মুসলিম খেলাফত যখন প্রকৃত ইসলাম থেকে দূরে সরে গিয়ে রাজতন্ত্রী-স্বৈরতন্ত্রীতে পরিণত হয় এবং মুসলিম শাসকশ্রেণী ও অভিজাত শ্রেণী কর্তব্যকর্ম ভুলে গিয়ে যখন ভোগ-বিলাস আর শান-শওকতের চোরাবালিতে আটকে পড়ে শক্তিহীন-লক্ষ্যহীন অবস্থায় উপনীত হয় তখনই ইউরোপীয় খ্রিস্টান বাহিনী ১০৯৫ সালে মুসলিম অধিকার থেকে জেরুজালেম উদ্ধারের বাহানায় বিভিন্ন মুসলিম শক্তি কেন্দ্রের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চরম দানবীয় আক্রোশে। খ্রিস্টান ঐতিহাসিক হিট্টির ভাষায়, “ক্রুসেড ছিল মুসলিম প্রাচ্যের বিরুদ্ধে খ্রিস্টান প্রতীচ্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া
ও ঘৃণার প্রকাশ।” ঐতিহাসিক গীবনের ভাষায়, “খ্রিস্টান ইউরোপের অর্বাচীন, বর্বর ও অশিক্ষিত লোকেরাই ক্রুসেডে যোগদান করে।’’
বস্তুত ইসলামের আবির্ভাব পৌত্তলিক ও ভোগবাদী গ্রীক ও রোমান সভ্যতার প্রতি ছিল এক প্রচণ্ড- হুমকি। তাওহীদবাদী ইসলামের আবির্ভাব ও তৎসংশ্লিষ্ট সভ্যতা ও সংস্কৃতির বাস্তব অবদান বহু ঈশ্বরবাদী গ্রীক-রোমান সভ্যতার ধারা ও প্রভাবকে ব্যাহত করেছে দেখে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে সমগ্র ইউরোপ। এই আতঙ্কের ফলশ্রুতিতে এবং নিজেদের মধ্যকার তীব্র দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করে জাতিকে উজ্জীবিত করতে ১০৯৫ সালের নভেম্বরে পোপ দ্বিতীয় আরবান ফ্রান্সের ক্লারমাউন্টে
মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের আহ্বান করেন। উক্ত ভাষণের মূল কথাগুলো ছিল নিম্নরূপ-
(১) “হে ফ্রাংক জাতির সন্তানেরা! এই মহান জাতি ঈশ্বর নির্বাচিত তাঁর এক প্রিয় জাতি।... জেরুজালেমের চৌহদ্দি থেকে এবং কনস্টান্টিনোপলের আশপাশ থেকে প্রাপ্ত নিদারুণ দুঃসংবাদ এই যে, সেখানে অভিশপ্ত এবং পুরোপুরি ঈশ্বরবিরোধী একজাতি খ্রিস্টানদের জনপদসমূহে হিংস্র আক্রমণ চালিয়ে আসছে আর লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে জনশূন্য করে দিচ্ছে সেসব জনপদকে। খ্রিস্টান বন্দীদের একাংশকে তারা নিয়ে যাচ্ছে নিজ দেশে, অন্যদেরকে নির্মম অত্যাচারের মাধ্যমে হত্যা করছে। তারা তাদের অশূচি নোংরামী দিয়ে কলুষিত করে দিচ্ছে গীর্জাগুলোর পূজাবেদী। গ্রীক সাম্রাজ্য এখন তাদের দ্বারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই গ্রীকদেরকে তারা বঞ্চিত করেছে এমন এক ভূখণ্ড- থেকে যার বিশালতা দুই মাসেও পাড়ি দেয়া সম্ভব নয়।
(২) আমাদের প্রভু ও পরিত্রাতা যীশুর পবিত্র কবরভূমি আজ ওই অশূচি জাতির অধিকারে- এই অপ্রিয় সত্য আপনাদেরকে জাগ্রত করুক। আপনাদের সহায়-সম্পত্তি যেন আপনাদেরকে পেছনে না টানে, পেছনে না টানে যেন আপনাদের পরিবার চিন্তা। যে জনপদে আপনারা বসবাস করছেন তা চারিদিক থেকে সমুদ্র আর পাহাড় বেষ্টিত। এত বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য খুবই সংকীর্ণ ও আপনাদের সবাইকে খাদ্যের যোগান দিতে অসমর্থ। এ জন্যই আপনারা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হন এবং অনেকেই ধ্বংসপ্রাপ্ত
হন।
(৩) জেরুজালেম হচ্ছে আমাদের সকলের আনন্দের এক স্বর্গভূমি। পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সেই রাজকীয় নগরী আজ উদ্ধারের জন্য আপনাদের নিকট মিনতি জানাচ্ছে। সর্বপাপ মোচনের জন্য আপনারা সাগ্রহে তার পথে অগ্রসর হোন, আর স্বর্গরাজ্যে
অক্ষয় বসবাসের গৌরব ও পুরস্কারের নিশ্চয়তা লাভ করুন।
(৪) জেরুজালেম পুনরুদ্ধারকল্পে অগ্রসরমান ক্রুসেডারদের বর্মে যতদিন থাকবে ক্রুসচিহ্ন, ততক্ষণ তাদের জন্য থাকবে ইহলোকে সকল আর্থিক সুযোগ এবং পরকালে স্বর্গলাভের নিশ্চয়তা। উদ্ধার কর জেরুজালেম!! God
wills it- ঈশ্বর ইহাই চান। (তথ্যসূত্র : ক্রুসেদের ইতিবৃত্ত, আশকার ইবনে শাইখ, পৃ. ৩১-৩২। তৎসূত্র : Alfred
Dugun, The Story
of the Crusseds,Page-42).
উল্লেখ্য তৎকালীন ইউরোপে শক্তিশালী এমন কোনো শাসক ছিল না, যিনি মুসলমানদের বিরুদ্ধে হামলা করতে সক্ষম। কিন্তু তখন খ্রিস্টান বিশ্বের ঐক্যের প্রতীক ছিলেন তাদের ধর্মনেতা পোপ। উক্ত পোপই খ্রিস্টান বিশ্বকে একত্রিত করে মিথ্যা ভাষণে অজ্ঞ-মূর্খ ইউরোপীয়দেরকে ধর্মের নামে, সম্পদের নামে, স্বর্গের লোভ দেখিয়ে ধর্মযুদ্ধে লিপ্ত করেছিল।
বর্তমান সাম্রাজ্যবাদীরা কি ধর্মনিরপেক্ষ? নাকি ধর্মযোদ্ধা?
মূলতঃ ১০৯৫ খ্রিস্টাব্দের
পোপ দ্বিতীয় আরবান ঘোষিত প্রথম ধর্মযুদ্ধের মেয়াদকাল ছিল ১০৯৫ থেকে ১২৯১ সাল পর্যন্ত প্রায় ২০০ বছর। উক্ত সময়ে প্রমে ২টি পর্যায়ে মুসলমানরা পরাজিত হলেও পরবর্তীতে ক্রুসেডাররা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। কিন্তু তারা তাদের পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তীতে বিজয়ীর বেশে আবির্ভূত হয়ে অদ্যাবধি মুসলিম নিধনে ব্যাপৃত রয়েছে। পক্ষান্তরে মুসলমানরা নিজেদের বিজয় থেকে শিক্ষা নেয়নি এবং সমকালীন শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের বিষয়ে গাফেল ছিল দীর্ঘদিন। ইত্যবসরে প্রাচীন ক্রুসেডাররা সমকালীন শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে বিশ্বব্যাপী মুসলিম দেশ দখল, মুসলমান হত্যা ও সম্পদ লুণ্ঠনে নিজেদেরকে নিয়োজিত রেখেছে। পূর্বে তারা মুসলমানদের দেশ দখল করেছিল পোপের ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে, আর বর্তমানে তারা দেশ দখল করছে যায়নবাদী ইসরাইলের গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে।
যায়নবাদী ইহুদীদের রচিত ষড়যন্ত্রের দলিল “Protocol
of the Elders of the Zion ” বইতে ইহুদীদের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে তা হলো- “ইহুদী ছাড়া অপর সকল ধর্মমতকে পৃথিবী থেকে নির্মূল করা হবে। ইহুদীরা যেহেতু (তাদের মতে) খোদার প্রিয় ও শ্রেষ্ঠ জাতি, সেহেতু পৃথিবী শাসন করার একমাত্র হকদার ইহুদীরা। সুতরাং পৃথিবীর সকল শাসনতান্ত্রিক
ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রসমূহকে
ধ্বংস করে একজন মাত্র ইহুদী বাদশাহ সমগ্র দুনিয়ার শাসনকার্য পরিচালনা করবে। এ লক্ষ্যে তারা ইতোমধ্যে সুপার গভর্নমেন্ট হিসেবে জাতিসংঘ স্থাপন করেছে।’’
বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের পরিচয়
যায়নবাদী ইসরাইল, তার বরকন্দাজ আমেরিকা, বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও ভারত। বিগত প্রায় এক হাজার বছর যাবত ইহুদীগণ কর্তৃক রচিত বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক মতবাদ ও গোপন ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এ সকল সাম্রাজ্যবাদী দেশসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে ইহুদীদের তল্পীবাহকগণ রাষ্ট্রক্ষমতা
দখল করতে সক্ষম হয়। ফলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ
জনগণের প্রত্যাশা মোতাবেক এ সকল দেশে সরকার গঠিত হয় না, এ সকল দেশ পরিচালিত হয় না। পূর্বে ক্রুসেড শুরু হয়েছিল পোপের আহ্বানে আর বর্তমানে ক্রুসেড পরিচালিত হয় যায়নবাদী ইহুদীদের চাহিদা মোতাবেক। বর্তমান রাশিয়া যতদিন পর্যন্ত ইহুদী কার্লমাক্স, লেনিন, ট্রটস্কি, ব্রেজনেভ-এর আদর্শে পরিচালিত হয়েছিল ততদিন রাশিয়াও সাম্রাজ্যবাদী ছিল। ইহুদীদের একমাত্র রাষ্ট্রটি একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র। কিন্তু পৃথিবীর অন্য কোনো জাতি ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে ইহুদীদের বরকন্দাজরা উক্ত রাষ্ট্রকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে ঝড়ের বেগে ধেয়ে আসে।
পোপ বনাম বুশ-জন মেজরের ভাষণ
বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী
শক্তিসমূহ কি রাজনৈতিক বা মতাদর্শগত যুদ্ধ করছে নাকি ধর্মযুদ্ধ পরিচালনা করছে তার পরিচয় জানতে হলে আমাদেরকে পোপের মানস ও ভাষণের সাথে বুশ-মেজরের ভাষণ ও মানসকে মিলিয়ে দেখতে হবে। পোপের ভাষণ ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষণে সাম্রাজ্যবাদী
রাষ্ট্রসমূহের কর্ণধারদের ভাষণের কয়েকটি অংশ পাঠকদের জ্ঞাতার্থে প্রদান করা হলো-
১. প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী আরব জাতীয়তাবাদীরা মুসলিম তুরস্কের বিরুদ্ধে মিত্রশক্তিকে সহায়তা করেছিল। ইসলাম ও মুসলমানদের দুশমন এ সকল নামধারী মুসলমানদেরকে তাদের খ্রিস্টান বন্ধুরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে- মিত্রশক্তি যুদ্ধে জয়লাভ করলে আরব এলাকার মুসলমানদেরকে তুরস্কের অধীনতা থেকে স্বাধীনতা দেয়া হবে। কিন্তু যুদ্ধের পর দেখা গেল আরবদের সহায়তায় তুরস্ককে পরাজিত করে খ্রিস্টান দেশগুলো আরব অঞ্চলকে টুকরো টুকরো করে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে এবং ইউরোপের ইহুদীদেরকে ফিলিস্তিনে এনে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেছে।
মক্কার শরীফ হোসেনের সহায়তায় খ্রিস্টান মিত্রশক্তি ৯-১২-১৯১৮ তারিখে বায়তুল মুকাদ্দাস দখল করে। ১-১০-১৯১৮ সালে শরীফ পুত্র আমীর ফয়সাল ও ফরাসী জেনারেল গুরবানী বিজয়ীর বেশে সিরিয়ার দামেস্কে প্রবেশ করে। এ সময় ফরাসী জেনারেল গুরবানী বায়তুল মোকাদ্দাস উদ্ধারকারী সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর কবরে পদাঘাত করে বললেন, “রে সালাউদ্দীন! আমরা এসে পড়েছি। আমরা সিরিয়া জয় করেছি।” (সূত্র : ত্রৈমাসিক সাময়িকী, ই.ফা.বা, ২৪ বর্ষ ২য় সংখ্যা, অক্টোবর-ডিসেম্বর-১৯৮৪)
২. ‘সভ্যতার সংঘাত’ থিওরীর রচয়িতা ও শীর্ষ মার্কিন বুদ্ধিজীবী ও নীতি-নির্ধারক স্যামুয়েল হ্যান্টিংটন ১৯৯৩ সালের ‘ফরেন এফেয়ার্স’ পত্রিকার জুন সংখ্যায় লিখেন- “সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পশ্চিমা জগতের এক নতুন শত্রুর প্রয়োজন ছিল। কারণ যুদ্ধ কখনো থেমে থাকবে না।... নতুন শত্রু ইসলামী বিশ্বও হতে পারে, চীনও হতে পারে।
৩. যুগোস্লাভিয়ার
খ্রিস্টান সার্বরা যখন স্বাধীনতাকামী নিরস্ত্র অসহায় বসনীয় মুসলমানদেরকে কচুকাটা করছিল তখন বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী
জন মেজর তার পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ দফতরের মন্ত্রী ডগলাস হগকে ২-৫-১৯৯৩ইং তারিখে একটি চিঠি লিখেছিলেন, চিঠির সারকথা ছিল-
(ক) ইউরোপের বুকে কোনো সম্ভাব্য ইসলামী রাষ্ট্র সহ্য করা হবে না। তাই বসনিয়া হারেজগোভিনা খণ্ড বিখণ্ড না হওয়া পর্যন্ত এবং ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে দেশটি ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত সে দেশের মুসলমানদের কোনো রকম সাহায্য প্রদান না করার নীতি ব্রিটেন অনুসরণ করে যাবে।
(খ) ব্রিটেন জানে গ্রীস, রাশিয়া ও বুলগেরিয়া সার্বীয়দের অস্ত্র ও ট্রেনিং দিচ্ছে। জার্মানি, অস্ট্রিয়া, স্লোভেনিয়া এমনকি ভ্যাটিকানও সে অঞ্চলে ক্রোয়েশিয়া ও বসনিয়ার ক্রোট বাহিনীকে অনুরূপ সাহায্য দিচ্ছে। এ সত্ত্বেও বৃটেনকে নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কোনো ইসলামী দেশ কিংবা গ্রুপ বসনিয়ার মুসলমানদের সাহায্য প্রদানে সফল না হয়।
(গ) ভবিষ্যত ইউরোপের মূল্যমান পদ্ধতি হবে এবং অবশ্যই হতে হবে খ্রিস্টান সভ্যতাভিত্তিক। এ অভিমত প্রতিটি ইউরোপীয় দেশের ও উত্তর আমেরিকার। (সূত্র : ইতিহাস- অন্বেষা, ডিসেম্বর-২০০৭, পৃ-২৪-২৫)
(৪) মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে মাহমুদ আব্বাস ও তৎকালীন ফিলিস্তিনী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাবিল শাব এর সাথে আলোচনাকালে প্রেসিডেন্ট বুশ বলেন, ‘‘I
am driven with a mission from God, God
would tell me George, Go &
fight those terrorist in
Afganistan, and I did, And
then God would tell me George, go
& end the tyranny in lraq, and I did.
(Source : The Independent, Britain,
7.10.2005) মূলত বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী
দেশসমূহ বাহ্যিকভাবে নিজেদেরকে ধর্মনিরপেক্ষ
দাবি করলেও তাদের মুখোশের নিচে লুকায়িত রয়েছে হিংস্র সাম্প্রদায়িকতা ও পরধর্ম, পরজাতি বিদ্বেষ। উপরোক্ত উদাহরণ এবং ভারতের সাম্প্রদায়িক
দাঙ্গায় সরকারের নীতি-কৌশলই এর সপক্ষে জ্বলন্ত প্রমাণ। পক্ষান্তরে মুসলমান নামধারী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও কম্যুনিস্টরা
হলো নিজ ধর্ম, দেশ ও জাতির দুশমন এবং সাম্রাজ্যবাদী
শক্তির সহযোগী গোলাম।
বর্তমান সাম্রাজ্যবাদীদের মাস্টার প্লান- বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী
শক্তিসমূহ নিজেদের আধিপত্য চিরদিন ধরে রাখার জন্য প্রধানত ৪টি কৌশল অবলম্বন করে। এই চারটি কৌশলেও যদি কোনো রাষ্ট্রকে পদানত করা না যায় তবে তারা উক্ত দেশে সরাসরি সর্বাত্মক হামলা পরিচালনা করে দেশটি ধ্বংস করে এবং তাঁবেদার পুতুল সরকার কায়েম করে। তাদের অনুসৃত উক্ত ৪টি অপকৌশল হলো-
(১) মানসিক অনৈক্য সৃষ্টি : টার্গেটকৃত অঞ্চল ও দেশের জনগণের মধ্যে মানসিক অনৈক্য ও বিভক্তি সৃষ্টি করা হয়। এই বিভেদ সৃষ্টির প্রধান প্রধান উপাদানসমূহ হলো :
(ক) মতবাদভিত্তিক বিভক্তি : গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষ
মতবাদ, ভূখণ্ড-ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ, গোত্রীয় ও আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদসমূহ বিগত কয়েক শতকে সাম্রাজ্যবাদী
শক্তিসমূহের বুদ্ধিজীবীরা
আবিষ্কার করেছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি উক্ত মতবাদগুলোকে বিশ্বব্যাপী প্রচারপ্রসারে সহায়তা করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষকে অন্তর্কোন্দলে লিপ্ত করেছে।
(খ) ধর্মভিত্তিক বিভক্তি : প্রত্যেক দেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের বসবাস। সাধারণত সংখ্যাগরিষ্ঠ
জনগণের ধর্ম অনুযায়ী উক্ত দেশে সভ্যতা-সংস্কৃতি গড়ে ওঠে এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রাধান্য পায়। এমতাবস্থায় সাম্রাজ্যবাদী
শক্তি উক্ত দেশের সংখ্যালঘু ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সংখ্যাগুরুদের
বিরুদ্ধে উস্কানি দেয়। সংখ্যাগুরু ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন ফেরকা সৃষ্টি করে, বিভিন্ন পীর-পুরোহিত সৃষ্টি করে সংখ্যাগুরুদেরকে মানসিকভাবে বিভক্ত করে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত করায় এবং জাতিকে শক্তিহীন ও বিপদগামী করে।
(গ) সাহিত্যিক মতভেদ : একটি জাতিকে স্থায়ীভাবে বিভক্তির জন্য সাহিত্যিক মতভেদ খুবই কার্যকরী। এক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদীরা সংশ্লিষ্ট দেশের অতীত ইতিহাস রচনা করে ভেজাল দিয়ে এবং মিথ্যা দিয়ে। তারা প্রতিটি দেশের কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে
কিনে নেয়। উক্ত বুদ্ধিজীবীরা
সাম্রাজ্যবাদীদের ফরমায়েশ মোতাবেক ইতিহাস লিখে। নাটক লিখে, সিনেমার ¯স্ক্রিপ্ট লিখে, উপন্যাস লিখে। উক্ত সাহিত্যকর্মের
কোনোটিতে একপক্ষের উপর অন্যপক্ষ আক্রমণাত্মক সংলাপ প্রয়োগ করে, ইতিহাসে যা ছিল না তা ঢুকিয়ে দিয়ে সাম্প্রদায়িক
বিভেদকে প্রকট করে তোলা হয়। দুটি উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটি পরিষ্কার হবে।
(১) ইয়েমেনের ইহুদী আবদুল্লাহ বিন সাবাহ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে দীর্ঘ কয়েক বছর কুরআন হাদীসের উপর ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করে নিজেকে ধর্মীয় বোদ্ধা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তখন হযরত ওসমান (রা:) মদীনার খলিফা ছিলেন। আবদুল্লাহ তখন হযরত আলী (রা:) এর একনিষ্ঠ ভক্ত হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। সরলপ্রাণ মুসলমানদেরকে
সে এই মর্মে ওসমান (রা:) এর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে যে, খেলাফতের সত্যিকারের হকদার হলো হযরত আলী (রা:), প্রথম তিন খলিফা হলো জবরদখলকারী। সুতরাং বর্তমান খলিফাকে অপসারণ করে হযরত আলী (রা:)কে খলিফা বানানো মুসলমানদের জন্য জরুরি। এই প্রচারণায় তার অনেক অনুসারী তৈরি হয়। সে ওসমান (রা:)-এর চিঠিকে বিকৃত করার মাধ্যমে তার অনুসারীদেরকে
খেপিয়ে তোলে এবং হযরত ওসমান (রা:) সাবাহর অনুসারীদের হাতে নিহত হন। এরপর মুসলিম জনমত দুইভাগে বিভক্ত হয়। একভাগ হযরত আলী (রা:) এর দলে, অন্যভাগ ওসমান (রা:)-এর হত্যার বদলা নেয়ার শপথে আমীর মুয়াবিয়ার দলে। এভাবেই মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতি ভয়াবহ সংঘাত শুরু হয় এবং মুসলমানরা শিয়া-সুন্নি দুই দলে বিভক্ত হয়ে অনেক রক্তপাত ঘটায়- যা এখনও বিদ্যমান।
(২) দীর্ঘ হাজার বছর ভারত উপমহাদেশ শাসন করেছিল তুর্কী, আফগান ও মোঘল বংশোদ্ভুত শাসন কর্তারা। তাঁরা ভারতে বহিরাগত হলেও তাঁরা নিজেদের জ্ঞান- যোগ্যতা ও সর্বস্ব দিয়ে বহুধা বিভক্ত ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করেন। তাদের আমলে সরকারি চাকরি, বাণিজ্যসহ সকল ক্ষেত্রে ভারতের সকল ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের লোক স্বাধীনভাবে নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী দেশ গঠনে ভূমিকা রেখে ভারতকে বিশ্বের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধশালী আবাসভূমিতে পরিণত করেছিল। উক্ত সময়ের কোনো সাম্প্রদায়িক
হানাহানির কথা জনগণের অজানা ছিল। তখন হানাহানি হতো রাজায়-রাজায়। নিরস্ত্র জনগণ নির্বিবাদে জীবনযাপন করত। ধর্মের নামে বা ধর্মের কারণে কেউ জুলুমের শিকার হতো না। কিন্তু ১৭৫৭ সালে মীরজাফর ও জগৎশেঠ গংদের সহায়তায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা দখল করার পর তারা এদেশের জনগণকে একের বিরুদ্ধে অন্যকে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার ব্যবস্থা করে। এক পক্ষকে চাকরি-ব্যবসা-জমিদারী দিয়ে অন্য পক্ষের চাকরি-ব্যবসা-জমিদারী কেড়ে নিয়ে তারা স্থায়ী বিভেদের বীজ বপন করে। দেশি-বিদেশি ভাড়াটিয়া বুদ্ধিজীবীদের
দিয়ে মিথ্যা ইতিহাস ও সাহিত্য রচনা করে ভারতবর্ষের জনমানসকে চিরদিনের জন্য বিষাক্ত করে যায়, যার ফলে অদ্যাবধি এ উপমহাদেশ হানাহানির দেশে পরিণত হয়।
সভ্যতার সংঘাত তত্ত্ব The great game plan
সাগর মহাসাগর ও বিশ্বে স্বীয় আধিপত্য বজায় রাখতে বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী
শক্তি কয়েকটি মতবাদ অনুসরণ করে। উক্ত মতবাদসমূহের রচয়িতা হলেন, নিকোলাস স্পাইফ্স্ম্যান, হার্বাট স্পেন্সার, হেনরি পাইরেনি ও স্যামুয়েল হান্টিংটন। উক্ত মতবাদের সারকথা হলো-
(ক) ইউরোয়েশিয়ান হার্টল্যান্ডে (উত্তরে রাশিয়া, দক্ষিণে ইরান, পূর্বে চীন, পশ্চিমে পূর্ব ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকা এলাকাকে ইউরোয়েশিয়ান হার্টল্যান্ড
বলা হয়) অবস্থিত রাষ্ট্রসমূহের
ঐক্য সমুদ্রে আধিপত্য বিস্তারকারী শক্তিসমূহের জন্য ব্যাপক হুমকি। এ জন্য এ এলাকার দেশগুলিকে ছিন্নভিন্ন করা, ভেঙে দেয়া, টুকরা করা বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী
দেশসমূহের স্থায়ী নীতি।
(খ) ইউরোয়েশিয়ার হার্টল্যান্ডে
অবস্থিত দেশগুলোতে প্রায়ই ঐক্যের প্রবণতা দেখা দেয়। এই প্রবণতাকে প্রতিহত না করলে বিশ্ব আধিপত্য বজায় রাখা যাবে না। এ জন্যই প্রথম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধের
পর যুক্তরাষ্ট্র-বৃটেন জোট মধ্যপ্রাচ্য, মধ্যএশিয়া, পূর্ব ইউরোপ, ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অনেকগুলো নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টিতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।
(গ) পূর্ব ইউরোপকে রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করা, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যকে
রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা বৃটেনের দীর্ঘস্থায়ী নীতি। দার্শনিক ম্যাকাইন্ডার
বৃটেনকে এই মর্মে সতর্ক করেন যে, অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে রাশিয়া-চীন- ইরান এবং ভারত যদি একটি একক অবস্থানে উপনীত হয় তবে সাগরের কর্তৃত্ব যুক্তরাষ্ট্র-বৃটেন ও জাপানের নিকট থেকে উক্ত শক্তি চতুষ্টয়ের নিকট চলে যাবে।
(ঘ) স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর স্যামুয়েল হান্টিংটন সভ্যতার সংঘাত নামক যে তত্ত্ব হাজির করেছেন তা মূলত ইউরোয়েশিয়ান হার্টল্যান্ড
ভিত্তিক সাম্রাজ্যবাদীদের দীর্ঘ দিনের ভাবনার ফসল। তিনি মূল ধারণাকে সভ্যতার সংঘাতের আবরণ পরিয়েছেন মাত্র। হান্টিংটন তত্ত্বের মূল কথা হলো- ইউরোয়েশিয়ান হার্টল্যান্ডে
নয়টি ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতা অবস্থান করেছে। এদের পরস্পরের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি করে এদের নিয়ন্ত্রণ ও গ্রাস করার জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ন্যাশন এস্টেট স্থাপন করলে পশ্চিমা আধিপত্য অক্ষুন্ন থাকবে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী মার্কিন কর্নেল রাল্ফ পিটার ২০০৬ সালের ‘U-S
Armed Forces Journal’- এর জুন সংখ্যায় একটি মানচিত্র প্রকাশ করেন। উক্ত মানচিত্রের শিরোনাম ছিল ‘বিস্তৃত মধ্যপ্রাচ্য প্লান’। উক্ত প্লানে যেসব দেশকে টুকরা করার এবং বড় করার লক্ষ্য ঘোষিত হয়েছে তা হলো-
১। সৌদি আরব
সৌদি আরবের বর্তমান ভূখণ্ড-কে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হবে। এর কিছু অংশ জর্দানের সাথে যোগ করে Greater Jordan, কিছু অংশ ইয়েমেনকে দেয়া হবে, কিছু অংশ কুয়েতকে দিয়ে অবশিষ্ট অংশে দুইটি দেশ গঠন করা হবে। একটি হলো মক্কা ও মদীনা নিয়ে। Islamic Sacred State অপরটির নাম হলো Soudi
Homeland Independent Territory.
২। ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের
প্রদেশ ও ইরাকের শিয়া অঞ্চল নিয়ে Arab
Shia State, ইরাকের মধ্য পশ্চিমাঞ্চলে
গঠিত হবে Sunni Iraq, ইরান-ইরাক-তুরস্ক ও সিরিয়ার কুর্দী অঞ্চল নিয়ে গঠন করা হবে Free Kurdistan. ইরানের উত্তরাঞ্চলের
কিছু অংশ তুর্কমেনিস্থানকে দেয়া হবে।
৩। সিরিয়ার পশ্চিমাঞ্চল ও তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চল যোগ করে গঠন করা হবে Greater Lebanan. তবে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলের
বিরাট এলাকা ও সিরিয়ার বেকা উপত্যাকার মালিক হবে ইসরায়েল। ফিলিস্তিন-মিশরের সীমানা তুলে দিয়ে ফিলিস্তিনীদেরকে মিশরের দিকে ঠেলে দেয়া হবে।
৪। পাকিস্তান থেকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ বিচ্ছিন্ন করে আফগানিস্তানের
সামিল করা হবে। আজাদ কাশ্মীরকে আফগানিস্তানের
সামিল করা হবে। আফগানিস্তানের
পশ্চিমাঞ্চলের শিয়া অধ্যুষিত এলাকা ইরানের সাথে সামিল করা হবে। পাকিস্তান থেকে সিন্ধু প্রদেশকে বিচ্ছিন্ন করে ভারতের সামিল করা হবে এবং বালুচিস্তানকে
বিচ্ছিন্ন করে Free Baluchistan নামক দেশ প্রতিষ্ঠা করা হবে। মার্কিন কর্নেলের আঁকা উপরোক্ত মানচিত্র যে কোনো কথার কথা নয়, তা যে কোনো চক্ষুষ্মান ব্যক্তিই অনুধাবন করতে পারবেন। কেননা ইতোমধ্যে পাকিস্তানকে প্লান অনুযায়ী অস্তিত্বহীনতার সংঘর্ষে নিমজ্জিত করেছে। পাকিস্তানের তালেবানদেরকে (টি.টি.পি) সাম্রাজ্যবাদী
শক্তিসমূহ সরকারের সাথে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত করিয়েছে, বালুচ লিবারেশন আর্মীকে অস্ত্র-অর্থ-প্রশিক্ষণ ও স্বীকৃতি দিয়ে বিচ্ছিন্নতার দ্বারপ্রান্তে
নিয়ে গেছে। সিন্ধুতে জিয়ে সিন্ধ আন্দোলনকে পরিচর্যা করা হচ্ছে।
ইরাক ইতোমধ্যে অঘোষিতভাবে তিন ভাগে বিভক্ত হয়েছে, সকল দেশের কুর্দীদেরকে অস্ত্র-অর্থ-প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র, সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু করানো হয়েছে, ইয়েমেনও গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে, ইরানে গৃহযুদ্ধ লাগানোর সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় সরাসরি হামলার প্রস্তুতি পর্ব চলছে। ইরানকে দমন করা সম্ভব হলে পারস্য উপসাগর ও এর পার্শ্ববর্তী
সকল দেশে সাম্রাজ্যবাদী
দখল পরিপূর্ণতা লাভ করবে। তখন ইরানবিরোধী আরব দেশগুলোর সুখনিদ্রা টুটে যাবে এবং জি.সি.সি দেশগুলোতে ও মধ্যপ্রাচ্যের
বাকি দেশগুলোতে রাল্ফ পিটার অংকিত মানচিত্র বাস্তবায়ন করা হবে। সৌদি আরবসহ অন্যান্য আরব দেশগুলো তখন বুঝতে পারবে ইহুদী-নাছারাদের সাথে বন্ধুত্বের পরিনাম কী। ভবিষ্যত ঐতিহাসিকরা লিখবে, ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রীক ক্ষমতা লিপ্সার বলি হয়েছে অজস্র সম্পদ ও সম্ভাবনার আরব দেশসমূহ। ইহুদী-নাছারাদের সাথে বন্ধুত্বের মাশুল দিতে গিয়ে আরবরাও শেষ হয়েছে পৃথিবীর অন্য দেশের মুসলমানদের আশা-ভরসার স্থলকেও সাগরের গভীরে তলিয়ে দিয়েছে।
(৩) সাম্রাজ্যবাদী রচিত ডকট্রিনসমূহ
সাম্রাজ্যবাদ দেশসমূহ নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে ও বিস্তৃত করতে যে সকল স্থায়ী নীতি রচনা করেছে তা Doctrine নামে পরিচিত। বর্তমানে আমরা যেসব Doctrine- এর কথা শুনি বা জানি সেগুলির উৎস কিন্তু প্রাচীন গ্রীস এর বিভিনড়ব নগর রাষ্ট্রসমূহ। এ সকল প্রাচীন ডকট্রিনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে রচিত হয় বিভিন্ন ডকট্রিনসমূহ। নিজ সম্প্রদায়, বর্ণ বা দেশের সমৃদ্ধির জন্য অন্য সম্প্রদায় বা জাতিকে শোষণ করা, নির্যাতন করা, পদপিষ্ট করা এই নীতির মূল প্রতিপাদ্য। এই নীতিসমূহের কয়েকটি নিমেড়ব প্রদান করা হলো-
(ক) মনরো ডকট্রিন : মার্কিন প্রেসিডেন্ট মনরোকে এ নীতির প্রবক্তা বলা হয়। এর মূল বিষয় হলোÑ যে এলাকাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বা প্রভাব বলয়ের জন্য প্রয়োজন মনে করবে সে এলাকায় অন্য কোনো বহিঃশক্তি অথবা স্বাধীনচেতা রাষ্ট্রের উপস্থিতি মেনে নেয়া হবে না এবং সেসব এলাকার কোনো সরকারকে মার্কিন স্বার্থের পরিপন্থী কোনো কাজ করতে দেয়া হবে না। প্রয়োজনে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বা হস্তক্ষেপ করে সরকার পরিবর্তন করা হবে অথবা দেশটি ধ্বংস করা হবে। (উল্লেখ্য, তেল-গ্যাস প্রাপ্তির পর থেকে মধ্যপ্রাচ্য এলাকাকে যুক্তরাষ্ট্র
নিজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এ জন্য এ এলাকায় শক্তিশালী ইরাককে ধ্বংস করা হয়েছে, পাকিস্তানকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে
নিয়ে গেছে এবং ইরানকে ধ্বংস করার জন্য বিভিন্নমুখী কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।)
(খ) এথেনীয় পদ্ধতি : প্রাচীন এথেন্স এর শাসকরা মনে করত সৃষ্টিকর্তা তাদেরকে তাদের অনুসৃত শাসন ব্যবস্থা সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব প্রদান করেছেন। এই মহান দায়িত্ব পালনার্থে তারা অপরাপর দেশগুলোকে নিজেদের শাসন কায়েমের জন্য দখল করে নিত। আলেজান্ডারের
বিশ্বজয় এরূপ মানসিকতার ফসল।
(গ) স্পার্টান মডেল বা পোলোপোনেশিয়ান
লীগ
: ড. আইভান এলান্ড তাঁর বিখ্যাত “দি এম্পায়ার হেজ নো ক্ল : ইউ.এস ফরেন পলিসি এক্সপোস্ড”
নামক গ্রন্থে লিখেছেন, প্রাচীন স্পার্টা অন্য দেশ দখল না করে সামরিক শক্তি দিয়ে উক্ত দেশের শাসকগোষ্ঠীকে
মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ করে নিয়ন্ত্রণ করত। এসব দেশের বৈদেশিক নীতি ও মৌলিক আভ্যন্তরীণ নীতি স্পার্টার মর্জিমাফিক হতো। এই মৈত্রীকে বলা হতো পেলোপোনেশিয়ান
লীগ।
(ঘ) চানক্য নীতি বা নেহেরু-ইন্দিরা ডকট্রিন : ডাকাত সর্দার শিবাজী ব্যতীত যে হিন্দুজাতির মধ্যে কোনো অনুসরণীয় বীর নাই সে জাতির সদস্য ছিল চানক্য বা কৌটিল্য তা আমার বিশ্বাস হয় না। প্রাচীন গ্রীক সভ্যতার রানী হেলেনকে যেরূপ সীতা বানিয়ে হেলেনের অপহরণ ও উদ্ধারের যুদ্ধকে রাম-রাবনের যুদ্ধ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, ঠিক তদ্রুপ আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের সময় আগত আলেকজান্ডারের
কোনো সভাসদকেই হয়তো ব্রাহ্মণ্যবাদীরা নিজেদের চানক্য বা কৌটিল্য হিসেবে আখ্যায়িত করে কাহিনী রচনা করেছে। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, চানক্যের সময়কাল ও আলেকজান্ডারের
ভারত অভিযানের সময়কাল প্রায় সমসাময়িক। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, উক্ত ধার করা চানক্যের ন্যায় নেহেরু-ইন্দিরা ডকট্রিনও পাশ্চাত্যের অনুকরণে রচিত। চানক্যের মতবাদ, মনরো ডকট্রিন, এথেনীয় পদ্ধতি ও স্পার্টান মডেলের সাথে নেহেরু-ইন্দিরা ডকট্রিন বা The
India Doctrine-এর কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। এ ডকট্রিনের মূল নীতিসমূহ হলো-
১. সার্ক দেশসমূহ, আফগানিস্তানের
কিছু অংশ এবং বার্মাকে অন্তর্ভুক্ত করে অখণ্ড- ভারত গঠন।
২. সামরিক তৎপরতা চালানোর মাধ্যমে রাষ্ট্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
৩. টার্গেটকৃত দেশগুলোর সাথে অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তি করা।
৪. অন্যকে নিজের কাছে আশ্রয় ও নিরাপত্তা চাইতে বাধ্য করাই হচ্ছে মিত্রতা।
৫. ভিন্ন বর্ণ ও জাতির সর্বস্ব অপহরণ কোনো পাপ নয়।
Orientalism বা প্রাচ্যতত্ত্ব : অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ অস্ত্রের শক্তিতে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ দখল করে নিজেদের স্বেচ্ছাচারী
শাসন চাপিয়ে দেয়। শাসনের ব্যাপারে তাদের নীতি ছিল পোড়ামাটি নীতি ও লুণ্ঠন। সমগ্র ইউরোপের জনগণ যাতে এই নীতিতে আসক্ত হয়ে পড়ে সে লক্ষ্যে পাশ্চাত্যে বুদ্ধিজীবীরা
অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগ থেকে প্রাচ্যতত্ত্ব
নামক বিভিন্ন তত্ত্ব হাজির করে। এসব তত্ত্বের দ্বারা ইউরোপ-আমেরিকার জনগণের মানস গঠন করা হয় এবং উপনিবেশিক দেশগুলোতে সামরিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তৃত ও বজায় রাখার জন্য প্রাচ্যের মানুষের মন-আচরণ-দৃষ্টিভঙ্গী ও সাংস্কৃতিক স্বভাবকে নিজেদের ইচ্ছামতো রূপান্তরিত, বিকৃত ও পরিবর্তন করে প্রাচ্যের একশ্রেণীর লোকের মনোজগত ও বাইরের ইমেজ পাশ্চাত্যের রঙে রঙিন করা হয়। বিংশ শতাব্দী থেকে অদ্যাবধি পাশ্চাত্য নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছে যেন প্রাচ্যের প্রতিটি দেশে পাশ্চাত্যের দেশীয় সেবাদাসরা ক্ষমতাসীন হয়। এর অন্যথা হলে পাশ্চাত্য বিভিন্ন অজুহাতে উক্ত সরকারের পতন ঘটায় বা ঘটানোর চেষ্টা করে। প্রাচ্য তত্ত্ববিশারদ
Edward
W. Sayeed বলেন-
“পশ্চিমা জ্ঞানজগতে প্রাচ্যতত্ত্ব
নামের ডিসকোর্সের পরিশোধিত বক্তব্য হলো- পৃথিবীতে পশ্চিমের মানুষ আছে, আর আছে প্রাচ্যবাসী। প্রমোক্তরা আধিপত্য করবে আর সেই আধিপত্যের শিকার হতে হবে অবশ্যই প্রাচ্যবাসীদেরকে। যার মূল কথা হলো- প্রাচ্যবাদী পাশ্চাত্যবাসীকে নিজেদের ভূমি দখল করতে দেবে, নিজেদের আভ্যন্তরীণ বিষয়সমূহ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে দেবে, তারা নিজেদের রক্ত ও সম্পদ তুলে দেবে কোনো না কোনো পশ্চিমা শক্তির হাতে। প্রাচ্যতত্ত্ব
প্রাচ্যকে নিকৃষ্ট মনে করে এবং প্রাচ্যের মানুষদেরকে নিজস্ব শাসনে পরিচালিত হওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করে। যেহেতু প্রাচ্য বিনষ্ট, অসভ্য, তাই প্রাচ্যজনকে কথা বলতে দেয়া যায় না। কারণ সে নিজেকেও ভাল করে চেনে না, তাকে যতটা চেনে পশ্চিমের লোকেরা। এ জন্যই প্রাচ্যের পক্ষে কথা বলে সাম্রাজ্যবাদী
ইউরোপ ও আমেরিকা- প্রাচ্য পরিণত হয় নিকৃষ্ট-নির্বাক- নিষ্ক্রিয় উপনিবেশে।”
মুসলিম বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত সম্পর্কিত কিছু সাম্প্রতিক তথ্য
সাম্রাজ্যবাদী
দেশসমূহের বর্ণবাদী বুদ্ধিজীবীদের
রচিত Doctrine The great game plan, বিভিন্ন মতবাদসমূহ, Orientalism এবং Clash
of Civilization তত্ত্বকে প্রাচ্যের উপর চাপিয়ে দেয় সাম্রাজ্যবাদী
রাষ্ট্রের সরকারসমূহ। স্যামুয়েল হান্টিংটনের ‘সভ্যতার সংঘাত’ খিওরী রচনার পূর্বে এবং সিনিয়র বুশের উক্ত তত্ত্ব ফেরী করার পূর্বে মুসলিম বিশ্বে কোনো জঙ্গী ছিল না। ছিল শুধু ভিটেমাটি হারা ফিলিস্তিনী প্রতিরোধ যোদ্ধা ও জবরদখলের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনরত কাশ্মিরী মুজাহিদ। উক্ত কল্পিত সভ্যতার সংঘাত তত্ত্ব বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র
ও ইসরাইল ৯/১১ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে টুইন টাওয়ার বিধ্বস্ত করে মুসলিম দেশ দখলের অজুহাত সৃষ্টি করে। তারপর থেকে পৃথিবীর সকল মুসলিম দেশ জঙ্গীময় হয়ে যায়। শুরু হয় জঙ্গী ও সন্ত্রাসী দমনের নামে রক্তাক্ত আগ্রাসন ও হত্যাযজ্ঞের নির্মম-নিষ্ঠুর-অমানবিক কার্যক্রম। তখন থেকে সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেরাই মুসলিম যুবকদেরকে জঙ্গী বানায় এবং উক্ত জঙ্গী দমনের অজুহাতে জঙ্গীর বাপ-দাদার ভিটেমাটি-সহায়-সম্পদ কেড়ে নেয়ার কার্যক্রম শুরু হয়। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি সুস্পষ্ট হবে।
১। আফগানিস্তান : রাশিয়ার দখল থেকে আফগানিস্তান মুক্ত করার লড়াইয়ে পশ্চিমা শক্তি আফগান মুজাহিদ বাহিনী গড়ে তোলে। রাশিয়া পরাজিত হওয়ার পর আফগানরা গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হলে পশ্চিমারাই তালেবানদের সংঘটিত করে আফগানিস্তানে
ক্ষমতাসীন করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর মধ্য এশিয়ার বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য পশ্চিমারা আফগানিস্তানের
উপর দিয়ে পাইপলাইন স্থাপনের জন্য তালেবান সরকারের সাথে একাধিক বৈঠক করে। পশ্চিমারা চেয়েছিল আফগান মোল্লাদেরকে নামমাত্র ভাড়া দিয়ে পাইপ লাইন স্থাপন করবে। কিন্তু মোল্লারা বলল- আমাদের দেশের উপর দিয়ে আমরা পাইপ লাইন বসাব, আপনারা আমাদেরকে ন্যায্য হিস্যা প্রদান করবেন। মোল্লাদের এরূপ জবাবে অসন্তুষ্ট হয়ে তালেবান সরকার উৎখাতে ৯/১১-কে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে আফগানিস্তানে
দখলদারিত্ব কায়েম করা হয়। স্বার্থে আঘাত লাগায় মুজাহিদরা হয়ে যায় জঙ্গী, তালেবানরা হয়ে যায় সন্ত্রাসী।
২। স্যামুয়েল বাকের লিউ রকওয়েল ওয়েবে লিখেছেন-
(ক) ১৯৬৩ সালে সি.আই.এ সাদ্দাম হোসেনের বাথ পার্টিকে সামরিক অভ্যুত্থানে সাহায্য করে। অভ্যুত্থানের
পর সি.আই.এ’র তালিকা অনুসারে জেনারেল করিম কাসেমসহ জাতীয়তাবাদীদেরকে হত্যা করা হয়।
(খ) মার্কিনীরা তাদের সাম্রাজ্য নির্মাণে তেলসমৃদ্ধ অঞ্চলকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। এর ধারাবাহিকতায়
ইরানের মোসাদ্দেক সরকারের পতন ঘটিয়ে রেজা শাহকে ক্ষমতাসীন করা হয়।
(গ) ইরাক দখল ও নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা করা হয় ১৯৯৬ সালে। বর্তমান মার্কিন সরকারের পরামর্শদাতা রিচার্ড পার্ল, ডগলাস ফেইথ, ডেভিড ওরম্সসহ কয়েকজন A Clean Break : A New Strategy for Securing the Realms” শিরোনামে জুলাই ১৯৯৬ সালে একটি প্লান পেশ করেন, যাতে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন ও ইরানের সরকার পরিবর্তনের নীল-নকশা উপস্থাপন করা হয়।
(ঘ) উক্ত রিচার্ড পার্ল-এর গ্রুপ ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে “Rebuilding Americas De Defence Strategy Fores” নামক আর একটি নীল্ নক্শা প্রণয়ন করে, যা বাস্তবায়নের অজুহাত সৃষ্টির জন্য পার্ল হারবারের ন্যায় একটি সর্বনাশা অজুহাত প্রয়োজন বলে মন্তব্য করা হয়। টুইন টাওয়ার হামলা ছিল উক্ত অজুহাত, যা ইসরাইল কর্তৃক বাস্তবায়ন করা হয়।
(৩) পাকিস্তানের পরমাণু বিজ্ঞানী ড. কাদির খান দ্য নিউজ- বিবিসিকে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র
২০১৫ সালের মধ্যে পাকিস্তান ভাঙার পরিকল্পনা করেছে। প্রেসিডেন্ট মোশাররফ পাকিস্তান ভাঙ্গার মার্কিন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছেন।
(৪) সাদ্দাম হোসেন ও বাগদাদের তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত এপ্রিল গ্লাসপাই-এর মধ্যে দীর্ঘ বৈঠকের ৮ দিন পর সাদ্দাম কুয়েত দখল করেন। বিশ্বের বেশির ভাগ সংবাদ মাধ্যমের মতে, ইরাকের কুয়েত আক্রমণের পিছনে মার্কিন ইন্ধন ছিল। (সূত্র : আলমগীর মহিউদ্দীন, নয়া দিগন্ত, ১৪-০৬-০৮ইং)
(৫) আমেরিকার উস্কানিতে ইরাক ১৯৮০ সালে ইরানে হামলা করে। এতে ১০ লাখ মুসলমান নিহত হয়। (দৈনিক সংগ্রাম, ২৭-০৬-০৮)
(৬) বিখ্যাত আন্তর্জাতিক মিডিয়া ব্যক্তিত্ব সিমুর হার্শ ৭ জুলাই ২০০৮ সালের নিউইয়র্কের পত্রিকায় লিখেন- “ইরানকে অস্থিতিশীল করতে যুক্তরাষ্ট্র
৪০০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে। ইরানের ধর্মীয় নেতৃত্বে ও রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি, আরবী ভাষী ইরানী ও বালুচদের সাথে পার্সী ভাষী ইরানীদের বিভেদ সৃষ্টি করে অস্থিতিশীল করা এ পরিকল্পনার অংশ।
মার্কিন কর্নেল রালফ পিটারের অংকিত Broader
Middle East Plan ও উপরোক্ত তথ্যসমূহ থেকে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী
শক্তিসমূহ নিজেদের অন্যায্য লুণ্ঠনবৃত্তি
চরিতার্থ করার জন্য মুসলিম বিশ্বকে ধ্বংস ও দখল করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তাদের টার্গেটকৃত দেশের মধ্যে পাশ্চাত্যের পক্ষের ও বিপক্ষের উভয় শ্রেণীর মুসলিম দেশ অন্তর্ভুক্ত। তবে পার্থক্য এই যে, সাম্রাজ্যবাদীরা প্রথমে পাকিস্তানে, ইরানে, সিরিয়ায়, ইরাকে ও তুরস্কে তাদের আগ্রাসী হামলা পরিচালনা করবে এবং তৎপর পাশ্চাত্যের বন্ধুরাষ্ট্র
বা বশংবদ মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের
জানকবজ করবে। মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা কি এসব তথ্য অবগত নয়? যদি অবগত না থাকে তাহলে এমন অযোগ্য বেখবর রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের পদত্যাগ করে যোগ্য ব্যক্তিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা দরকার। আর যদি জানা থাকে তাহলে তাদের উচিত আর কোনো মুসলিম দেশ সাম্রাজ্যবাদী
হামলার শিকারে পরিণত হওয়ার পূর্বে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের মতভেদ দূর করা ও নিজ নিজ জনগণকে সাম্রাজ্যবাদীদের আসন্ন হামলার ব্যাপারে সজাগ -সতর্ক -ঐক্যবদ্ধ ও সশস্ত্র করা। মনে রাখতে হবে। সাম্রাজ্যবাদীরা কখনও কোনো স্বাধীন দেশের বন্ধু নয়। সাম্রাজ্যবাদীর পুতুল সরকারগণ সাম্রাজ্যবাদীদের দৃষ্টিতে টয়লেট পেপারের চেয়ে বেশি মূল্যবান নয়। সিরিয়ার বিপদে যদি তুরস্ক সহযোগিতার পরিবর্তে সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষাবলম্বন করে, তবে তুরস্ককেও ধ্বংস হতে হবে। ইরানের বিপদে যদি সৌদি আরব, পাকিস্তান ও জিসিসি দেশসমূহ ইরানকে সাহায্যের পরিবর্তে সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষাবলম্বন করে তবে ইরানের পতনের সাথে তাদেরও পতন হবে। আমাদের পবিত্র ভূমি অভিশপ্ত ইহুদী নাছারাদের পদতলে পিষ্ট হবে। এমতাবস্থায় একবিংশ শতাব্দীর জাগ্রত মুসলিম তরুণেরা প্রথমে তাদের দুর্ভোগের কারণ শাসকদের খুঁজে বের করে বিচারের সম্মুখীন করবে এবং সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে নির্মম-কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলে সাম্রাজ্যবাদীদের পতন নিশ্চিত করবে। সবাইকে স্মরণ রাখা উচিত, আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে মুসলিম তরুণ-যুবকগণ এখন অনেক বেশি সচেতন সজাগ ও স্বাধীনতা প্রিয়। অযোগ্য-অথর্ব তাঁবেদার সরকারকে তারা জীবন্ত কবর দেবে।
পতন-পরবর্তী মুসলমানদের উত্থানের কারণ
সৌদি আরব
ধ্বংসপ্রায় মুসলিম বিশ্বের উত্থানের রূপরেখা প্রণয়ন করেন প্রখ্যাত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব শায়খ আবদুল ওয়াহাব নজদী। তাঁর শিক্ষায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা ঘুম থেকে জেগে উঠে এবং ১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দে
আরবের একটি ক্ষুদ্র রাজ্যের শাসক মুহাম্মদ ইবনে সউদ শায়খ আবদুল ওয়াহাবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। নির্ভেজাল ইসলাম চর্চা ও প্রতিষ্ঠাই ছিল ইবনে ওয়াহাব এর মূল লক্ষ্য। সউদ পরিবার এর পর থেকে সকল কুসংস্কার দূর করে ইসলাম প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে রাজত্ব বিস্তৃত করার কার্যক্রম পরিচালনা করেন। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এ বংশের মহান ব্যক্তি আবদুল আযীয ইবনে সউদ ১৯০১ সাল থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে বর্তমান ভূখণ্ডের মধ্যে সউদী আরব প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁকে আধুনিক সউদী রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। এ বংশ সউদী আরবে ইসলামী শাসনব্যবস্থা
প্রবর্তন করায় সৌদি আরব এখনও বিশ্বের সবচেয়ে শান্তি ও ন্যায়বিচার সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে টিকে আছে। ১৯৭৫ সালে আততায়ীর গুলিতে এ বংশের মহান শাসক বাদশাহ ফয়সাল নিহত হওয়ার পর থেকে সৌদি আরব ক্রমান্বয়ে সাম্রাজ্যবাদী
শক্তির বলয়ে প্রবেশ করে। ১৯৮৪ সালে এ দেশটি যুক্তরাষ্ট্র-ফ্রান্স ও ব্রাজিলের সাথে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ এবং সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য চুক্তি করে। আভ্যন্তরীণভাবে দেশটি এখনও ইসলামের নিয়ম-কানুন পালনে সচেষ্ট থাকলেও আন্তর্জাতিকভাবে এরা ইসলামের দুশমন ইসরাইল ও সাম্রাজ্যবাদীদের সহযোগীতে পরিণত হয়েছে। এর থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে এ দেশটি মুসলমানদের জন্য যথাযথ কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হবে এবং নিজেদের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনবে। এ রাজবংশের উত্থানের কারণ নির্ভেজাল ইসলাম প্রতিষ্ঠা আর পতনের কারণ হবে ইসলামের দুশমন ইহুদীনাছারাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন।
পাকিস্তান
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্ম লাভ বিংশ শতাব্দীর বিস্ময়, রাজনৈতিক ইতিহাসের বিস্ময়। দীর্ঘ ১৫০ বছরের ইঙ্গ-হিন্দু শাসন-শোষণে নিষ্পেষিত মৃতপ্রায় মুসলমানরা ধর্মের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রবল শক্তিধর বৃটিশ কর্তৃপক্ষ ও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ
উগ্র সাম্প্রদায়িক হিন্দু শক্তির সাথে যুগপৎ মোকাবেলা করে অর্জন করে পাকিস্তান। মুষ্টিমেয় মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবী ঘুমন্ত ও মৃতপ্রায় জাতিকে মুসলিম জাতীয়তার মন্ত্রে দীক্ষিত করে ঐক্যবদ্ধ করে মাত্র ৪১ বছরের মধ্যে হিন্দুস্থানের
বুক চিরে নিজেদের জন্য নিজেদের সার্বভৌম ভূখণ্ড- লাভ করা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র স্বীয় ধর্মকে অবলম্বন করায়। কিন্তু ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর পর এ জাতির মহান নেতা কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ইন্তেকাল করায় পরবর্তী দুর্বল নেতৃত্ব জাতিকে সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হওয়ায় দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে মাত্র ২৪ বছরে দেশটি ভেঙে যায়। এতদসত্ত্বেও বর্তমান পাকিস্তান ও বাংলাদেশ শত ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে বিশ্বে নিজেদের আসন ধরে রেখেছে। উভয় দেশের বতর্মান দূরবস্থার প্রধান কারণ হলো ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ
ও মূল্যবোধ থেকে দূরে সরে যাওয়া। আত্মজিজ্ঞাসা
ও ভুল সংশোধন উভয় দেশের স্বাধীনতাকে সংরক্ষণ করবে।
ইরান
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ইরান ক্রমান্বয়ে রাশিয়া ও বৃটেনের কলোনীতে পরিণত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের
পর ১৯৫১ সালে ড. মোসাদ্দেক সরকার ইরানের তেলশিল্প জাতীয়করণ করায় সাম্রাজ্যবাদীরা মোসাদ্দেক সরকারের উপর ক্ষিপ্ত হয়। সিআইএর অর্থে সামরিক অভ্যুত্থানে মোসাদ্দেক সরকারের পতন হয়, পলাতক শাহ দেশে ফিরে এসে রাজতান্ত্রিক
শাসন ব্যবস্থা চালু করেন এবং ইরানে পাশ্চাত্যের বেলেল্লাপনা, মদ, জুয়া, নেশা, অশ্লীল পুস্তক, অশ্লীল সিনেমা, পতিতালয় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেন এবং ইসরাইলের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। এতদিন শাহের দেশবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ইরানের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলি সক্রিয় ছিল কিন্তু শাহ কর্তৃক ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন ও ইসলামবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করায় ইরানের শক্তিশালী ধর্মীয় নেতারা তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলেন। জনগণ আলেমদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পুতুল রেজাশাহ পাহলবীকে দেশ ছাড়া করেন। তৎকালীন পৃথিবীর সকল বৃহৎ শক্তি, বৃহৎশক্তির দেশীয় এজেন্টগণ এবং রাজতান্ত্রিক
মুসলিম দেশসমূহের সম্মিলিত বাধা উপেক্ষা করে ইরানের ইসলামী বিপ্লব বিজয়ী হয়েছে, টিকে রয়েছে এবং বর্তমানে বিশ্বমোড়লদেরকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়ার শক্তি অর্জন করেছে। ইরানী জনগণ যতদিন ইসলাম থেকে দূরে থেকেছিল ততদিন তারা অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর গোলামী করেছে।
তুরস্ক
১২৯০ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তুরস্কে উছমানিয়া খেলাফত/রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল। ইরাকসহ সমগ্র আরব উপদ্বীপ, মিসর, মরক্কো, গ্রীস, বুলগেরিয়া, আলবেনিয়া, সার্বিয়া, বসনিয়া, মন্টেনেগ্রো, হার্জেগোভিনা, হাঙ্গেরী, রুমানিয়া, আর্মেনিয়া এই সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। ১ম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর এ সাম্রাজ্য ভেঙে যায় এবং বর্তমান তুরস্ক অবশিষ্ট থেকে যায়। আমার আলোচ্য বিষয় হলো তুর্কীদের উত্থান ও পতনের কারণসমূহ উল্লেখ করা। তা সংক্ষেপে নিম্নরূপ-
তুর্কীরা মধ্য এশিয়ার তাতার জাতির বংশধর ছিল। তারা ছিল যাযাবর ও প্রকৃতিপূজারী। নবম ও দশম শতাব্দীতে তুর্কীরা ইসলাম গ্রহণ করে। ১০৫৫ খ্রিস্টাব্দে
সেলজুক তুর্কীরা বাগদাদ দখল করে এবং ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে
হালাকু খান কর্তকৃ ক্ষমতাচ্যুত হয়। অপরদিকে ১২৯০ সালে ১ম ওছমান ওছমানিয়া তুর্কী সালতানাতের ভিত্তি স্থাপন করেন তুরস্কের ইশকি শহরকে কেন্দ্র করে। প্রত্যেক শাসক তুর্কী সাম্রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি করে ১৮২৮ পর্যন্ত অত্যন্ত প্রতাপের সাথে এশিয়া মাইনর, আরব ভূখণ্ড- ও ইউরোপের বর্ণিত দেশসমূহ শাসন করেন এবং এর পর থেকে ১৯১৩ সাল নাগাদ ইউরোপীয় অংশসমূহে পর্যায়ক্রমে তুর্কী শাসন লোপ পায় এবং ১ম মহাযুদ্ধে পরাজয়ের পর বর্তমান আকার ধারণ করে। তুর্কী সেনাপতি কামাল পাশা ১৯২২ সালের ২৯ অক্টোবর তুর্কী সুলতানকে ক্ষমতাচ্যুত করে তুরস্কে প্রজাতন্ত্র স্থাপন করেন। কামাল পাশা প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে কামাল পাশা খিলাফত ব্যবস্থা বিলুপ্ত করেন। অসংখ্য আলেম হত্যা করেন। ধর্মচর্চা নিষিদ্ধ করেন। আরবীতে নাম রাখা, আরবী পড়া, আরবীতে আজান দেয়া নিষিদ্ধ করেন। তুরস্ককে তথাকথিত সেক্যুলার (অর্থাৎ ইসলামবিরোধী) দেশে পরিণত করেন। মূলত ৬৩২ বছর পর্যন্ত প্রবল প্রতাপান্বিত
তুর্কী সালতানাত কামাল পাশা ও তার অনুসারীদের দ্বারা ১৯২২ সাল থেকে সামরিক শাসনের দেশ, ইসলাম বিরোধীদের দেশ, জরুরি অবস্থা জারির দেশ ও ভিক্ষুকের দেশে পরিণত হয়। ইসলামপন্থী রজব তাইয়ে এরদোগানের ক্ষমতা গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত তুরস্ককে বলা হলো ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’। কিন্তু মাত্র এক দশকের মধ্যে এরদোগান সরকার তুরস্ককে ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশে পরিণত করেন। দুর্নীতিবাজ সেক্যুলারগণ যে তুরস্ককে ইউরোপের ভিক্ষুকে পরিণত করেছিল সে তুরস্ক এখন ইউরোপের সবচেয়ে ধনী ও শক্তিশালী দেশে পরিণত হয়েছে। এই সেক্যুলাররা তুরস্কে ২৫টি মার্কিন ঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ দিয়ে তুরস্ককে গোলামে পরিণত করেছিল।
কামাল পাশার আসল পরিচয় : আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামসহ পৃথিবীর অনেক মুসলমান লেখক দীর্ঘদিন কামাল পাশাকে নিয়ে গর্ব করে সাহিত্য-কবিতা রচনা করেছেন। কিন্তু তার আসল রূপ যারা জানে তারা অবশ্যই ঘৃণায় তার প্রতি সহস্র অভিশাপ বর্ষণ করবেন।
মুখোশের অন্তরালে কামাল পাশা : কামাল পাশা ইহুদী কবলিত দূনমা (প্রত্যাবর্তনকারী) সম্প্রদায়ের সদস্য ছিল। দুনমাদের পরিচয় হলো- ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে
শারতে শিবী নামক স্নার্নাবাসী ইহুদী নিজেকে ‘মসীহ মউদ’ বা প্রতিশ্রুত মসিহ (ঈসা আ.) হিসেবে দাবি করে। বিপুল সংখ্যক ইহুদী তার উপর ঈমান আনে। শিবী সদলবলে সিরিয়া ও বায়তুল মুকাদ্দাস সফর করে ইস্তাম্বুলে উপস্থিত হলে তুর্কী খলিফা তাকে গ্রেফতার করেন। এমতাবস্থায় শিবী ও তার দল ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুক্তি লাভ করে ও তুরস্কে স্থায়ীভাবে অবস্থান করে। তার অনুসারীরা ইতিহাসে দূনমা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীতে এ সম্প্রদায়ের লোকেরা তুরস্কে Comittee
of Union and Progressনামক দল গঠন করে। এ দলের সদস্যগণ অনেক তুর্কী যুবককে নিজ দলে অন্তর্ভুক্ত করে এবং সালতানাতের অনেক বড় পদ দখল করে। ১ম বিশ্বযুদ্ধের
প্রাক্কালে দানিয়ুব প্রদেশের গভর্নর মাদহাত পাশা এবং ড. নাজেম, ফওজী পাশা, ছগুম আফেন্দী প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ
ব্যক্তিতে পরিণত হন। এসব ব্যক্তি তুর্কী সেনাবাহিনীতে
একটি গোপন ইউনিট গড়ে তোলে এবং ১ম বিশ্বযুদ্ধের
সময় উক্ত ইউনিট কামাল পাশার নেতৃত্বে তুর্কী সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ও তুর্কী খেলাফত ধ্বংস করে। কামাল পাশা ইহুদীদের গোপন আন্দোলন ফ্রী ম্যাসন এর সদস্য ছিল। ইহুদীদের নির্দেশে সে তুরস্ক থেকে ইসলামকে উচ্ছেদ করার কর্মসূচি গ্রহণ করে। (তথ্য সূত্র: জাতির উত্থান-পতন সূত্র, প্রবন্ধকার, পৃ. ৪২)
উপরোক্ত আলোচনায় দেখা গেল ইসলাম ধর্মের প্রকৃত অনুসরণ যাযাবরকে বাদশাহী প্রদান করে এবং ইসলাম থেকে দূরে সরে গেলে আমীর থেকে গোলামে পরিণত হয়ে সকল জাতির পদতলে পিষ্ট হতে হয়। ইসলামী জাতীয়তাবোধ পরাধীন থেকে স্বাধীন করে এবং ভৌগোলিক, গোত্রীয়, ভাষাভিত্তিক ও অন্যান্য জাতীয়তাবাদ এবং অন্যান্য ইজম মুসলমানদের পতন নিশ্চিত করে।
বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের পতনের কারণসমূহ-
১. নিজ নিজ মাতৃভাষায় ইসলামকে না জানা এবং ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়া।
২. খেলাফত থেকে রাজতন্ত্রে এবং গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন। এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো- সত্যিকারের খেলাফত ব্যবস্থা সবচেয়ে উত্তম, যদি খেলাফত প্রতিষ্ঠা সম্ভব না হয় তবে ইসলামী মূল্যবোধের ধারক ও বাহক ন্যায়পরায়ণ রাজা বাদশাহর শাসন জনগণের জন্য উত্তম। গণতন্ত্র মুসলমানদের জন্য উত্তম হবে যদি প্রত্যেক ধর্মীয় জাতি পৃথক ভোটের মাধ্যমে নিজেদের নেতা নির্বাচিত করে এবং সৎ ও দূরদর্শী ব্যক্তি প্রধান নির্বাহী ও সংসদ সদস্য হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ইহুদী মস্তিষ্কপ্রসূত বর্তমান গণতন্ত্র, পৃথিবীর দেশে দেশে রাজনীতি ব্যবসায়ী দুর্বৃত্তদেরকে নেতা নির্বাচিত করে এবং দেশ জাতিকে ধ্বংস করে।
৩. যায়নবাদী ইহুদী চক্রান্ত সম্পর্কে অজ্ঞতা।
৪. ধর্ম ও রাজনীতির বিভাজন।
৫. ইসলামী নেতৃত্বের অযোগ্যতা।
৬. জ্ঞান-বিজ্ঞানে পশ্চাদপদতা।
৭. শিরক ও বিদআতে লিপ্ত হওয়া।
৮. ধর্ম ব্যবসা ও ফেরকাবাজি।
৯. ধর্মবিমুখ শাসক।
১০. তাতায়ী ফেতনা।
১১. ক্রুসেড।
১২. বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও
বিজাতীয় মতবাদ গ্রহণ।
মুসলিম বিশ্বের করণীয়
১. সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদার সরকার থেকে মুসলিম দেশগুলোকে রক্ষা করা।
২. মুসলিম বিশ্বে একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। প্রথম শর্ত পূরণ করা গেলে ২য় শর্ত পূরণ করা যাবে।
৩. সাম্রাজ্যবাদের সেনাঘাঁটি ও গোয়েন্দা ঘাঁটি থেকে নিজ নিজ দেশকে মুক্ত করা।
৪. সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দেশগুলোর সাথে মুসলিম বিশ্বের ঐক্যপ্রতিষ্ঠা।
৫. জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে দ্রুত আত্মনির্ভরশীল
হওয়া।
৬. সাম্রাজ্যবাদী
দেশসমূহের ইহুদীবিরোধী ব্যক্তি ও সংগঠনকে সহায়তা প্রদান।
৭. সরকার ও জনগণের মধ্যে দূরত্ব নিরসন।
৮. সার্বজনীন উচ্চশিক্ষা ও সামরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা।
৯. শিক্ষা ব্যবস্থা ও সিলেবাসকে লক্ষ্য অনুযায়ী বিন্যস্ত করা।
১০. মুসলিম জাতীয়তাবোধ ও মূল্যবোধকে শক্তিশালী করা।
১১. শক্তিশালী ও.আই.সি বাহিনী গঠন, আঞ্চলিক ও ভাষাভিত্তিক লীগ বিলুপ্তকরণ।
১২. সর্বক্ষেত্রে
সমকালীন শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা।
১৩. যায়নবাদী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে নিজ জাতিকে ও অন্যান্য জাতিকে অবহিত করা, সতর্ক করা ও প্রতিহত করা।
এস, এম, নজরুল ইসলাম।
সম্পাদক মাসিক ইতিহাস অন্বেষা।
No comments:
Post a Comment