আহম্মদ সারহিন্দী (র.) ৯৭৫ হিজরীতে (১৫৬৩ খ্রি.) পাঞ্জাবের তৎকালীন পাতিয়ালা রাজ্যের বিখ্যাত সারহিন্দ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক (র.)-এর ২৮তম অধঃস্তন বংশধর। তাঁর বয়সকাল ছিল রাসূল (স.)-এর ন্যায় ৬৩ বছর। তাঁর জীবন ও কর্ম তাঁকে সত্যিকারের ওয়ারাছাতুল আম্বিয়ার মর্যাদা দান করেছে। তিনি হানাফী মাজহাবের অনুসারী ছিলেন, তবে ইমাম শাফেয়ীকে তিনি অত্যন্ত ভক্তি শ্রদ্ধা করতেন এবং কোনো কোনো আমল ইমাম শাফেয়ীর তরীকায় সম্পাদন করতেন।
ফসলের ক্ষেতে যেরূপ আগাছা জন্মায় এবং উক্ত আগাছা যথাযথরূপে উৎপাটন না করলে যেভাবে ফসলের মাঠ আগাছার মাঠে পরিণত হয় ঠিক তদ্রুপ ইসলাম নামক শস্যক্ষেত্রেও শিরক, বেদাত, কুফরীসহ বিভিন্ন আগন্তুক মতবাদের আগাছা জন্মায় অথবা উদ্দেশ্যমূলকভাবে আগাছার বীজ ছড়িয়ে দেয়া হয়, যাতে ইসলামের বাগান বাতিলের বাগানে পরিণত হয়।
এমতাবস্থায় যে ধর্মনেতা পরিপূর্ণভাবে আল্লাহ ও রাসূল (স.)কে অনুসরণ করে ইসলামের বাগানকে আগাছামুক্ত করার দায়িত্ব পালন করেন তাঁকে বলা হয় মুজাদ্দেদ বা সংস্কার কর্তা।
মুজাদ্দেদ কোনো দাবি করার জিনিস নয়- করে দেখানোর জিনিস। শতাব্দীব্যাপী কুসংস্কার ও অনাচারে ইসলামের সত্য-সুন্দর রূপ আচ্ছন্ন হয়ে বিকৃত হয়ে পড়লে যে মনীষী তাঁর অনুপম পাণ্ডিত্য, অতুলনীয় শাস্ত্রজ্ঞান, বিপুল কর্মশক্তি, দুর্জয় সাহস, তেজোদ্দীপ্ত কণ্ঠ এবং ক্ষুরধার লেখনীর সাহায্যে ইসলামকে জঞ্জাল, আবর্জনা ও আগাছা মুক্ত করে ইসলামের সত্য-সুন্দর রূপের বিকাশ ঘটাবেন এবং যুগের চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হবেন তিনিই মুজাদ্দিদ বলে পরিগণিত হন। তাঁর কার্যসীমা মাদ্রাসা কিংবা খানকার চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। তাঁর জীবন কেবল আনুষ্ঠানিক ইবাদাত-বন্দেগী, মুরাকাবা-মুশাহাদাতে ব্যয় হবে না বরং তাঁর কাজের ধরন হবে ভিন্নতর। এ প্রসঙ্গে তিনি তাঁর প্রিয় পুত্রকে চিঠির মাধ্যমে বলেছিলেন, “বৎস, আমাকে সৃষ্টি করার পিছনে যে উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে- তা সত্ত্বেও আর একটি বিশাল কারখানা আমার জিম্মায় দেয়া হয়েছে। পীর-মুরিদী করার জন্য আমাকে সৃষ্টি করা হয়নি। মুরীদদের তারবিয়ত এবং মানুষের ইরশাদও এর উদ্দেশ্য নয়। সেটা ভিন্ন এক ব্যাপার এবং অন্য এক কারখানা। এর সাথে যে সম্পর্ক রাখবে সে উপকৃত হবে। অন্যথায় নয়। আমার উপর যে কারখানাটির দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে- তার মোকাবিলায় তারবিয়ত ও ইরশাদ এমন একটি ব্যাপার- যেমন রাস্তায় পতিত কোনো বস্তু।” (পত্র নং-৬, ২য় খ-)
শেখ আহমদ সারহিন্দী ছিলেন একজন যুগনায়ক, মরদে মুজাদ্দিদ ও মুজাহিদ। ইসলাম ও মুসলিম মিল্লাতের এক মহাসংকটকালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং স্বীয় সাধনা ও কর্মশক্তি গুণে জাতির ইতিহাসে মুজাদ্দিদে আলফেসানী (দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মুজাদ্দিদ) নামে পরিচিত হন। এ প্রসঙ্গে রাসুল (স.) বলেন- “আল্লাহ এই উম্মতের জন্য প্রতি শতাব্দীর অবসানকালে এমন একজন ব্যক্তিকে পাঠাবেন, যিনি উম্মতের স্বার্থে তাঁর দ্বীনের সংস্কার সাধন করবেন।”
মুজাদ্দিদ সাহেবের উপলব্ধি ও শিক্ষা
সম্রাট আকবর রাজত্ব করেন ১৫৫৬ থেকে ১৬০৬ খ্রি. পর্যন্ত। আহমদ সারহিন্দের জন্ম ১৫৬৩ খ্রি. এবং ইন্তেকাল ১৬২৪ খ্রি.। সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬০৬ খ্রি. সিংহাসনারোহণ করেন। সুতরাং আহমদ সারহিন্দ এই উভয় প্রবল প্রতাপান্বিত মোগল সম্রাটদের রাজত্ব প্রত্যক্ষ করেন। মুজাদ্দেদ (র.) যখন সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন তখন সম্রাট আকবরের চূড়ান্ত উন্নতি, সমৃদ্ধি ও শানশওকতের কাল। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য আকবর তখন ইরানী শিয়া ও ব্রাহ্মণ্যবাদী ঠাকুর-পুরোহিতদের পরামর্শে সঠিক ইসলামকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দ্বীনে ইলাহী নামক কুফরী ধর্ম প্রচারে ব্যস্ত। এমতাবস্থায় শেখ আহমদ সারহিন্দ অভিজ্ঞ ডাক্তারের মতো প্রথমে রোগীর রোগের কারণ নির্ণয় করেন এবং অতঃপর রোগমুক্তির দাওয়াই সংগ্রহ করে প্রয়োগ করা শুরু করেন। ক্রমান্বয়ে তাঁর চিকিৎসা পদ্ধতি সফলতার দিকে এগিয়ে যায় এবং মুরতাদ আকবর শেষ জীবনে তওবা করে নিজ ধর্মে ফিরে আসেন এবং সম্রাট জাহাঙ্গীর পর্যায়ক্রমে সংশোধিত হয়ে এক পর্যায়ে শেখ আহমদ সারহিন্দের মাধ্যমে ইসলামের নিকট আত্মসমর্পণ করেন ও শরীয়া আইন জারি করেন।
মুজাদ্দিদ (র.) রোগের কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে দেখতে পান তৎকালীন ভারতবর্ষের বেশির ভাগ মুসলমান মূল ইসলাম থেকে দূরে সরে গিয়ে মনগড়া ইসলাম অনুসরণ করছে। জাতির আলেমগণ তখন দুনিয়াদারীর লোভে পথভ্রষ্ট ও বিপদগামী। বেদায়াত, পীরবাদ, সুফীবাদ আলেম ও জনসাধারণকে ইসলাম থেকে দূরে নিয়ে গেছে। আল্লাহর খলিফারা তখন পীরের খলিফা ও বাদশাহর মোসাহেবে পরিণত হয়েছে। দুনিয়াদার দরবারী আলেম, বিকৃত শিয়া মতবাদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদী কূটচালে সম্রাট আকবর তখন পথভ্রষ্ট হয়ে ইসলাম বিরোধী ‘দ্বীনে ইলাহী’ ধর্ম চালু করেছেন। এক আল্লাহকে বাদ দিয়ে সূর্য পূজা, নক্ষত্র পূজা ও শক্তি পূজায় ব্যস্ত। ইসলামের সকল স্তম্ভের উপর আকবর প্রচণ্ড হামলা করে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। অগণিত মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে, অনেকগুলোকে মন্দিরে পরিণত করা হয়েছে। ইসলামের সকল হুকুম-আহকাম পালন আকবরী শাসনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। এমতাবস্থায় মুজাদ্দেদ (র.) এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, সকল রোগ, দুঃখ-দুর্দশা ও অধঃপতন থেকে রক্ষা পাওয়ার মহৌষধ একটাই- আর তাহলো মূল ইসলামের দিকে ফিরে আসা। কেবল এর মাধ্যমেই মুসলমানগণ পুনরায় জেগে উঠবে এবং বিজয়ী জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে।
১. মূল ইসলামের দিকে ফিরে আসতে হবে-
তিনি লিখেন, একটি বৃক্ষ যত বড়ই হোক মূলের সাথে তাকে সংযোগ বজায় রাখতেই হবে। তাহলেই সে মূল থেকে রস/জীবনীশক্তি টেনে নিতে সক্ষম হবে এবং উর্ধ্বাকাশ ও প্রকৃতি থেকে সূর্যালোক ও নাইট্রোজেন গ্রহণ করে সতেজ থাকতে পারবে। সুস্থ সতেজ অবস্থায় গাছ কখনো উর্ধ্বাকাশ ও প্রকৃতি থেকে ক্ষতিকর কোনো জিনিস গ্রহণ করে না। এভাবেই একটি গাছ বেঁচে থাকে এবং ফলে-ফুলে সুশোভিত হয়। কিন্তু মূলের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন বৃক্ষ উর্ধ্বাকাশ থেকে যত খাদ্যই গ্রহণ করুক না কেন তার মৃত্যু অনিবার্য।
ইসলাম ও মুসলমানদের মূল হলো কুরআন ও রাসূল (স.)-এর সুন্নাহ। ইসলাম রূপ বৃক্ষটির সাথে যদি এর মূলের নিবিড় সংযোগ থাকে তবে সে এই মূল থেকেই রস/জীবনী শক্তি আহরণ করবে এবং প্রয়োজনবোধে পৃথিবীর অন্যান্য মতবাদ থেকে প্রয়োজনীয় অংশ গ্রহণ করবে, অপ্রয়োজনীয় অংশ পরিত্যাগ করবে। এভাবেই সে নিজেকে জীবন্ত, সতেজ ও পরিপূর্ণ রাখবে। মুসলমানদের অনুকরণীয় আদর্শ হলো ইসলাম। তাদের ব্যক্তিক, সামষ্টিক, জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় ভাবধারা এবং কার্যক্রম এই আদর্শের উপরই নির্ভরশীল। যতদিন তারা এই আদর্শের উপর কায়েম থাকবে ততদিন তারা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে বেঁচে থাকবে। বিশ্বের নেতৃত্ব তারাই দিবে, কর্তৃত্ব তারাই করবে। কিন্তু মূল থেকে সরে গেলে তারা আর জীবন্ত জাতি হিসেবে টিকে থাকতে সক্ষম হবে না। মূলের সাথে সংযোগহীন বৃক্ষের ন্যায় অন্য জাতির জ্বালানি কাঠে পরিণত হবে। বিশ্বে তারা একটি নিকৃষ্ট, নিপীড়িত, নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত জাতিতে পরিণত হবে। জ্বালানি কাঠের ন্যায় অন্যের কাজে, অন্যের উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহৃত হবে। নিজ জাতির কোনো কাজে আসবে না। এমনকি কুঠারের হাতল হয়ে স্বজাতির ধ্বংস সাধনে ব্যবহৃত হবে।
২. মূল ইসলামের জন্য ক্ষতিকর মতবাদসমূহ পরিত্যাগ করা-
তিনি মূল ইসলামের জন্য ক্ষতিকর মতবাদসমূহকে চিহ্নিত করেন। এগুলো হলো- বিদা’ত, পীরবাদ, সুফীবাদ ও বিজাতীয় মতবাদ। এসকল বিষয়ে তার বক্তব্য হলো-
(ক) বিদা’ত : ইসলামে যদি কেউ নতুন কোনো কিছুর উদ্ভাবন বা সংযোজন করে যা তাতে (ইসলামে) নেই তবে তা বিদআত। এ প্রসঙ্গে তিনি রাসূল (র.)-এর বিদায় হজ্বের ভাষণের সময় নাজিল হওয়া পবিত্র কুরআনের সর্বশেষ নাজিলকৃত আয়াত- (“আল্ইয়াত্তমু আক্মালতু লাকুম দ্বীনুকুম ওয়া আতমামতু আলাইকুম নে’মাতা, ওয়ারাদীতু লাকুমুল ইসলামা দ্বীনা”; যার অর্থ আজ আমি দ্বীনকে তোমাদের জন্য পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং আমার নেয়ামতকে তোমাদের উপর সম্পূর্ণ করে দিলাম। আর দ্বীন (জীবন বিধান) হিসেবে ইসলামকেই তোমাদের জন্য মনোনীত করলাম।) উল্লেখ করে বলেন, যে বস্তু পরিপূর্ণ হয়ে আছে তাতে বাইরের কোনো বস্তুর জন্য সামান্য কোনো স্থান থাকতে পারে না। যদি স্থান থাকে তবে সে পূর্ণ নয়- অপূর্ণ। আর পূর্ণ পানির গ্লাসে বাইরের কিছু প্রবেশ করালে সেখান থেকে মূল পানি বাইরে বেরিয়ে যাবে এবং অবশিষ্ট পানি ভেজালে পরিপূর্ণ হবে। তিনি আরো বলেন, ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান। আল্লাহর কিতাব এবং রাসূল (স.)-এর হাদীসে বর্ণিত আদেশ-নিষেধ কিংবা আমল ও আকীদা ছাড়া অন্য কোনো উদ্ভাবিত বিষয়ের স্থান ইসলামে নেই। কুরআন সুন্নাহর সাথে সামঞ্জস্যহীন কোনো কিছু ইসলামে অনুপ্রবিষ্ট হলে, কিংবা করানো হলে তা হবে সম্পূর্ণ বেদআত- স্থান বিশেষে শিরক ও কুফর।
(খ) বেদআতে হাসানা ও সাইয়্যাহ্
মুজাদ্দেদ (র.) বেদআতে হাসানা ও সাইয়্যাহ্ নামক বিভাজনকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, সকল বেদআতই অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাবে। এ প্রসঙ্গে তিনি ৩টি হাদীসের উল্লেখ করেছেন। যার অনুবাদ হলো-
১. ইসলামে যদি কেউ নতুন কোনো কিছুর উদ্ভাবন করে, যা তাতে (ইসলামে) নেই তবে তা পরিত্যাজ্য।
২. রাসূল (স.) বলেছেন- তোমাদের উপর অবশ্য কর্তব্য- আমার ও হেদায়াতপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শ অনুযায়ী চলা। তা থেকেই দলিল প্রমাণ নিবে এবং তাকেই দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবে। নব-উদ্ভাবিত আমল বেদআত, প্রত্যেক বেদআতই গোমরাহী ও ভ্রান্তি।
৩. হযরত হাস্সান (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (স.) বলেছেন, জাতি যদি নিজের দ্বীনে কোনো বেদাআত সৃষ্টি করে তাহলে আল্লাহ তাদের থেকে ঠিক অনুরূপ একটি সুন্নাতকে ছিনিয়ে নেন। এরপর সেই সুন্নাত কেয়ামত পর্যন্ত আর তাদের কাছে ফেরত আসে না।
(গ) সুন্নাত ও বেদআতের প্রকারভেদ
মুজাদ্দেদ (র.) বলেছেন, রাসূল (স.)-এর সব আমল দুই ধরনের ছিল। (১) ইবাদাতের পর্যায়ভুক্ত, (২) অভ্যাসের অন্তর্ভুক্ত।
(১) রাসূল (স.) যেসব আমল ইবাদাত হিসেবে করেছিলেন তার বিপরীত আমলই বেদআত-ই-মুনকার (অবশ্যই নিষিদ্ধ)। এর প্রতিরোধ ও গতিরোধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো সাচ্চা উম্মতের কর্তব্য।
(২) রাসূল (স.) যেসব কাজ দেশপ্রথা ও অভ্যাস হিসেবে করতেন তার বিপরীত কাজকে আমি (মুজাদ্দেদ) বেদআতে মুনকার মনে করি না। এর প্রতিরোধ ও গতিরোধে অপ্রয়োজনীয় প্রয়াসও চালাই না। কেননা, দ্বীনের সাথে এ কাজের কোনো সম্পর্ক নেই। তার উদ্ভব প্রচলিত প্রথার কারণেই হয়েছিল- দ্বীন ও মিল্লাতের কারণে নয়।
তিনি (মুজাদ্দেদ) আরো বলেছেন, প্রত্যেক বেদআতী ও বিভ্রান্ত ব্যক্তি স্বীয় বাতিল আকিদার যথাযোগ্যতা প্রমাণের জন্য কুরআন ও সুন্নারই আশ্রয় নিয়ে থাকে ও দোহাই পাড়ে। অথচ নিঃসন্দেহে তা নিস্ফল ও নিরর্থক। এজন্য সর্বাগ্রে আকায়েদ পরিশোধন নেহায়েত জরুরি। এরপর হালাল-হারাম, ফরজ-ওয়াজিব প্রভৃতি শরীয়তের হুকুম আহকাম সম্পর্কে জ্ঞানর্জন, তারপর তদানুযায়ী আমল এবং এরপরেই তাজকিয়ার (আত্মার বিশুদ্ধকরণ) স্থান।
(ঘ) পীরবাদ : এ সম্পর্কে মুজাদ্দেদ (র.) বলেছেন, পীরবাদ দ্বারা আল্লাহর খলিফারা মানুষের খলিফা হয়ে যায়। আলাদা হয়ে যায় শরীয়ত থেকে তরীকত। শরীয়তের অধীনে না হলে যে কোনো তরীকতই সুস্পষ্ট গোমরাহী। পীরবাদীরা রাসুলুল্লাহ (স.)-এর অনুসরণের পরিবর্তে পীরের অনুসরণ করে গোমরাহ হয়।
(ঙ) সুফীবাদ : এ সম্পর্কে মুজাদ্দেদ (র.)-এর বক্তব্যের সারকথা হলো, পথভ্রষ্ট সুফীবাদের মাধ্যমে মহাবিপ্লবী মুসলমানেরা হয়ে যায় মহাধ্যানী, মহাযোগী বা বৈরাগীতে। বনের রাজা সিংহরা পরিণত হয় গৃহপালিত বিড়ালে।
মূল ইসলামে উপরোক্ত ক্ষতিকর মতবাদসমূহের অনুপ্রবেশের ফলে সম্রাট আকবরের আমলে ভারতবর্ষের আলেম সমাজ ও মুসলমানদের বেশির ভাগ সদস্যই ঈমান ও আমল হারিয়ে গোমরাহীতে নিমজ্জিত হয়েছিল। আকবর এ সকল গোমরাহ সুফী (বিড়াল)দেরকে শুঁটকী দিয়ে, পীরদেরকে শিরনী দিয়ে, বেদাআতীদেরকে অপকর্মের লাইসেন্স দিয়ে নিজের ইসলামবিরোধী কার্যকলাপের সহযোগীতে পরিণত করেছিল। এ জন্যই সম্রাট আকবরের আমলে ভারতবর্ষের পীর-সুফী বেদআতীরা আকবরের ইসলামবিরোধী অপকর্মের প্রতিবাদ করেনি এবং সঠিক ইসলামপন্থীদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য আকবরের সহযোগী হয়েছিল।
মুজাদ্দেদ (র.) সাহেবের আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণকারী ও তৃতীয় পুত্র খাজা মাসুম বলেছেন-
তিন ব্যক্তির সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকবে-
১. দায়িত্বে অবহেলাকারী আলেম।
২. শরীয়তবিরোধী দরবেশ।
৩. মূর্খ সুফী।
তিনি আরো বলেছেন-
যে ব্যক্তি আধ্যাত্মিক দীক্ষা দানকারী পীরের আসনে আসীন হয়েছে অথচ রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সুন্নাতের অনুসারী নয় এবং শরীয়তের অলঙ্কারে সুসজ্জিত নয়Ñ তার থেকে দূরে অবস্থান করিও... সে আত্মগোপনকারী চোর এবং শয়তানের এজেন্ট।
৩. শরীয়ত, তরীকত ও হাকিকত সম্পর্কে মুজাদ্দেদ (র.)-এর বক্তব্য
শরীয়তের তিন অংশ- জ্ঞান (ইলম), কর্ম (আমল) ও একাগ্রতা বা নিষ্ঠা (ইখলাস)। যতক্ষণ পর্যন্ত এ তিনটির সম্মিলন না হলো ততক্ষণ শরীয়ত হলো না। যখন শরীয়ত প্রমাণিত ও বাস্তবায়িত হয়ে গেল, আল্লাহর সন্তুষ্টিও হাসিল হয়ে গেল। ইহকালীন ও পরকালীন যাবতীয় সৌভাগ্যের চাবিকাঠি একমাত্র শরীয়ত।
তরীকত ও হাকিকত (আধ্যাত্মিকতা) সুফীদের বৈশিষ্ট্য গুণ। কিন্তু এ দুটি জিনিস শরীয়তের তৃতীয় অংশ অর্থাৎ ইসলাম এর পূর্ণতার জন্য শরীয়তের খাদেম বিশেষ। শরীয়তের পূর্ণতা বিধানই হচ্ছে তরীকত ও হাকিকতের একমাত্র উদ্দেশ্য।
৪. কেয়াস ও ইজতিহাদ
এ প্রসঙ্গে মুজাদ্দিদ (র.)-এর বক্তব্যের মূল কথা হলো- কেয়াস (অনুমান) ও ইজতিহাদের কোনো সম্পর্ক বেদআতের সঙ্গে নেই। কেয়াস ও ইজতিহাদ অতিরিক্ত কোনো কিছুর সৃষ্টি করে না। বরং তা একমাত্র কুরআন ও হাদীসের উদ্দেশ্য ও মর্মার্থকে প্রকাশ করে থাকে।
শেখ আহমদ সারহিন্দীর সংস্কার কর্মসূচি
তিনি সহজ-সরল-বোধগম্য ভাষায় তাঁর উপলব্ধি ও সিদ্ধান্ত মৌখিক ও লিখিত আকারে জাতির সামনে তুলে ধরেন। তিনি বুঝেছিলেন মূল ইসলাম ধর্মে অন্যান্য বিষয় অনুপ্রবেশের ধারাবাহিকতায় ধর্মনেতাদের বেশির ভাগ অংশ বিপদগামী এবং মাতৃভাষায় ইসলামকে না বুঝার কারণে জনগণ গোমরাহীতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। তাঁর সমকালীন উপলব্ধি ছিল- শাসকগোষ্ঠীই সকল অনাচারের মূল। আরবীতে একটি প্রবচন আছে যার অর্থ হলো- “জনগণ শাসকদেরই অনুসারী হয়ে থাকে।” এ প্রসঙ্গে পত্র নং-৪৭, (১ম খ-)-এর ৬৫ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, “সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাদশাহর সম্পর্ক ঠিক তেমন- যেমন সম্পর্ক দেহের সাথে মনের। মন যদি ঠিক থাকে তবে দেহও ঠিক থাকে। যদি মন বিগড়ে যায় তবে দেহ বিপথগামী হয়। সুতরাং বাদশাহর সংশোধন সাম্রাজ্যেরই সংশোধন। বাদশাহর বিপর্যয় সমগ্র সাম্রাজ্যের ধ্বংসের নামান্তর। এ জন্য তিনি শাসক পরিবর্তনের চাইতে শাসকের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তনকেই অগ্রাধিকার দেন। এর আলোকে তাঁর কর্মসূচি ছিল-
(ক) বেসরকারি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংশোধন।
(খ) উচ্চপদস্থ সরকারি আমলাদের সংশোধন।
(গ) বাদশাহর সংশোধন।
(ঘ) দুনিয়াদার ও দরবারী আলেমদের সংশোধন।
উক্ত কর্মসূচি বাস্তবায়নের পদ্ধতি ও পন্থা ছিল নিম্নরূপ-
তিনি তাঁর কর্মসূচি বাস্তবায়নে তরবারির আশ্রয় নেননি। তিনি ভারতের নেতৃস্থানীয় সামরিক-বেসামরিক, সরকারি-বেসরকারি গুরত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের এবং জনগণের মনোজগতে বিপ্লব সৃষ্টির পন্থা অনুসরণ করেন। উক্ত বিপ্লব তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষের চিন্তায় ও দৃষ্টিভঙ্গীতে, নৈতিকতা ও তামাদ্দুনে, রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থায়, সমাজ ও অর্থনীতিতে। তাঁর একমাত্র পাথেয় ছিল- আল্লাহর উপর নির্ভরশীলতা, আল্লাহর সাহায্য এবং দৃঢ় মনোবল। এ লক্ষ্যে তাঁর কার্যক্রম ছিল নিম্নরূপ-
১. তিনি প্রথমত লোকদের সামনে দ্বীনের সঠিক রূপটি তুলে ধরেন, যারা তা গ্রহণ করে তাদেরকে সংঘবদ্ধ করেন এবং তাদের চারিত্রিক দিক অর্থাৎ ঈমান, আকীদা ও আচার-আচরণ সংশোধন করতে সচেষ্ট হন।
২. তিনি বেদআতের প্রকাশ্য বিরোধিতায় না গিয়ে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সুন্নাত অনুসরণের নির্দেশ দিতেন। আর এটাকেই সফলতা ও সৌভাগ্যের একমাত্র পথ বলে ঘোষণা করতেন। তাঁর বক্তব্য ছিল- “বন্দেগীর সকল প্রকার হক আদায় করা এবং আল্লাহর প্রতি সর্বদা ও সব সময় দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখাই মানব সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য। এই অবস্থা ঠিক তখনি সৃষ্টি হবে- মানুষ যখন দুনিয়া ও আখেরাতের মহান নেতার আদর্শকে প্রকাশ্যে ও গোপনে সর্বাবস্থায় পূর্ণরূপে অনুসরণ করবে।”
পার্থিব শান্তি ও উন্নতি এবং পরকালীন মুক্তি একমাত্র নবী (স.)-এর আদর্শের অনুসরণের উপরই নির্ভলশীল। একজন মুসলমান যখন পূর্ণভাবে নবী (স.)-এর আদর্শের অনুসরণ করে তখনিই সে আল্লাহর সত্যিকার বান্দায় পরিণত হয়। উন্নীত হয় আল্লাহর প্রেমাষ্পদের পর্যায়ে, লাভ করে সফলতা ও পূর্ণতা। এই সফলতা লাভকারী ও পূর্ণতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ বনী ইসরাইলের নবীগণের সমপর্যায়ে উন্নীত হয়।
৩. তিনি আগ্রা, সারহিন্দ ও লাহোরে উচ্চ মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন এবং ছাত্রদেরকে স্বীয় লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের অনুকূলে প্রস্তুত করেন।
৪. তিনি ভারতের বিশিষ্ট বেসরকারি ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করেন এবং অনেককে স্বীয় মতে দীক্ষিত করেন।
৫. তিনি সম্রাট আকবরের ঘনিষ্ঠ সুন্নী মতাবলম্বী সভাসদদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের অনেককে স্বীয় মতাদর্শে দীক্ষিত করেন। এ সকল সভাসদদের তৎপরতায় সম্রাট আকবর শেষ জীবনে তওবা করে আপন ধর্মে ফিরে আসেন।
৬. আকবরের মৃত্যুর পর ১০১৪ হিজরীতে সম্রাট জাহাঙ্গীর সিংহাসনারোহণ করলে তিনি চূড়ান্ত লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। তিনি স্বমতে দীক্ষিত দরবারের সভাসদদের দ্বারা জাহাঙ্গীরের মনোভাবকে ইসলামের অনুকূলে আনতে সক্ষম হন এবং এক পর্যায়ে সম্রাট জাহাঙ্গীর মুজাদ্দেদ (র.)-এর দাবিগুলো মেনে নেন। অবশ্য দাবি মানার পূর্বে সম্রাট জাহাঙ্গীর মুজাদ্দিদকে স্বীয় সিংহাসনের জন্য হুমকি মনে করে কুখ্যাত গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দী করেন। দুর্গাধিপতি এক সময় সম্রাটের নিকট এই মর্মে রিপোর্ট প্রেরণ করেন যে, “আহমদ সারহিন্দ এর সংস্পর্শে থেকে গোয়ালিয়র দুর্গের পশুসুলভ বন্দীরা মানুষে পরিণত হয়েছে এবং মানুষগুলো ফেরেশতায় পরিণত হয়েছে।” এরূপ রিপোর্ট পাওয়ার পর সম্রাট জাহাঙ্গীর নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং মুজাদ্দেদকে মুক্তি দান করে তাঁর সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। সাক্ষাতে মুজাদ্দিদ (র.) সম্রাটের নিকট স্বীয় দাবিনামা পেশ করেন। তাঁর দাবিগুলো ছিল-
(ক) সম্রাটকে সেজদা করার রীতি সম্পূর্ণভাবে রহিত করতে হবে।
(খ) মুসলমানদেরকে গরু জবেহ করার অনুমতি দিতে হবে।
(গ) বাদশাহ ও তাঁর দরবারীদের জামায়াতে নামাজ আদায় করতে হবে।
(ঘ) কাজীর পদ ও শরীয়ত বিভাগ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
(ঙ) সমস্ত বেদায়াত ও ইসলামবিরোধী অনাচারকে সমূলে উৎখাত করতে হবে।
(চ) ইসলামবিরোধী যাবতীয় আইন রহিত করতে হবে।
(ছ) ভগ্ন ও বিধ্বস্ত মসজিদগুলোকে পুনরায় আবাদ করতে হবে।
(উল্লেখ্য, সম্রাট আকবরের আমলে হিন্দুরা ভারতের অনেক মসজিদকে ধ্বংস করেছিল এবং অনেকগুলোকে মন্দিরে পরিণত করেছিল।)
সম্রাট জাহাঙ্গীর মুজাদ্দেদ (র.)-এর দাবিসমূহ সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেন এবং শাহী ফরমান জারি করে তা কার্যকর করেন।
মুজাদ্দেদ (র.)-এর দাবির সারকথা ছিলÑ নির্ভেজাল ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা। অপর কোনো ধর্ম বা ফেরকার বিরোধিতা করা বা ব্যক্তিগত লাভের কোনো ব্যাপার এতে ছিল না।
৭. প্রত্যেক শহর ও পল্লীতে মুজাদ্দেদ (র.) সাহেবের একজন করে প্রতিনিধি ছিলেন যারা নিজেদের উদ্দেশ্যের প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান, একাগ্রচিত্ত ও বজ্রকঠোর।
মুজাদ্দেদে আলফেসানী (র.) কেন সশস্ত্র যুদ্ধের পথে যাননি?
রোগ বুঝে চিকিৎসা করা মুজাদ্দেদ (র.)-এর নীতি ছিল। তিনি জানতেন, একশ্রেণীর দুনিয়াদার দরবারী আলেম, পীর ও সুফী সম্রাট আকবরকে ইসলামবিমুখ করেছে। তার সাথে যোগ হয়েছিল শিয়া মূলহেদ সম্প্রদায় ও হিন্দুরা। অথচ প্রথম জীবনে আকবর ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন। এমতাবস্থায় তিনি প্রথমে আকবরের সভাসদদের শুদ্ধ করেন এবং অতঃপর উক্ত সভাসদদের মাধ্যমে আকবরের মানসিক পরিবর্তনের প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন। এছাড়া আরো যেসব কারণ অনুমান করা যায় তা হলো-
১. হাদীসের নির্দেশ অনুযায়ী কোনো মুসলিম শাসনকর্তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লব ঠিক তখনই জায়েজ, যখন প্রমাণিত হবে যে, তিনি প্রকাশ্যে কুফরীতে ও ইসলামদ্রোহীতায় লিপ্ত রয়েছেন। মুশরেকী ও কাফেরী কার্যকলাপ সংগঠিত হওয়া যদিও হারাম তবুও কোনো ব্যক্তিকে ঠিক তখনই কাফের ঘোষণা করা যায়, যখন তাকে মুসলমান বলার মতো আর কোনো কারণই বিদ্যমান থাকে না। সম্ভবত আকবরের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদে অবতীর্ণ হওয়ার শক্তি মুজাদ্দিদ সাহেব তখনও অর্জন করতে পারেননি। অথচ শরীয়তের দৃষ্টিতে জেহাদ ঘোষণার জন্য শর্ত হলো- এতটুকু বৈষয়িক শক্তি অর্জিত হতে হবে, যা দ্বারা বিজয়ী ও সফল হওয়ার কিছুটা আশা করা যায়। তাছাড়া আকবরের জীবনে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসাটাও সশস্ত্র যুদ্ধ না করার কারণ হতে পারে।
২. মুজাদ্দেদ সাহেব আকবরকে স্বার্থপর ও ফাসেক মুসলমান বলতেন। অসাধু চাটুকার ও স্বার্থপর লোকদের দ্বারা আকবর পরিবেষ্টিত ছিলেন। এ জন্য আকবরের তুলনায় তিনি এসব স্বার্থপর আলেম, বিলাসপ্রিয় সভাসদ এবং চাটুকারদের সমালোচনাই বেশি করেছিলেন। সম্রাটের সংশোধনের জন্য তাঁর পারিষদদের সংশোধনকেই তিনি অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন।
৩. সরকারের সংস্কার ও সংশোধনই যার একমাত্র লক্ষ্য সে রক্তাক্ত সংগ্রামকে ঠিক তখনই জরুরি মনে করেন যখন এ ছাড়া আর গত্যন্তর থাকে না। ক্ষমতাসীনদের সংশোধনই মুজাদ্দিদ সাহেবের উদ্দেশ্য ছিল। এ লক্ষ্যেই তিনি কাজ করেছেন। শরীয়তের হুকুম-আহকাম কায়েম করাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। এ জন্য নিজেকেই ক্ষমতাসীন হতে হবে এমন বিষয়কে তিনি জরুরি মনে করেননি।
৪. মুসলমান রাজা-বাদশাহরা তখন গৃহযুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। প্রত্যেকেই অন্যের বিরুদ্ধে অযোগ্যতা, দুর্নীতিপরায়ণতা ও বিলাসিতার দোহাই পাড়তেন এবং সংশোধনের দাবি জানিয়েই যুদ্ধ ঘোষণা করতেন। ঠিক এই অবস্থায় মুজাদ্দিদ সাহেবও যদি সশস্ত্র যুদ্ধের ডাক দিতেন তবে জনগণ বিষয়টিকে ক্ষমতার লড়াই হিসেবে মনে করতেন। এমতাবস্থায় ক্ষমতার হাতবদল হলেও ভিতর থেকে সংশোধন ও সংস্কার সাধিত হতো না বরং মুসলমানদের রক্ত ঝরত।
তদুপরি আকবরের অনুসৃত ধ্বংসাত্মক নীতির ফলে সাম্রাজ্যের উপর হিন্দু ও শিয়ারা বিশেষ আধিপত্য বিস্তার করে ফেলেছিল। তারা একটি আত্মঘাতি যুদ্ধ লাগার অথবা লাগানোর অপেক্ষায় ছিল। মুজাদ্দিদ সাহেব যুদ্ধ ঘোষণা করলে তারা সে সুযোগটি পেয়ে যেত এবং ভারতবর্ষের মুসলমানরা আত্মঘাতি যুদ্ধে নিঃশেষ হয়ে যেত।
এ সকল কারণে মুজাদ্দেদ (র.) সমস্যার সমাধান ও কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে অহিংস নীতি অবলম্বন করেছিলেন।
তথ্যসূত্র : মুজাদ্দিদ-ই-আলফেসানীর সংস্কার আন্দোলন, মোহাম্মদ রুহুল আমিন, ১ম প্রকাশ, ইফাবা প্রকাশনী
লেখক : সম্পাদক, মাসিক ইতিহাস-অন্বেষা