Monday, January 2, 2012

খাল কেটে কুমির আনার পরিণতি থেকে শিক্ষা নিন (প্রথম প্রকাশ সেপ্টেম্বর ২০০৭ সংখ্যা,মাসিক ইতিহাস অন্বেষা)


খাল কেটে কুমির আনার প্রবাদটি বাংলা ভাষায় বহুল প্রচলিত প্রবাদ। এই প্রবাদটি শুধুমাত্র প্রাকৃতিক খাল কাটা অর্থে ব্যবহৃত হয় না। এর রয়েছে বহুমাত্রিক অর্থ ও তাৎপর্য। প্রাকৃতিক খাল কেটে সাধারণত সেচ ব্যবস্থা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করা হয়। সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নে খাল কাটা দোষের নয় কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে যে খাল কাটা হয় সেটি অনেক সময় সংশ্লিষ্ট দেশের অস্তিত্বের সংকট সৃষ্টি করে। এছাড়া অর্থনৈতিক খাল কাটা, সাংস্কৃতিক খাল কাটা, রাজনৈতিক ও সামাজিক খাল কাটা সম্ভব। আপনি যদি বিচার-বিবেচনা ও লাভক্ষতির হিসাব না করে খাল কাটেন এবং আপনি যদি দুর্বল হন তবে উক্ত খাল কাটার মাধ্যমেই আপনার সলিল সমাধি হবে। আলোচনার শুরুতে আমরা প্রাকৃতিক খালকাটা সম্পর্কে আলোচনা করবো, এরপর সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক খাল কাটার বিষয়ে আলোকপাত করবো। প্রাকৃতিক খাল কাটার বিষয়ে আমরা পৃথিবীর বিখ্যাত ২টি খাল যথাক্রমে সুয়েজ খাল ও পানামা খাল কাটা, সংশ্লিষ্ট দেশে এর প্রভাব-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করবো।


সুয়েজ খাল : এই খালটি ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরকে একত্রিত করেছে এবং এশিয়া ও আফ্রিকার সমভূমিকে পৃথক করেছে। বর্তমানে এর দৈর্ঘ্য ১০৭ মাইল, প্রস্থ ১৯৭ ফুট, গভীরতা ৪২.৫ ফুট। ১৮৬৯ সালের ১৬ নভেম্বর বর্তমান খালটি চালু করা হয়। সুয়েজ খাল খননের ইতিহাস চার হাজার বছরের প্রাচীন। খ্রি : পূ: ২০০০ সালের ফেরআউন ১ম Sesostris এই খাল খনন করেন। টলেমির যুগ এবং রোমান যুগ পর্যন্ত এ খালটি চালু ছিল। <b>ইসলামের ২য় খলিফা হযরত উমরের আমলে মিসর বিজেতা আমর ইবনুল আস এ খালের সংস্কার করেন। তবে হযরত উমর রা. পরবর্তীতে আমর ইবনুল আসকে এ খালের পুনসংস্কারে নিরুৎসাহিত করেন। কারণ তাঁর আশঙ্কা ছিল, এই খালের পথে ইউরোপীয় জলদস্যুরা আরব ভূমিতে এসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে। ৮ম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফা আল মানসুর সামরিক কারণে এই খালটি বন্ধ করে দেন।</b>


১৭৯৮ সালে ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্ট মিসর দখল করেন। যদিও ফ্রান্স বেশিদিন মিসর দখলে রাখতে সক্ষম হয়নি তবুও মিসরের সাথে পরবর্তীতে ফ্রান্সের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়। এ সূত্রে ফরাসি কোম্পানি “Societe d’ Etudes pour le canal de suez” সুয়েজ খাল খনন কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনা করে কিন্তু নিরাপত্তার কারণে মিসর শাসক মুহাম্মদ আলী পাশা ও পরবর্তীতে খেদিভ আব্বাস এর বিরোধিতা করায় উক্ত কোম্পানির প্রয়াস ব্যর্থ হয়। কিছু দিনের মধ্যেই খেদিভ আব্বাস দেশী-বিদেশী চক্রান্তে নিহত হন। তাঁর স্থলে ক্ষমতাসীন হন খেদিভ সাঈদ পাশা। তৎকালীন ফরাসি সম্রাজ্ঞীর ভাই “Fedinand le lesseps ছিলেন খেদিভ সাঈদ পাশার অন্তরঙ্গ বন্ধু। তিনি সুয়েজ খাল খননে সাঈদ পাশাকে রাজি করার জন্য বলেছিলেন, “Your name will be on, when the name of Kings who built pyramid are forgotten’  অর্থাৎ ‘যখন মানুষ পিরামিড নির্মাতা মিসরের রাজাদের কথা ভুলে যাবে তখনো লোকেরা সুয়েজ খাল খননের জন্য তোমাকে স্মরণ করবে।” (সূত্র :Rifat Bey, The anakening of Moder Egypt- Page 127)
(পাঠকবৃন্দ, পরবর্তী আলোচনায় আপনারা দেখতে পাবেন সাম্রাজ্যবাদী ফরাসি নাগরিক লেসেপস-এর সহিত সাঈদ পাশার বন্ধুত্বের ঋণ মিসরবাসী অনেক রক্তের বিনিময়ে এখনো শোধ করতে পারেনি।) সাঈদ পাশা খাল খননে রাজি হওয়ার পর ফরাসি সংস্থা ‘Compagnee
Universelle’  খাল খননের দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং নিম্ন লিখিত শর্ত মোতাবেক উভয়পক্ষের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।


শর্তাবলী:
১. সুয়েজ খাল ৯৯ বছর পর্যন্ত ফরাসি কোম্পানির অধিকারে থাকবে। এর ৬০ ভাগ শেয়ারের মালিক হবে ফ্রান্স, ৪০ ভাগের মালিক হবে মিসর।
২. মিসরকে ১,৭৬,৬০২টি শেয়ার ক্রয় করতে হবে যা ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও আমেরিকার নিকট হস্তান্তরযোগ্য নয়।
৩. খনন কাজে প্রয়োজনীয় শ্রমশক্তির চার-পঞ্চমাংশ সরবরাহ করবে মিসর এবং এর নিরাপত্তার জন্য খাল এলাকায় ২০ হাজার মিসরীয় সৈন্য মোতায়েন রাখতে হবে।
৪. বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য মিসরের খরচে নীলনদ থেকে সুয়েজ এলাকা পর্যন্ত খাল খনন করতে হবে।
৫. খাল খননের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের খরচ স্বাগতিক দেশ হিসেবে মিসরকে বহন করতে হবে। 
৬. নিট লভ্যাংশের ১৫% পাবে মিসর।
<b>সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির পরিণতি তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রনায়ক ও আমলাগণ সাদা চামড়ার লোকদের প্রশংসা পেতে সর্বদা চাতক পাখির ন্যায় হাঁ করে থাকে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীরা যে কখনো বিদেশী দেশপ্রেমিকদের প্রশংসা করতে জানে না এক কথাটা আমরা ভুলে যাই। আমাদের দেশের হীনম্মন্য রাজনৈতিক, আমলা ও বুদ্ধিজীবীর ক্ষেত্রেও দেখা যায় প্রেসিডেন্ট বুশ এ সরকারের কার্যক্রমে  প্রশংসা করেছেন, অমুক আমলা বা বুদ্ধিজীবীকে পুরস্কৃত করছেন এ কথা টেলিভিশনের পর্দায় বার বার দেখানো হয়। সাম্রাজ্যবাদীরা এ সকল হীনমনা লোকদেরকে সহজে ফাঁদে ফেলে। ফরাসি নাগরিক লেসেপস-এর প্রশংসাসূচক কথায় বিগলিত হয়ে সাঈদ পাশা কিরূপে খাল কেটে কুমির এনে মিসরবাসীকে উক্ত কুমিরের খাদ্যে পরিণত করেছিল তার ইতিহাস নিম্ন রূপ :</b>
১. উক্ত খাল খননে ১২০০০ মিসরি নিহত হয়। এতে গণঅসন্তোষ দেখা দিলে মিসর সরকার শ্রমিক সরবরাহ হ্রাস করে। তখন ফরাসি সরকার মিসরকে চুক্তির শর্ত লঙ্ঘনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে এবং ৪ কোটি ফ্রঁ ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করে।
২. খাল খনন বাবদ মিসর সরকার ১ কোটি ৮০ লাখ পাউন্ড ব্যয় করে এবং জাঁকজমকপূর্ণ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও মেহমানদারিতে ব্যয় হয় আরো ১০ লক্ষাধিক পাউন্ড।
৩. এ সকল ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে মিসর সাম্রাজ্যবাদীদের ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে। চক্রবৃদ্ধি হারে ঋণের পরিমাণ বেড়ে ১৮৭৫ সাল নাগাদ এর পরিমাণ ৯ কোটি ১০ লাখ পাউন্ডে উন্নীত হয়। এবার শুরু হয় ঋণ পরিশোধের অব্যাহত চাপ। ঋণদাতাদের চাপে মিসর সরকার স্বীয় সকল শেয়ার মাত্র ৪০ লাখ পাউন্ডের বিনিময়ে ইহুদি শিল্পপতি রথচাইল্ডের নিকট বিক্রয় করতে বাধ্য হয়। ১৮৭৯ সাল নাগাদ মিসর তার প্রাপ্য লভ্যাংশের ১৫ শতাংশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। (সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি, নীল নদ থেকে সুয়েজ খাল পর্যন্ত দীর্ঘ খাল খনন, ৪ কোটি ফ্রাঁ ক্ষতিপূরণ, ৯ কোটি ১০ লক্ষ পাউন্ড ঋণ পরিশোধ, দীর্ঘ ১০ বছর ২০ হাজার সৈন্যের পাহারা, ১২ হাজার মিসরীয় মৃত্যুর বিনিময় স্বরূপ মিসরের নিট প্রাপ্য দাঁড়ালো সকল অধিকার পরিত্যাগ করে ৪০ লাখ পাউন্ড অর্জন। (সাম্রাজ্যবাদী চুক্তির ফাঁদে পা দিলে এমনই হয়।) কিন্তু পাঠকবৃন্দ এখানেই শেষ নয়।
৪. ব্রিটেনের প্রতিপক্ষ ফ্রান্সের সাথে সুয়েজ খাল খনন চুক্তি করায় ব্রিটেন মিসর সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে ১৮৮২ সালে ‘তেল-এল-কবিরের’ যুদ্ধ শুরু করে এবং মিসরে স্থায়ীভাবে সেনাশিবির গড়ে তোলে।
৫. সুয়েজ খালের ভবিষ্যত নিরাপত্তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ ১৮৮৮ সালে কন্সট্যান্টিনোপলে ‘সুয়েজ খাল কনভেনশনে মিলিত হয় এবং মিসর সরকারকে একটি চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করে। উক্ত চুক্তির বিষময় ফলাফল ছিল মিসর ১৯০৪ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনের আশ্রিত রাজ্য হিসেবে থাকতে বাধ্য হওয়া।
৬. প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে (১৯১৪-১৭ খ্রি:) ব্রিটেন সুয়েজ খাল এলাকায় বিশাল সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করে। ১৯২২ খ্রি: ব্রিটেন সুয়েজ খালকে ব্রিটেনের নিজস্ব সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে। মিসরীয়দের প্রবল আন্দোলন-সংগ্রামেও ব্রিটেন সুয়েজ এলাকা ত্যাগ করতে রাজি হয়নি।
৭. মিসর পার্লামেন্ট ১৯৫১ সালে ফারুককে মিসরের বাদশাহ হিসেবে ঘোষণা করে। বাদশাহ ফারুক সুয়েজ খাল বিষয়ক ১৯৩৬ সালের অসম চুক্তি বাতিল করেন। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেন মাইনাস ফর্মুলা নিয়ে অগ্রসর হয়। বাদশাহ ফারুক ১৯৫২ সালে জেনারেল নাজিব কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হন। জনমতের চাপে তিনিও ব্রিটেনকে সুয়েজ এলাকা ত্যাগ করতে চাপ সৃষ্টি করেন। আবার শুরু হলো সাম্রাজ্যবাদী মাইনাস ফর্মুলার চক্রান্ত। ১৯৫৪ সালে কর্নেল জামাল আবদুন নাসের কর্তৃক জেনারেল নাজিব ক্ষমতাচ্যুত হন।
৮. কর্নেল নাসের ১৯৫৬ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট পদ দখল করেন। রুশপন্থী নাসের সমাজতান্ত্রিক শিবির থেকে অস্ত্র আমদানি শুরু করলে ক্ষিপ্ত ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র নীলনদের উপর নির্মাণাধীন আসওয়ান বাঁধের জন্য বরাদ্দকৃত ঋণ প্রত্যাহার করে। নাসের সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করে উক্ত খালের আয় দ্বারা আসওয়ান বাঁধ নির্মাণের কাজ অব্যাহত রাখেন। এমতাবস্থায় ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরাইল মিসর আক্রমন করে। ১৯৬৭ এবং ১৯৭০ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের প্রধান কারণও ছিল সুয়োজ খালের কর্তৃত্ব লাভ। অদ্যাবধি মিসরীয় জনগণ নিজ দেশে পরবাসীর ন্যায় জীবনযাপন করছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এখনো নিজেদের তল্পিবাহক হোসনি মোবারককে মিসরের ক্ষমতায় বহাল রেখেছে। উক্ত হোসনি মোবারককে মিসরের ক্ষমতায় বহাল রেখেছে। উক্ত হোসনি মোবারক ও তার পূর্বসূরি আনোয়ার সা’দতের কাজ হলো পাশ্চাত্যের সেবাদাসত্ব করা, নিজ দেশের জনগণ ও মুসলিম বিশ্বের সর্বনাশ সাধন করা। (তথ্য সূত্র : ১. Rifat Bey, The anakening of modern Egypt. 2. William Benton, Encyelopaedia Britanica ৩. ইসলামী বিশ্বকোষ, ২.৪শ খণ্ড ২য় ভাগ, পৃ: ৫১৭-৫২৪।)


এই হলো মিসরের খেদিভ ইসমাইল পাশার খাল কেটে কুমির আনার গল্প। মিসরবাসী ও ফিলিস্তিনিরা আজও উক্ত খাল কেটে কুমির আনার ঋণ শোধ করছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে অসম চুক্তির বিষময় ফল এরকমই হয়। তেলসমৃদ্ধ নাইজেরিয়া অদ্যাবধি দরিদ্র দেশের তালিকায় রয়েছে শুধুমাত্র সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে অসম চুক্তির জালে জড়িয়ে পড়ার জন্য। তৃতীয় বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্র নায়কের এর থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত।


২. পানামা খাল:
১৯১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ৩৮ কোটি ডলার ব্যয়ে এ খাল খনন শুরু করে এবং ১৯১৪ সালে এটি চালু করা হয়। এই খাল প্রশান্ত মহাসাগরকে আটলান্টিক মহাসাগরের সাথে যুক্ত করেছে। এই খাল খনন পানামাবাসী ও মধ্য আমেরিকার দেশ কলম্বিয়াকে এখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তাবেদার কলোনি হিসেবে থাকতে বাধ্য করেছে।


১৮২১ সাল থেকে পানামা কলম্বিয়ার একটি রাজ্য হিসেবে ছিল। যুক্তরাষ্ট্র পানামা খাল খনন পরিকল্পনা গ্রহণ করার পর পানামাকে কলম্বিয়া থেকে আলাদা করার সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত মোতাবেক পানামাবাসীদের মধ্য থেকে কিছুসংখ্যক স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি সংগ্রহ করে। উক্ত স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি পানামাকে কলম্বিয়া থেকে স্বাধীন করার আন্দোলন শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থে, অস্ত্রে ও সক্রিয় সহযোগিতায় বলীয়ান হয়ে ১৯০৩ সালে পানামা কলম্বিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতা! লাভ করে এবং স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি পানামার ক্ষমতা দখল করে।<b> ১৯০৪ সালে স্বাধীনতার চেতনা সম্পন্ন পানামা সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি মহান চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কলোনিতে পরিণত হয়। চুক্তির শর্ত মোতাবেক যুক্তরাষ্ট্র পানামা খাল, খাল অঞ্চলের ৩ লাখ ৬০ হাজার ২৪০ একর ভূমির ব্যবহার ও যাবতীয় স্বত্বাধিকার লাভ করে। চুক্তির আর একটি শর্ত মোতাবেক যুক্তরাষ্ট্র পানামার প্রধান সড়ক ও রেলপথের নিয়ন্ত্রণ লাভ করে।</b>


উক্ত অসম চুক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনচেতা পানামাবাসী তুমুল আন্দোলন শুরু করে কিন্তু স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তির সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় উক্ত আন্দোলন কঠোরহস্তে দমন করে। এতদসত্ত্বেও ১৯০৩, ১৯৫৫ ও ১৯৬৪ সালে পানামাবাসীদের সাথে মার্কিন সৈন্যদের ব্যাপক সংঘর্ষ ঘটে। তখন থেকে অদ্যাবধি যুক্তরাষ্ট্রের পুতুল সরকারগণই পানামা শাসন করছে। ১৯৮০র দশকে প্রেসিডেন্ট নরিয়েগা পানামাবাসীর স্বার্থ সংরক্ষণের পদক্ষেপ গ্রহণ করলে যুক্তরাষ্ট্র নরিয়েগাকে মাদক চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগ করে এবং মার্কিন সেনাবাহিনী পানামার প্রেসিডেন্ট নরিয়েগাকে পানামা থেকে ধরে নিয়ে যায়। আজও নরিয়েগা যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারে মাদক চোরাচালানি হিসেবে আটক রয়েছে। <b>নরিয়েগাকে আটক করার পর পানামাব্যাপী তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। উক্ত অসন্তোষের প্রতিক্রিয়া থেকে রক্ষা পেতে যুক্তরাষ্ট্র ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯ সালে পানামা খালের কর্তৃত্ব পানামা সরকারের নিকট প্রত্যর্পণ করে কিন্তু পানামা সরকারের কর্তৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র এখনো বহাল রয়েছে। বন্ধুগণ, স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি কিভাবে নিজ দেশকে সাম্রাজ্যবাদের পদতলে সমর্পণ করে তার জ্বলন্ত উদাহরণ পানামা নামক দেশটি।</b>


পাঠকবৃন্দ, সুয়েজ খাল ও পানামা খাল কাটার গল্প ও কুমিরের গল্প শুনলেন। এগুলো হলো প্রাকৃতিক খাল। এর বাইরে রয়েছে অর্থনৈতিক খাল কেটে কুমির আনা, সাংস্কৃতিক খাল কেটে কুমির আনা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক খাল কেটে কুমির আনার গল্প। পৃথিবীর বহু জাতি এরূপ এক বা একাধিক খাল কেটে কুমির এনে স্বীয় দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও মর্যাদাকে হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
<b>রাজনৈতিক খাল কেটে কুমির আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনীতিকগণ অতিশয় পারদর্শী। নিজেদের রাজনৈতিক মতপার্থক্য দূর করতে আমরা বিদেশী দূতাবাসে ধরনা দিই, বিদেশে মিছিল-মিটিং, স্মারকলিপি দিয়ে বিদেশীদেরকে নিজেদের দেশের রাজনীতিতে নাক গলানোর সুযোগ করে দিই। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আমাদের দেওয়া এ সুযোগ লুফে নেয়। আর তাই আমাদের দেশের সকল রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অসন্তোষে বিদেশীরা সাগ্রহে হস্তক্ষেপ করে চলেছে। আমাদের নেতৃবৃন্দের এ সকল অবার্চীন কার্যকলাপের ফলে আমাদের সুখ, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি আজ হুমকির সম্মুখীন। আমাদের যেসব নেতানেত্রী রাজনৈতিক খাল কেটে বিদেশী কুমিরদেরকে এদেশে এনেছেন তাদের অনেকেই এবং তাদের প্রতিপক্ষরা এখন কুমিরের ছোবলে আহত-অর্ধমৃত। যারা এখনো আহত হননি তাদের আনন্দিত হওয়ার সুযোগ নেই। কেননা কুমির শুধু খেতে চায়। তার খাদ্য তালিকায় বাঙালি না বাংলাদেশী, মৌলবাদী না সংস্কারবাদী, বাছবিচার করার নিয়ম নেই। এমতাবস্থায়, আমরা যারা এখনো আহত হইনি তাদের উচিত অবিলম্বে ক্ষমতালোভী রাজনীতিকদের কাটা খালসমূহ কংক্রিটের দেয়াল দিয়ে বন্ধ করা। নইলে আমাদেরকে মিসর ও পানামাবাসীর ভাগ্যবরণ করতে হবে।</b>


এস, এম, নজরুল ইসলাম। 
০১৭১১৭২০৯২৩ 
সম্পাদকঃমাসিক ইতিহাস অন্বেষা।
ঢাকা, ০৮.০৯.০৭

No comments:

Post a Comment