ফরাসী বিপ্লবের পূর্বে ইউরোপে ইহুদীদের নাগরিক অধিকার ছিল না। ইহুদীদের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত ফরাসী বিপ্লবের ঢেউ ইউরোপের অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত দেশের সরকার ও প্রশাসন ব্যবস্থায় ইহুদী ষড়যন্ত্রকারীরা জেঁকে বসে। যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বে লন্ডনই ছিল ইহুদী ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রভূমি। ইহুদীদের ষড়যন্ত্রে পরিচালিত হয়ে ব্রিটিশ জাতি বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্য কায়েম করে সমগ্র বিশ্বে লুণ্ঠন করে অবশেষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়। ব্রিটিশ জাতি সর্বস্ব হারালেও নেপথ্যে থাকা ইহুদীরা ব্রিটিশদের লুট করা সম্পদরাজি নিজেদের গোলায় তুলে নেয়। একই অবস্থা এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। বৃটেনের পতনের পর ইহুদী ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় নিউইয়র্ক। ইহুদী পরিচালনায় যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্বব্যাপী লুটতরাজ, দেশ দখল অব্যাহত রাখে। একই নিয়মে ইহুদীরা মার্কিন জাতির লুট করা সম্পদ নিজেদের গোলায় তুলে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে দেউলিয়াত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ইহুদীদের পরবর্তী গন্তব্য সম্ভবত ভারত, চীন অথবা অন্য কোনো উদীয়মান জাতির রাজধানীকে সাব্যস্ত করা হবে।
তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে
সম্পদশালী ও শান্তিময় দেশ
ভারতবর্ষকে সর্বশান্ত করার লক্ষ্যে মোগল আমলে ইহুদীরা মাদ্রাজে এবং কোলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে
তাদের ষড়যন্ত্রের গোপন
ঘাঁটি ‘ফ্রী ম্যাসন লজ’ স্থাপন করেছিল। ইহুদী ষড়যন্ত্রের গোপন দলিল ÔProtocol
of the elders of the ZionÕ বইতে ফরাসী
বিপ্লবে তাদের ভূমিকার কথা এবং মাদ্রাজ ও পোর্ট উইলিয়ামে ‘ফ্রী ম্যাসন লজ’ স্থাপনের কথা
উল্লেখ রয়েছে। এ দুটি গোপন ঘাঁটির মাধ্যমে ইহুদীরা এ দেশের কিছুসংখ্যক চরিত্রহীন, ক্ষমতালোভী, নারী লোলুপ ব্যক্তিকে সংগ্রহ
করে উদীয়মান ব্রিটিশ বণিকদের মাধ্যমে প্রথমে বাংলা-বিহার- উড়িষ্যার স্বাধীনতা হরণ করে এবং পরবর্তীতে সমগ্র ভারত উপমহাদেশের
স্বাধীনতা হরণ করে।
দখলীকৃত ভূখ-কে দীর্ঘদিন যাবত শাসন- শোষণের লক্ষ্যে Protocol-এ বর্ণিত Divide & Rule নীতিকেই অনুসরণ করেছে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ
বণিক ও রাজশক্তি। এ জন্য দেখা যায় পৃথিবীর যে দেশে ব্রিটিশ শাসন কায়েম হয়েছে সে দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতি, ধর্মীয় ব্যবস্থায়
বিভেদের বিষবৃক্ষ রোপণ করা হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে উক্ত বিষবৃক্ষের ফুল, ফল, চারা সমগ্র দেশ ও
জাতিকে চরম অশান্তিতে
নিমজ্জিত করেছে। মুসলিম শাসনামলে ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, উপজাতি নির্বিশেষে সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে অবদান রেখে উপমহাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী ও
শান্তিময় দেশে পরিণত করেছিল। তখন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, রাজা জমিদারের
লোমহর্ষক অত্যাচার নিপীড়ন, সাম্প্রদায়িক
হানাহানি, শাসক মহলের শোষণ, অত্যাচার-নিপীড়নের সাথে উপমহাদেশবাসী অপরিচিত ছিল। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসন কায়েম হওয়ার পরে
ব্রিটিশ রোপিত বিষবৃক্ষের প্রতিক্রিয়ায় সমগ্র উপমহাদেশ ১৭৫৭ থেকে অদ্যাবধি জ্বলছে। অথচ ১৯৪৭ সালের পর থেকে উপমহাদেশে অশান্তি থাকার কথা ছিল না। ব্রিটিশ
শাসকগোষ্ঠী উপমহাদেশ ত্যাগ করার সময় তাদের ভাবশিষ্য নেহেরুপ যাটেল-বিড়লা-ইস্পাহানির সাথে ষড়যন্ত্র করে একটি অযৌক্তিক, অন্যায্য দেশ বিভাগ কার্যকর করায় উপমহাদেশ এখনও জ্বলছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে ব্রিটিশ রোপিত বিষবৃক্ষসমূহ চিহ্নিত করে
উপড়ে ফেলতে হবে এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা ১৯৪৭- এর মানচিত্রকে ন্যায্য ও যৌক্তিকভাবে পুনর্বিন্যাস করতে হবে। ১৯৪৭ পর অন্যায়ভাবে দখল করা ভূখণ্ড- ও জাতিসমূহকে স্বাধীনতা প্রদান করতে
হবে।
পাঠকবৃন্দের মনে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে
আমি ষড়যন্ত্রকারী
হিসেবে নেহেরু-প্যাটেল গংয়ের নাম করলাম অথচ জিন্নাহ গং-এর নাম নিলাম না। তদুপরি
বিড়লা-ইস্পাহানীর ন্যায় স্বনামধন্য ব্যবসায়ীদেরকেও কেন ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে উল্লেখ করলাম?
এর সংক্ষিপ্ত উত্তর এই যে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী নেহেরু পরিবারকে তাদের সার্থক উত্তরসূরি
হিসেবে উপমহাদেশে প্রতিষ্ঠা করে গেছে আর প্যাটেল ছিলেন দখলদার ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর সার্থক উত্তরসূরি। বিড়লা ও ইস্পাহানী ছিলেন ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর
স্বার্থরক্ষাকারী পদলেহী ব্যবসায়ী-শিল্পপতি। উভয়ের অন্য পরিচয় ছিল বিড়লা নিয়ন্ত্রণ করতেন
ভারতীয় কংগ্রেস আর ইস্পাহানী নিয়ন্ত্রণ করতেন মুসলিম লীগকে। অন্যায্য দেশ বিভাগে জিন্নাহকে রাজী করাতে ইস্পাহানীর ব্যক্তিগত
লাভ-ক্ষতি ছিল মুখ্য। নেহেরু-প্যাটেল সম্পর্কে ঐতিহাসিক তথ্য অন্যত্র আলোচনা করা হবে। নিম্নে বিড়লা- ইস্পাহানীর ভূমিকা
সম্পর্কিত তথ্য উল্লেখ করা হলো।
১৯৪৭ সালে বর্তমান ভারতের
জাতির পিতা মোহনদাস করমচাঁদ
গান্ধী ভারত বিভাগ কোনোভাবেই মেনে নিতে চাননি। অপরদিকে পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সমগ্র পাঞ্জাব, সমগ্র বাংলা ও আসাম ব্যতিত দেশ বিভাগ মেনে নিতে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন। এমতাবস্থায় পর্দার অন্তরালে ঘটে যাওয়া ঘটনাই উভয়কে
সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য করে। উক্ত ঘটনাটি ছিল এই- “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিড়লা ও ইস্পাহানী যৌথভাবে ব্রিটিশ সরকারকে
খাদ্য-শস্য সরবরাহের ঠিকাদারী পান। উভয়ের খাদ্য সংগ্রহের ফলে বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, যাতে কমপক্ষে ৫০ লাখ লোক মারা যায়। উক্ত ব্যবসা থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশের কয়েক কোটি টাকা ইস্পাহানী বেনামীতে
বিড়লার মালিকানাধীন
ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে জমা রাখেন। ডা. বিধান চন্দ্রের অনুরোধে বিড়লা এই টাকা বাজেয়াপ্ত
করার হুমকি দিলে ইস্পাহানি মি. জিন্নাহকে চাপ প্রয়োগ করে খণ্ডিত বাংলা ও পাঞ্জাব নিয়ে
গঠিত পাকিস্তান প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য করেন। একইভাবে ডা. বিধান চন্দ্র রায় বিড়লাকে দিয়ে মি. গান্ধীকে চাপ প্রয়োগ করে
ভারত বিভাগ মেনে নিতে বাধ্য করেন। (তথ্য সূত্র : দৈনিক আজকাল, ২৪/০৮/১৯৯৫,
লেখক ও প্রত্যক্ষদর্শী-ড. পূর্ণেন্দু ঝা) উক্ত সময়ে সমগ্র বাংলা ও পাঞ্জাবকে পাকিস্তানভুক্ত করার জন্য সমগ্র ভারতে চলমান
রক্তক্ষয়ী দাঙ্গায় লাখ লাখ লোক আহত নিহত হচ্ছিল। ইস্পাহানীবিড়লার ব্যবসায়ীক স্বার্থে
রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অন্যায্য দেশ বিভাগ মেনে নিয়ে উপমহাদেশকে দীর্ঘস্থায়ী অশান্তির আবর্তে নিক্ষেপ করে।
উপমহাদেশে অশান্তির কারণ
উপমহাদেশে অশান্তির প্রথম কারণ ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর Divide & Rule Policy সৃষ্ট ভারতীয় জনমানসের বহুধা বিভক্তি, দ্বিতীয় কারণ অন্যায্য ও অযৌক্তিক দেশ বিভক্তি, তৃতীয় কারণ ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর মানসপুত্র পণ্ডিত নেহেরুর India
Doctrine এবং চতুর্থ কারণ হলো ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক অপর দেশ-জাতি দখলের অন্তহীন
অপকর্ম। এতদসংক্রান্ত প্রামাণ্য তথ্যাদি
নিম্নরূপ-
(ক)Divide & Rule Policy- মুসলিম শাসকদের নিকট থেকে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী
ভারতবর্ষের ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল বিধায় মুসলমানদেরকে প্রতিপক্ষ
বানানো হলো এবং ব্রিটিশদের পদলেহী অপরাপর অমুসলিমদেরকে ব্রিটিশরা স্বপক্ষে টেনে নিল। তারা প্রথমে মুসলমানদের
হাত থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা
কেড়ে নেয়। তৎপর সেনাবাহিনী ও সরকারি চাকরি থেকে মুসলমানদেরকে বিতাড়িত করে তাদের আজ্ঞাবহ অমুসলিমদেরকে দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করে, তৎপর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও সূর্যাস্ত আইনের মাধ্যমে মুসলমান
জমিদারদের জমি কেড়ে নিয়ে নিম্নশ্রেণীর নিষ্ঠুর অমুসলিমদেরকে জমিদার বানায়। রাষ্ট্রভাষা ফারসী বাতিল করে মুসলমানদেরকে মুর্খ ও
চাষীতে পরিণত করে। বিভিন্নমুখী করারোপ করে
ও নীলচাষে দাদন নিতে বাধ্য করে জনগণকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে। এরপর শুরু হয় ভারতবাসীর
ইতিহাস ও ধর্ম বিকৃত করার কাজ, নতুন নতুন ধর্মমত প্রবর্তন করে জনগণের মধ্যে ধর্মীয় হানাহানির পথ উন্মুক্ত
করা হয়। বিভিন্ন ধর্মের কিছু সংখ্যক নীতিহীন ধর্মনেতাকে বৈষয়িক সুবিধা দিয়ে নতুন নতুন
ধর্মীয় দল-উপদল, ফের্কা সৃষ্টি করে
প্রত্যেক ধর্মের জনগণকে বহুধাবিভক্ত করা হয়। সাম্প্রদায়িক দূরত্ব সৃষ্টির ইতিহাস, তালপত্র, পুঁথি, ধর্মগ্রন্থ, মুদ্রা, শিলালিপি তৈরি করে বিভাজনকে অনতিক্রমনীয় করে তোলা হয়। ভারতীয় জনগণকে মানসিকভাবে বিভক্ত করার জন্য কিছু নতুন মতবাদ চালু করা হয়। তন্মধ্যে প্রধান দুটি মতবাদ হল- আর্য-অনার্য
তত্ত্ব এবং হিদেন বা হিন্দু
নামকরণ।
১. আর্য-অনার্য তত্ত্ব : ব্রিটিশ
শাসনের সূচনালগ্ন থেকে যে সকল অমুসলিম
ব্যক্তিবর্গ তাদেরকে সার্বিক সহযোগিতা দিয়েছে তারা অচিরেই কুলীন শ্রেণীর মর্যাদা পায়। আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া এসব ভদ্রলোক
শ্রেণীর অনেকে পূর্ব থেকে ব্রাহ্মণ বংশোদ্ভুত ছিলেন, অনেককে ব্রাহ্মণ শ্রেণীতে
অন্তর্ভুক্ত করা হয় অথবা নিদেন পক্ষে কায়স্থ শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করা হয়। প্রথম পর্ব সমাধা হওয়ার পর
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ক্রিড়ানক জার্মান বুদ্ধিজীবী
ম্যাক্স মুলার অশ্রুতপূর্ব আর্য-অনার্য তত্ত্ব নিয়ে হাজির হন। এ মতবাদ দ্বারা ভারতবর্ষের জনগণকে সুস্পষ্ট ২ ভাগে ভাগ করা হয়।
ইংরেজের পদলেহী সহযোগীরা হয়ে গেল আর্য বা প্রাচীন বিজয়ী শ্রেণী আর অন্যরা হয়ে গেল বিজিত বা অনার্য শ্রেণী। প্রাচীন ভারতের
সকল সভ্যতার মালিক-মোখতার
বানানো হলো আর্যদেরকে আর সকল অনিষ্টের কারণ বানানো হলো অবশিষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতবাসীকে। অথচ
১৮৬০ সালের পূর্ব পর্যন্ত পৃথিবীবাসী আর্য জাতি সম্পর্কে জানতো না।
নব-আবিষ্কৃত আর্য জাতি (Aryan) তত্ত্বের মাধ্যমে ভারতবর্ষের ব্রাহ্মণগণ জানতে পারে যে, তারা ইউরোপের জার্মান ও ব্রিটিশ জাতির সমগোত্রীয়। ক্রমে ক্রমে আর্যতত্ত্ব এ দেশের
ব্রাহ্মণদের বিশ্বাসের অংশে পরিণত হয় এবং তারা মনে করতে থাকে যে, তারা অর্থাৎ
ব্রাহ্মণরা ইউরোপীয় বংশোদ্ভুদ। ইউরোপের স্বার্থ রক্ষার্থে নীচু জাতের native অনার্যদের ঘৃণা করা, শাসন- শোষণ-জুলুম-নিপীড়ন করা তাদের মৌরসী অধিকার। ইতোমধ্যে এদেশবাসীকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করার
প্রচেষ্টায় ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবীরা নতুন নতুন হিন্দু ধর্ম গ্রন্থ রচনা করে তাতে খ্রিস্টানদের
ত্রিতত্ত্ববাদের অনুপ্রবেশ ঘটায়। এতদসংক্রান্ত প্রামাণ্য তথ্যাদি সংক্ষেপে নিম্নরূপ-
১. পৃথিবীতে আর্য জাতি
নামে কোনো কালে কোনো জাতি বা মানববংশের অস্তিত্ব ছিল- এর সমর্থনে কোনো সাক্ষ্য
নাই। প্রমাণ নাই। তবুও
বিংশ শতাব্দীতে প্রথম ভাগ পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই এই আর্য জাতিই হয়ে ওঠে মানব ইতিহাসে সবচেয়ে বাস্তব। সবচেয়ে শক্তিশালী মানব বংশ। আর্য জাতির কথা পৃথিবী জানতে পারে ১৮৬০ সালের পর। (সূত্র : আর্য জাতির অস্তিত্বই ছিল না- পরমেশ চৌধুরী, পৃ : ১৭১)
২. ষড়যন্ত্রের বড় কারিগর
ম্যাক্সমূলার ইন্দো- ইউরোপীয় শব্দের ব্যবহারে ‘আর্য’ শব্দটির জন্ম দিয়েছেন। শব্দটি জার্মান হওয়ায় ম্যাক্স মুলার ষড়যন্ত্রকারী পণ্ডিতমণ্ডলীর নিকট কয়েকটি শব্দ পাঠিয়েছিলেন বেছে নেয়ার জন্য। তাঁর সৃষ্টি করা ও পাঠানো
শব্দসমূহ ছিল এরিয়ান, ইন্দো-জার্মান, ইন্দো-ইউরোপীয়ান, জাফেটিক, সাংস্কৃতিক, ম্যাডিটারেনিয়ান
প্রভৃতি। এই শব্দগুলো থেকে
জার্মানি, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স গ্রহণ করল ‘এরিয়ান’ শব্দটি। (সূত্র :
ঐ, পৃ-১৯৪)
৩. ১৮৮৬ সালের ১০ এপ্রিল
লন্ডনের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটিতে একটা ষড়যন্ত্রের জন্ম হয়েছিল। সে ষড়যন্ত্রটা ছিল ‘আর্যদের ভারত আক্রমণ তত্ত্ব’। এ কাল্পনিক তত্ত্বটিকে প্রতিষ্ঠিত করা হলো। (সূত্র : ঐ পৃ. ৭৭)
৪. ব্রিটিশরা ভারতের
ইতিহাস বিকৃতি ঘটিয়েছিলেন তাঁদের নিজেদের স্বার্থে। ভারতবাসীদের বোকা বানিয়ে তাদের ওপর ইচ্ছে মতো জবর-দখল-ভোগ করার জন্য। (সূত্র : ঐ পৃ. ১২২)
৫. ইতিহাস গবেষণার
ক্ষেত্রে এই আর্য নামক ধারণাটি অনেক বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে।... আর্য ধারণাটি ব্রিটিশ
শাসনাধীন শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত ভারতীয়দের হীনমন্যতা দূরীকরণে কিছুটা সাহায্য করেছিল সন্দেহ নেই। উচ্চবর্ণের ভারতীয়
এবং তাদের মালিক ইংরেজরা যে
আসলে একই গাছের ফল, এ রকম একটা বিশ্বাস এ
দেশে সহজে দানা বেঁধেছিল।
সেই হিসাবে আর্য শব্দটি আজও জনপ্রিয়। (সূত্র : নরেন্দ্রনাথ ভট্টচার্য : ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস, পৃ. ৫৬-৫৭, কলকাতা)
মূলত বর্ণাঢ্য
ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সভ্যতার স্রষ্টা ভারতীয় মুসলমানদের গৌরবকে ম্লান করার জন্য ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী আর্য তত্ত্বসহ আরও অনেক মিথ্যা ইতিহাস রচনা
করে তাদের দালালদেরকে
ভূতপূর্ব মুসলমান ও বৌদ্ধ শাসকগোষ্ঠীর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গড়ার প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। এসব কাল্পনিক
মতবাদ, পরিকল্পিত ধর্মগ্রন্থ ও বিকৃত
ইতিহাস ভারতীয় জনগণকে বহুধা বিভক্ত করেছে এবং ভারতের হিন্দু-মুসলমােনর মাঝে,
শিখ-হিন্দুর মধ্যে, বর্ণহিন্দু ও হরিজনের মধ্যে টাইম বোমা স্থাপনের কাজ করেছে। ইংরেজ রচিত
ইতিহাসই হিন্দুদেরকে বলেছে, বাবরী মসজিদের স্থলে
রামের জন্ম হয়েছে এবং
দক্ষিণেশ্বরের মন্দির এক সময় মসজিদ ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ সালে বাবরী মসজিদ ধ্বংস হয়। দ্বিতীয় বিস্ফোরণ কবে ঘটে তা ইতিহাসই বলে দেবে।
২. হিদেন বা হিন্দু
নামকরণ তত্ত্ব : আরব ও ইরানের জনগণ সিন্ধু নদের পাড়ের বা সিন্ধু নদের পূর্ব পাড়ের
অধিবাসীদেরকে সিন্ধু বা সিন্ধী হিসাবে নামকরণ করেন। এই নামকরণটি ধর্মীয় বা জাতিগত নয়- ইহা আঞ্চলিক বা ভূখণ্ড-গত নাম। এ
অঞ্চলের যেসব অধিবাসীর
সাথে ইরানীরা মিশেছিল তাদের আচার ব্যবহার ও কার্যকলাপের বৈশিষ্ট্যের দরুন ফার্সী অভিধানসমূহ ও
Samsad English-Bengal; dictionery- তে হিন্দু শব্দের যে অর্থ
লেখা রয়েছে তা রীতিমতো কদর্যপূর্ণ ও অবমাননাকর। ইংরেজ ও ভারতীয় পণ্ডিতগণ হিন্দু শব্দের এরূপ কদর্য অর্থ সম্পর্কে জানতেন। এতদসত্ত্বেও সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ রাজশক্তির পরামর্শে এদেশীয় ব্রাহ্মণগণ বিশেষ
উদ্দেশে এই শব্দটিকে নিজেদের
পরিচিত হিসেবে নির্বাচন করেন। এর ফলে ভারতবর্ষের মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান ও
পারসিক ব্যতিত অপরাপর সকল জাতিগোষ্ঠীকে হিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ
মুসলমানরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয় এবং সংখ্যালঘু ব্রাহ্মণরা (যারা মাত্র ৯%) সংখ্যাগুরু
হিন্দু জাতির পরিচালকের আসন
দখল করে। এই তত্ত্বের দ্বারাই ব্রাহ্মণবাদী শাসকগোষ্ঠী ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময়
ভারতের অধিকাংশ এলাকা কুক্ষিগত করে। অথচ যাদের কপালে হিন্দুত্বের সীল মেরে ব্রাহ্মণরা
ভারতের বৃহৎ অংশ দখল করে নিয়েছে তাদের অধিকাংশকে মন্দিরে প্রবেশের অধিকারও দেওয়া হয় না। নিজেদের বৈষয়িক ও সাম্রাজ্যবাদী
স্বার্থে ব্রাহ্মণরা কিরূপ কলঙ্কজনক শব্দকে নিজেদের পরিচিতি হিসেবে সাব্যস্ত করেছে, এবং গলার মালার ন্যায় ঝুলিয়েছে। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে তা উল্লেখ রা হলো-
১. যে হিন্দু নামে পরিচয়
দেওয়া এখন আমাদের নিয়ম হয়ে
দাঁড়িয়েছে তার কোনো সার্থকতা নেই। কারণ ঐ শব্দের অর্থ যারা সিন্ধু নদের পাড়ে বাস করতো।... মুসলমান শাসনামল থেকে আমরা ঐ শব্দ নিজেদের উপর প্রয়োগ করতে শুরু করেছি।... সুতরাং আমি হিন্দু শব্দ ব্যবহার না করে ‘বৈদিক’ শব্দ ব্যবহার করব। অবশ্য ‘বৈদান্তিক’ শব্দ ব্যবহার আরও যুক্তিসংগত। (সূত্র :
বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র পৃ.
৭০০, ১৯৮৮)
২. হিন্দু বা হিদেন এর সহজ বাংলা অর্থ হচ্ছে অধার্মিক, নিম্নস্তরের
ধর্মাবলম্বী জাতিভুক্ত ব্যক্তি, অখ্রিস্টান,
অসভ্য বা বর্বর ব্যক্তি, রুক্ষ্ম, নিষ্ঠুর, ম্লেছ প্রভৃতি। (সূত্র : Samsad English-Bangali Dictorery, Fifth edition, 1976, p. 504)
৩. হিন্দু শব্দের অর্থ- অবিশ্বাসী,
দাস ও কৃতদাস। (সূত্র : ফার্সী অভিধান হাফত কুলযুম, ৩য় খ-, পৃ-৯৮)
৪. হিন্দু শব্দের অর্থ- চোর, চৌকিদার, দাস ও ক্রিতদাস। এখানে আরও উল্লেখ আছে ভারতের বাসিন্দাদের হিন্দি বলা হয় হিন্দু নয়। (সূত্র : ফার্সী
অভিধান বাহরে আযম, ২য় খ-, পৃ-৪৯৭)
৫. হিন্দু শব্দের অর্থ- চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারী ও
গোলাম। (সূত্র : ফার্সী অভিধান- লোগাতে কিশওয়ারী, পৃ. ৮২১- ২২)
৬. শ্রীরামপুরের পাদ্রী উইলয়াম কেরী ভারতে আসার পূর্বেই তাঁর স্বদেশ
বিলেতে এই ‘হিদেন’ নামটি ভারতীয়দের জন্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। ভারতের হিদেনদের কোন কায়দায় খ্রিস্টান করা হবে সে ষড়যন্ত্রের কারখানা তৈরি হয়ে যাওয়ার
অনেকদিন পর তিনি
পৌঁছেছিলেন ভারতে। কেরী ভারতে না এসেও হিদেনদের মধ্যে খ্রিস্টের বাণী প্রচারের জন্য উতলা হয়ে উঠেছিলেন এবং কোটারিং
শহরে The
Particular
Baptist Society for Propaguting the Gospel amongst the Healthen নামে সমিতি গঠন করেছেন। (সূত্র : বাংলার সংবাদপত্র ও বাঙালির নবজাগরণ, অধ্যাপক ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ১৯৭৭, পৃ. ১৪)
ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর
পদলেহী ও সহযোগী বুদ্ধিজীবী এবং নব্য ধনিক শ্রেণী হিদেন ও হিন্দু শব্দের ভয়ানক কদর্য অর্থ জেনে বুঝেও শুধুমাত্র ভারতের বিশাল জনগোষ্ঠীর
উপর আধিপত্য ও শোষণ বজায় রাখার জন্য ব্রিটিশদের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। এ ষড়যন্ত্রের স্বরূপ ছিল নিম্নরূপ- অর্থাৎ ভারতের
স্বাধীনচেতা ও মর্যাদা সচেতন জাতি মুসলিম, খ্রিস্টান,
বৌদ্ধ ও পারসিকরা ব্যতিত অপরাপর সকল জাতি- গোষ্ঠী, উপজাতি
নির্বিশেষে সকলেই হিদেন বা হিন্দু। আর মুষ্টিমেয় ব্রাহ্মণ শ্রেণী (তখন ছিল মাত্র ৬%) ও ব্রিটিশের
অনুগ্রহপ্রাপ্ত কায়স্থ শ্রেণী উক্ত হিদেনদের নেতা। এরূপ ধারণা প্রতিষ্ঠিত করার পর
সাধারণ নির্বাচন ও দেশ ভাগের সময় ব্রাহ্মণরা হয়ে গেল সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের নেতা ও
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং দেশভাগের সময় মুসলমানদেরকে বিশাল ভারতের সামান্য অংশ দিয়ে বিশাল অংশটি হিদেন বা হিন্দুদের নামে ব্রাহ্মণদের কব্জায় চলে যায়। অথচ ভারতের
বিশাল জনগোষ্ঠী, যাদের কপালে হিন্দু সীল
মেরে ব্রাহ্মণরা নিজেদেরকে ভারতের মালিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে তাদের সাথে সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় কোনো
প্রকার মিল নেই এই ব্রাহ্মণদের।
প্রাগৈতিহাসিক যুগ এবং
ঐতিহাসিক যুগ থেকে ভারতে বহু জাতি ও বহু দেশ ছিল। প্রত্যেক জাতি গোষ্ঠীর ছিল আলাদা দেশ, আলাদা ভাষা, পৃথক পৃথক দেবতা ও দেবী,
পূজা পদ্ধতি স্বতন্ত্র, সামাজিক ও পারিবারিক বিধিনিষেধ স্বতন্ত্র, বিবাহ পদ্ধতি ও মৃতের সৎকারও ছিল ভিন্ন। দীর্ঘ মুগল শাসনের শেষ দিকে মুসলমানরাই ছিল
ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি। শিখ, পার্সী, ইহুদী, বৌদ্ধ, রাজপুত, অহমী, টিপরা, মিজো, নাগা, সাঁওতাল, কুকী, লুসাই, মণিপুরী, জৈন, মার্মা, চাকমা, উড়িয়া, মারাঠা, তামিল, বিহারী, ঝাড়খণ্ডী সহ শত শত জাতি ছিল সংখ্যালঘু।
ব্রাহ্মণরা ছিল আরও সংখ্যালঘু। এমতাবস্থায় ব্রিটিশ রাজশক্তি ও সুচতুর ব্রাহ্মণরা মুসলমানদেরকে সংখ্যালঘু করার জন্য ভারতের অপরাপর
জাতিগোষ্ঠীর ললাটে হিন্দু সীল
লাগিয়ে দেয় এবং ১৯৪৭ সালে ভারতের বিশাল অংশ হিন্দুদের নামে গ্রহণ করে। কিন্তু যাদের নামে বিশাল অংশগ্রহণ করা হয়েছে তারা কিন্তু এখনও ব্রাহ্মণবাদী শাসকদের দ্বারা অবহেলিত, লাঞ্ছিত-নিপীড়িত, শোষিত ও বঞ্চিত। ব্রাহ্মণদের পুকুরের পানি ব্যবহার বা মন্দিরে প্রবেশের অধিকারও নেই এসব তথাকথিত হিন্দুদের। ভারতের দিকে দিকে যেসব স্বাধীনতার লড়াই চলছে তা মূলত ব্রাহ্মণবাদী আধিপত্য ও শোষণ বঞ্চনার
ফসল।
খ. অন্যায্য ও অযৌক্তিক
ভারত বিভাগ
সাধারণভাবে একটি ধারণা
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, মুসলিম লীগ এবং এর সভাপতি
জিন্নাহ সাহেবের দাবির কারণেই ভারত দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। কিন্তু এই ধারণাটি আংশিক সত্য হলেও পুরোপুরি সত্য
নয়। ইতিহাস বোদ্ধারা জানেন
যে, ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সময়কালে দেশ বিভাগের কোনো চিন্তা মুসলমানদের ছিল না। ১৯০৫ সালে শাসনতান্ত্রিক সুবিধার্থে ঢাকাকে পূর্ব বাংলার রাজধানী করায় প্রথমে বাংলার হিন্দু
জনগোষ্ঠী এবং পরবর্তীতে
সর্বভারতীয় হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত বিরোধিতা শুরু করায়
সর্বভারতীয় হিন্দু-মুসলিম মানস সুস্পষ্ট দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। অথচ
উক্ত বঙ্গভঙ্গের ফলে হিন্দুদের ক্ষতির কোনো কারণ ছিল না। কেবলমাত্র পূর্ব বাংলার পশ্চাদপদ মুসলমানদের লাভ হবে এই ভেবে
হিন্দুদের অন্তর বিস্ফোরিত হয়। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে ’৩৬ সালের নির্বাচনে ভারতের ৬টি প্রদেশে কংগ্রেস ক্ষমতাসীন হলে
সর্বভারতীয় মুসলমানরা চরম
নির্যাতনের শিকার হয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, কংগ্রেসের বা হিন্দুদের শাসনে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এ
সিদ্ধান্ত থেকেই ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব (যা পরবর্তীতে পাকিস্তান প্রস্তাব হিসেবে পরিচিতি
পায়) গৃহীত হয়। তখন থেকেই শুরু হয় ভারত বিভাগের বিভিন্ন ফর্মুলা বা Plan প্রণয়ন। উক্ত Planগুলো ছিল নিম্নরূপ :
জিন্নাহ প্ল্যান
১. লাহোর প্রস্তাবে
ব্রিটিশ ভারতকে তিন ভাগে ভাগ করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। (উল্লেখ্য, তখন ব্রিটিশ ভারতের আওতা বহির্ভূত আরও ২৮৩টি আধা স্বাধীন রাজ্য রাজা কর্তৃক শাসিত হতো) উক্ত তিনটি ভাগ হলো
যথাক্রমে- ক. সিন্ধু প্রদেশ, পাঞ্জাব প্রদেশ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং
বেলুচিন্তান নিয়ে একটি মুসলিম দেশ, (খ) ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বঙ্গ প্রদেশ ও আসাম প্রদেশ নিয়ে অপর একটি মুসলিম দেশ, (গ) ব্রিটিশ ভারতের বাকি অংশ নিয়ে গঠিত হবে হিন্দুস্তান।
ভারতীয় কংগ্রেস মুসলিম
লীগের লাহোর প্রস্তাবের তীব্র
বিরোধিতা করে। তারা প্রথমে পাঞ্জাবকে দুই ভাগ করার প্রস্তাব করে।
আসামকে প্রস্তাবিত মুসলিম দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার দাবি তোলে এবং সর্বশেষ বঙ্গদেশকে
দুই ভাগ করার জোর দাবি জানায়।
ক্যাবিনেট মিশন প্লান
২. ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬
সালে ভারতের তৎকালীন ভাইসরয়
ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ৩ সদস্যের কাবিনেট মিশন
ভারতে আসে। ১৬ মে ১৯৪৬ সালে ক্যাবিনেট মিশন মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবি নাকচ করে এবং ভারতের প্রদেশগুলোকে ৩টি গ্রুপে ভাগ করে ফেডারেল সরকারের অধীনে স্বাধীনতা
প্রদানের ঘোষণা দেয়। এতে উল্লেখ ছিল- দেশরক্ষা, বৈদেশিক সম্পদ ও যাতায়াত ফেডারেল সরকারের অধীনে থাকবে; বাকি ক্ষমতা থাকবে প্রাদেশিক সরকারের হাতে। সারা ভারতের ব্রিটিশ শাসিত প্রদেশগুলোকে ৩টি গ্রুপে
ভাগ করে প্রত্যেক গ্রুপকে স্বাধীনতার ১০ বছর পর প্রদেশগুলোর সংসদ সদস্যদের নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠদের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে প্রয়োজনে সে গ্রুপ কেন্দ্রীয় ফেডারেশন থেকে পৃথক হওয়ার
স্বাধীনতা থাকবে বলে উল্লেখ
করা হয়। উক্ত ৩টি গ্রুপের গঠন নিমড়বরূপ- A গ্রুপ-মাদ্রাজ প্রদেশ, বোম্বে প্রদেশ, সংযুক্ত প্রদেশ, বিহার প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ ও উড়িষ্যা প্রদেশ।
B গ্রুপ- পাঞ্জাব প্রদেশ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও সিন্ধু
প্রদেশ। C গ্রুপ- বাংলা প্রদেশ ও আসাম প্রদেশ।
গান্ধী ও নেহেরু কেবিনেট
মিশনের এই প্লান গ্রহণ করে এবং জানায় যে, ১০ বছর পরে কোনো গ্রুপের কেন্দ্রীয়
ফেডারেশন ত্যাগ করার ক্ষমতা ভারতীয় কনস্টিটিউট এসেম্বলীর সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে বাতিল করে দিতে পারবে। মুসলিম লীগ ও জিন্নাহ কেবিনেট মিশন
প্ল্যান গ্রহণ করে এবং
সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে ফেডারেশন ত্যাগ করার ক্ষমতাকে স্বাগত জানায়। মুসলিম লীগ আরও জানায়, কেবিনেট মিশনের প্রস্তাব বাতিল করার কোনো অধিকার থাকবে না কনস্টিটিউট
এসেম্বলির। উভয় পক্ষ স্ব-স্ব দাবিতে অটল থাকায় লন্ডনে উভয় পক্ষকে ডেকে পাঠানো হয়। ব্রিটিশ সরকার
কেবিনেট মিশন প্ল্যান সমর্থন করে ভাইসরয়কে প্ল্যান কার্যকর করার
নির্দেশ দিয়ে ভারতে পাঠায়।
ভাইসরয় এবং মুসলিম লীগ
প্রতিনিধি দল ভারতে
প্রত্যাবর্তন করেন। কংগ্রেস নেতারা লন্ডনে অবস্থান করে বৃটেনের কিছু প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দের সাথে গোপন
শলা-পরামর্শ করে বৃটেন সরকারের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তৎকালীন ভাইসরয়ের পরিবর্তে নেহেরুর বন্ধু লর্ড
মাউন্টব্যাটেন ভারতের ভাইসরয় নিযুক্ত হন। মাউন্টন্যাটেন ভারত এলে লেডী মাউন্টব্যাটেনের সাথে নেহেরুর এবং মাউন্টব্যাটেনের সাথে নেহেরু কন্যা ১৯ বছরের তরুণী
ইন্দিরা গান্ধীর গভীর সখ্যতা স্থাপিত হয় এবং ভারতবর্ষ অন্যায় ও অযৌক্তিক বিভক্তির শিকার
হয়। উভয় পক্ষের সাথে আলাপ শেষে মাউন্টব্যাটেন ভারত বিভাগের নিজস্ব একটি প্ল্যান প্রস্তুত করে ব্রিটিশ সরকারের অনুমোদন
নেন এবং গোপনে নেহেরুকে প্ল্যানটি দেখান। নেহেরু উক্ত প্ল্যান মেনে না নেওয়ায় মাউন্টব্যাটেন নেহেরুর
আবদার অনুযায়ী প্ল্যানটি সংশোধন করে বাংলা ও পাঞ্জাব বিভক্ত
করেন এবং কোলকাতা বন্দরকে
পশ্চিম বাংলার অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৩ জুন ১৯৪৭ সালে প্ল্যানটি ঘোষণা করেন। উল্লেখ্য, দুই পক্ষের মধ্যে সালিশ করতে এসে একপক্ষের সাথে গোপন পরামর্শ করা ও একপেশে আবদার রক্ষা করে মাউন্টব্যাটেন মূলত নীতি বিবর্জিত কাজ করে ভারতবাসীকে অদ্যাবধি অশান্তিতে
নিমজ্জিত রেখেছেন।
৩. ঘোষিত মাউন্টব্যাটেন
প্লান
ক. পাঞ্জাবের লাহোর
ডিভিশনের : গুজরানওয়ালা,
গুরুদাসপুর, লাহোর, শেখপুরা ও শিয়ালকোট, খ. রাওয়ানপিন্দি ডিভিশনের : কটক, গুজরাট, ঝিলাম, মিয়ানওয়ালী,
রাওয়ালপিন্ডি ও শাহাপুর। গ. মুলতান ডিভিশনের : ডেরাগাজী খান,
জং, লয়ালপুর, মন্টগোমারী, মুলতান ও মুজাফফরগড় পাকিস্তানকে দেয়া হয়। ঘ. বেঙ্গলে চট্টগ্রাম ডিভিশনের : চট্টগ্রাম,
নোয়াখালী ও ত্রিপুরা জেলা, ঙ. ঢাকা ডিভিশনের
: বাখরগঞ্জ, ঢাকা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ জেলা,
চ. প্রেসিডেন্সী ডিভিশনের : যশোর, মুর্শিদাবাদ ও নদীয়া জেলা, ছ. রাজশাহী
ডিভিশনের : বগুড়া, দিনাজপুর, মালদহ, পাবনা, রাজশাহী ও রংপুর জেলা পাকিস্তানকে দেওয়া হয়।
শেষ পর্যন্ত
মাউন্টব্যাটেন নিজের ঘোষিত প্ল্যানও কার্যকর করেননি তার ব্যক্তিগত বন্ধুবান্ধবীর আবদারের কারণে।
গুরুদাসপুর, কটক, ত্রিপুরা, মুর্শিদাবাদ,
নদীয়া, মালদহ শেষ পর্যন্ত
পাকিস্তানকে দেওয়া হয়নি। গণভোটের মাধ্যমে সিলেট পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হলেও করিমগঞ্জকে কেটে ভারতকে দেয়া হয় এবং দিনাজপুর
জেলাকে খণ্ডিত করা হয়। মাউন্টব্যাটেনের এই প্রস্তাব অন্যায্য হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম
লীগের তা না মেনে উপায় ছিল না। কেননা ইতোমধ্যে ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করে যে, যদি মাউন্টব্যাটেনের প্রস্তাব গ্রহণ করা না হয় তবে ব্রিটিশ সরকার ভারতের সর্বময় শাসন
ক্ষমতা দিল্লিতে তৈরি কনস্টিটুয়েন্ট এসেম্বলীর হাতে ছেড়ে দিয়ে আগস্টের মধ্যেই ভারত ছেড়ে
চলে যাবে। তদুপরি কায়েদে
আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ব্যক্তিগত ডাক্তার তাঁ
এই মর্মে সতর্ক করেছিলেন যে, “যহ্মা রোগের কারণে আগামী ছয় মাসের মধ্যে আপনার
মৃত্যু হতে পারে।” এমতাবস্থায় মি. জিন্নাহ কংগ্রেস-ব্রিটিশ ষড়যন্ত্রের ভয়াবহতা
লক্ষ্য করে নিজের জীবদ্দশায় মুসলমানদের জন্য একটি নিরাপদ আবাসভূমি পেতে এই অন্যায় দেশ বিভাগ মেনে নেন।
৪. কম্যুনিস্ট পার্টি অব
ইন্ডিয়ার প্ল্যান
কংগ্রেস ভারত বিভাগে
সম্মতি দেওয়ার ঢের আগে ১৯৪০-৪১ সালে C.P.I বোম্বাই থেকে প্রকাশিত তাদের People
war কাগজে ভারত বিভাগ যে হওয়া উচিত সে সম্পর্কে তাদের
অভিমত প্রকাশ করেন। উক্ত পত্রিকায় ভারত বিভাগের একটি ম্যাপ
প্রকাশ করা হয়। ম্যাপে ভারত বিভাগের ফলে ভারতের যে অংশ নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়েছে তার চেয়ে বেশি অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান দেখানো
হয়েছিল। ম্যাপ দুটি (ভারত ও পাকিস্তান) দেশ পত্রিকার ঐ সংখ্যায় ১২৮ ও ১৩১ পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছিল। শুধু তাই নয় ভারতীয় জনসংঘের
স্রষ্টা শ্যামাপ্রসাদ বাবু বহু স্থানে ভারত বিভাগের স্বপক্ষে বক্তৃতা দিয়েছেন। (সূত্র :
সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকার কংগ্রেস শতবর্ষ সংখ্যা ১৮৮৫-১৯৮৫), অতুল্য ঘোষ, পৃ. ১২৫ ও ১৩০)
৫. সার্বভৌম বঙ্গদেশ
প্ল্যান
বঙ্গ প্রদেশ (পূর্ব বাংলা
ও পশ্চিমবাংলা) ও আসাম প্রদেশ একত্রিত করে একটি সার্বভৌম দেশ গঠনের প্রস্তাব প্রথম গ্রহণ করা হয়
১৯৪০ সালের লাহোর
প্রস্তাবে। পরবর্তীতে ১৯৪৬ সালের ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানেও এই ধারণার স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
১৯৪৬-৪৭ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শরৎচন্দ্র বসু,
কিরন শংকর, ফজলুল হক,
সৈয়দ আবুল হাশিম প্রমুখ নেতৃবৃন্দ সার্বভৌম বাংলার নতুন প্ল্যান গ্রহণ করেন। এ প্রস্তাবে
পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামসহ বিহার প্রদেশের
দুমকা, কাটিহার, সিংভূম, মানভূম এবং সমগ্র
ত্রিপুরা প্রদেশের বাংলাভাষী অঞ্চল নিয়ে সার্বভৌম বঙ্গদেশ গঠনের পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু কংগ্রেস নেতা
নেহেরু-মাউন্টব্যাটেন ষড়যন্ত্র এবং এ সি চ্যাটার্জি, শ্রামাপ্রাসাদ মুখার্জী ও গান্ধীর অসহযোগিতায় এ প্ল্যান কার্যকর করা যায়নি। এতদসংক্রান্ত প্রামাণ্য তথ্য নিম্নরূপ :
ক. মি. জিন্নাহর পরামর্শে শহীদ
সোহরাওয়ার্দী অবিভক্ত বাংলা
প্রতিষ্ঠার জন্য হিন্দু নেতা শরৎচন্দ্র বসু ও কিরন শংকর রায়ের সাথে
কয়েক দফা আলোচনায় মিলিত হন। হঠাৎ আলোচনা বন্ধ হয়ে
যায়। ‘আমি
মুজিব বলছি’ বইতে ‘কৃত্তিবাস ওঝা’
লিখেছেন, ‘শরৎ বসু ভারত ডোমিনিয়নের অন্তর্ভুক্তি ছাড়া মুক্ত বাংলায় রাজী হননি। সিরাজুদ্দীন হোসেন তাঁর ‘ইতিহাস কথা কও’ গ্রন্থে লিখেছেন
গান্ধীর বিরোধিতার কারণেই যুক্ত বাংলার প্রস্তাব নস্যাৎ হয়। (সূত্র : জাতির উত্থান পতন সূত্র, পৃ. ১৫১, প্রবন্ধকার)
খ. কায়েদে আজমের আশীর্বাদপুষ্ট বসু- সোহরাওয়ার্দীর সার্বভৌম বাংলার পরিকল্পনাকে গান্ধী এই বলে নস্যাৎ করে
দেন যে, “এই পরিকল্পনা কংগ্রেসের নিকট গ্রহণযোগ্য হতে হলে সার্বভৌম বাংলার সংস্কৃতি হিসেবে হিন্দু উপনিষদের আদর্শকে গ্রহণ করতে হবে।
গান্ধীর এই অন্যায় প্রস্তাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে শরৎ বসু এক পত্রে তাকে লেখেন, “যে কংগ্রেস একদা মহান জাতীয় প্রতিষ্ঠান ছিল, তা দ্রুত একটি হিন্দু প্রতিষ্ঠানে
পরিণত হতে চলেছে দেখে আমি
মর্মাহত। (In Retrospection, Abul Hashim, page-161)
গ. তদানীন্তন কংগ্রেস
নেতা কুমিল্লার আশরাফ উদ্দীন চৌধুরীর পত্রের জবাবে নেহেরু লিখেন, “অখণ্ড- ভারতের নীতিকে আমরা জলাঞ্জলী দিয়েছি
একথা সত্য নয়। তবে আমরা কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না। ভারত বিভাগ মেনে নেব আমরা এই শর্তে যে, বাংলা ও পাঞ্জাবকে বিভক্ত করতে হবে। কারণ একমাত্র এ পথেই অখণ্ড- ভারত পুনরায়
ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে। (সূত্র : রাজবিরোধী আশরাফ উদ্দীন চৌধুী, জাসনে উদ্দীন
চৌধুরী)
উপরোক্ত তথ্য-উপাত্তের
মাধ্যমে এটি সুস্পষ্ট যে, ১৯৪৭ সালের দেশ
বিভাগের উপরোক্ত ৫টি প্ল্যানের কোনোটি কার্যকর হতে পারেনি কেবলমাত্র সংখ্যালঘু বর্ণ হিন্দু নেতৃবৃন্দ ও সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ
সরকারের গোপন ষড়যন্ত্রের
কারণে। এমতাবস্থায় ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ লাঞ্ছিত নিপীড়িত অধিকার বঞ্চিত জাতি গোষ্ঠীর উচিত হবে
ঐক্যবদ্ধভাবে সাম্রাজ্যবাদী
শক্তির পদলেহী বর্ণ হিন্দুদেরকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানো এবং জনগণের শান্তির স্বার্থে উপরোক্ত প্ল্যানসমূহের মধ্যে যেটি সবচেয়ে ন্যায়সঙ্গত ও
বাস্তব সে প্ল্যানবাস্তবায়নের জন্য উপমহাদেশের মানচিত্র পুনর্বিন্যাস করা।
গ. দেশীয় রাজ্য দখল
ব্রিটিশ ভারতের প্রত্যক্ষ
শাসনাধীন অঞ্চলের বাইরে আরও ৭শ’ স্বাধীন রাজ্য ছিল ভারতবর্ষে। সাম্রাজ্যবাদী
শক্তি ছলে-বলে-কলে-কৌশলে এ সকল রাজ্যের অনেকগুলোকে দখলে নিতে সক্ষম হয়েছিল। এরপরেও ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী ১৯৪৭ সালে
ভারত ত্যাগের প্রাক্কালে ভারত
উপমহাদেশে ২৮৩টি রাজ্য ছিল যাদেরকে বলা হতো করদ বা মিত্র রাজ্য। এ সকল রাজ্যের
হিন্দু-মুসলিম রাজা ও নবাবগণ স্বয়ং নিজ নিজ আইন অনুসারে রাজ্য শাসন
করতেন। ইংরেজ সরকারকে এই রাজ্যগুলো কর দিত। ইংরেজ সরকার
ভারতবর্ষ ত্যাগ করার আগে দেশীয় রাজাদের ডেকে বলেছিলেন যে, “তারা
প্রত্যক্ষভাবে ব্রিটিশ সরকারের অধীন, ভারত সরকারের
সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। ইংরেজ ভারত ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে তারা স্বাধীন।” (সূত্র : সাপ্তাহিক দেশ, কংগ্রেস শতবর্ষ সংখ্যা (১৮৮৫-১৯৯৫) লেখক- শ্রী অতুল্য ঘোষ, পৃ. ১৩০) শ্রী ঘোষ আরও লিখেছেন, “ইংরেজ যাবার সময় ভারতবর্ষ শুধু দু’ভাগ করে গেল তা নয়- ২৮৫ ভাগ করে গেল।
যথা :
দেশীয় রাজ্য ২৮১টি
হিন্দুস্থান ১টি
পাকিস্তান ১টি
পতুর্গীজ শাসনকৃত ১টি
ফরাসী শাসনাধীন ১টি
সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ
সরকারের ভাবশিষ্য ও দোসর হিন্দুস্থান সরকার বিভিন্ন কৌশলে উক্ত ২৮৩টি স্বাধীন রাজ্যকে জবরদখল করে নেয়। এ প্রসঙ্গে অতুল্য ঘোষ
লিখেছেন, “এসব
ইতিহাস লুকিয়ে রাখার কোনো কারণ নেই। আমরা ২৮৩টি রাজ্যকে ভারতের
মধ্যে ঢুকিয়ে নিতে পেরেছি।
নিঃসন্দেহে এটা আমাদের রাজনৈতিক বিজয়। পাকিস্তানের জিন্নাহ সমান সমান অংশ দাবি করেও যা
পেয়েছিলেন, আমরা কিন্তু ভারতের
মানচিত্রে তারচেয়েও বেশি এবং বিরাট অংশ বাড়িয়ে ফেলেছি। এটাকে কেউ যদি আগ্রাসন, অত্যাচার অথবা আন্তর্জাতিক নীতিভঙ্গ বলেন তাতে আমাদের কী এসে যায়? এর মাধ্যমে স্বাধীন ভারতের আয়তন লক্ষাধিক মাইল বেড়েছে।... কংগ্রেসের পক্ষে সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের অত্যন্ত ধৈর্য, সাহসিকতা ও কুশলতার জন্য দেশীয় রাজ্যগুলো একে একে ভারতভুক্ত হয়। (দেশ, ঐ, পৃ. ১৩০)
অতুল্য ঘোষের উপরোক্ত
তথ্যে আমরা জানতে পারি যে, ১৯৪৭ সালের পর থেকে
অত্যাচার, আগ্রাসন, আন্তর্জাতিক নীতিভঙ্গ, সাহসিকতা ও কুশলতার মাধ্যমে হিন্দুস্থানের শাসকগোষ্ঠী উপমহাদেশের ২৮৩টি স্বাধীন
রাজ্য জবরদখল করে নেয়। উক্ত
জবরদখলকৃত ভূখণ্ডের স্বাধীনচেতা নাগরিকদের
আন্দোলন, সংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং
অন্যায্য ভারত বিভাগই উপমহাদেশে অশান্তির মূল কারণ। অশান্তির আর একটি মূল কারণ নেহেরু
ডকট্রিন বা দি ইন্ডিয়া ডকট্রিন। এ ডকট্রিনের মূলকথা হলো- আফগানিস্তান,
পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, সিকিম, বাংলাদেশ ও
বার্মাকে ভারতভুক্ত করার অন্তহীন আগ্রাসী কর্মকাণ্ড। ভারতের এই আগ্রাসী মনোভাব ও
কার্যকলাপে বিগত ৬৩ বছর যাবত তার প্রতিবেশী দেশগুলো বারবার অশান্তিতে নিমজ্জিত হচ্ছে।
উক্ত ২৮৩টি রাজ্য দখলে
হিন্দুস্থানের শাসকগোষ্ঠী একটি ন্যক্কারজনক ও অপমানকর কৌশল গ্রহণ করে। উক্ত কৌশলটি ছিল- পাকিস্তান ১৯৪৭
সালের ১৪ আগস্ট থেকে সার্বভৌম দেশে পরিণত হলেও ভারত সরকার ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্টের পূর্ব পর্যন্ত ব্রিটিশ সম্রাটের প্রতিনিধি
হিসেবে ভারত শাসন করে। এর মূল কারণ ছিল ইংরেজ সরকারের ভারত ত্যাগের পর ইংরেজ সরকারের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে ভারতের ২৮৩টি স্বাধীন রাজ্য দখলের বৈধ
কর্তৃপক্ষ হওয়া। উক্ত সময়ের মধ্যে ভারত সরকার উক্ত ২৮৩টি রাজ্য জবরদখল করে নেয় এবং প্রতিবেশী দেশে আগ্রাসনের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। দখলকৃত রাজ্যগুলোর মধ্যে
উল্লেখযোগ্য হলো- কাশ্মীর, হায়দরাবাদ,
ভূপাল, ইন্দোর, ময়ুরভঞ্জা, বরোদা, ছোট উদয়পুর,
গোয়ালিয়র, ত্রিবাঙ্কুর, মহীশুর, কপুরতলা, পাতিয়ালা, ভরতপুর, জয়পুর, যোধপুর, বিকানীর, সিকিম, কুচবিহার, মণিপুর, ত্রিপুরা, কাশী, আলোয়ার, দেওয়াস, অরুণাচল, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড,
জলপাইগুড়ি ইত্যাদি। নাগাল্যান্ডকে ভারতীয় রাজ্যে পরিণত করা হয় ১৯৬৩ সালে, আসাম, ত্রিপুরা,
মেঘালয়, মণিপুরকে ১৯৭২ সালে, মিজোরাম ও অরুনাচলকে ১৯৮৭ সালে। (সূত্র : অতুল্য
ঘোষ, সাপ্তাহিক দেশ, কংগ্রেস শতবর্ষ সংখ্যা
(১৮৮৫-১৯৮৫) পৃ. ১৩০ এবং গ.ই.ও. গঁহংযর, ঞযব ওহফরধ উড়পঃৎরহ, ২হফ বফরঃরড়হ ঢ়ধমব ৩২৮)
উপরোক্ত তথ্যাদির সমর্থনে
আরও প্রামাণ্য তথ্য নিম্নে প্রদান করা হলো-
১. ১৫ আগস্ট আমরা কেন
স্বাধীনতা দিবস পালন করব? সেদিন আমাদের
গভর্নর জেনারেল কে ছিলেন? নিশ্চয়ই
মাউন্টব্যাটেন। দেশ ভাগের পর দু’দেশের গভর্নর
জেনারেল থাকতে চেয়েছিলেন মাউন্টব্যাটেন। কিন্তু জিনড়বাহ সে প্রস্তাবে রাজী হননি। প্রশ্ন হচ্ছে স্বাধীন
ভারতের গভর্নর জেনারেল ব্রিটিশ শাসক প্রতিনিধি হলেন কি করে? আর হলে স্বাধীনতা লাভই বা কিভাবে হয়? (সূত্র : সম্পাদকীয়, দৈনিক বর্তমান, লেখক জয়ন্ত ঘোষাল,
১২/০৮/১৯৯৫)
২. মাউন্টব্যাটনের পর
ভারতীয় গভর্নর জেনারেল হলেন চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারী। কিন্তু ১৯৪৯ সালের ২১ জুন তিনি
শপথবাক্য পাঠ করলেন কার নাম স্মরণ করে? কার প্রতি আনুগত্য, কার প্রতি
দায়িত্ব প্রকাশ করলেন তিনি? ভারতবর্ষের
আম-জনতার উদ্দেশে নয়, তিনি সম্রাট ষষ্ঠ জর্জ ও
তার বংশধরদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শপথ নিলেন। শপথ নিতে গিয়ে তিনি বললেন,
“আমি চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারী
যথাবিহিত প্রতিজ্ঞা করছি যে, আমি সম্রাট ষষ্ঠ
জর্জ, তার বংশধর এবং
উত্তরাধিকারীদের প্রতি আইনানুসারে বিশ্বস্ত ও অনুগত থাকব এবং আমি শপথ নিচ্ছি যে,
আমি গভর্নর জেনারেলের পদে অধিষ্ঠিত থেকে সম্রাট
ষষ্ঠ জর্জ, তার বংশধর ও
উত্তরাধিকারীদের সুচারু ও যথাযথভাবে সেবা করব। আমাদের গভর্নর জেনারেল রাজার নামে
শপথ নেন, আমরা সংবিধানে ঔপনিবেশিক
স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা পাই আর লন্ডনে আমরা কমনওয়েলথ করতে যাই সার্বভৌমত্বের
প্রমাণ দিতে। ধ্যাষ্ঠামীর একটা সীমা আছে। (সূত্র : ঐ)
৩. রজনীপাম দত্ত তাঁর বিখ্যাত বই India Todayর মধ্যে বলেছেন
যে, ভারতের জনগণের কোনো সার্বভৌম ক্ষমতা নেই এবং Independence বলায় তিনি একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন
দিয়েছেন। পেঙ্গুইনের বই মারফত জানা যায়, আমাদের পাশের দেশ বার্মা স্বাধীন, কিন্তু আমরা পরাধীন। (অমিতাভ মৈত্র, বর্তমান দিনকাল, জুলাই ১৯৮২ পৃ. ২৬)
৪. ভারতের রাষ্ট্রপতি,
রাজ্যপাল ও লেফটেনেন্ট গভর্নরদের সরকারি বাসভবন
ও গাড়িগুলোতে এতদিন ইংল্যান্ডের রাজার দেওয়া যেসব পতাকা শোভা পেত ১৯৭১ সালের ১৫
আগস্ট থেকে তার পরিবর্তে দেখা যাবে ভারতের জাতীয় পতাকা। (সূত্র : আনন্দবাজার
পত্রিকা, ২০/০৭/১৯৭১ সংখ্যা)
ঘ. অন্যায্য দেশ বিভাগ ও
দেশীয় রাজ্য দখলের কুফল
অন্যায্য দেশ বিভাগ বিশেষ
করে পাঞ্জাব ও বাংলাকে বিভক্ত করার ফলে এর পক্ষবিপেক্ষর দাঙ্গায় ১৯৪৬-৪৭ সালে
ভারতে যে হিন্দু-মুসলিম-শিখ দাঙ্গা হয় তাতে কমপক্ষে ১০ লাখ লোক নিহত হয়। আহত ও
উদ্বাস্তু হয় কয়েক কোটি মানব সন্তান। অথচ দেশ বিভাগের জিন্নাহ প্ল্যান অথবা
ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান বাস্তবায়ন করা হলে উক্ত হত্যাযজ্ঞ বা জনদুর্ভোগের ঘটনা
ঘটতো খুবই কম। ভারতীয় হিন্দু নেতাদের আগ্রাসী মনোভাবের কারণেই ১৯৪৬ থেকে অদ্যাবধি
কোটি কোটি ভারতবাসী আহত নিহত ও পঙ্গু হচ্ছে। সর্বোপরি উক্ত হিন্দু নেতৃবৃন্দ ও
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের গোপন আঁতাতের ফলে উপমহাদেশের জনগণ তাদের ১৯০ বছরের
দুঃখ-দুর্দশা, হত্যাকা-, অপমান, লাঞ্ছনার জন্য
দায়ী ব্রিটিশ দুর্বৃত্তদের প্রতি মনোযোগ দিতে সক্ষম হয়নি। কংগ্রেস-ব্রিটিশ চক্রান্ত ও আঁতাতের ফলে ভারতের
জনগণ ভাইয়ে ভাইেয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। কমন
শত্রু ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী ও তাদের পদলেহী গোলামরা নিরাপদে পার পেয়ে যায়। এই
অন্যায্য দেশ বিভাগ ভারতবাসীর জন্য আরও যেসব সমস্যার সৃষ্টি করেছে তা প্রধানত
নিমড়বরূপ :
১. জনদুর্ভোগ ও
অর্থনৈতিক দুর্দশা সৃষ্টি
অন্যায্য দেশ বিভাগের ফলে
আসাম ও উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোকে কোলকাতা বন্দরের পশ্চাদভূমি করা হয়েছে। অথচ প্রাকৃতিক
ও ভৌগোলিকভাবে আসাম ও উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যগুলো চট্টগ্রাম বন্দরের পশ্চাদভূমি
তখনও ছিল এখনও আছে। জিন্নাহ প্ল্যান বা ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান বাস্তবায়ন করা হলে
আসামসহ উত্তর-পূর্ব ভারতের জনগণকে বন্দরে মালামাল পরিবহন ও পানিসম্পদ ব্যবহার নিয়ে
ভোগান্তি পোহাতে হতো না। অন্যদিকে সমগ্র পাঞ্জাব, বোম্বে বা মাদ্রাজ বন্দরের পশ্চাদভূমি নয়। অখণ্ড- পাঞ্জাব সব সময়
করাচী বন্দরের পশ্চাদভূমি ছিল। তদুপরি সমগ্র পাঞ্জাব ব্রিটিশ আমলেই একই ইরিগেশন
সিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত ছিল। অন্যায্য পাঞ্জাব বিভাগের ফলে পানি ব্যবস্থাপনায়,
যোগাযোগ ব্যবস্থায় ও ইরিগেশন সিস্টেমে
পাঞ্জাববাসী সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হয়েছে। এ দুর্ভোগের কারণেই পাঞ্জাবে বারবার
বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠে। অন্যায্য দেশ বিভাগ না হলে পূর্ব পাঞ্জাববাসী, আসাম ও উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যসমূহের অধিবাসীরা নিজেদের
উৎপাদিত পণ্য করাচী ও চট্টগ্রামের মাধ্যমে রফতানি করে অর্থনৈতিকভাবে অধিকতর
সমৃদ্ধশালী হতো। কংগ্রেস ও ব্রিটিশ চক্রান্তকারীদের অন্যায্য দেশ বিভাগ ভারতের বিশাল জনগোষ্ঠীর
দারিদ্র্য ও দুর্ভোগের কারণ হয়েছে। বর্তমানে চক্রান্তকারীদের ভুলের মাশুল
দিতে রাজী হয়েছে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু চুক্তি কার্যকর করতে গেলে দেখা যাবে
বাংলাদেশের জনগণ এই অন্যায্য চুক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। এই বিদ্রোহের দাবানল
সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতে ছড়িয়ে যাবে।
২. বাংলাভাষী জনগণের
বহুধা বিভক্তি
সাম্রাজ্যবাদী বৃটেন
পৃথিবীর যেসব দেশ থেকে বিদায় নিয়েছে সেসব দেশে স্থায়ী অশান্তির টাইমবোমা পেতে তবে
বিদায় নিয়েছে। তাদের মূল উদ্দেশে হলো জনগণ যাতে নিজেদের মধ্যে হানাহানি-মারামারি
করে এক সময় বলে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ রাজশক্তি ভালো ছিল। এর ফলে অদূর ভবিষ্যতে
হয়তো তারা আবার তাদের হারানো সাম্রাজ্যে ফিরে আসতে পারবে। মধ্যপ্রাচ্যের দিকে
তাকিয়ে দেখুন। তুরস্কের শাসনাধীন মধ্যপ্রাচ্যকে তারা এই ওয়াদা দিয়েছিল যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আরবরা যদি বৃটেনকে তুরস্কের বিরুদ্ধে সহায়তা
করে তবে তাদেরকে তুরস্ক থেকে স্বাধীনতা এনে দেবে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর
শক্তিহীন হয়ে মধ্যপ্রাচ্য ত্যাগ করার সময় মধ্যপ্রাচ্যকে অনেক ভাগে ভাগ করে যায় এবং
মধ্যপ্রাচ্যের আরবদেরকে কয়েক টুকরা করে, শক্তিশালী কুর্দী জাতিকে ভাগ করে তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক ও ইরানের
অংশ করে দেয়। ইরাক থেকে একটি অংশ কেটে নিয়ে কুয়েত রাষ্ট্র সৃষ্টি করে এবং
ফিলিস্তিনে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইসরাইল রাষ্ট্র স্থাপন করে। তখন থেকে অদ্যাবধি
সংশ্লিষ্ট দেশসমূহ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের অন্যায্য দেশ বিভাগের মাশুল গুনছে।
একইভাবে ১৭৫৭ সালে
ব্রিটিশ বেনিয়ারা এ দেশ দখল করার সময় বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা নিয়ে একটি দেশ ছিল। এ
দেশের হিন্দুমুসলিম-বৗদ্ধ-খ্রিস্টান শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের দেশ শাসন করতো। এখানে
ছিল না কোনোরূপ সাম্প্রদায়িক হানাহানি, দুর্দশা বা দুর্ভিক্ষ। ব্রিটিশ শাসকরাই এ দেশে সাম্প্রদায়িকতা, হানাহানি, দুর্ভিক্ষ ও
জনদুর্ভোগের জন্য দায়ী।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের
সময় তাদের উচিত ছিল বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাকে নিয়েই একটি দেশ গঠন করে ভারত ত্যাগ করা।
অথচ তারা তা না করে শক্তিশালী বাঙালি জাতিকে কুর্দীদের ন্যায় বিভিন্ন রাজ্য ও দেশের
মধ্যে ভাগ করে দেয়। এর মাধ্যমে তারা উত্তর ভারতের বর্ণহিন্দুদের স্বার্থ রক্ষা
করেছে। বাঙালিদের করেছে সর্বনাশ। একইভাবে তারা তাদের ভারত সাম্রাজ্য গঠন ও বিকাশের
কেন্দ্রভূমি কোলকাতা থেকে রাজধানী প্রত্যাহার করে দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে উত্তর ভারতের
বর্ণ হিন্দুদেরকে উপমহাদেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। অথচ শক্তিশালী বাঙালি জাতি
নিয়ে যদি একটি মাত্র স্বাধীন সার্বভৌম দেশ থাকতো তবে সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারত হতো
শক্তিশালী, সমৃদ্ধ ও শান্তির
আবাসভূমি। হিন্দী মাড়োয়ারীদের বুটের তলায় সংস্কৃতিবান বাঙালিদেরকে পিষ্ট হতে হতো
না। সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতজুড়ে বিদ্রোহের দাবানল ছড়িয়ে পড়তো না। দীর্ঘদিনের
ঐতিহ্যবাহী রাজধানী কোলকাতা ভিক্ষুকের শহর বা জার্মান নোবেল বিজয়ী গুন্টার গ্রাসের
ভাষায় ‘ঈশ্বরের বিষ্ঠা’ হতো না।
৩. দেশীয় রাজ্যসমূহ দখলের
কুফল
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের পর
পরই ভারত সেনা পাঠিয়ে জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাশ্মীর রাজ্যের দুই-তৃতীয়াংশ দখল
করে নেয়। ১৯৪৮ সালে মি. জিন্নাহর মৃত্যুর পর পরই সেনাবাহিনী ও সাম্প্রদায়িক গুন্ডা পাঠিয়ে
হায়দরাবাদ দখল করে নেয়। এরপর ভারত একে একে ২৮৩টি দেশীয় রাজ্য দখল করে বর্তমানে
প্রতিবেশী স্বাধীন দেশ দখলের পথে পা বাড়িয়েছে। অথচ ১৯৪৭ থেকে অদ্যাবধি শুধুমাত্র
কাশ্মীরের দখলদারিত্ব বজায় রাখার জন্য ভারতকে যে পরিমাণ অর্থ ক্ষয় ও লোকক্ষয়
স্বীকার করতে হয়েছে তা যদি না করতে হতো তবে ভারত এতদিনে বিশ্ব শক্তিতে পরিণত হতো,
ভারতের সিংহভাগ জনগণকে দারিদ্র্য, অপুষ্টি ও মানবেতর জীবন যাপন করতে হতো না। উক্ত ২৮৩টি
রাজ্যের মধ্যে যে সকল রাজ্য আয়তনে বড়, জাতিগতভাবে সম্পূর্ণ আলাদা ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ সে সকল রাজ্যে দীর্ঘদিন যাবত চলছে
সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম।
বুশ-ব্লেয়ার যেরূপ স¤পূর্ণ অন্যায়ভাবে জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সীমাহীন নৃশংসতায়
আফগানিস্তান ও ইরাক দখল করে ও দখলদারিত্ব বজায় রাখতে গিয়ে নিজেরা ইতিহাসের
আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, নিজ দেশের জনগণকে
ও বিশ্বকে সীমাহীন অর্থনৈতিক দুর্দশায় নিপতিত করেছে ঠিক তদ্রƒপ ভারতের বর্ণবাদী-আগ্রাসী শাসকগোষ্ঠী ভিনড়ব দেশ ও রাজ্য
জবরদখল করে সমগ্র ভারতব্যাপী যে বিদ্রোহের দাবানল প্রজ্জ্বলিত করেছে তাতে করে
ভারতও খুব শিগগিরই সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিণতি বরণ করবে অথবা আরও শোচনীয় পরিস্থিতির
শিকার হবে। এই অন্যায় দখলদারিত্ব বজায় রাখতে গিয়ে ভারত খুব শিগগিরগই নৃশংস
গৃহযুদ্ধের শিকার হয়ে অস্তিত্বহীনতায় নিমজ্জিত হবে।
শান্তিময় উপমহাদেশ
প্রতিষ্ঠায় করণীয়
দীর্ঘ ৭০০ বছরের মুসলমান
শাসনামলে ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। রাজায়-রাজায় যুদ্ধ
হয়েছে, সরকার-বিদ্রোহী লড়াই
হয়েছে কিন্তু ধর্ম বা সম্প্রদায়ের কারণে কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামা, শোষণ-অবিচার সংঘটিত হয়নি। মুসলিম শাসকদের ছত্রছায়ায় ভারতের
সকল ধর্মের, সকল জাতির লোকজন নিজ নিজ
যোগ্যতা অনুযায়ী দেশ শাসনে ও দেশ গড়ায় অবদান রেখে ভারতকে বিশ্বের সবচেয়ে
ঐশ্বর্যশালী দেশে পরিণত করেছিল। পক্ষান্তরে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী বিশ্বের সেরা
সম্পদশালী ভারতের সোনাদানা, মণি-মানিক্য,
হীরা- জহরতসহ সকল আস্থাবর সম্পত্তি নিজ দেশে নিয়ে
গেছে এবং ভারতের বিশাল ভূখণ্ডের কোটি কোটি মানুষের শ্রম ও ফসল নিজ দেশে নিয়ে গিয়ে ভারতকে
পৃথিবীর সবচেয়ে গরিব দেশে পরিণত করেছে।
শুধু তাই নয়, তারা দীর্ঘদিন অবস্থান করে ভারতে শাসন-শোষণ অব্যাহত রাখার
জন্য যে Divide & Rule পলিসি অনুসরণ করেছিল তা ছিল অত্যন্ত মারাত্মক ও ব্যাপক
বিস্তৃত। তারা ধর্মে-ধর্মে বিরোধ সৃষ্টি করেছে, একই ধর্মের মধ্যে বিভিন্ন উপদল সৃষ্টি
করেছে, জাতিতে জাতিতে বিরোধ
সৃষ্টি করেছে, জাতির মধ্যে বিভিন্ন উপদল ও উপদলীয়
কোন্দল সৃষ্টি করেছে। বর্ণে বর্ণে, গোত্রে গোত্রে
বিরোধ সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন দল- উপদল সৃষ্টি করেছে। তারা ভূখণ্ড-গত ও মতবাদগত
দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি করে অশান্তিকে দীর্ঘায়িত করার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে।
বিভিন্ন কাল্পনিক ইতিহাস, পরিকল্পিত ধর্মমত, পুঁথি, তালপত্র, মুদ্রা, শিলালিপি, স্থাপত্যকর্ম,
প্রাচীন নগর, ধর্মগ্রন্থ সৃষ্টি করে ভারতবাসীকে দীর্ঘস্থায়ী হানাহানিতে
লিপ্ত করার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে এদেশ ত্যাগ করেছে। ইতোপূর্বে উল্লেখিত উইলিয়াম
কেরীর হিদেন বা হিন্দু তত্ত্ব, আর্যতত্ত্ব,
আর্য-অনার্য তত্ত্ব, আর্যদের ভারত আক্রমণ তত্ত্ব, বাবরী মসজিদ ও
রাম জন্মভূমির ইতিহাস, দক্ষিণেশ্বরের
মন্দিরের স্থলে মসজিদ থাকার ইতিহাস, শিখমুসলমান বিরোধের কাল্পনিক ইতিহাস, জাতিউপজাতি বিরোধের মিথ্যা ইতিহাস, হিন্দুমুসলিম বিরোধের পরিকল্পিত ইতিহাস, গল্প, উপন্যাস, চিত্রকলা, স্থাপত্য সৃষ্টি
করে প্রতিটি ধর্ম, জাতি, গোত্রের মধ্যে এক একটি টাইম বোমা স্থাপন করে গেছে। বর্তমানে
প্রচলিত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বেদ-আয়ুর্বেদ, মুসলিম ধর্মাবলম্বীদেরকে বিভ্রান্ত করে কাদিয়ানী ও বাহাই
মতবাদ ব্রিটিশ শাসক ও বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পিত সৃষ্টি। অন্যদিকে অজন্তা-ইলোরা নামক
প্রাচীন কীর্তি সৃষ্টিও ব্রিটিশ মস্তিষ্কপ্রসূত। এসবের ফিরিস্তি দীর্ঘ বিধায় মূল
আলোচনায় ফিরে আসছি। এমতাবস্থায় আমাদের করণীয় নিমড়বরূপ-
১. দীর্ঘ আড়াইশ’ বছরে ব্রিটিশ রোপিত বিষবৃক্ষসমূহ ফুলে ফলে বিকশিত হয়ে
ভারতবাসীকে গ্রাস করে ফেলেছে। এমতাবস্থায় উপমহাদেশের চিন্তাশীল ও আত্মমর্যাদাবান
গবেষকদের এগিয়ে এসে ব্রিটিশ রোপিত বিষবৃক্ষসমূহ চিহ্নিত করে উপড়ে ফেলার ব্যবস্থা
করতে হবে এবং তদস্থলে সঠিক ইতিহাসকে পুনর্বহাল করতে হবে। এটি করা সম্ভব হলে
সাম্প্রদায়িক হানাহানির উৎসমূল নিশ্চিহ্ন হবে।
২. জবরদখলকৃত দেশীয়
রাজ্যসমূহকে স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে।
৩. হোসেন শহীদ
সোহরাওয়ার্দী, শরৎচন্দ্র বসু, কিরন শংকর রায়, ফজলুল হক, সৈয়দ আবুল হাশিম প্রমুখ
নেতৃবৃন্দ কর্তৃক প্রণীত ‘সার্বভৌম বঙ্গদেশ’
পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। এ
বঙ্গদেশ পরিচালিত হবে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের ‘বেঙ্গল-প্যাক্টে’র নীতিকে সমুনড়বত রেখে।
৪. প্রাকৃতিক, ভৌগোলিক ও জাতিগত স্বার্থ সমুন্নত রেখে ভারতের
বর্তমান মানচিত্রকে পুনর্বিন্যাস করতে হবে।
৫. খ্রিস্টান পাদ্রী
উইলিয়াম ক্যারির হিদেন তত্ত্ব বা হিন্দুতত্ত্বের মুখোশ উন্মোচন করে ভারতের স্বতন্ত্র
জাতিসমূহের ললাট থেকে এই তত্ত্বের সীল অপসারণ করতে হবে।
৬. জার্মান পণ্ডিত ম্যাক্সমুলারের
কল্পিত ‘আর্যদের ভারত আক্রমণ তত্ত্ব’, আর্য তত্ত্ব ও আর্য-অনার্য তত্ত্ব থেকে ভারতের স্বতন্ত্র
জাতিসমূহকে বেরিয়ে আসতে হবে।
৭. ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীকে
আগ্রাসী মনোভাব বর্জন করতে হবে।
আমি ভারত উপমহাদেশের একজন
স্বাধীন ও সচেতন নাগরিক। উপমহাদেশের শান্তি- অশান্তির সাথে আমার অস্তিত্ব জড়িত। এ
জন্য অত্র প্রবন্ধ রচনা করেছি। আমার এ প্রবন্ধ স্বাধীনতার সপক্ষের ও আধিপত্যবাদ ও
জবরদখলের বিরুদ্ধে। শান্তির সপক্ষে- অশান্তির বিপক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে- অন্যায়ের বিরুদ্ধে,
মজলুমের পক্ষে- জালিমের বিপক্ষে।
আধিপত্যবাদী ও জবরদখলকারীরা এ প্রবন্ধের প্রতি বিরূপ মনোভাব দেখাতে পারেন। তবে
আমার ধারণা তারাও এর থেকে শিক্ষা নিতে পারেন। যারা এ প্রবন্ধের দ্বারা বিরক্ত হবেন
তাদের জ্ঞাতার্থে নিকট অতীতের একটি ঐতিহাসিক ঘটনা উল্লেখ করছি।
বর্তমান রাশিয়া প্রথম ও
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে অপর দেশ দখল করে সোভিয়েত ইউনিয়ন সেজেছিল। কোটি কোটি
মানুষের অধিকার হরণ করে, কোটি কোটি
মানুষকে হত্যা করে, অসংখ্য জাতি গোষ্ঠী ও
দেশের স্বাধীনতা হরণ করে, ভূমি ও সম্পদ জবরদখল
করে কিছুদিন বিশ্বশক্তিও হয়েছিল। কিন্তু ১৯৯০ সাল নাগাদ দেখা গেল যে, এত জবরদখল, অপরের সম্পদ
লুণ্ঠনের পরও দখলদারিত্ব বজায় রাখতে গিয়ে রাশিয়া ভিতর থেকে দেউলিয়া হয়ে গেছে।
বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী রুশ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ সভা করে আনুষ্ঠানিকভাবে
জবরদখলকৃত ভূমি ছেড়ে দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরায় রাশিয়ায় পরিণত করেন। এতে করে
রাশিয়া বর্তমানে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী ও সুখী দেশে পরিণত
হয়েছে। জবরদখল থেকে মুক্তি লাভ করা জাতিসমূহও আগের চেয়ে অনেক বেশি সুখী ও
সমৃদ্ধশালী হয়েছে। ভারতের বর্তমান শাসক গোষ্ঠীও যদি ১৯৪৬ সালের ক্যাবিনেট মিশন
প্ল্যানের A গ্রুপ-এর প্রদেশসমূহ অর্থাৎ মাদ্রাজ প্রদেশ, বোম্বে প্রদেশ, সংযুক্ত প্রদেশ, বিহার প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ ও উড়িষ্যা প্রদেশ নিয়ে নিজেদের দেশ গঠন করে এবং
অপরাপর জবরদখলকৃত রাজ্যসমূহকে স্বাধীনতা প্রদান করে তবে ভারতও রাশিয়ার ন্যায়
শক্তিশালী, সম্পদশালী ও শান্তিময়
দেশে পরিণত হবে। সাথে সাথে উপমহাদেশের অসংখ্য জাতি-গোষ্ঠী স্বাধীনতা, সমৃদ্ধি ও শান্তিময় জীবনের অধিকারী হবে। উপমহাদেশের কোটি
কোটি জনতার শান্তির জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ভারতের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর সুমতি হবে
কি? না-কি লোভে পাপ- পাপে মৃত্যুর পথে
এগিয়ে যাবে?
তথ্যসূত্র :
১. এ এক অন্য ইতিহাস,
গোলাম আহমদ
মোর্তজা।
২. ইতিহাস সঠিক কথাই বলে,
এ কে এম
রফিকউল্লাহ চৌধুরী
৩. জাতির উত্থান-পতন
সূত্র, এস এম নজরুল
ইসলাম
৪. সমকালীন সংলাপ,
ঐ
সম্পাদক মাসিক ইতিহাস অন্বেষা।
সম্পাদক মাসিক ইতিহাস অন্বেষা।