষাবিদ কর্ডোভা মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন।
৫। উক্ত প্রবন্ধে তিনি আরো লিখেন, ‘লন্ডনস্থ বিজ্ঞান জাদুঘরে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বিধৃত রয়েছে যে, Were it not for Islam, Greek Learning Might not have Survived the dark age. (অর্থাৎ মুসলমান জ্ঞানসাধকরাই গ্রিক জ্ঞান বিজ্ঞানকে অতীতের অন্ধকার থেকে বর্তমানের আলোয় এনেছেন)।

ইতিপূর্বেকার আলোচনা ও উদ্ধৃতিসমূহ থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, জ্ঞান বিজ্ঞান-ধর্ম-মানবিক মূল্যবোধ, সুশাসন ও জনকল্যাণমূলক চিন্তা ভাবনার সাথে অপরিচিত অন্ধকার ইউরোপ মহাদেশের কিছুসংখ্যক জ্ঞানপিপাসু ইউরোপীয় নাগরিক বাগদাদ, কায়রো, কর্ডোভা, স্পেন, সেভিল ও মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য স্থানে স্থাপিত মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন শেষে স্বদেশে গিয়ে জ্ঞানের মশাল প্রজ্বলিত করার কাজ শুরু করেন। তাদের সংগ্রাম ও প্রচেষ্টায় ইউরোপের মানুষ সজাগ ও সচেতন হয়ে বিজ্ঞান ও যুক্তিহীন ধর্মের বিরুদ্ধে এবং রক্তলোলুপ স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঝাণ্ডা উত্তোলন করে। কায়েমী স্বার্থবাদী ধর্মযাজকগণ স্বৈরাচারী রাজাদের সহায়তায় বিদ্রোহীদের ওপর চরম দমননিপীড়ন চালায়। ফলে বিপ্লবীরা এক পর্যায়ে ধর্ম, যাজকতন্ত্র ও অভিজাত শ্রেণীকে অস্বীকার করে। দীর্ঘ ২শবছরের সংগ্রামের পর বুর্জোয়া, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ জনতার বিজয় সূচিত হয়। বিজয়ের শুরুতে প্রমে ১৬৮৮ সালে ইংল্যান্ডের স্বৈরতন্ত্র ধ্বংস হয়, ১৭৭৬ সালে স্বৈরাচারী ইংল্যান্ডের শাসন থেকে আমেরিকা মুক্ত হয় এবং ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে ফরাসি অভিজাত শ্রেণী ও যাজকশ্রেণীর স্বৈরতান্ত্রিক জুলুমের অবসান হয় এবং খ্রিস্টানধর্ম বিরোধী বুর্জোয়া ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর রাজত্ব কায়েম হয়।

অথচ পরিতাপের বিষয়, এতো ত্যাগতিতীক্ষা, সংগ্রাম, রক্তদানের পরও কিন্তু ইউরোপে হানাহানি, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও মানবতার ধ্বংসযজ্ঞ অদ্যাবধি বন্ধ হয়নি। জনগণ অত্যাচারী ও স্বৈরাচারী শাসকদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পরপরই পুঁজিপতি বুর্জোয়া শ্রেণীর যাঁতাকলে পিষ্ট হতে থাকে। পূর্বে তারা যাজক ও অভিজাতশ্রেণী কর্তৃক নিগৃহীত হয়েছিল, বিপ্লবের পর রক্তশোষক সুদখোর মহাজন, পুঁজিবাদী বুর্জোয়াদের ও স্বৈরাচারী একনায়কদের শাসন-শোষণে নিষ্পেষিত হতে থাকে। সর্ব মানবের কল্যাণোপযোগী কোনো নীতি-আদর্শ বা ধর্ম সকল পক্ষের নিকটই অজানা বিধায় একশ্রেণীর অপসারণের পর অন্যশ্রেণী ক্ষমতায় এলেও দৃশ্যপটের কোনো পরিবর্তন হয় নাই।

যাজক-অভিজাতশ্রেণীকে অপসারণ করে বুর্জোয়া শ্রেণী ক্ষমতায় আসার পর জনগণের অবস্থা পূর্ববত তিমিরেই থেকে যায়। ক্রমে ক্রমে গণঅসন্তোষ ব্যাপকতা লাভ করে। এহেন অবস্থায় সংকট মোচনে অনেক হাতুড়ে ডাক্তার, কবিরাজ, বৈদ্য, বুদ্ধিজীবীর পরিচয়ে ইউরোপের ভূমিতে আবির্ভূত হতে থাকে। ইউরোপের জনগণ তখন যে কোনো নতুন মতবাদকে নিয়ে মাতামাতি শুরু করে দেয়। এ সময়কার সকল ডাক্তার, কবিরাজের কাহিনী লিখতে গেলে মহাকাব্য হয়ে যাবে। প্রবন্ধের কলেবরে তা সম্ভবও নয়। তাই আমি সংক্ষেপে এরূপ কয়েকজন ইউরোপীয় পণ্ডিত অথবা তথাকথিত দার্শনিকদের দর্শন সম্পর্কে ও এর পরিণতি সম্পর্কে আলোকপাত করবো।
১. কার্লমাক্স ও সমাজতন্ত্র : তিনি দেখলেন, কূপমুণ্ডুক যাজকতন্ত্র ও অভিজাতদের রাজতন্ত্র থেকে দেশের শাসনক্ষমতা পুঁজিপতি ও ব্যবসায়ীদের নিকট হস্তান্তর হওয়ায় জনগণের অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় তিনি সর্বহারার শাসন কায়েমের আহ্বান করলেন। সংক্ষেপে সমাজতন্ত্র ও তার পরিণাম নিম্নরূপ :
সমাজতন্ত্রের মূলকথা : ভূমি ও শিল্পসম্পর্কিত পুঁজির ক্ষেত্রে সব ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার বিলোপ করে একে সামাজিক ও যৌথ স্বত্বাধিকারের আওতায় বা যৌথ মালিকানায় আনতে হবে। সংক্ষেপে সমাজতন্ত্র হচ্ছে এমন একটি আন্দোলন যা দেশের সকল ভূমি ও শিল্পপুঁজিকে সমাজতান্ত্রিক দলের প্রশাসনের দ্বারা পরিচালনার ব্যবস্থা করবে। এতে কার্যত কিছুসংখ্যক দলীয় ক্যাডার দেশের সকল ভূমিপুঁজি ভোগ করার অবাধ অধিকার লাভ করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ শ্রমদাসে পরিণত হয়।
বাস্তবে সমাজতন্ত্র : মানুষ যখন দরিদ্র থাকে, তখন তারা প্রায়শঃ উৎসাহ সহকারে (সমাজতান্ত্রিক) পরিকল্পনা উপস্থাপন করে, কিন্তু অর্থশালী হওয়ার পর স্বয়ংক্রিয় ধারায় এতে তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তদুপরি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ভয়ে সকল শ্রেণীর টুঁটি চেপে ধরে সমগ্র দেশকে জেলখানায় পরিণত করে ও জনগণকে রোবটে পরিণত হতে বাধ্য করে।
সমালোচকদের মতে, সমাজতন্ত্রের কাজ হচ্ছে বিফল ও হতাশ মানুষকে সাফল্যের পথ ধরানো আর সফল মানুষকে সর্বস্বান্ত করা।

মেকিয়াভেলীর (১৪৬৯-১৫২৭) রাজনৈতিক দর্শন
পনেরো শতকের মেকিয়াভেলীর দর্শন থেকে আমরা যা পাই তা হলো :
১. তিনি ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা বিষয় হিসেবে সাব্যস্ত করেন এবং নীতি নৈতিকতাকে দুভাগে ভাগ করেন। একটি হলো সরকারি ও অপরটি হলো ব্যক্তিগত।
২. খ্রীস্ট ধর্মের সম্পর্ক থাকবে কেবল অপার্থিব তথা পারলৌকিক জীবনের সঙ্গে। পার্থিব ও জাগতিক জীবনের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
৩. ধর্মভীরু ও সৎ লোকদের কোনো প্রয়োজন রাষ্ট্রের নেই। কেননা ধার্মিকেরা নীতি-নৈতিকতার বাধা অতিক্রম করতে পারে না, অথচ রাজা-বাদশাহ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের শৃগালের মতো ধূর্ত হতে হয়, রাষ্ট্র রাজনীতি ও স্বার্থের প্রয়োজনে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ, মিথ্যা কথন, ধোঁকা ও প্রতারণা, খেয়ানত ও মুনাফেকীর ন্যায় কার্যক্র পরিচালনা করতে হয়।

ডারউইনের বিবর্তনবাদ
১৮৫৯ সালে চার্লস ডারউইন তার চমকসৃষ্টিকারী বই Origin of Species (প্রজাতিসমূহের উৎপত্তি) লিখেন। উক্ত বইতে তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, “মানুষ মূলত পশুরই ক্রমবিবর্তিত একটি রূপ মাত্র, যা হাজার হাজার বছরের ক্রমোন্নতি ও ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে জীবাণু বিশেষ (Amoebu) থেকে বানর ও অতঃপর মানবাকৃতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। ডারউইনের যুগে ইউরোপে যে কোনো নতুন মতবাদকে লুফে নেয়ার একটি প্রবণতা ছিল। সুতরাং আর যায় কোথায়? সমগ্র ইউরোপবাসী ধরে নিলো যে, তারা নিশ্চয়ই লাল বানরের পরবর্তী রূপ। সুতরাং বানরের ন্যায় সকল বাঁদরামী করা তাদের মৌরসী অধিকার।

ডারউইনের আর একটি ধ্বংসাত্মক মতবাদ ছিল Survival of the fittestঅর্থাৎ যোগ্যতমরাই অথবা 
শক্তিশালীরাই শুধুমাত্র বেঁচে থাকার অধিকারী আর দুর্বলদেরকে অবশ্যই মরতে হবে। মানবের পশুত্বের মতবাদ ও শক্তিশালী হিংস্র পশুরাই শুধু টিকে থাকবে এরূপ মতবাদ ইউরোপীয় চরিত্রের সাথে এমনভাবে মিশে গেল যে, যেরূপ পানিতে চিনি মিশে যায়। এ জন্যই যুদ্ধ-বিগ্রহ, অপর দেশ ও জাতিকে নিশ্চিহ্ন করা, পাশবশক্তিতে অপরের সর্বস্ব কেড়ে নেয়ার কাজটি ইউরোপ সমগ্র দুনিয়ায় অব্যাহত রেখেছে। মানবতা কাকে বলে, মনুষ্যত্ব কাকে বলে, দয়া-মায়া-মমতা কি জিনিস তা সকল যুগে তাদের নিকট অজ্ঞাত রয়েছে।

ইউরোপের বা পাশ্চাত্যের এরূপ অমানবিকতার ও পশুপ্রবৃত্তির ঐতিহাসিক কারণও রয়েছে। প্রমত, ইউরোপ কখনো কোনো নবী/রাসুলের জন্মস্থান বা কর্মস্থান ছিল না, নবী-রাসুলদের নেতৃত্বাধীন কোনো শাসনব্যবস্থা তারা প্রত্যক্ষ করেনি। নবী/রাসুলের জীবদ্দশায় যে প্রকৃত ধর্ম এশিয়াবাসী সকল যুগে প্রত্যক্ষ করেছে ইউরোপ কখনো তা দেখেনি। কেবলমাত্র আংশিক বা পুরোপুরি বিকৃত ধর্মসমূহ শ্রতি পরস্পরায় ইউরোপে প্রবেশ করেছিল। ফলে এশিয়া যেভাবে দাউদ (আ.), সম্রাট দারায়ুস, সোলায়মান (আ.), মুহাম্মদ (সা.), খলিফা উমর (রা.), খলিফা হারুন,খলিফা মামুন, উমর ইবনে আবদুল আজিজ, আওরঙ্গজেব আলমগীর ও সম্রাট অশোকের ন্যায় শাসক ও শাসনব্যবস্থা পেয়েছিল ইউরোপ তা কখনো পায়নি। আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই- নবী/রাসুল ছাড়াও এশিয়ায় আরো শত শত ন্যায়পরায়ণ শাসক যেরূপ সর্বদা মানবতার কল্যাণ সাধন করেছেন, সমগ্র ইউরোপে এরূপ একজন শাসকও কখনো জন্ম নেয়নি। সমগ্র ইতিহাস খুঁজেও ইউরোপে একজন খলিফা হারুন বা সালাউদ্দীন আইয়ুবীর সন্ধান পাওয়া যাবে না। এ জন্যই অর্থ-বিত্ত-ভোগবিলাসের পক্ষের সকল মতবাদকেই ইউরোপ লুফে নেয়। ডারউইনের মতবাদকেও তারা এভাবে লুফে নিয়েছিল, কোনো প্রকার সত্যাসত্য যাচাই না করে।

ফ্রয়েড/দরখায়েম/কার্ল মার্কসের যৌন মতবাদ : ডারউইন মানুষকে পশু বানিয়েছেন আর ফ্রয়েড মানুষকে পশুর চেয়েও জঘন্য হিসেবে চিত্রিত করেছেন। তিনি বলেছেন, মানুষের সমস্ত কাজের মৌল উৎস হচ্ছে যৌনতা। এ জন্য দার্শনিকটি আরো বলেছেন, ‘শিশু মায়ের স্তন চুষে যৌন সুড়সুড়ি লাভের জন্য। একই কারণে শিশু তার বৃদ্ধাঙ্গুল চুষে থাকে। মানুষ প্রস্রাব-পায়খানা করে যৌন সুখ পায় বলে। তার গ্রন্থিসমূহ নাড়ায় যৌন সুখের আশায়। যৌন সুখের তাড়নায় মানুষ তার মায়ের প্রতি প্রেমবোধ করে। ফ্রয়েডের মতে, মানুষের ধর্ম পালন, নৈতিকতাসহ সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে যৌন-অগ্নি তাপ ও চাপের জন্য। তার মতে, ধর্ম, নৈতিকতা, সমাজ, ঐতিহ্য হচ্ছে মানুষের সাফল্যের পথে প্রতিবন্ধক, তাই এটি বাতিলযোগ্য ও মূল্যহীন। সুতরাং এসবকে অবশ্যই নির্মূল করতে হবে।

দরখায়েম বলেছেন, আইনগত বা নৈতিক নিয়ম-কানুন বলতে কোথাও কিছু নেই। নৈতিকতাবিশারদরা মানুষের নিজের ওপর কর্তব্যসমূহকে নৈতিকতার ভিত্তি সাব্যস্ত করে। আসলে নৈতিকতা স্থিতিশীল কোনো বিষয় নয়- এটি আপেক্ষিক ধারণা মাত্র। কার্ল মার্কসের মতে, যৌন পবিত্রতা গ্রামীণ সামন্তবাদী সমাজের অবশিষ্ট চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বটে। তার যা কিছু মূল্য, তা সেই সময়কার অর্থনৈতিক স্তরের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল।
সংক্ষেপে পনের শতক থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপীয় দার্শনিকদের চিন্ত ধারাসমূহ উল্লেখ করা হলো। এছাড়াও এ সময়ে ইউরোপে আরো শত শত দার্শনিক আবির্ভূত হয়েছিল যাদের দর্শনসমূহ মূলত উপরোক্ত দার্শনিকদের চিন্তাধারা সমূহের অনুরূপ। এসব দার্শনিক ও দর্শনের ফলে ইউরোপে প্রমে প্রতিষ্ঠিত হয় Secularism বা ধর্মনিরপেক্ষতা! (ধর্মহীনতা)। তৎপর একনায়কতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ, নাজীবাদ এবং সবশেষে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ পুঁজিবাদী গণতন্ত্র। বস্তুবাদ বা বৈষয়িক ক্ষেত্রে, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ক্ষেত্রে ইউরোপ অনেক এগিয়ে গেল আর ভাববাদের ক্ষেত্রে ইউরোপ অতল অন্ধকারে হারিয়ে গেল। ধর্ম, নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ, মূল্যবোধহীন ইউরোপীয় জনগণ মানুষের স্তর অতিক্র করে হিংস্র-হায়েনাসদৃশ ভোগবাদী কামুক দানবে পরিণত হলো। মূলত ধর্মনিরপেক্ষতা বা ঝবপঁষধৎরংস যেদিন থেকে ইউরোপে প্রতিষ্ঠিত হলো সেদিন থেকে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, নৈতিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল আর নৈতিকতা এর আসল উৎস ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো।

শুধু এখানেই শেষ নয়। এই নৈতিকতাহীন দানবগণ বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির অধিকারী হয়ে প্রমে নিজেদের মধ্যে ও পরবর্তীতে সারাবিশ্বের প্রতিটি জনপদে তাদের হিংস্র ক্রমণ পরিচালনা করে বিশ্বের নিভূত কোণের বাসিন্দাদেরকেও হত্যা, নির্যাতন ও শোষণ করা শুরু করে। তাদের সীমাহীন লোভ-লালসার শিকার আজ সমগ্র বিশ্বের প্রকৃতি, পরিবেশ ও মানবসন্তানগণ। তাদের হাতে নিষ্পেষিত হচ্ছে, ধর্ষিত হচ্ছে, লাখ লাখ বছরের মানবসভ্যতা, সকল মানবীয় গুণাবলী ও মূল্যবোধ। তারা সত্য কথা বলে যদি এতে তাদের বস্তুগতলাভ হয়, তারা সুন্দর কথা বলে যদি এতে তাদের শোষণের পথ উন্মুক্ত হয়, তারামানবসেবা করে গরু মোটা-তাজাকরণ প্রকল্পেরঅংশ হিসেবে, তারা দরিদ্রদেরকে সাহায্য করে তাদের ভবিষ্যৎ শ্রমশোষণকরার জন্য, তারা খাদ্য সাহায্য দেয়-শ্রমদাসের ঘাটতি মোকাবিলার জন্য, তারাচুক্তি করে নিজেরা লাভবান হওয়ার জন্য,পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে লাভ না হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে, উক্ত চুক্তির কপি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে দেয়, তারা ওয়াদা করে ও ভঙ্গ করে নিজেদের লাভের জন্য, তারা যুদ্ধ করে তেল, গ্যাস ও সোনা-রুপার জন্য, শান্তিচুক্তি করে অশান্তি কে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য, তারা আইন রচনা করে ও তা বাতিল করে বৈষয়িক সুবিধার লক্ষ্যে এবং তাদের বর্তমান ধর্মযাজকগণ যীশুর বাণী প্রচার করে অপর দেশ ও জাতির ঘাড় মটকিয়ে রক্ত পান করার জন্য।

অনেকে হয়তো চমকে উঠবেন এই ভেবে যে, Secularism মতবাদে তো ধর্ম ও রাজনীতি আলাদা বিষয়, সেক্ষেত্রে ধর্মযাজকগণ অপর জাতির ঘাড় মটকাবে কেন? তাদের অবগতির জন্য বলছি, ইউরোপ-আমেরিকার সেক্যুলারিজম মতবাদ বর্তমানে তাদের নিজের জন্য নয়- যাদেরকে তারা গোলাম বানাতে চায় তাদের জন্য। সেক্যুলার ইউরোপের ধর্মযাজকদের কার্যকলাপ সম্পর্কে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ভিজি কিরনান,‘আমেরিকা-নয়া সাম্রাজ্যবাদগ্রন্থে লিখেছেন, ‘১৮৩৮ সালের দিকে নিম্নবার্মা থেকে যেসব মিশনারিকে বের করে দেয়া হয়েছিল তারা ১৮৫১ সালে বার্মা দখলের ব্যাপারে ব্রিটিশদেরকে খুব সহায়তা প্রদান করেছিল। (পৃ. ১৬৫, অনুবাদ : বিনোদ দাশ গুপ্ত)।

উপরোক্ত আলোচনা ও তথ্যাদির আলোকে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, বহু দেব-দেবীর উপাসনাকারী ভোগবাদী ও যৌন উচ্ছৃঙ্খল স্বেচ্ছাচারী গ্রিক ধর্ম ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে খ্রিস্টপূর্ব যুগে সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল যে ধর্মবিরোধী আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন তার আধুনিক সংস্করণ হলো- মেকিয়াভেলী, ডারউন, কার্ল মার্কস, ফ্রয়েড, দরখায়েম নির্দেশিত ইউরোপীয় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বা Secularism ও সমাজতন্ত্র সক্রেটিসের যুক্তিবাদ, প্লেটোর দ্বৈতবাদ ও রাজনৈতিক দর্শন এবং এরিস্টটলের জগৎ নিরপেক্ষ খোদায়ী দর্শনের ভাবধারায় সম্পৃক্ত। উক্ত তিন গ্রিক দার্শনিকের ভাবশিষ্য মেকিয়াভেলীর সেক্যুলারিজম, ডারউইনের বিবর্তনবাদ, কার্ল মার্কসের সমাজতান্ত্রিক মতবাদ, ফ্রয়েড ও দরখায়েমের যৌনতাবাদ, হবস, লক, রুশো, ভলতেয়ার, মন্টেস্কুসহ অসংখ্য বুদ্ধিজীবী ও দার্শনিকের মতবাদসমূহ বর্তমান দানবীয় পাশ্চাত্য সভ্যতার সৃষ্টি করে। পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা ও সিলেবাসের অনিবার্য ফলশ্রতিতে সেক্যুলারিজম বর্তমানে প্রাচ্যকে গ্রাস করার পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।

পাশ্চাত্য ধর্মনিরপেক্ষতার বর্তমান রূপ-
গীর্জাকেন্দ্রিক শাসন, শোষণ, স্বেচ্ছাচার, বিজ্ঞান ও যুক্তি বিরোধিতা ও ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর সীমাহীন জুলুম,অত্যাচারের ফলস্বরূপ পনের শতকে মোকিয়াভেলী সেকুলারিজমের যে তত্ত্ব নিয়ে হাজির হন তা হলো সরকার, সরকারি নীতিআদর্শ, জাগতিক বিষয়াদিতে ধর্ম ও নৈতিকতার কোনো ভূমিকা থাকা চলবে না, তবে ব্যক্তিগতভাবে কেউ ধর্ম পালন করতে চাইলে, ধর্মীয় মনোভাব পোষণ করলে বা অপার্থিব বিষয়াদির সাথে জড়িত হতে চাইলে রাষ্ট্র কোনো প্রকার বাধা প্রদান করবে না। তদুপরি ধর্মযাজকগণ যেহেতু অভিজাত শ্রেণীর সাহায্যে ধর্মের নামে কুশাসন প্রতিষ্ঠা করেছে, সেহেতু ইউরোপের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী বিপ্লবীদের প্রধান লক্ষ্য ছিল ধর্মযাজক ও অভিজাতদের নির্মূল করা অথবা নিদেনপক্ষে ধর্মযাজক ও অভিজাতদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের পর সমগ্র ইউরোপে এই বিপ্লব দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ইউরোপের অন্যান্য রাজতন্ত্র ও যাজকতন্ত্র ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিপ্লবী ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। বিপ্লব ও যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর দেখা গেল, ইতোমধ্যে নতুন শাসকশ্রেণী অভিজাত শ্রেণীতে পরিণত হয়েছে আর ধর্মযাজকগণ নতুন শাসকশ্রেণীর সহায়তাকারী অগ্রবর্তী বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। পূর্বে পোপের ভাষণে রোমাঞ্চিত হয়ে জনগণ যুদ্ধে যোগদান করত আর বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষ(?) শাসকের নির্দেশে ও ধর্মগুরুদের গোপন তৎপরতায় জনগণ যুদ্ধে যোগদান করে অপরের সর্বস্ব হরণ করে।

যে লাউ সে কদু-
সত্যিই পাঠকবৃন্দ! কি বিচিত্র এই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী খ্রিস্টান বিশ্ব। ১০৯৫ সালে পোপ দ্বিতীয় আরবান ইউরোপের রাজন্যবর্গকে একত্রিত করে ফ্রান্সের ক্লারমাউন্ট্রের উন্মুখ প্রান্তরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেডের ঘোষণা দিয়েছিলেন আর ৯/১১-এর পর গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ হোয়াইট হাউসে দাঁড়িয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেডের ডাক দিয়েছেন। অথচ উপরোক্ত পোপ ছিলেন ধর্মরাজ্যের প্রধান আর বুশ হলেন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী রাষ্ট্রের প্রধান। দুজনের বিঘোষিত নীতি সম্পূর্ণ বিপরীত হওয়া সত্ত্বেও দুজনেই ধর্মের নামে মুসলমান হত্যায়, ভিন্ন জাতির সর্বস্ব হরণে, মানবাধিকার ও সব ধরনের ন্যায়নীতি বিসর্জনে ও মানবীয় মূল্যবোধ ধ্বংসে এক ও অভিন্নপোপ আরবান দ্বিতীয় এর ভাষণের শেষ বাক্য কয়টি ছিল-জেরুজালেমের পুনরুদ্ধারে অগ্রসরমান ক্রুসেডারদের বর্মে যতক্ষণ থাকিবে ক্রুশচিহ্ন ততক্ষণ তাহাদের জন্য থাকিবে ইহলোকে আর্থিক সকল সুযোগ এবং পরলোকে স্বর্গ লাভের নিশ্চয়তা। উদ্ধার কর জেরুজালেম, ইহাই গড চান।উপস্থিত শ্রোতাদের গগনবিদারী স্লোগান লক্ষ কণ্ঠে প্রতিধ্বনি হলো-গড ইহাই চান(সূত্র : The Crusades, Hans Eberhurd Mayer, 1972, P. 9)

ওই গ্রন্থের ৬০ পৃষ্ঠায় জেরুজালেম দখলকরার পরবর্তী দৃশ্য সম্পর্কে প্রফেসর মেয়ার লিখেন, ‘জেরুজালেমের গভর্নর ও তার অনুচরবর্গ ছিলেন একমাত্র পলাতক মুসলমান। বিজয়ের প্রমত্ততা, ধর্মীয় অন্ধ গোঁড়ামি এবং তিন বছরের অবরুদ্ধ কষ্টের স্মৃতি ফেটে পড়ল ভয়ঙ্কর এক রক্তস্নানের মধ্য দিয়ে, যাতে ক্রুসেডাররা ফালি ফালি করে কেটে ফেলল ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষকে, যারা দুর্ভাগ্যক্রমে এসে পড়ল তাদের তরবারির নাগালের মধ্যে। লাশে ঢাকা রাস্তা দিয়ে পায়ের গোঁড়ালি সমান রক্তধারা পেরিয়ে অতিকষ্টে তারা হেঁটে যেতে লাগল।ধর্মান্ধ পোপ আরবানের নেতৃত্বাধীন ক্রুসেড আর তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ পাশ্চাত্যের নেতা বুশ-ব্লেয়ারের নেতৃত্বাধীন বর্তমান বীভৎসতায় ও চেতনায় সে পার্থক্য আছে কি? বসনিয়া, ফিলিস্তিন, ইরাক, আফগানিস্তানে যারা রক্তবন্যা বইয়ে দিচ্ছে তারা কি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী? না নব্য ক্রুসেডার। ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার- জাতীয় নয়, ধর্মের নামে রাজনীতি করা যাবে না, এরূপ বক্তব্যের সাথে বাস্তবের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে কি?

মার্টিন লুার কিংয়ের আপস আন্দোলনের ফলে সমগ্র ইউরোপে বনাম ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের লড়াই থেমে যায় এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের নেতৃত্বে বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো গঠিত হয়। ধর্ম নিয়ে যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার পর যুদ্ধপ্রিয় শ্বেতাঙ্গরা লিপ্ত হয় দেশ দখল ও লুটতরাজের যুদ্ধে। এ সময়ের মধ্যে তারা এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের প্রায় সব দেশে নিজেদের উপনিবেশ স্থাপন করে এবং সংশ্লিষ্ট দেশের খনিজ সম্পদসহ সব ধরনের সম্পদ লুণ্ঠনের প্রতিযোগিতা শুরু করে। এই প্রতিযোগিতায় তারা এতই উন্মত্ত হয়ে পড়ে যে, লুটের মালের ভাগাভাগি নিয়ে অসংখ্য যুদ্ধের সাথে দুদুটি বিশ্বযুদ্ধও উপহার দেয় বিশ্ববাসীকে। খ্রিস্টান ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের আধিপত্যের লড়াইয়ের একপর্যায়ে ১৯১৪ সালে শুরু হয় বিশ্বযুদ্ধ। এ যুদ্ধে জার্মানি, ইতালি ও মুসলিম তুরস্ককে নিয়ে গঠিত হয় অক্ষশক্তি আর ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও আমেরিকাকে নিয়ে গঠিত হয় মিত্রশক্তি। তখন আরব উপদ্বীপ ছিল তুরস্ক সালতানাতের অংশ। ১৮৬৭ সালে মিশনারি কলেজ হিসেবে চালু হওয়া বৈরুতে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে এবং খ্রিস্টান বংশোদ্ভূত সাইফেল আফলাফের প্রচেষ্টায় ইতিমধ্যে আরব বিশ্বে ইসলামি জাতীয়তার বিপরীতে আরব জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয়েছিল। মিত্রশক্তি ওই আরব জাতীয়তাবাদীদের সাথে এক গোপন অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়। ওই অঙ্গীকারের মূল কথা ছিল, যুদ্ধে মিত্রশক্তি বিজয় লাভ করলে সমগ্র আরব, ফিলিস্তিন ও সিরিয়াকে তুরস্ক সালতানাতের কবল থেকে উদ্ধার করে স্বাধীনতা প্রদান করা হবে। বিশ্ববাসী বিগত ৯০ বছর ধরে দেখছে, মিত্রশক্তি আরবদের সাথে প্রদত্ত ওয়াদা কীভাবে রক্ষা করছে। আমার আলোচ্য বিষয় তা নয়। আমার বক্তব্য হচ্ছে- প্র বিশ্বযুদ্ধ ছিল ইউরোপীয়দের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই, ধর্মযুদ্ধ নয়। যুদ্ধে অক্ষশক্তি পরাজিত হলে তুরস্কের খেলাফতকে উচ্ছেদ করা হয় ও ধর্মনিরপেক্ষ (ধর্মবিরোধী) মোস্তফা কামাল পাশাকে তুরস্কের ক্ষমতায় বসানো হয় এবং আরবদের তুরস্কের কবল থেকে উদ্ধার করে নিজেদের গোলামে পরিণত করা হয়। এ যুদ্ধ প্রকাশ্যে ধর্মযুদ্ধ না হলেও খ্রিস্টান ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের অন্তরে ছিল তীব্র মুসলমান বিদ্বেষ। ধর্ম ও রাজনীতির পৃকীকরণের ব্যাপারে সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও তার চর্চা পাশ্চাত্যে অনুপস্থিত, অমুসলিম বিশ্বেও অনুপস্থিত। কয়েকটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি সুস্পষ্ট হবে।
১. খ্রিস্টানদের বন্ধু এবং আরব জাতীয়তাবাদী সরকার শরীফ হোসাইনের সহায়তায় ৯ ডিসেম্বর ১৯১৮ সালে মিত্রশক্তি বায়তুল মুকাদ্দাস দখল করে। ১ অক্টোবর ১৯১৮ সালে শরীফ পুত্র আমীর ফয়সাল ও জেনারেল গুরবানী বিজয়ীর বেশে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে প্রবেশ করেন। ফরাসি জেনারেল গোর বায়তুল মুকাদ্দাস বিজেতা সুলতান সালাউদ্দীন আইয়ুবীর কবরে পদাঘাত করে বলল, রে সালাউদ্দীন! আমরা এসে পড়েছি। আমরা সিরিয়া জয় করেছি। উঠে দেখ! (সূত্র: ত্রৈমাসিক সাময়িক, ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২৪ বর্ষ, ২য় সংখ্যা, অক্টোবর-ডিসেম্বর, ১৯৮৪)
২. যুদ্ধে একজন সেমিনোল সর্দারের মৃত্যুর পর একজন আমেরিকান অফিসার তার মাথা কেটে নিয়ে পেপার ওয়েট হিসেবে ব্যবহার করছিল। জেনারেল কিচেনার সুদানের প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতা মেহেদীর মাথার খুলি দোয়াত হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। (সূত্র : আমেরিকা : নয়া সাম্রাজ্যবাদ, ডিজি, ফিরনান, পৃ. ১১৫)।
৩. খ্রিস্টান ধর্মনেতা রেভারেঞ্জ জোসিয়া স্ট্রং পৃথিবীর অপরাপর জনগোষ্ঠীর নির্মূল করার পক্ষে অধিক জনসংখ্যার বিপদনামক একটি তত্ত্ব প্রচার করেন। যার সারকথা হলো-আমার মনে হয় যে, ঈশ্বর তাঁর অসীম প্রজ্ঞা ও দক্ষতাবলে এংলো-স্যাক্সন জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ দান করেছেন। এটাই হলো বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতার মুহূর্ত ...... যদি আমি সঠিকভাবে বুঝে থাকি তাহলে এই মানবগোষ্ঠী (এংলো-স্যাক্সন) মেক্সিকো, সেন্ট্রাল এবং দক্ষিণ আমেরিকা, সমুদ্রে অবস্থিত দ্বীপমালা, আফ্রিকা এবং আরো অনেকদূর পর্যন্ত এগিয়ে যাবে। এটা কাউকে নিশ্চিহ্ন করার যুদ্ধ নয়, নিরীহ এবং দুর্বল মানবগোষ্ঠী ঈশ্বরের নির্দেশে সহজেই বিলীন হয়ে যাবে, তারা উন্নত মানবগোষ্ঠীর পথ রচয়িতা। (সূত্র : ওই, পৃ. ১৪১-৪২)।
৪. মার্কটোয়েন খ্রিস্টান মিশনারি তৎপরতাকে সভ্যতা প্রচারের বুলিবলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘গির্জা এবং রাষ্ট্র একই লক্ষ্যের অভিমুখে চলেছিল। ধর্মপ্রচার তৎপরতাও আমেরিকার মর্যাদার স্বার্থে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল এবং এভাবে সে নিজেকে সত্যিকার আমেরিকান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছিল। এই একই পদ্ধতিতে ফ্রান্সের ক্যাথলিক ধর্মযাজকরা তৃতীয় রিপাবলিক দলের মধ্যে নিজেদের সুদৃঢ় করার মাধ্যমে ইন্দোচীন দখলে কার্যকর সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছিল। একদিন একজন মৌলবাদী যাজক এবং যুদ্ধে ব্যাপৃত জেনারেল কোন এক বড়দিনে ভিয়েতনামের মাটিতে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে আগুন জ্বালাবে এবং বিদ্রোহীদের হত্যাযজ্ঞের আয়োজন করবে। (সূত্র : , পৃ. ১৪৬)।
৫. বিশ্বব্যাংকের একজন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট (আমেরিকান) পরবর্তী সময়ে বলেছেন, ‘যেসব আমেরিকান বিদেশে তৎপরতা চালিয়েছিলেন তাদের অধিকাংশই কোনো না কোনোভাবে মিশনারি কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এর উল্টোটাও সমানভাবে সত্য। আমেরিকান ও অন্য দেশের খ্রিস্টান মিশনারিরা কখনো তাদের জাতীয়তার কথা ভুলেনি এবং স্বর্গের পথকে তারা নিজ দেশের তৈরি রাজপথ বলেই বিবেচনা করে। ... একজন ব্রিটিশ বাণিজ্য মুখপাত্র বলেছিলেন, ‘চীনে অবস্থানরত মিশনারি দলগুলোর সদস্যরা শুধু যদি আমাদের কানসালগুলোর সাথে মিলেমিশে সে দেশ শোষণে আমাদের সহায়তা করতেন তবে তারা আমাদের বাণিজ্য স্বার্থের অনুকূলে অশেষ কল্যাণ সাধন করতে পারতেন।’ (সূত্র : , পৃ. ১৪৬-১৪৭)।
৬. কেবলমাত্র আধ্যাত্মিক চিন্তার দিক থেকে বলা যায় যে, আমেরিকা চীনকে রক্ষা করেছিল। ১৯২০ সালের মধ্যে এখানে আমেরিকার ১৩টি এবং ২৫০০ মিশনারি কেন্দ্র ছিল।
৭. ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী পাশ্চাত্যের ২য় প্রধান নেতা জন মেজরের ২/৫/১৯৯৩ইং তারিখের লেখা একটি পত্র যা ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ দফতরের প্রতিমন্ত্রী ডগলাস হগকে প্রদান করা হয়েছিল। তার সারকথা ছিল নিম্নরূপ-
ক. ইউরোপের বুকে কোনো সম্ভাব্য ইসলামী রাষ্ট্র সহ্য করা হবে না। তাই বসনিয়া, হারজেগোভিনা খণ্ড-বিখণ্ড না হওয়া পর্যন্ত এবং ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে দেশটি ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত সে দেশের মুসলমানদের কোনো রকম সাহায্য প্রদান না করার নীতি ব্রিটেন অনুসরণ করে যাবে।
খ. বসনিয়ার মুসলমানদের এখন কিংবা ভবিষ্যতে সমরাস্ত্র দিয়ে অস্ত্রসজ্জিত কিংবা প্রশিক্ষণ প্রদান করতে ব্রিটেন কখনই রাজি হবে না। ব্রিটেন সে অঞ্চলে জাতিসংঘের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও কার্যকর করতে সাহায্য প্রদান অব্যাহত রাখবে।
গ. ব্রিটেন জানে গ্রিস, রাশিয়া ও বুলগেরিয়া সার্বীয়দের অস্ত্র ও ট্রেনিং দিচ্ছে। জার্মানি-অস্ট্রিয়া, শ্লোভেনিয়া এমনকি ভ্যাটিকান ও সে অঞ্চলে ক্রোয়েশিয়া ও বসনিয়ার ক্রোট বাহিনীকে অনুরূপ সাহায্য দিচ্ছে। এ সত্ত্বেও ব্রিটেনকে নিশ্চিত করতে হবে যাতে কোনো ইসলামী দেশ কিংবা গ্র বসনিয়ার মুসলমানদের এ ধরনের সাহায্য প্রদানের প্রচেষ্টায় সফল না হয়। এটা পশ্চিমাদের জন্য অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ।
ঘ. সাবেক সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে আফগান মুজাহিদদের ট্রেনিং প্রদান ও অস্ত্র সজ্জিত করা ভুল হয়েছে। এর ফলে সেখানে ইসলামী মুজাহিদ বাহিনী গড়ে উঠেছে। বসনিয়া-হারজগোভিনার মুসলিম জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে একই ভুল করা যায় না।
ঙ. জন মেজর লিখেন, টেকসই রাষ্ট্র হিসেবে বসনিয়া-হারজেগোভিনার অস্তিত্ব লোপ না পাওয়া পর্যন্ত এবং এর মুসলিম জনগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ উৎখাত না করা পর্যন্ত ভ্যান্স-ওয়েন শান্তি আলোচনার অভিনয় চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।
চ. ভবিষ্যৎ ইউরোপের মূল্যমান পদ্ধতি হবে ও অবশ্যই হতে হবে খ্রিস্টান সভ্যতাভিত্তিক এবং নৈতিকতাভিত্তিক। তার এ অভিমত প্রতিটি ইউরোপীয় ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলোও দৃঢ় মত। তাই পশ্চিমা দেশগুলো বসনিয়ার মুসলিম জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করার জন্য সেখানে হস্তক্ষেপ করবে না কিংবা তাদের ওপর থেকে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পদক্ষেপ নেবে না। (সূত্র : ক্রুসেডের ইতিবৃত্ত, আশকার ইবনে শাইখ, পৃ. ১৩০-১৩২)।

ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশধারী খ্রিস্টান ধর্মান্ধ নেতাদের উপরোক্ত মানসিকতার ও অপকর্মের হাজারো তথ্য উল্লেখ করা যায়। তবে প্রবন্ধের কলেবরে এ বিষয়ে আর কোনো উদাহরণ না দিয়ে আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, তথাকথিত খ্রিস্টান ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা সদাসর্বদা ধর্মান্ধ ও লুটেরার দল বৈ নয়। তাদের ধর্মনিরপেক্ষতার আলখেল্লার নিচে সজ্জিত থাকে হিংস্র ধর্মান্ধতা, তাদের সুন্দর সুন্দর কথার আড়ালে লুকিয়ে থাকে হিংস্র-হায়েনার চতুর হাসি। তাদের সভ্যতা কেবলমাত্র খ্রিস্টান সভ্যতা- মানব সভ্যতা নয়, ইতিহাসের কোনো একটি যুগেও তারা মানবীয় আচরণ করতে শিখেনি। এজন্য খ্রিস্টানদের ব্যাপারে বলা হয়- প্রমে মিশনারি, অতঃপর রণতরী, এরপর গৃহযুদ্ধ ও ধ্বংস, সবশেষে শোষণ ও লুণ্ঠন। অপর জাতিগোষ্ঠীর সর্বস্ব হরণের লক্ষ্যেই তাদের ধর্ম, দর্শন, প্রযুক্তি, শিক্ষা ও তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। এতদসত্ত্বে যেসব অর্বাচীন নামধারী মুসলমান পাশ্চাত্য সভ্যতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার অনুসারী হিসেবে নিজেদের দাবি করে তারা হয় আহাম্মক নতুবা সাম্রাজ্যবাদী শোষকদের দালাল ও দাসানুদাস এবং নিজ দেশ-জাতি-ধর্ম-সভ্যতা ও উন্নতির চরম দুশমন।
এস, এম, নজরুল ইসলাম।
সম্পাদকঃ মাসিক ইতিহাস অন্বেষা।

No comments:

Post a Comment