সম্ভবতঃ ৩য় বা ৪র্থ শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে আমার এক শিক্ষক ক্লাসে প্রশ্ন করেছিলেন, তোমরা বড় হলে কে কি হতে চাও? উপস্থিত অনেকেই, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করে। আমি বলেছিলাম, বিমানের পাইলট হবো। কিন্তু বাস্তবে বিমানের পাইলট হওয়া দূরের কথা- নিজের গাড়ি চালাতেই ভয় পাই। পরবর্তীতে বহু পরীক্ষায় ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য’ বা ‘Your Aim in Life’ রচনার উপর লিখেছি, পাসও করেছি। রচনা বইয়ের অনুকরণে কখনও ডাক্তার হয়ে দেশসেবা করার কথা, কখনও বিজ্ঞানী হয়ে নতুন নতুন আবিষ্কার করার কথা, উকিল হয়ে জনগণকে আইনী সহায়তা প্রদানের কথা লিখেছিলাম। কিন্তু বাস্তব জীবনে এসে এর কোনো কিছু করার সুযোগ হয় নাই। এর কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, পরিবারের অর্থনৈতিক সচ্ছলতার অভাব, স্বশিক্ষিত ও আদর্শ নাগরিক হওয়ার শিক্ষানীতির অভাব, জাতীয় পর্যায়ে প্রয়োজনীয় নীতিমালার অভাবের জন্যই আমাদের কিশোর বয়সের সুন্দর-সুন্দর সপ্নগুলো নিজের অজান্তে বিলীন হয়ে গেছে। পারিপার্শ্বিক, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির শিকার হয়ে আমরা যা হতে চাই, তা হতে পারি না, আমাদের মহৎ ও সৃষ্টিশীল চিন্তাসমূহ বাস্তব জীবনের দূষিত পরিবেশে এসে এইড্স রোগীর ন্যায় নিঃশেষ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, আমাদের যেসব সহপাঠী তাদের কাংখিত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হওয়ার সুযোগ পেয়েছে তাদের অনেকে বাস্তব জীবনে এসে শুধুমাত্র অধিক অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণের পর স্বনামধন্য পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছে।
আমাদের Aim in life-এর এই দুরবস্থার কারণ সম্ভবত এই যে : ১. আমরা আবেগের বশবর্তী হয়ে Aim ঠিক করেছিলাম। অথবা রচনা বইয়ে লিখিত Aim-কে নিজের Aim হিসেবে উল্লেখ করে পরীক্ষা পাসের চেষ্টা করেছিলাম। ২. আমাদের Aim-কে আমাদের অভিভাবক সমাজ ও রাষ্ট্র জানার চেষ্টা করেনি এবং গুরুত্ব দেয়নি। ৩. লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য যে সাপোর্ট প্রয়োজন ছিল তা আমরা পাইনি। ৪. লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য যে দৃঢ় মনোবল সৃষ্টির দরকার ছিল, মনোবল সৃষ্টির জন্য যেরূপ নৈতিক শিক্ষার দরকার ছিল আমরা তা অর্জন করার সুযোগ পাইনি।
৫. আমাদের পাঠ্যপুস্তকে আদর্শ মানব সৃষ্টির সিলেবাস অনুপস্থিত ছিল বরং খারাপ হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা আমাদের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত ছিল। দু-একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি বোধগম্য হবে।
ক. আমরা অংক করেছি এক সের দুধের সাথে কি পরিমাণ পানি মিশ্রিত করলে কত টাকা লাভ হবে। সুতরাং বর্তমানে আমরা ভেজাল মিশানোয় বিশ্বচ্যাম্পিয়নে পরিণত হয়েছি।
খ. আমরা টোনা-টুনির গল্পে পড়েছি, টোনা এবং টুনি কিভাবে বনের পশুদেরকে দাওয়াত দিয়ে নিজেরা পালিয়ে গিয়ে গাছের ডালে অবস্থান নিয়ে আনন্দ করছে এবং উক্ত গল্পে সরল বিশ্বাসে দাওয়াতে আগমনকারী পশুদেরকে বোকা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই গল্পের মাধ্যমে প্রতারক টোনা-টুনিকে বুদ্ধিমান সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং প্রতারিত পশুকুলকে বোকা আখ্যায়িত করা হয়েছে। সম্ভবত এইরূপ গল্পের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমাদের সমাজে প্রতারকগণ বাহবা পায় আর প্রতারিত জনগণ বোকা সাব্যস্ত হয়।
গ. একটি গল্পের শিরোনাম ছিল ‘বাঘ ও বক’। উক্ত গল্পের সারকথা হলো- বাঘের গলায় হাঁড় বিদ্ধ হয়েছিল। বক পুরস্কারের প্রতিশ্র“তিতে বাঘের গলা থেকে উক্ত হাঁড় বের করে বাঘকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। বিপদ থেকে উদ্ধারের পর বক প্রতিশ্র“ত পুরস্কার দাবি করায় বাঘ পুরস্কারের পরিবর্তে বককে মৃত্যুর হুমকি প্রদান করেছিল। পাঠকবৃন্দ একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন, আমাদের দেশের বেশিরভাগ রাজনীতিকের আচরণ উক্ত বাঘের ন্যায় আর জনগণ হচ্ছে উক্ত বকের ন্যায়।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষা পদ্ধতি ও সিলেবাসের করুণ শিকারে পরিণত হচ্ছে সমগ্র জাতি। এই শিক্ষা ব্যবস্থাই কাউকে তৈরি করছে ভেজাল মিশ্রণকারী হিসেবে, কাউকে প্রতারক হিসেবে আর কাউকে অকৃতজ্ঞ হিংস্র জানোয়ার হিসেবে। হয়তো এজন্যই ব্যবসায়ী ঠকাচ্ছে দেশ ও জনগণকে, রাজনীতিকগণ জনগণকে, উকিল মক্কেলকে, ডাক্তার রোগীকে, শিক্ষক ছাত্রকে, হাকিম ন্যায়বিচার প্রার্থীকে, পুলিশ নির্যাতিতকে, আমলা নাগরিককে, আলেম ভক্তদেরকে, পীর মুরীদদেরকে। ফলে যে যত বেশি ঠক বিদ্যায় পারদর্শী সে এদেশে ততো বেশি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
এদেশের ১৪ কোটি লোকের ১৪ কোটি Aim in life আছে। প্রকাশ্যে উক্ত Aim in life-এ দোষণীয় কোনো উপাদান নেই। উক্ত Aim in life-এর ফলে আমরা ডাক্তার, কবিরাজ, প্রফেসর, অফিসার, দেশ নেতা, দেশ নেত্রী হচ্ছি, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী হচ্ছি, আলেম-উলামাসহ অনেক কিছু হচ্ছি কিন্তু আমাদের সবকিছুই পরিচালিত হচ্ছে ব্যক্তিস্বার্থে- জাতীয় স্বার্থে নয়। কারণ আমাদের Aim in life শিখানো হয়েছে Aim of Nation নয়।
জাতীয় স্বার্থে নয় কেনো? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যাবে আমরা স্বাধীনতার এত বছর পরও জাতীয় লক্ষ্য নির্ধারণ করিনি, লক্ষ্য নির্ধারণের প্রয়োজন মনে করিনি। প্রত্যেকেই আমরা ব্যক্তিস্বার্থে/ দলীয় স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছি- জাতীয় স্বার্থ আমরা এখনও নির্ধারণ করিনি। পৃথিবীর সকল মহান এবং শক্তিশালী জাতি তাদের জাতীয় স্বার্থ নির্ধারণ করেছে, জাতীয় লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, লক্ষ্যে পৌঁছার একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে এবং একটি সময়সীমা নির্ধারণ করেছে। ফলে উক্ত জাতির সদস্যগণ তাদের সকল ব্যক্তিস্বার্থকে জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে বিন্যস্ত করেছে। তাদের ব্যক্তিস্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থ সমান্তরালভাবে প্রবাহিত হয়ে জাতিকে সমৃদ্ধ করছে, জাতীয় স্বার্থ ব্যক্তিস্বার্থের উপরে প্রাধান্য পাচ্ছে। কয়েকটি দেশের উদাহরণই এ ব্যাপারে যথেষ্ট বিবেচিত হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে আমেরিকা নিজেকে বিশ্বশক্তির কাতারে দাঁড় করানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করে। লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হওয়ার পর সে তার প্রতিপক্ষ সোভিয়েত ইউনিয়নকে শক্তিহীন করতে সচেষ্ট হয় এবং বিভিন্নমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভাঙ্গার ব্যবস্থা করে সে বিশ্বের একক পরাশক্তিতে পরিণত হয়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় লক্ষ্য হলো- পৃথিবীর অপর কোনো শক্তি যাতে তার সমকক্ষ হতে না পারে তার ব্যবস্থা করা এবং নিজেকে আরও শক্তিশালী করা। এ লক্ষ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থা, মিডিয়াসমূহ ও সকল জাতীয় সংস্থাসমূহ, সরকারি ও বিরোধীদলসমূহ কাজ করে যাচ্ছে। ফলে জাতীয় স্বার্থে তারা একই টেবিলে সমবেত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর জাপান ও জার্মানী ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। মিত্রশক্তির সাথে গোলামী চুক্তি করতে বাধ্য হয়েও তারা জাতীয় অগ্রগতির অভিন্ন লক্ষ্য নির্ধারণ করে। চুক্তির কারণে সামরিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার পথ রুদ্ধ হওয়ায় উভয় দেশ নিজেকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করার ব্রত গ্রহণ করে। মাত্র কয়েক দশকের প্রচেষ্টায় তারা প্রত্যেকে বিশ্ব অর্থনীতির নীতি নির্ধারকের ক্ষমতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় বর্তমানে তারা নিজেদেরকে সামরিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে নিরলসভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
১৯৬২ সালে বর্তমান মালয়েশিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ইন্দোনেশিয়ার শাসন থেকে মুক্ত হয়। উপযুক্ত নেতৃত্বের বাস্তবধর্মী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে মালয়েশিয়া বর্তমানে মধ্যম সারির অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। তারা তাদের জাতীয় লক্ষ্য বা Aim of Nation নির্ধারণ করেছে। লক্ষ্যে পৌঁছার সময়সীমা নির্ধারণ করেছে ২০২০ সাল। এর সুন্দর নাম দিয়েছে ভিশন টুয়েন্টি-টুয়েন্টি। তাদের অগ্রগতি পর্যালোচনা করলে তাদের সাফল্যের ব্যাপারে কোনো প্রকার সংশয়ের সম্ভাবনা দৃষ্টিগোচর হবে না।
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হয়। ভারতের নেতা পণ্ডিত নেহেরু অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী পারমাণবিক শক্তিধর ভারত গড়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে এবং ব্রিটিশ শাসিত সমগ্র উপমহাদেশকে ভারতের শাসনাধীন করার ব্রত গ্রহণ করে। ইতিমধ্যে ভারত নেহেরু ঘোষিত শক্তিশালী অর্থনীতির দেশে, পারমাণবিক শক্তিধর দেশে পরিণত হয়েছে। হায়দরাবাদ, কাশ্মীর, সিকিম, গোয়া-দমন-দিউসহ শতাধিক ছোট-বড় দেশীয় রাজ্য দখল করে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করেছে। শক্তিশালী প্রতিপক্ষ পাকিস্তানকে দুই টুকরা করেছে। নিজের প্রভাব বলয় সৃষ্টি করে নেহেরু-ডকট্রিনের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার লক্ষ্যে প্রতিবেশী সকল দেশে অশান্তি সৃষ্টির মাধ্যমে তাবেদার সরকার, তাবেদার দল, গোষ্ঠী সৃষ্টি করে লক্ষ্যপানে এগিয়ে চলেছে। প্রতিবেশীদের জন্য ভারতের এহেন নীতি যতই ক্ষতিকর হোক না কেনো, জাতীয় লক্ষ্য অর্জনের দিক থেকে ভারতীয়দের দৃষ্টিতে এই নীতি তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার কর্মসূচি মাত্র। এজন্যই জাতীয় লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে ভারতের সকল প্রকার বিরোধী মতাদর্শের দলসমূহ একযোগে কাজ করে।
পক্ষান্তরে আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী কারো জাতীয় লক্ষ্য নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে চিন্তা করার সময় পর্যন্ত নেই। জাতির কর্ণধারগণ যদি এ ব্যাপারে সজাগ-সচেতন হতেন তবে অবশ্যই ভারতের মতো না হলেও মালয়েশিয়ার মতো সমন্বিত জাতীয় লক্ষ্য নির্ধারণে সক্ষম হতেন। এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের অভাবে এদেশের জনগণ হয়েছে মাঝিবিহীন নৌকার যাত্রীর ন্যায়, যেখানে দাঁড়িরা অর্থের বিনিময়ে দাঁড় টানে কিন্তু মাঝি না থাকায়, নৌকার গন্তব্য নির্ধারিত না হওয়ায় ডানদিকের দাঁড়িদের টানে আমরা ডানদিকে যাই আর বামদিকের দাঁড়িদের টানে বামদিকে যাই। অথবা কখনও সামনে যাই, কখনও যাই পিছনে। এমতাবস্থায় কখনও যদি সত্যিকারের হ্যারিকেন-টর্নেডো উক্ত নৌকায় আঘাত হানে তবে আমরা ১৭৫৭ সালের পলাশী বিপর্যয়ের ন্যায় সমুদ্রের গভীরে তলিয়ে যাব। আমাদের মহান পূর্বপুরুষদের বিগত ২৫০ বছরের সমস্ত ত্যাগ ও অর্জন বিলুপ্ত হবে।
আমাদের করণীয়-
১. Aim of Nation নির্ধারণ- ঐকমত্যের ভিত্তিতে সমন্বিত জাতীয় লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। সৎ এবং অসৎ এর মধ্যে ঐকমত্য হবে না। তাই সৎ ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা যাতে রাজনৈতিক নেতৃত্বে আসীন হতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। এ লক্ষ্যে প্রথমত দলীয় সংসদ সদস্য প্রার্থী মনোনয়নে ক্রয়-বিক্রয় নীতি পরিহার করতে হবে। সরকার গঠনের পর মন্ত্রীত্ব বেচা-কেনার সংস্কৃতি, স্বজনপ্রীতি কঠোরভাবে পরিহার করতে হবে।
২. শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার সাধন- শিক্ষা ব্যবস্থাকে, পাঠক্রমকে, পাঠ্যসূচিকে জাতীয় লক্ষ্য নির্ধারণের অনুকূলে বিন্যস্ত করতে হবে। সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক সৃষ্টির সিলেবাস প্রণয়ন করতে হবে। জাতীয় চেতনা বিরোধী প্রবন্ধকার/ সাহিত্যিকদের লেখা পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দিতে হবে। ধর্মীয় ও জাগতিক শিক্ষার সমন্বয় সাধন করে একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন করতে হবে। কর্মহীন ধর্ম নয়- কর্মের মাধ্যমে ধর্ম পালনের শিক্ষা প্রদান করতে হবে।
৩. জাতীয় সংস্কৃতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন- আমার বিশ্বাস, বর্তমান বাংলাদেশে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের চেয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের গুরুত্ব অনেক বেশি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় জাতির মানস গঠন করতে পারে, দেশপ্রেমিক ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন নাগরিক সৃষ্টিতে প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারে। আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও স্বাতন্ত্র্য সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে জাতীয় সংস্কৃতির রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে। উক্ত রূপরেখা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সক্ষম এমন ব্যক্তিকে উক্ত মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রী পদে মনোনীত করতে হবে। সংস্কৃতির সাথে জড়িত সকল গুরুত্বপূর্ণ পদে উপযুক্ত ব্যক্তি নিয়োগ করতে হবে। সর্বোপরি সকল উপজেলায় উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ‘উপজেলা সংস্কৃতি বিষয়ক কর্মকর্তা’র পদ সৃষ্টি করতে হবে।
জাতীয় সংস্কৃতির রূপরেখার অনুপস্থিতিতে বর্তমানে বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন চলছে। আমাদের জাতীয় নীতি-আদর্শ ও মূল্যবোধের বিরোধী নাটক, সিনেমা, সাহিত্য প্রচারিত হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী শক্তিসমূহ জাতির মন-মানসকে কলুষিত-বিভ্রান্ত করে জাতিকে আদর্শহীন ও নিস্তেজ করছে, জাতির প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস করছে।
পরিশেষে আমি আমাদের জাতির বর্তমান কর্ণধারগণের নিকট এই সতর্ক বার্তা পৌঁছাতে চাই যে, উন্নত তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে ২৮ কোটি চক্ষু আপনাদের কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করছে। জনগণ দেখছে, আপনারা জাতীয় স্বার্থকে বাদ দিয়ে নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ নিয়ে কাড়াকাড়ি করছেন। আপনারা জনগণের সমস্যার কথা জাতীয় সংসদে তুলে ধরার জন্য জনগণের নিকট ভোটভিক্ষা চেয়েছেন, জনগণ আপনাদেরকে সংসদে যাওয়ার টিকেট দিয়েছে। আপনারা উক্ত টিকেট লাভ করে সংসদে না গিয়ে জনগণের গাড়ি ভাংচুর করছেন, জাতীয় স্বার্থে আপনারা ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেন না, অথচ আপনাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির বিলের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছেন, জনগণের টাকায় বিলাসবহুল শুল্কমুক্ত পোরশে, বিএমডব্লিউ, ক্যাডিলাক, ল্যাক্সাস গাড়ি প্রাপ্তির ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছেন। ব্যক্তিস্বার্থে রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা এক হতে পারেন- জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আপনারা দুই দলের দুই মুক্তিযোদ্ধাও এক হতে পারেন না। জাতীয় স্বার্থেই আপনাদেরকে এমপি নির্বাচিত করা হয়েছিল। অচিরেই আপনারা আপনাদের এ সকল কর্মকাণ্ডের উপযুক্ত প্রতিফল ভোগ করবেন।
সম্পাদকীয়ঃ মে ২০১২(মাসিক ইতিহাস অন্বেষা)