৩০ ডিসেম্বর ২০১১ বিকেল
৪টায় বাংলাদেশ মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভায় শ্রোতা হিসেবে
উপস্থিত ছিলাম। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন আ.স.ম হান্নান শাহ্। অনুষ্ঠানে
বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টির সভাপতি এডভোকেট আবদুল মুবিন বলেছিলেন, “জিন্নাহ না হলে পাকিস্তান হতো না- পাকিস্তান না হলে
বাংলাদেশ হতো না।” তাঁর এই বক্তব্য শেষ
হওয়ার আগেই ঐতিহ্যবাহী মুসলিম লীগের বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল কাজী আবুল
খায়ের- মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নাম শুনেই তেলে- বেগুনে জ্বলে উঠে বক্তৃতার
প্রতিবাদ করেন। প্রধান অতিথির হস্তক্ষেপে মান্যবর সেক্রেটারি মুখ বন্ধ করলেও তাঁর
চেহারা ছিল মারমুখী। তাঁর এ অবস্থা দেখে আমার মনে হলো- সত্যিই সেলুকাস, কি বিচিত্র এ দেশ! ‘পড়েছে দেশে কলিকাল- ছাগলে চাটে বাঘের গাল’।
সত্যিই পাঠকবৃন্দ,
ব্যক্তিগতভাবে আমি এদেশের অনেক ছোট-বড়
রাজনৈতিক নেতাদেরকে চিনি, তাদের বক্তব্যও
শুনি। তাঁদের ইতিহাস জ্ঞান দেখে, অদূরদর্শিতা দেখে
আমাদের বুঝতে কষ্ট হয় না যে, বাংলাদেশে
বর্তমানে ঘোর কলিকাল উপস্থিত। কাজী আবুলের মতো ইতিহাস বিস্মৃত লোকেরা বাংলাদেশের
ছোট-বড় দল ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে বাঘের চামড়া গায়ে দিয়ে আসীন হয়ে আমাদের
মাতৃভূমিকে পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ করছে। কাজী আবুলের মতো লোকদের অবগতির জন্য
জিন্নাহর ব্যাপারে বিশিষ্টজনদের মূল্যায়ন সম্পর্কে মাত্র ৪টি উদ্ধৃতি নিম্নে
প্রদান করা হলো।
কবি নজরুল বলেন-
১. লীগের আন্দোলন যেরূপ
গদাই লস্করী চালে চলছিল, তাতে আমি আমার
অন্তরে কোনো বিপুল সম্ভাবনার আশার আলোক দেখতে পাইনি। হঠাৎ লীগ নেতা কায়েদে আযম
যেদিন পাকিস্তানের কথা তুলে হুংকর দিয়ে উঠলেন- “আমরা বৃটিশ ও হিন্দু দুই ফ্রন্টে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার
জন্য যুদ্ধ করব।” সেদিন আমি উল্লাসে চীৎকার
করে বলেছিলাম- হ্যাঁ, এতদিনে একজন
সিপাহসালার-সেনাপতি এলেন। আমার তেজের তলোয়ার তখন ঝলমল করে উঠল। (শেখ দরবার আলম,
অজানা নজরুল, পৃ. ৪১৭)। (উল্লেখ্য, ২৪.১১.১৯৪৫ সালে জিন্নাহ একথা বলেছেন)। নজরুল বলেন- “যে কোনো আন্দোলন হোক, নেতারা যদি পূর্ণ নির্লোভ, নিরহংকার ও নির্ভয় না হন, সে আন্দোলনকে একদিন না একদিন ব্যর্থ হতেই হবে।” (সূত্র : ঐ, পৃ. ঐ)
২. ভারতীয় লেখক ও
সাংবাদিক শ্রী বিমলানন্দ শাসমল তাঁর ‘ভারত কি করে ভাগ হল’ গ্রন্থে লিখেছেন,
“বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দেবার জন্য আমরা
ভারতীয়রা কৃতিত্বের দাবি করি এবং শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে সে জন্য এশিয়ার
মুক্তিসূর্যও বলা হয়। কিন্তু বিনীতভাবে বলতে চাই, যে লোকটির জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন হতে পারল তাঁর নাম মহাম্মদ
আলী জিন্নাহ। ১৯৪৭ সালের ২০ জুন পূর্ব বাংলার মুসলমানরা জিন্নাহর আহ্বান অগ্রাহ্য
করে যদি পাকিস্তানে যোগ না দিতেন এবং তার দশ-বিশ বছর বাদে, যে কারণে পাকিস্তান হতে বিচ্ছিন্ন হতে চাইলেন, অর্থাৎ ভাষা পার্থক্যের জন্য ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে
স্বাধীনতা লাভ করতে চাইতেন, তাহলে শেখ
মুজিবুর রহমানকে আমরা বাঙালিরা কি ফুল দিয়ে পূজা করতাম, না রাস্তায় গুলি করে মারার দাবি জানাতাম?
৩. শেখ মুজিবুর রহমান ‘নেতাকে যেমন দেখিয়াছি’ শীর্ষক প্রবন্ধে কায়েদে আযম সম্পর্কে লিখেন- “তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি খণ্ডিত পাকিস্তানে খণ্ডিত
বাংলার কুফল উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাহার ফলে উদ্ভব হয়েছিল বৃহত্তর বাংলার
সোহরাওয়ার্দী- বসু চুক্তি। এই পরিকল্পনার প্রতি কায়েদে আযমের আশীর্বাদ ছিল।
কিন্তু মি. বল্লভ ভাই প্যাটেলের নেতৃত্বে পরিচালিত চরমপন্থী কংগ্রেস মহল এবং মি.
শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর ন্যায় সাম্প্রদায়িকতাবাদীগণ এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত
হতে দেয় নাই। (সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক, সোহরাওয়ার্দী সংখ্যা, মার্চ ১৯৬৪)
৪. ভারতের শেষ বড়লাট
মাউন্ট ব্যাটেন ১৯৭৬ সালে ফরাসী সাংবাদিক ল্যারী কলিন্স ও ডোমিনিক ল্যাপিয়ারের
নিকট মি. জিন্নাহ সম্পর্কে যে মন্তব্য করেন তাহলো- “ভারতের গোয়েন্দা বিভাগ ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী
গোয়েন্দা বিভাগ, সারা ভারতের কোনো স্থানে
যদি একটি আলপিনও পতিত হতো এবং ভারত সরকার তার কারণ জানতে চাইতো- গোয়েন্দা বিভাগ
তা এনে দিত। জিন্নাহ ছিলেন পাথরের মতো হীমশীতল কঠিন ব্যক্তিত্ব। তাঁর কোনো
ভূমিকাতেই আমি বিস্মিত হতাম না। তিনি ছিলেন এক আজব চিড়িয়া। তাঁর যক্ষ্মা ছিল এবং
ডাক্তারেরা জানিয়ে দিয়েছিল যে, কোনো অবস্থাতেই
তিনি ২/৩ বছরের অধিক বাঁচবেন না। তাঁর সে রোগের খবর গোপন রাখা হয়েছিল। ভারত
সরকারের এত শক্তিশালী গোয়েন্দা বিভাগও সে খবর জানত না। কেউ যদি আমাকে তখন জানাতো
যে, তিনি কয়েক মাসের মধ্যেই মারা যাচ্ছেন, এতদিন পর আজও আমার মনে প্রশ্ন জাগছে, আমি কি তখন এ কথাই বলতাম যে, ভারতকে অবিভক্ত রাখা হোক, বিভাগের দরকার নেই। আমি কি ঘড়ির কাঁটা পিছন দিকেই ঘুরিয়ে
দিতাম এবং স্থিতাবস্থা বজায় রাখতাম? খুব সম্ভব সেটাই করতাম। (সূত্র : মাউন্ট ব্যাটেন এন্ড দ্য পার্টিশন অব
ইন্ডিয়া, পৃ. ৪৭)
৫. অন্যত্র মাউন্ট
ব্যাটেন জিন্নাহ সম্পর্কে বলেছেন- “তিনি ছিলেন এক
দারুণ দুষ্ট প্রতিভা। অন্যদের বাগে আনা যেত, কিন্তু তাকে নয়। জিন্নাহ বেঁচে থাকতে কিছু করা সম্ভব ছিল
না। (ফ্রীডম এট মিডনাইট, ল্যারি কলিন্স
এন্ড দোমিনিক লাপিয়ের, পৃ. ১০৫)
৬. “গান্ধী না থাকলেও ভারত একদিন না একদিন স্বাধীন হতো। কিন্তু
জিন্নাহ না থাকলে কি পাকিস্তান আদৌ স্বাধীন হতো? ভারতকে স্বাধীন করার দাবিদার আরো একজন কি দু’জনের নাম শোনা যায়। কিন্তু পাকিস্তানকে স্বতন্ত্র করার
দাবিদার আর একজনও নেই। লা শরিক জিন্নাহ। যেমন লা শরীক আল্লাহ্।” (সূত্র : অন্নদা শংকর যায়, ভূমিকা : শৈলেশ কুমার বন্দোপাধ্যায় : জিন্নাহ পাকিস্তান
নতুন ভাবনা)।
No comments:
Post a Comment