ভূমিকা
শ্রদ্ধা ও ভক্তি বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত প্রায় সমার্থক দুটি
শব্দ। ব্যক্তি বা বস্তুর বৈশিষ্ট্য বা গুণাগুণ পর্যবেক্ষণের পর আকৃষ্ট হয়ে মানুষ প্রমত কোন
ব্যক্তিকে শ্রদ্ধা করতে শুরু করে বা কোন বস্তুকে গুণের আধার মনে করে। অনেক ক্ষেত্রে
শ্রদ্ধা থেকে ভক্তি জন্ম নেয়। এ অবস্থায় শ্রদ্ধার পরবর্তী স্তর হচ্ছে ভক্তি। অন্যদিকে কোন
ব্যক্তি বা বস্তুকে দেখা মাত্র অথবা উক্ত ব্যক্তি বা বস্তুর বিভিনড়ব বর্ণনা
শুনে কোন প্রকার বিচার
বিবেচনা ব্যতীত যখন মানুষ উক্ত ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়, উক্ত ব্যক্তি বা বস্তুকে গুণের আধার মনে করে এবং অন্ধভাবে
শ্রদ্ধাবনত হয় তখন আমরা একে এক প্রকারের ভক্তি বলে থাকি। সংক্ষেপে আমরা
বলতে পারি প্রম প্রকারের ভক্তির চোখ রয়েছে, আর দ্বিতীয় প্রকার ভক্তি চক্ষুহীন, বিবেকহীন বা অন্ধ।
আমাদের ভারতবর্ষে
অনেক পীর/পুরোহিত রয়েছেন যারা নিজেদের সততায় ও যোগ্যতায় ভক্তের দল সৃষ্টি করেন আবার অনেক পীর/পুরোহিত
রয়েছেন যারা সৎ ও যোগ্য নয় কিন্তু কূটকৌশলে অতি দক্ষ। এসব কূটকৌশলী পীর/
পুরোহিতগণ ধুরন্ধর মুরীদ/ পাণ্ডার মাধ্যমে ভক্তের দল সৃষ্টি করে বৈষয়িক ও সামাজিক
প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। আবার এমন অনেক পীর/পুরোহিত ও বুদ্ধিজীবী আছেন যারা
সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দালালীকে পেশা হিসেবে পছন্দ করেছেন। শেষোক্ত শ্রেণীর প্রতিষ্ঠায়
নিজেদের প্রচেষ্টার চেয়ে আধিপত্যবাদী শক্তির প্রচেষ্টা ও সহযোগিতায় বৈষয়িক, সামাজিক ও
রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি অর্জন করেন। শেষোক্ত ব্যক্তিদেরকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি স্বীয় স্বার্থে ব্যবহারের
লক্ষ্যে ‘জিরো’ থেকে ‘হিরো’তে পরিণত করে স্বীয় স্বার্থ হাছিল করে। সাম্রাজ্যবাদের বিরাগভাজন হলে অথবা
সাম্রাজ্যবাদের পতনে উক্ত ‘হিরো’দের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে পর্যায়μমে ‘জিরো’তে পরিণত হয়।
বিভিনড়বমুখী
তথ্যপ্রবাহের ফলে বর্তমানে পৌরাণিক চরিত্র গুরুত্বহীন। আধুনিক যুগের মানুষ ধর্মীয়
কারণ ব্যতীত পৌরাণিক হিরোকে সম্মান করে না। আধুনিক যুগের মানুষ যুক্তিবাদী বিধায়
ঐতিহাসিক কষ্টিপাথরে যাচাই করে হিরোর হিরোত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। সাম্রাজ্যবাদী
ব্রিটিশ রাজশক্তি ভারতবর্ষে নিজেদের শাসন শোষণকে স্থায়ী এবং যুক্তিপূর্ণ করতে এদেশের অনেক
নীতিহীন, সুবিধাবাদী ব্যক্তিকে জিরো
থেকে হিরো বানিয়েছে এবং তাদের রচিত ইতিহাস উক্ত দালালদের মুখোশ হিসেবে অদ্যাবধি
ব্যবহৃত হচ্ছে এবং জনগণ বিভ্রান্ত হচ্ছে। অপরদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এদেশের
স্বাধীনতাকামী ও আপোসহীন ব্যক্তিত্বদের ইতিহাসে ভেজাল মিশ্রণ করে হিরো থেকে জিরোতে
পরিণত করেছে অথবা তাদের রচিত কলঙ্কিত ইতিহাসের পাতা থেকে উক্ত বীর পুরুষদের দূরে সরিয়ে রেখেছে। ব্রিটিশ রচিত
ইতিহাস আমাদের প্রতিরোধ যোদ্ধাদেরকে ও স্বাধীনতার বীর সেনাপতিদেরকে
ভিলেনে পরিণত করেছে পক্ষান্তরে দেশদ্রোহী ও খলনায়কদেরকে নায়কে পরিণত করেছে। অদ্যাবধি ভারত উপমহাদেশে ইংরেজ
রচিত ইতিহাস পঠিত ও চর্চিত হচ্ছে বিধায় উপমহাদেশের অধিবাসীগণ সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্র জাল ছিনড়ব করে
কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে
সক্ষম হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, ১৯৪৭ সালের পরও ব্রিটিশ শাসকদের অনুসৃত ডিভাইড এন্ড রোল
পলিসির তেজস্ক্রিয়তায় লক্ষ লক্ষ
ভারতবাসী প্রতিনিয়ত হত্যানির্যাতনের শিকার হচ্ছে, নিজ দেশে পরবাসীর জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে।
প্রত্যেক বিখ্যাত
ব্যক্তির পক্ষে-বিপক্ষে ২টি দল থাকা স্বাভাবিক। আমরা উভয় দলের এবং মতের প্রতি
শ্রদ্ধা রেখে তৃতীয় পক্ষ বা নিরপেক্ষ হয়ে আমাদের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা বিশ্বকবি
রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কর্মের ঐতিহাসিকতা তুলে ধরার চেষ্টা করব।
রবীন্দ্র ভক্তদের যুক্তি
প্রচারিত ও
প্রচলিত ইতিহাসে আছে তিনি ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি, কলিকাতার ঠাকুর পরিবারে জন্ম, পিতা
দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন মহর্ষি, দাদা ছিলেন প্রিন্স, বিশ্ববিখ্যাত নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন ‘গীতাঞ্জলি’ লিখে, পেয়েছিলেন নাইট উপাধি। বাল্যকাল থেকে কবিতা রচনায়
সিদ্ধহস্ত। সাহিত্য, নাটক, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, চিত্রাঙ্কন, নৃত্যকলায় ছিলেন সফল ও সার্থক। শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্য
বিদ্যালয়, বিশ্বভারতী ও
শ্রীনিকেতন তাঁর শ্রেষ্ঠ
কীর্তি। বাঙালী জাতির ও ভারতীয়দের উনড়বয়নে আমৃত্যু সাধনা করেছেন। সেইসঙ্গে তিনি
ছিলেন জমিদার, কবি ও প্রতিভাবান
শিল্পী। বাংলা ভাষাকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।
এতো গেল ভক্তদের
কথা। সমকালে, পরবর্তীতে এবং বর্তমানের তথ্য প্রবাহের যুগে সবাইকে যে প্রচলিত ও প্রচারিত ইতিহাসকে বিশ্বাস করতে হবে
তাতো নয়। প্রচারিত ইতিহাস ও ভক্তদের দাবিসমূহকে ইতিহাসের আলোকে বিচার-বিশ্লেষণ করার নিমিত্তে অত্র প্রবন্ধের
অবতারণা করা হয়েছে। প্রবন্ধের লেখক একজন মুসলমান নামধারী ব্যক্তি হওয়ায়
প্রবন্ধকারের মূল্যায়নকে যাতে ফুৎকারে কেউ উড়িয়ে না দেয় এবং প্রবন্ধকারের
সততাকে সাম্প্রদায়িকতা বলে গালি না দেয় তজ্জন্য খাঁটি
ব্রাহ্মণের/ক্ষত্রিয়ের হস্তলিখিত তথ্যাদি এবং গঙ্গাজলে পবিত্র হওয়া বাঙালী
জাতীয়তাবাদী দু-একজন মুসলমানের উদ্ধৃতির মাধ্যমে প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়েছে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক
যদুনাথ সরকার বলেছেন, “সত্য প্রিয় হউক, অপ্রিয় হউক,
সাধারণের গ্রহণযোগ্য হোক কি
না হোক তাকে খজুঁতে হবে, বুঝতে হবে, প্রচার করতে হবে।”
রবীন্দ্রনাথের জন্ম ও বংশ পরিচয়
কবিসম্রাট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ব পুরুষ পঞ্চানন কুশারী
খুলনা জেলা ত্যাগ করিয়া কালিঘাটের নিকট গোবিন্দপুরে আসিয়া বসতি স্থাপন
করেন। রবিবাবু যে খুলনা জেলার পিঠাভোগের কুশারী বংশ সম্ভূত উহারই সমর্থনে
কয়েক বৎসর পূর্বে কলিকাতার যুগান্তর পত্রিকায় এক সুদীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশিত হইয়াছিল। (পৃষ্ঠা ১২৪-১২৫, সুন্দরবনের
ইতিহাস, এ.এফ.এম আবদুল জলিল, ৩য় খণ্ড)
প্রখ্যাত গীতিকার, কবি ও অধ্যাপক আনিসুল হক চৌধুরী
তাঁর রচিত ‘বাংলার মূল’ বইয়ে দাবি করেছেন
যে, রবীন্দ্রনাথের
পূর্ব পুরুষ প্রাচীন আরবের পৌত্তলিক ‘কুশাইরী’ বংশ সম্ভূত ছিলেন। উক্ত কুশাইরীগণ কাবা মন্দিরের তাকুত দেবতার পূজো করত।
উক্ত তাকুত দেবতার পূজারী
হিসেবে রবীন্দ্রনাথের বংশের লোকেরা পরবর্তীতে (তাকুত>টাকুট>টাকুর>) ঠাকুর পদবী গ্রহণ করে (পৃ.
১৫২-১৫৩)।
কলকাতা জোড়াসাঁকো
ঠাকুর বংশের প্রতিষ্ঠাতা
দ্বারকানাথের দাদা নীলমণি ঠাকুর। তিনি প্রমে ইংরেজদের অধীনে চাকুরী করে
সাহেবদের সুনজরে পড়েন এবং উন্নতির দরজা খুলতে থাকে μমে μমে। এঁরা কিন্তু
বরাবরই ঠাকুর পদবীধারী নন, পূর্বে এঁরা
ছিলেন কুশারী। পূর্বপুরুষ পঞ্চানন কুশারী যখন শ্রমিকের কাজ করতেন তখন তাকে নিমড়বশ্রেণীর লোকেরা ঠাকুর
মশাই বলতেন। ঐ ঠাকুর মশাই থেকে ঠাকুর পদবীর সৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বারকানাথ ছিলেন নীলমণির জ্যেষ্ঠ
পুত্র রামলোচন এর দত্তক পুত্র (এ-এক অন্য ইতিহাস, গোলাম আহমাদ
মোর্তজা, পৃ. ১৪২)।
দ্বারকানাথ
দ্বারকানাথের
পিতা ইংরেজদের সাধারণ কর্মচারী ছিলেন। তবুও ইতিহাসে তিনি প্রিন্স দ্বারকানাথ। আর
একজন ইংরেজ দালাল রামমোহন ছিল দ্বারকানাথের দীক্ষাগুরু। উভয় গুরু-শিষ্য মিলে এদেশে ইংরেজদের শাসন-শোষণে
সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করে অঢেল অর্থের মালিক হয়েছিলেন তথাকথিত রাজা রামমোহন ও
প্রিন্স দ্বারকানাথ। সংক্ষেপে দ্বারকানাথের বিত্তশালী হওয়ার তথ্য ও উৎসসমূহ নিমড়বরূপ
:
১. নীতি ও বুদ্ধি
বিচারের দিক দিয়ে রামমোহন ছিলেন তাঁর গুরু। গরীবের রক্ত শোষণ করা অর্থে প্রিন্সের
এই প্রাচুর্যের পূর্বে তিনি ছিলেন মাত্র দেড়শ’ টাকা বেতনের সাহেব ট্রেভর
প্লাউডেনের চাকর মাত্র
(তথ্যÑ ড. কুমুদ ভট্টাচার্য, রাজা রামমোহন :
বঙ্গদেশের অর্থনীতি ও
সংস্কৃতি, পৃ. ৮২)।
২. এদেশে ইস্ট
ইন্ডিয়া কোম্পানীর আগমনের সময় থেকেই ঠাকুরবাড়ির সৌভাগ্যের সূত্রপাত। শুরু
থেকেই তা যুক্ত হয়েছিল ভারতে ব্রিটিশ শক্তির আবির্ভাব ও প্রতিষ্ঠা লাভের সঙ্গে
(কৃষ্ণ কৃপালিনী, দ্বারকানাথ ঠাকুর, বিস্মৃত পথিকৃৎ, পৃ. ১৭)।
৩. রঞ্জন
বন্দোপাধ্যায় লিখেছেন, “রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদা দ্বারকানাথের তেতাল্লিশটা বেশ্যালয় ছিল কলিকাতাতেই।” এছাড়া ছিল মদের ব্যবসা, আফিমের ব্যবসা, ঘোড়ার রেস খেলা, বিপদগ্রস্ত লোকের বন্ধু সেজে মামলার তদ্বির করা এবং ২৪ পরগনার সল্ট এজেন্ট ও সেরেস্তাদার (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৮ কার্তিক, ১৪০৬)।
৪. ১৮২৪ সালে
লুণ্ঠনকারী ব্রিটিশদের যেখানে ২৭১টি নীল কারখানা ছিল সেখানে প্রিন্স ও তার দোসরদের নীল
কারখানা ছিল ১৪০টি (প্রমোদ সেনগুপ্ত, নীল বিদ্রোহ ও বাঙালী সমাজ, পৃ. ৬)।
এভাবেই ট্রেভর
প্লাউডেনের চাকর দ্বারকানাথ প্রিন্স দ্বারকানাথ হলেন এবং জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের
প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে অবদান রাখলেন।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ
ইনি
রবীন্দ্রনাথের পিতা। বাংলার শ্রেষ্ঠ জমিদার। জন্মসূত্রে পিতার চরিত্র, ব্যবসাবাণিজ ্য, ইংরেজ দালালী ও
জমিদারী প্রাপ্ত হয়ে মহান ঋষি বা মহর্ষি হলেন। তাহার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রজাকূল বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। তিনি নির্মম হাতে
উক্ত প্রজা বিদ্রোহ দমন করে সুনাম-সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন এবং ঠাকুরবাড়িকে
কেন্দ্র করে গড়ে উঠা তথাকথিত বাঙালী হিন্দু রেনেসাঁর মধ্যমণি ছিলেন। তাঁর জমিদারীর দু-একটি
নমুনা উলে-খ করা হলো :
১. ঠাকুর
পরিবারের এই মহর্ষি-জমিদারদের প্রতি কটাক্ষ করে হরিনাথ লিখেছেন, “ধর্ম মন্দিরে
ধর্মালোচনা আর বাহিরে আসিয়া মনুষ্য শরীরে পাদুকা প্রহার একথা আর গোপন করিতে পারি না।” (অশোক
চট্টোপাধ্যায়, প্রাক-বৃটিশ-ভারতীয় সমাজ, পৃ. ১২৭)।
২. “ইত্যাদি নানা
প্রকার অত্যাচার দেখিয়া বোধ হইল পুষ্করিণী প্রভৃতি জলাশয়স্থ মৎস্যের যেমন মা-বাপ নাই, পশুপক্ষী ও মানুষ, যে জন্তু যে প্রকারে পারে
মৎস্য ধরিয়া ভক্ষণ করে, তদ্রƒপ প্রজার স্বত্ব হরণ করিতে সাধারণ মনুষ্য দূরে থাকুক, যাহারা যোগী-ঋষি
ও মহাবৈষ্ণব বলিয়া সংবাদপত্র
ও সভা-সমিতিতে প্রসিদ্ধ, তাহারাও ক্ষুৎক্ষামোদর।” (কাঙাল হরিনাথের ‘অপ্রকাশিত ডায়েরী’, চতুষ্কোণ, আষাঢ়, ১৩৭১)।
৩. প্রজারা
অতিষ্ঠ হয়ে ঠাকুরবাড়ির অত্যাচারের প্রতিশোধ নেবার বিক্ষিপ্ত চেষ্টা করলে তা ব্যর্থ
হয়। ঠাকুরবাড়ি থেকে ব্রিটিশ সরকারকে জানানো হলো যে,
একদল শিখ বা পাঞ্জাবী প্রহরী
পাঠাবার ব্যবস্থা করা হোক। মঞ্জুর হলো সঙ্গে সঙ্গে। সশস্ত্র শিখ প্রহরী
দিয়ে ঠাকুরবাড়ি রক্ষা
করা হলো আর কঠিন হাতে নির্মম পদ্ধতিতে বর্ধিত কর আদায় করাও সম্ভব হলো। ঠাকুরবাড়ির
জন্য শ্রী অশোক চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “অথচ এরাও কৃষকদের উপর থার্ড ডিগ্রী (প্রচণ্ড প্রহার) প্রয়োগ করতে
পিছপা হননি, কর ভার চাপানোর
প্রতিযোগিতায় শীর্ষস্থান অধিকার করেছেন, পরন্তু ভয় দেখিয়ে কর আদায়ের জন্য এবং
বিদ্রোহীদের মোকাবেলার জন্য একদল শিখ প্রহরী নিযুক্ত করেছিলেন (প্রাকবৃটিশ
ভারতীয় সমাজ, পৃ: ১৩২)।
৪. মহর্ষিদের
অসংখ্য করের মধ্যে কয়েকটি নমুনা নিমড়বরূপ :
ক. গরুর গাড়ি করে
মাল পাঠালে ধুলা উড়তো, তাই গাড়ির
মালিককে যে কর দিতে হতো, তার নাম ‘ধুলট’।
খ. প্রজা নিজের
জায়গায় গাছ লাগালে যে কর দিতে হতো তার নাম ‘চৌথ’।
গ. প্রজা আখ গাছ
থেকে গুড় তৈরি করলে দিতে হতো ‘ইক্ষুগাছ’ কর।
ঘ. প্রজার
গরু-মোষ মারা গেলে দিতে হতো ‘ভাগাড় কর’।
ঙ. নৌকায় মাল
উঠানো-নামানোর জন্য দিতে হতো যে কর তার নাম ছিল ‘কয়ালী’।
চ. ঘাটে নৌকা
ভিড়লে যে কর দিতে হতো তার নাম ছিল ‘খোটাগাড়ি কর’।
ছ. জমিদারের
সঙ্গে দেখা করলে দিতে হতো যে কর তার নাম ‘নজরানা’। জ. জমিদার হাজতে গেলে দিতে হতো ‘গারদ সেলামী’ কর।
(তথ্য, গণঅসন্তোষ ও ঊনিশ
শতকের বাঙালী সমাজ, স্বপন বসু, পৃ. ১৬৬)
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ
রতনে রতন চিনে।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথও রতন চিনতে ভুল করেননি। দাদা দ্বারকানাথ ও পিতা দেবেন্দ্রনাথের
যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে নির্বাচিত করা হয় রবীন্দ্রনাথকে। এ বিষয়ে স্বপন বসু
লিখেছেন : “মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের এতগুলো ছেলেমেয়ের মধ্যে জমিদার হিসেবে তিনি নির্বাচন
করলেন চৌদ্দ নম্বর সন্তান রবীন্দ্রনাথকে। এও এক বিস্ময়! অত্যাচার, শোষণ, শাসন, চাবুক, চাতুরী, প্রতারণা ও কলাকৌশলে
রবীন্দ্রনাথই কি যোগ্যতম ছিলেন তাঁর পিতার বিবেচনায়? অনেকের মতে, পিতৃদেব ভুল করেননি। প্রচণ্ড বুদ্ধিমান ও প্রতিভাবান
রবীন্দ্রনাথের সৃজনশীলতা বহু বিষয়েই অনস্বীকার্য (ঐ,
স্বপন বসু)।
রবীন্দ্র মানস গঠন
বৈষয়িক, সামাজিক ও
রাজনৈতিক দিক থেকে জমিদার রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পিতা দেবেন্দ্রনাথ, ঠাকুর্দা দ্বারকানাথ ও বাঙালী বাবু সমাজের পথিকৃৎ তথাকথিত
রাজা রামমোহনের যোগ্য উত্তরসূরি। অপরদিকে কাব্য ও সাহিত্য ভাবনায় তিনি
ছিলেন চরম মুসলিম বিদ্বেষী ইংরেজ দালাল ঋষি বঙ্কিম ও তাঁর গুরু ঈশ্বর গুপ্তের যোগ্য
প্রতিনিধি। তাই রবীন্দ্র
আলোচনার পূর্বে ঈশ্বর গুপ্ত ও বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা প্রয়োজন। ব্রিটিশ
রচিত প্রচলিত ও প্রচারিত ইতিহাস উক্ত ব্যক্তিদের অন্ধকার দিকসমূহ ছাইচাপা দিয়েছে। ব্রিটিশের অন্ধ অনুকরণে অভ্যস্ত পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারত
সরকার একইভাবে দেশের
পাঠ্যপুস্তকে উক্ত ব্যক্তিদের অন্ধকার দিকসমূহ উন্মোচনের চেষ্টা করেনি। ফলে সত্যানুসন্ধানী লেখকের সঠিক তথ্যাবলী অনেকের কাছে নতুন
মনে হবে বৈকি।
ঈশ্বর গুপ্ত
আমরা জানি ঈশ্বর
গুপ্ত যুগ সন্ধিক্ষণের কবি। অর্থাৎ প্রাচীন ও আধুনিক কাব্য প্রতিভা ঈশ্বর গুপ্তকে আশ্রয়
করেছে। তাঁর জন্ম ১৮১২ খ্রীস্টাব্দে। ১৫ বছর বয়সে বিয়ে করেন তবে পতড়বী দুর্গামণি
দেবীর সঙ্গে তিনি আজীবন সংসার করেননি। আশুতোষ দেবের ভাষায়Ñ “ঈশ্বরচন্দ্র
গুপ্ত কোন সাধারণ কবি ছিলেন না, বরং অসাধারণই ছিলেন। কারণ সে যুগের অত্যন্ত সীমিত
সংখ্যক পত্রপত্রিকার বাজারে তিনি বিখ্যাত পত্রিকা সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদনা করতেন।
এছাড়াও ‘সংবাদ রতড়বাবলী’, ‘পাষণ্ড পীড়ন’ প্রভৃতি তাঁর সম্পাদিত সাময়িক
পত্রিকা ছিল। বোধেন্দু বিকাশ প্রভৃতি প্রবন্ধও তাঁর দ্বারা রচিত হয়। সবচেয়ে মনে রাখার
মতো উল্লেখযোগ্য কথা হলো, স্বাধীনতা
আন্দোলনের যিনি প্রতিষ্ঠাতা বলে কথিত সেই বঙ্কিমচন্দ্রের ইনি ছিলেন গুরু (নতুন বাঙ্গালা
অভিধানের চরিতাবলী অধ্যায়, পৃষ্ঠা ১১১৫, আশুতোষ দেব সংকলিত)।
“তিনিই হচ্ছেন
আধুনিক কালের ‘কবিগোষ্ঠীর প্র ম প্রবর্তক’। রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায়, দ্বারকানাথ
অধিকারী, দীনবন্ধু মিত্র ও
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্রধান চার শিষ্য’। (সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, ২য় খণ্ড)। এহেন মহান গুরু ঈশ্বরচন্দ্রের
কাব্য প্রতিভার নমুনা পেশ করা হলো :
১. একেবারে মারা
যায় যত চাঁপদেড়ে (দাড়িওয়ালা)
হাঁসফাঁস করে যত
প্যাঁজ (পিঁয়াজ) খোর নেড়ে।।
বিশেষত: পাকা
দাড়ি পেট মোটা ভূড়ে।
রোদ্র গিয়া পেটে
ঢোকে নেড়া মাথা ফূড়ে।।
কাজি কোল্লা মিয়া
মোল্লা দাঁড়িপাল্লা ধরি
কাছাখোল্লা
তোবাতাল্লা বলে আল্লা মরি।
বি:দ্র: ইংরেজদের
সাথে যুদ্ধরত মুসলমানদের মৃত্যুতে খুশী হয়ে তিনি উক্ত কবিতা রচনা করেছেন।
২. ১৮৫৭ সালের
সিপাহী বিপ-ব বা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি লিখলেন :
চিরকাল হয় যেন
ব্রিটিশের জয়।
ব্রিটিশের
রাজলক্ষ্মী স্থির যেন রয়।।
ভারতের প্রিয়
পুত্র হিন্দু সমুদয়।
মুক্তমুখে বল সবে
ব্রিটিশের জয়।।
(দিল্লীর যুদ্ধ : গ্রন্থাবলী, পৃ. ১৯১)
৩. মুসলমানদের
হাতে ব্রিটিশের পরাজয়ে লিখলেন :
“দুর্জয় যবন নষ্ট, করিলেক মানভ্রষ্ট
সব গেল বৃটিশের
ফেম
শুকাইল রাঙ্গা
মুখ ইংরাজের এত দুখ,
ফাটে বুক হায় হায়
হায়।।”
৪. দিল্লীর
সম্রাট বাহাদুর শাহ যখন বেগমসহ গ্রেফতার হলেন এবং তাঁর সন্তানদের কাটা মাথা তাঁকে উপহার
দেওয়া হলো তখন ঈশ্বর গুপ্ত লিখলেন :
“বাদশা-বেগম দোঁহে ভোগে কারাগার।।
অকারণে μিয়াদোষে করে
অত্যাচার।
মরিল দু’জন তাঁর প্রাণের
কুমার।।
একেবারে ঝাড়ে
বংশে হল ছারখার।”
৫. ব্রিটিশ
সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশে এবং রাণী ভিক্টোরিয়ার প্রতি ভক্তিতে লিখলেন:
ক. “জয় হোক বৃটিশের, ব্রিটিশের জয়।
রাজ অনুগত যারা, তাদের কি ভয়।”
খ. এই ভারত কিসে
রক্ষা হবে
ভেব না মা সে
ভাবনা।
সেই তাঁতীয়া
তোপীর মাথা কেটে
আমরা ধরে দেব ‘নানা’।”
(দিল্লীর যুদ্ধ গ্রন্থাবলী, পৃষ্ঠা ৩২০, ১৩৬)
[“প্রিয় পাঠক, এই হলো বাঙালী বাবু সমাজের গুরুস্থানীয় চিন্তাবিদ কবির চিন্তা ও কবিত্বের নমুনা। তাঁরই
যোগ্য শাগরেদ ঋষি বঙ্কিম।”]
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
অখণ্ড ভারতবর্ষে
যখন ইংরেজের রাজত্ব তখন তাদের প্রয়োজন হয়েছিল একদল লেখক, কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, ঐতিহাসিক ও বিশ্বস্ত
কর্মচারীর। ইংরেজ জাতি তা সংগ্রহ করেছিল হিন্দু সম্প্রদায় হতে। ঐ হিন্দু লেখকগোষ্ঠীর গুরু
হিসেবে ধরা যেতে পারে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে। কারণ তার জন্যই বলা হয়, ‘আমাদের দেশের
সকলের কবি’Ñ অর্থাৎ শিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত এবং
নিরক্ষরদের কাছেও তিনি সমান
প্রিয়। তাঁর সম্পর্কে শিষ্য বঙ্কিমের উক্তি নিমড়বরূপ :
১. “মধুসূদন, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ শিক্ষিত বাঙালীর
কবিÑ ঈশ্বর গুপ্ত
বাঙ্গালার কবি। এখন আর
খাঁটি বাঙ্গালী কবি জন্মে নাÑ জন্মিবার যো নাই, জন্মিয়া কাজ নাই।” মধুসূদন, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তুলনা করে
শেষ সিদ্ধান্তে বঙ্কিম ঈশ্বর গুপ্তের জন্য লিখিয়াছেন, তাঁহার যাহা আছে, তাহা আর কাহারও
নাই। আপন অধিকারের ভিতর তিনি রাজা (সমালোচনা সংগ্রহ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়,
৪র্থ সংস্করণ, ১৯৫৫, পৃ. ২১৫-২১৭)।
২. “বিবেচনা করিয়া
দেখিতে হইবে, ঈশ্বর গুপ্ত যখন
সাহিত্য গুরু ছিলেন, বঙ্কিম তখন তাঁহার শিষ্যশ্রেণীর মধ্যে গণ্য ছিলেন।” (ঐ, পৃ. ২৫৩)
বঙ্কিম মানস
১. “হিন্দু জাতি
ভিনড়ব পৃথিবীতে অনেক জাতি আছে। তাহাদের মঙ্গল মাত্রেই আমাদের মঙ্গল হওয়া সম্ভব নহে।
অনেক স্থানে তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল। যেখানে
তাহাদের মঙ্গলে আমাদের
অমঙ্গল সেখানে তাহাদের মঙ্গল যাহাতে না হয় আমরা তাহাই করিব। ইহাতে পরজাতি পীড়ন করিতে হয় করিব। অপিচ, যেমন তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল ঘটিতে
পারে তেমনি আমাদের মঙ্গলে তাহাদের অমঙ্গল ঘটিতে পারে। হয় হউক, আমরা সেই জন্য
আত্মজাতির মঙ্গল সাধনে বিরত হইব না। পরজাতির অমঙ্গল সাধন করিয়া আত্মমঙ্গল
সাধিত হয়, তাহাও করিব।” (বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩৯)।
২. “ঢাকাতে দুই
চারিদিন বাস করিলেই তিনটি বস্তু দর্শকদের নয়ন পথের পথিক হইবেÑ কাক, কুকুর এবং মুসলমান। এই তিনটিই সমভাবে কলহপ্রিয়, অতিদুর্দম, অজেয়। μিয়াবাড়িতে কাক আর
কুকুর, আদালতে মুসলমান।” (বঙ্গদর্শন, অগ্রহায়ণ- ১২২৭, পৃ. ৪০১)।
৩. আনন্দমঠে
বঙ্কিম লিখেছেন, “মুসলমানের পর ইংরেজ রাজা হইল, হিন্দু প্রজা তাহাতে কথা কহিল না। বরং হিন্দুরাই ডাকিয়া রাজ্যে বসাইল। হিন্দু
সিপাহী ইংরাজের হইয়া লড়িল। হিন্দুরা রাজ্য জয় করিয়া ইংরাজকে দিল। কেননা হিন্দুর ইংরাজের উপর ভিনড়ব জাতীয় বলিয়া কোন
দ্বেষ নাই। আজিও ইংরাজের অধীন ভারতবর্ষে (হিন্দু) অত্যন্ত প্রভুভক্ত।”
৪. ভারতীয় ঐক্যের
পন্থা সম্পর্কে ঋষি বঙ্কিম বলেন, “ভারতবর্ষীয় নানা জাতি একমত, একপরামর্শী, একোদ্যোগী না
হইলে ভারতবর্ষের
উনড়বতি নাই। এই মতৈক্য, একপরামর্শীত্ব, একোদ্যম কেবল ইংরেজীর দ্বারা সাধনীয়। কেননা এখন সংস্কৃত লুপ্ত হইয়াছে। বাঙ্গালী, মহারাষ্ট্রী, তৈলঙ্গী, পাঞ্জাবী ইহাদের সাধারণ
মিলনভূমি ইংরাজি ভাষা। এই রজ্জুতে ভারতীয় ঐক্যের গ্রন্থি বাঁধিতে হইবে।” (বঙ্কিম রচনাবলী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬-১৭) (পাঠকবৃন্দ, বঙ্কিম আমাদের
আলোচ্য বিষয় নয়, তথাপি আমাদের
কবিগুরুর পূর্বসূরি হিসাবে কিঞ্চিৎ উদাহরণ উল্লেখ করা হয়েছে।)
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথের
জীবন ও কর্ম বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর জন্ম ১৮৬১ সালে এবং মৃত্যু ১৯৪১ সালে। তাঁর প্রতিভা ও ব্যক্তিত্ব যেমন গুরুত্বপূর্ণ
তেমনি তাঁর ভূমিকাও সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি সমকালীন বাঙালী বাবু সমাজের নয়নমণি
এবং ঠাকুরবাড়ির যথাযোগ্য উত্তর পুরুষ ছিলেন বিধায় বাঙালী হিন্দু
চিন্তা-চেতনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। তাঁর যুগে বাঙালী হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের বেশির ভাগ যে চেতনায়
সাহিত্য সৃষ্টি করতেন তিনি তার ব্যতিμম ছিলেন না। কেউ যদি ভিনড়বমত পোষণ করেন তাহলে
বলবো, অনেক ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক, সামাজিক-রাজনৈতিক
চাপে পড়ে তিনি হয়তো
স্রোতের বিপরীতে কিছু কথা বলেছেন তবে যখনই অবস্থা অনুকূলে এসেছে তখনই তিনি
সমকালকে আঁকড়ে ধরেছেন। অবশ্য তিনি যদি সমকালীন ইংরেজ চাহিদার বিরুদ্ধে
মাতামাতি করতেন তাহলে যেভাবে তিনি আজ সমাদৃত হচ্ছেন হয়তো তা নাও হতে পারতেন।
ইংরেজদের বিরুদ্ধে যারা সত্য কথা লিখেছেন তারা ইতিহাসের গোলক ধাঁধায় হারিয়ে গেছেন।
এরূপ তিনজন বাঙালী ভদ্রলোক হচ্ছেন যথাμমে হরিশচন্দ্র, শিশির কুমার ও দীনবন্ধু মিত্র। দীনবন্ধু ঋষি বঙ্কিমের সহপাঠী এবং
সরকারি কর্মচারী ছিলেন। যদিও তাঁকে রায়বাহাদুর খেতাব প্রদান করা হয়েছিল তবু তিনি চিরদিন
নীলকরদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র আক্ষেপ করে বলেছিলেনÑ দীনবন্ধু যদি ইংরেজ বিরোধিতা না করতো তবে তাঁর পোস্টমাস্টার জেনারেল এবং পরে ডাইরেক্টর জেনারেল হওয়া অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। (দ্র: নীল
বিদ্রোহ ও বাঙালী সমাজ, প্রমোদ
সেনগুপ্ত)।
মুসলিম বিদ্বেষী
বঙ্কিমচন্দ্রকে অত্যন্ত সমীহ করতেন রবীন্দ্রনাথ। কারণ তাঁর জানা ছিল যে, বঙ্কিম
ব্রিটিশরাজের এক নম্বর বাছাই করা ব্যক্তি। তিনি বঙ্কিম রচিত চরম সাম্প্রদায়িকতাদুষ্ট
আনন্দমঠে রচিত ‘বন্দে মাতরম’ গানে সুর দেন এবং
নিজে গেয়ে বঙ্কিমকে শোনান।
(রবীন্দ্র জীবনী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৩৬)।
গুরু বঙ্কিমের
আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি লিখলেন :
“ম্লেছ সেনাপতি এক মহম্মদ ঘোরী
তস্করের মত আসে আμমিতে দেশ।”
(প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্র জীবনী, পৃ. ৩৭)
উক্ত সময়ে
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সাহিত্য চর্চা ছিল আরও ভয়াবহ। বাঙালী জাতীয়তার শক্তি
বৃদ্ধির লক্ষ্যে তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে অনবরত কলমযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন।
তাদের রচিত প্রবন্ধ, সাহিত্য, নাটক, প্রহসনের বিষয়বস্তু ছিল হিন্দুর গৌরব গাথা এবং
মুসলমানদের প্রতি আμমণ। রবীন্দ্রনাথও ছিলেন ঠাকুরবাড়ির প্রভাবশালী সদস্য।
ঠাকুরবাড়িতে যেসব নাটক হতো সেগুলোর লেখক ছিলেন তাঁরাই এবং অভিনয়ও করতেন
অনেক ক্ষেত্রে ঐ বাড়ির পুরুষ ও মহিলারা। যে ভাষা ও বিষয় সেখানে ঝংকৃত হতো তার
একটি নমুনা :
“ওঠ! জাগ! বীরগণ। দুর্দান্ত যবনগণ,
গৃহে দেখ করেছে
প্রবেশ।
হও সবে একপ্রাণ, মাতৃভূমি কর ত্রাণ,
শত্র“দলে করহ নিঃশেষ।।
বিলম্ব না সহে আর, উলঙ্গিয়ে তরবার
জ্বলন্ত অনলসম চল
সবে রণে।
বিজয় নিশান দেখ
উড়িছে গগনে।।
যবনের রক্তে ধরা
হোক প্লাবমান
যবনের রক্তে নদী
হোক বহমান
যবন শোণিত বৃষ্টি
করুক বিমান
ভারতের ক্ষেত্র
তাহে হোক বলবান।
এত স্পর্ধা যবনের, স্বাধীনতা ভারতের
অনায়াসে করিবে
হরণ?
তারা কি করেছে
মনে, সমস্ত ভারতভূমে
পুরুষ নাহিক
একজন।”
যায় যাক প্রাণ
যাক, স্বাধীনতা বেঁচে
থাক
বেঁচে থাক চিরকাল
দেশের গৌরব।
বিলম্ব নাহিক আর, খোল সবে তরবার
ঐ শোন ঐ শোন
যবনের রব।
এইবার বীরগণ কর
সবে দৃঢ়পণ
মরণ শয়ন কিংবা
যবন নিধন,
যবন নিধন কিংবা
মরণ শয়ন
শরীর পতন কিম্বা
বিজয় সাধন।”
(সরকার সাহাবুদ্দীন আহমেদ, ইতিহাসের নিরিখে রবীন্দ্র-নজরুল চরিত, ১৯৯৮, পৃ. ২৮৩)
[মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারী প্রগতিশীল যবনগণের উপলব্ধিতে কি এখনও পরিষ্কার হয়নি বাঙালী বাবু সমাজ এবং
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ আসলে কোন বিশ্বের কবি? মুসলিম বিশ্বের না হিন্দু
বিশ্বের? হিন্দু বিশ্বতো
বর্তমান ভারতকেই বুঝায় আর ভারতে প্রত্যেহ যবনদেরকে কচুকাটা করা হচ্ছে, তাদের রক্তে ভারতভূমির উর্বরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের যবনগণ যদি ভারতভূমির
উর্বরতার জন্য স্বীয় রক্ত দান করতে চান তবে ’৪৭-এর সীমানা মুছে দিলেই চলবে, আর কিছু করতে হবে
না।]
উপরোক্ত
কবিতায়/গানে একটি বিষয় পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, বাঙালী হিন্দুদের স্বাধীনতার চেতনা আর
মুসলমানদের স্বাধীনতার চেতনা এক নয়। মুসলমানরা যাকে অধীনতা মনে করে বাঙালীরা
তাকে স্বাধীনতা মনে করে পক্ষান্তরে মুসলমানদের বিজয় বাঙালীদের পরাধীনতার
নামান্তর।
রবীন্দ্রনাথের স্বজাতি চিন্তা
রবীন্দ্রনাথের
স্বজাতি কারা ছিল তা তাঁর বক্তব্য ও লেখনী থেকে অনুভব করা সহজ হবে। তাই নিমেড়ব কয়েকটি
উদাহরণ দেওয়া হলো।
১. হিন্দু মেলা
যে সৃষ্টি হয়েছিল সেটা ঠাকুর বাড়িরই অবদান। রবীন্দ্রনাথ দাবী করেছিলেন যে, তাঁদের বাড়ির
সহায়তায়ই হিন্দু মেলার জন্ম হতে পেরেছিল।” রবীন্দ্রনাথ আরও বলেন, ভারতবর্ষকে স্বদেশ বলিয়া ভক্তির সহিত উপলব্ধির
চেষ্টা হিন্দু মেলাতেই সর্বপ্রম লক্ষণীয়। এই মেলায় দেশের স্তবগান, গীত, দেশানুরাগের কবিতা পঠিত, দেশী শিল্প, ব্যায়াম প্রভৃতি
প্রদর্শিত ও দেশী গুণীলোক পুরস্কৃত হইত।... এই মেলার প্রম উদ্দেশ্য, বৎসরের শেষে হিন্দু জাতিকে একত্রিত করা।...
যত লোকের জনতা হয় ততই ইহা হিন্দু মেলা ও ইহা হিন্দুদিগের জনতা এই মনে হইয়া হৃদয় আনন্দিত স্বদেশানুরাগ
বর্ধিত হইতে থাকে। আমাদের এই মিলন সাধারণ ধর্ম-কর্মের জন্য নহে, কেবল আমোদ
প্রমোদের জন্য নহে। ইহা স্বদেশের জন্যÑ ভারতভূমির জন্য। (যথাμমে-জীবন-স্মৃতি, রবীন্দ্র রচনাবলীÑ ১০, পৃ. ৬৬/
যোগেশচন্দ্র বাগল : হিন্দু মেলার ইতিবৃত্ত (কলকাতা মৈত্রী-১৯৬৮), পৃষ্ঠা ৭)।
২. হিন্দু মেলাকে
কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছিল ‘জাতীয় সভা’ ১৮৬৯ খ্রীস্টাব্দে। মুসলমান, নিমড়ববর্ণের
হিন্দু ও খ্রীস্টানদের এই সভায় প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। (জাতীয় সভা মধ্যস্থ, ২৩ অগ্রহায়ণ ১২৭৯, পৃ. ৫৪২)।
৩. হিন্দু-মুসলিম
বিভেদের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল ঐ হিন্দুমেলা ও ‘জাতীয় সভা’ থেকেই।... মেলার
কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন ঠাকুরবাড়ির সদস্য।... সত্যেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ এ মেলার কর্মকর্তা নির্বাচিত না
হলেও তাঁরা সμিয়ভাবে মেলার কাজে অংশগ্রহণ করতেন দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা রচনার মাধ্যমে। (তথ্য : যোগেশচন্দ্র বাগল, ঐ, পৃ. ৬ এবং ৪৮)।
৪. হিন্দু মেলার
নেতা ও রবি ঠাকুরের বড় ভাই তাঁর জীবন স্মৃতিতে লিখলেনÑ হিন্দু মেলার পর হইতে কেবলই
আমার মনে হইত কী উপায়ে দেশের প্রতি লোকের অনুরাগ ও স্বদেশ প্রীতি উদ্বোধিত হইতে পারে। শেষে স্থির করিলাম নাটকে
ঐতিহাসিক বীরত্বগাথা ও ভারতের গৌরব কাহিনী কীর্তন করিলে হয়তো কতকটা উদ্দেশ্য
সিদ্ধ হইলেও হইতে পারে। এইভাবে অনুপ্রাণিত হইয়া কটকে থাকিতেই আমি পুরুবিμম নাটকখানি রচনা
করিয়া ফেলিলাম। (তথ্য:
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন স্মৃতি, বসন্ত কুমার চট্টোপাধ্যায়, পৃ. ১৪১)।
৫. জ্যোতি বাবুর
অপর তিনটি নাটক হচ্ছে যথাμমে সরোজিনী, অশ্র“মতি ও স্বপড়বময়ী। নাটকগুলোর আলোচ্য বিষয় ছিল নিমড়বরূপ :
ক. সরোজিনী :
সম্রাট আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে মেবারের রাজপুত রাজা লক্ষণ সিংহের লড়াই।
খ. অশ্র“মতি : সম্রাট
আকবরের বিরুদ্ধে রাজা প্রতাপ সিংহের লড়াই।
গ. স্বপড়বময়ী :
সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে শুভ সিংহ এর বিদ্রোহ।
ঊনবিংশ শতাব্দীর
এসব লেখকের দৃঢ় ধারণা ছিল যে, এরই ফলে গণমানুষের হৃদয়ে দেশাত্মবোধ জাগ্রত হবে এবং জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে।
জ্যোতিবাবুর সরোজিনী নাটকের (১৮৭৫) সংলাপের নমুনা হচ্ছেÑ
‘সরোজিনী’ ॥ মা চতুর্ভুজা! যাদের জন্য পিতার আজ এরূপ বিষম ভাবনা হয়েছে, সেই দুষ্ট মুসলমানদের শীঘ্র
নিপাত কর।
লক্ষণ ॥ বৎসে!
মুসলমানদের নিপাত সহজে হবার নয়। তার পূর্বে অশ্র“পাত করতে হবে। স্বপড়বময়ীর
(১৮৮২) অন্যতম চরিত্র ‘সুরজমল’ এর সংলাপ হচ্ছে : “যেখানে মুসলমান থাকে সেখানকার বাতাসও যেন আমার বিষতুল্য বোধ হয়।” নাটকের প্রধান
চরিত্র শুভসিংহ এর সংলাপÑ
... দেব মন্দির সকল,
চূর্ণ চূর্ণ করিতেছে ম্লেছ পদাঘাতে,
বেদ-মন্ত্র
করিতেছে লোপ,
গো-হত্যা নির্ভয়ে
করে রাজপথ মাঝে।
(তথ্য : কোলকাতাকেন্দ্রীক বুদ্ধিজীবী, এম.আর. আকতার মুকুল, পৃ. ৪৯)
[পাঠকবৃন্দ, জ্যোতিদাদার এরূপ
মহান নাটকের জন্য গান ও কবিতা
লিখতেন বিশ্বকবি (হিন্দু বিশ্বÑমুসলিম বিশ্ব নয়) রবিঠাকুর।]
এরূপ একটি কবিতার
নমুনাÑ
জ্বল জ্বল চিতা!
দ্বিগুণ দ্বিগুণ
পরাণ সঁপিবে
বিধবা বালা।
জ্বলুক জ্বলুক
চিতার আগুন
জুড়াবে এখনই
প্রাণের জ্বালা।।
শোন্রে যবন!
শোন্রে তোরা!
যে জ্বালা হৃদয়ে জ্বালালি সবে,
সাক্ষী রলেন
দেবতা তার
এর প্রতিফল
ভুগিতে হবে।।
(তথ্য: জ্যোতিদার নাট্যসংগ্রহ (কোলকাতাবিশ ¦ভারতী), পৃ. ২২৫)
[সুতরাং বাংলাদেশী রবীন্দ্রভক্ত যবনগণ, আনন্দে নৃত্য কর]
৬. ‘ব্রাহ্ম’ ধর্মীয়দের সভায়
হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের পোশাক পরিচ্ছদের পার্থক্য কিভাবে রক্ষিত হবে তা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে
রবীন্দ্রনাথ বলেনÑ
“ধুতিটা
কর্মক্ষেত্রের উপযোগী নহে অথচ পাজামাটা বিজাতীয়।”(রবীন্দ্র রচনাবলী-১০, জীবন স্মৃতি, পৃ. ৬৭)
[উপরোক্ত আলোচনার পর রবীন্দ্রনাথের স্বজাতি কারা আর বিজাতি কারা তা বলার অপেক্ষা রাখে না।]
* ১৯০২ সালে শান্তিনিকেতন ব্রহ্ম বিদ্যালয়ে ব্রাহ্ম শিক্ষক কুঞ্জলাল ঘোষ
কবির কাছে জানতে চান ছাত্ররা প্রণাম করলে তা নেওয়া হবে না নিষেধ করা হবে? উত্তরে রবিবাবু লিখেন,
“যাহা হিন্দু সমাজ বিরোধী তাহাকে
এ বিদ্যালয়ে স্থান
দেওয়া চলিবে না; সংহিতায় যেরূপ উপদেশ আছে, ছাত্ররা তদনুসারে ব্রাহ্মণ
অধ্যাপকদিগকে পাদস্পর্শপূর্বক প্রণাম ও অন্যান্য অধ্যাপকদিগকে নমস্কার করিবে।
এই নিয়ম প্রচলিত করাই শ্রেয়।” (রবীন্দ্র জীবনী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৭)।
* “যে কবি রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ধর্মের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ জানিয়ে ব্রাহ্মধর্ম
গ্রহণ করেন, সেই রবীন্দ্রনাথই অপরের বেলায় ধুয়ো তোলেন এতে হিন্দু ধর্মের
প্রভূত ক্ষতি হবে।” লেখক আরও লিখেছেন, “ভারতের বৃহত্তর অনুনড়বত হরিজনেরা আম্বেদকরের নেতৃত্বে যখন
মাথা তুলতে চেয়েছিলেন তখন রবীন্দ্রনাথ তাদের সেই চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিতে
গান্ধীর কথা শুনতে আবেদন জানান। কারণ গান্ধী উপবাস শুরু করেছিলেন এই জন্য যে, অস্পৃশ্যদের পৃ ক
নির্বাচন মেনে নিলে তিনি মৃত্যুবরণ করবেন। আম্বেদকরের সামনে যে বিরাট সুযোগ এসেছিল রবীন্দ্রনাথ এবং
তার সঙ্গে হিন্দুদের এলিট শ্রেণী মিলে এমন চাপ সৃষ্টি করলেন যে, তার ফল দাঁড়ালো এইÑ যদি অনশনে গান্ধী মারা যান তার ফল হবে মারাত্মক। রবীন্দ্রনাথ
গান্ধীর জন্য করুণ সুরে বাণী লিখলেন, “আজ তপস্বী উপবাস আরম্ভ করেছেন, দিনের পর দিন তিনি অনড়ব নেবেন না। কিন্তু তাঁর
বাণীকে গ্রহণ করাই তার অনড়ব, তাই দিয়ে তাঁকে বাঁচাতে হবে।” (জগদীশ চন্দ্র
মণ্ডল, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী ও আম্বেদকর, পৃ. ৪৮, ৪৯)।
(উপরোক্ত উদ্ধৃতির মাধ্যমে পাঠকের বুঝতে কষ্ট হয় না যে, রবীন্দ্রনাথের স্বজাতি তালিকায় রয়েছে শুধু বর্ণ হিন্দু, নিমড়বশ্রেণীর হিন্দুরাও নয়।)
* রবীন্দ্র-জাতীয়তার উৎস মূল : “হিন্দু জাতীয়তা জ্ঞান
বহু হিন্দু লেখকের চিত্তে বাসা বেঁধেছিল যদিও সজ্ঞানে তাঁদের অনেকেই কখনো এর
উপস্থিতি স্বীকার করবেন না। এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হচ্ছেন ভারতের শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যাঁর পৃথিবী বিখ্যাত
আন্তর্জাতিক মানবতাকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে কিছুতেই সুসংগত করা যায়
না। তবু বাস্তব সত্য এই যে, তাঁর কবিতাসমূহ
শুধুমাত্র শিখ, রাজপুত ও মারাঠাকুলের
বীরবৃন্দের গৌরব ও মাহাত্ম্যেই
অনুপ্রাণিত হয়েছে। কোন মুসলিম বীরের মহিমা কীর্তনে তিনি কখনো এক ছত্রও লিখেননিÑ যদিও তাঁদের অসংখ্যই ভারতেই আবির্ভূত
হয়েছেন। এ থেকেই প্রমাণিত
হয়, ঊনিশ শতকী বাংলায় জাতীয়তা জ্ঞানের
উৎসমূল কোথায় ছিল।”
(ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার, বাংলাদেশের ইতিহাস, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২০০৩)।
* সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজগণই বর্ণ হিন্দুদেরকে হিন্দু জাতীয়তা জ্ঞান শিখিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের
সাহিত্যিক গুরু প্রকাশ্যেই তাহা স্বীকার করিয়াছেন। “যে সকল অমূল্য রতন আমরা
ইংরেজদের চিত্তভাণ্ডার হইতে লাভ করিতেছি, তাহার মধ্যে দুইটির আমরা এই প্রবন্ধে উল্লেখ করিলামÑ স্বাতন্ত্র্যপ্রিয়তা ও জাতি
প্রতিষ্ঠা। ইহা কাহাকে বলে তাহা হিন্দু জানিত না।” (বঙ্কিম রচনাবলী, পৃ. ২৪০-৪১)।
* বঙ্কিমচন্দ্রের মুসলিম বিদ্বেষপূর্ণ সাহিত্যের পক্ষে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “মুসলমান বিদ্বেষ বলিয়া আমরা
আমাদের জাতীয় সাহিত্য বিসর্জন
দিতে পারি না। মুসলমানদের উচিত
নিজেদের জাতীয় সাহিত্য নিজেরাই
সৃষ্টি করা।” (‘ভারতী’ পত্রিকা থেকে
উদ্ধৃতি দিয়েছেন আবুল আসাদ তাঁর ‘একশ’ বছরের রাজনীতি’ বইতে)।
রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবোধ : সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তি এদেশের ক্ষমতা দখলের পর তাদের সহায়তাকারী
হিন্দুদেরকে বলল, পূর্বে তোমাদের
সব ছিল। যথাÑ তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি ছিলে, তোমাদের ইতিহাস ছিল, বিজ্ঞান ছিল, আভিজাত্য ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। মুসলমানরা এদেশ দখল করে
তোমাদের ইতিহাস, বিজ্ঞান, জাত্যাভিমানসহ সবকিছু বরবাদ করে দিয়েছে। এমতাবস্থায় আমরা পুনরায়
তোমাদেরকে সবকিছু দেব। এভাবে ইংরেজ চাটুকারগণই μমে μমে বর্ণ হিন্দুতে ও বাঙ্গালীতে পরিণত হলো এবং
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে বাংলায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখে ভীত হয়ে ভারতীয়
জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত হলো। ইংরেজদের পরামর্শ মোতাবেক অনেক খোঁ জাখুিঁ জ
করেও যখন এদেশের বর্ণ হিন্দুরা নিজেদের কোন গৌরবময় ইতিহাস খুেঁ জ
পেল না তখন তারা হতাশ হয়ে নিজেদেরকে অপাংক্তেয় মনে করল এবং রাজপুত, মারাঠা ও শিখ জাতির বীরত্বগাথা দিয়ে কবিতা, কাব্য, গল্প, উপন্যাস, নাটক ও ইতিহাস
রচনা শুরু করল। এরূপ করতে গিয়ে এ সকল হতাশ বর্ণহিন্দুরা বাঙালী
জাতীয়তাবোধকে হারিয়ে
ফেলল এবং সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ অভিমুখে ধাবিত হয়ে নিজেদের ভৌগোলিক ও ভাষাগত জাতিসত্তাকে সর্বভারতীয় জাতিসত্তার বেদীমূলে বিসর্জন দিয়ে আত্মহত্যা করল। মূলত: সমগ্র
ভারত জয় করার পূর্বে
বাংলাভাষীদেরকে ধর্মীয়ভাবে বিভক্ত করার জন্য হিন্দুদেরকে ইংরেজরাই প্রমে বাঙালী
জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিল। সমগ্র ভারত কুক্ষিগত করা শেষ হলে ব্রিটিশ
রাজশক্তি উক্ত বাঙালীদেরকে পর্যায়μমে ভারতীয় জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত করে। ব্রিটিশের এ
সকল কূটবুদ্ধি বুঝতে না পেরে তৎকালীন বাঙালী জাতীয়তার কর্ণধারগণ নিজ
জাতি সম্পর্কে হতাশ প্রতিμিয়া ব্যক্ত
করেছেন। তিনটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি পাঠকবৃন্দ অনুধাবনে সক্ষম হবেন আশা করি।
১. বাঙালীর বল
নাই, বিμম নাই, বিদ্যাও নাই, বুদ্ধিও নাই, সুতরাং বাঙালীর একমাত্র ভরসা
তৈল। বাংলায় যে কেহ কিছু করিয়াছেন সকলেই তৈলের জোরে। (হরপ্রসাদ রচনা সংগ্রহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৯২)
২. “বাঙলার ইতিহাস
নাই, যাহা আছে, তাহা ইতিহাস নয়, তাহা কতক উপন্যাস, কতক বাঙলার
বিদেশী, বিধর্মী, পরপীড়কদিগের জীবন
চরিত মাত্র। বাঙলার
ইতিহাস চাই, নহিলে বাঙলার ভরসা নাই।
কে লিখিবে?” [একটু খেয়াল করলে পাঠকবৃন্দ বুঝতে পারবেন বঙ্কিমবাবু ইতিহাস বলতে কাদের ইতিহাস
বুঝিয়েছেন। আবার বিদেশী ও বিধর্মী বলতে কাদের বুঝাচ্ছেন? জীবন চরিত বলতে কাদের ইতিহাসকে বুঝাচ্ছেন?]
৩. রবীন্দ্রনাথও
পূর্বোক্তদের ন্যায় বাঙালী জাতি সম্পর্কে হীনম্মন্যতায় ভুগতেন। তিনিসহ তৎকালীন
বাঙালী জাতীয়তার কর্ণধারগণ বাংলাদেশে কোন বীর পুরুষ, মহান পুরুষ খুঁজে না পেয়ে দস্যু শিবাজীকে হিন্দু
পুনরুত্থানের নায়ক বানিয়েছেন এবং বাংলাভাষী হিন্দু জাতি সম্পর্কে হতাশা ব্যক্ত করে সর্বভারতীয় জাতীয়তায় নিজের অস্তিত্বকে
বিসর্জন দিয়েছেন। কয়েকটি
উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি
সুস্পষ্ট হবে।
১.
সাত কোটি
বাঙালীরে- হে মুগ্ধ জননী
রেখেছ বাঙালী করে- মানুষ করনি।
(রবীন্দ্রনাথ)
২.
রবীন্দ্রনাথ তাঁর
‘দুরন্ত আশা’ কবিতায় বাঙালী হওয়া
অপেক্ষা আরব বেদুইন হওয়াকে সম্মানজনক বলেছেন। মর্মে যবে মত্ত আশা সর্প সম ফোঁসে
অদৃষ্টের
বন্দনেতে দাপিয়া বৃ া রোষে,
তখনও ভাল মানুষ
সেজে
বাঁধানো হুকা
যতনে মেজে,
মলিন তাস সজোরে
ভেজে
খেলিতে হবে কষে।
অনড়বপায়ী
বঙ্গবাসী স্তন্যপায়ী জীব
জনাদশেক জটলা করি’ তক্তপোষে বসে।
দেখা হলেই মিষ্ট
অতি
মুখের ভাব শিষ্ট
অতি
অলস দেহ ক্লিষ্ট
গতি
গৃহের প্রতি টান,
তৈলঢালা সিড়বগ্ধ
তনু নিদ্রা রসে ভরা,
মাথায় ছোট বহরে
বড় বাঙালী সন্তান।
বাঙালী মোরা ভদ্র
অতি পোষমানা এ প্রাণ,
বোতাম আঁটা জামার
নীচে শান্তিতে শয়ান।
ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন
চরণ তলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন,
ছুটেছে ঘোড়া, উড়েছে বালি
জীবন স্রোত আকাশে
ঢালি
হৃদয় তলে বহ্নি
জ্বালি’
চলেছি নিশিদিন,
বরশা হাতে ভরসা
প্রাণে সদাই নিরুদ্দেশ।
মরুর ঝড় যেমন বহে
সকল বাধাহীন।
পাদুকা তলে পড়িয়া
লুটি।
ঘৃণায় মাথা অনড়ব
খুঁটি
যেতেছ ফিরি ঘর
ঘরেতে বসে গর্ব
কর পূর্ব পুরুষের
আর্য তেজ দর্পভরে
পৃথিবী থর থর।
হেলায় মাথা
দাঁতের আগে মিষ্ট হাসি টানি’
বলিতে আমি
পারিবনাতো ভদ্রতার বাণী।
উচ্ছ্বসিত রক্ত
আসি বক্ষতল ফেলিছে গ্রাসি,
প্রকাশহীন চিন্তা
রাশি করিছে হানাহানি,
কোথাও যদি ছুটিতে পাই বাঁচিয়া যাই তবে
ভব্যতার গণ্ডি মাঝে শান্তি নাহি মানি।
৩. দুরন্ত আশার শেষ
দুইটি লাইনে তিনি যা বলেছেন তাতে বুঝা যাচ্ছে বাঙালীত্বে তিনি খুশী নন। বাঙালীত্ব থেকে বেরিয়ে তিনি কোথায় যেতে চান
তাও তিনি অব্যক্ত রাখেননি। মারাঠা দস্যু
শিবাজীর জন্য তিনি লিখলেনÑ
সেদিন শুনিনি কথা, আজি মোরা তোমার
আদেশ শির পাতি লব,
কণ্ঠে কণ্ঠে
বক্ষে বক্ষে ভারতে মিলিবে
সর্বশেষ ধ্যানমন্ত্র তব,
এক ধর্ম রাজ্য
হবে এ ভারতে এ মহাবচন
করিব সম্বল।
৪. শিবাজী এবং রবীন্দ্রনাথের রুচিবোধ :
বাঙালী
জাতীয়তাবাদের কর্ণধারগণ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির দরুন বাংলা মুলুকে কোন বীর পুরুষের
খোঁজ না পেয়ে মারাঠা দস্যু সর্দার শিবাজীকে জাতীয় বীর হিসেবে বরণ করে নেয়। তাই
শিবাজী সম্পর্কে সাধারণ ধারণা লাভ করলে রবীন্দ্র জাতীয়তাবোধ ও রবীন্দ্র রুচির বিশেষত্ব সম্যক উপলব্ধি
করা সহজ হবে।
সম্রাট
আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে দাক্ষিণাত্যে এক নতুন জাতির উত্থান হয়। এর নাম মারাঠা
জাতি। শিবাজীরা ছিলেন ভোঁসলে পরিবারের সদস্য। এই পরিবার ছিল কৃষিজীবী।
শিবাজীর পিতা শাহজী ভোঁসলে প্রমে নিজাম শাহী সুলতানের পরে আদিল শাহী সুলতানের অধীনে চাকুরি করে প্রতিপত্তি ও
জমিদারী লাভ করেন। হঠাৎ উনড়বতির আতিশয্যে অনেক সুন্দরীর সহজ প্রাপ্তিতে তিনি তাঁর প্র মা স্ত্রী জীজাবাঈকে
উপেক্ষা করেন। জীজাবাঈ স্বামী সংসার ত্যাগ করে অশিক্ষিত এক ব্রাহ্মণ
কোন্দদেবের আশ্রিতা হন। কোন্দদেব নিরক্ষর শিবাজীকে মুসলিম বিদ্বেষী হিসাবে
গড়ে তোলেন।
শিবাজী
বয়ঃপ্রাপ্তির পর কোন্দদেবের শিক্ষা কাজে পরিণত করতে ‘মাওয়ালী’ নামে দুর্ধর্ষ অসভ্য পার্বত্য জাতির সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন। মিত্রতার
প্রধান শর্ত হলো মারাঠা ও মাওয়ালীরা একতাবদ্ধ হয়ে লুটতরাজ করবে এবং প্রত্যেকে
লুণ্ঠিত দ্রব্যের যথাযথ হিস্যা পাবে। শিবাজীর নেতৃত্বে গঠিত ডাকাত দল সারা ভারতে
ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে লুটতরাজ করতো। রাতের আঁধারে অতর্কিত আμমণ করতো নিরীহ গ্রাম
ও নগরবাসীর উপর। সোনাদানা-অর্থ লুট করতো, নারীশিশুদেরকে μীতদাস করে দাসবাজারে বিμয় করতো। তাদের নিষ্ঠুর অত্যাচারে এদেশের মানুষ এতো
আতঙ্কগ্রস্ত ছিল যে, ছোট শিশুদের কানড়বা থামানোর জন্য বাংলার মায়েরা মারাঠা
বর্গীদের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়াতো! এরূপ একটি বহুল প্রচলিত ছড়া হলো :
খোকা ঘুমাল পাড়া
জুড়াল।
বর্গী এল দেশে।।
বুলবুলিতে ধান
খেয়েছে
খাজনা দেব কিসে।।
সম্রাট
আওরঙ্গজেবের হাতে বার বার পরাজিত হয়ে শিবাজী গোপনে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাথে
এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। ১৬৭৪ সালের ১২ জুন কোম্পানীর দূত হেনরী ওকসিন্ডেন
গোপনে শিবাজীর পার্বত্য দুর্গে এসে মোগল শক্তি ধ্বংসে চুক্তিবদ্ধ হন। ইংরেজদের সহায়তায় শক্তি বৃদ্ধি করে
শিবাজীর লুটতরাজ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ঐতিহাসিক শ্রী অজয় কর তাঁর ‘ঐতিহাসিক
প্রশেড়বাত্তর’ বইতে মারাঠা বর্গীদের
ভূমিকাকে নিমেড়বাক্তভাবে চিত্রিত করেছেন।
ক. “ইংরেজ বণিকেরা
বর্গী হাঙ্গামার সুযোগে নবাবের কোন অনুমতি গ্রহণ না করিয়া কলিকাতার দুর্গ নতুন করিয়া গড়িতে আরম্ভ
করিল।”
খ. “এইরূপে রঘুজী
(মারাঠা) পুনঃ পুনঃ বঙ্গদেশ লুণ্ঠন করিতে লাগিল। আলীবর্দ্দী কিছুতেই তাকে পরাস্ত করিতে না পারিয়া
গুপ্ত ঘাতকের দ্বারা নিহত করাইল।”
গ. “মারাঠা অশ্বারোহী
সৈন্যরা এদেশে বর্গী নামে পরিচিত। আলীবর্দ্দী খাঁর সিংহাসনারোহণের পূর্ব হইতে তাহারা সময়ে অসময়ে মোগল
সাম্রাজ্য আμমণ করিয়া লুটপাট
করিত। আলীবর্দ্দী খাঁর
আমলে এদেশে যে আμমণ ও লুণ্ঠন চলিতে থাকে তাহাই ‘বর্গীর হাঙ্গামা’ নামে পরিচিত।”
ঘ. “বর্গীরা তখনকার
শ্রেষ্ঠ ধনী জগৎ শেঠের বাড়ী লুণ্ঠন করিয়া প্রায় আড়াই কোটি টাকা লইয়া প্রস্থান করে।”
দস্যু সর্দার
শিবাজীর মৃত্যু হয় ৩ এপ্রিল ১৬৮০ সালে। এই সংবাদ শুনে সম্রাট আওরঙ্গজেবের
মন্তব্য ছিল : “আমার দয়া, ক্ষমা, উদারতা, সহনশীলতা এবং দাক্ষিণাত্যে আমার অনুপস্থিতির সুযোগেই শিবাজী ক্ষণিকের ‘ইঁদুর রাজা’ হয়ে মরল।” (উল্লেখ্য, সম্রাট আওরঙ্গজেব দীর্ঘ ২৪ বছর দাক্ষিণাত্যে
অনুপস্থিত ছিলেন। তাঁর প্রতিনিধিরাই দাক্ষিণাত্য শাসন করতেন)।
এখানে একটি বিষয়
লক্ষণীয়। রবীন্দ্রনাথসহ সকল বর্ণহিন্দু বাঙালী বুদ্ধিজীবীগণ মারাঠা, রাজপুত ও শিখদের সে সকল ব্যক্তিদের বন্দনা করেছেন, যাদের সাথে মুসলমানদের
সংঘর্ষ হয়েছিল, কিন্তু যেসব মারাঠা, শিখ ও রাজপুত
ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে
লিপ্ত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ গং তাদের বীরত্বের পক্ষে কিছুই লিখেননি। এর থেকে কি একথাই
প্রমাণ হয় না যে, তৎকালীন বাঙালী বাবুরা সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের পক্ষ নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক
মসীযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন?
৫. ডাকাত সর্দার
শিবাজীর জন্য রবীন্দ্রনাথ লিখলেন :
বিদেশীর ইতিবৃত্ত
দস্যুবলি’ করে পরিহাস অট্টহাস্য রবে,
তব পুণ্যচেষ্টা
যত তস্করের নিষ্ফল প্রয়াস এই জানে সবে।
...... ...... ...... ......
অশরীরি হে তাপস, শুধু তব তপমূর্তি
লয়ে আসিয়াছ আজ,
তবু তব পুরাতন
সেই শক্তি আনিয়াছ ব’য়ে, সে তব কাজ।
মারাঠীর সাথে আজি
হে বাঙালী এক কণ্ঠে বল জয়তু শিবাজী,
মারাঠীর সাথে আজি
হে বাঙালী, একসঙ্গে চল মহোৎসবে সাজি।
(কবির উপরোক্ত
আহ্বানে সাড়া দিতে হলে মারাঠার সাথে বাঙালীরা এক সাথে দস্যুবৃত্তিতে লিপ্ত হতে হবে, বেপরোয়া হত্যাকাণ্ড করে
ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে হবে। সবকিছু করতে রাজী হলেও যবনগণ কবির স্বদেশবাসীর অন্তর্ভুক্ত নয়।) নিমেড়বর উদ্ধৃতি লক্ষ্য করুন:
৬. ঠাকুরবাড়িতে
আর একটি সভা সৃষ্টি হয়েছিল বিষবৃক্ষের মত, সেটি হল সঞ্জীবনী সভা। কবির মতে সেটা স্বাদেশিকের সভা।
সভ্যদের দীক্ষা দেওয়া হত ঋক বেদের মন্ত্র পড়িয়েÑ ঋক বেদের পঁিু থ, মরার মাথার খুিল ইত্যাদি নিয়ে
এখানে যে সভা হতো তা বাস্তবিক সত্য। (জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন স্মৃতি, বসন্ত কুমার চট্টোপাধ্যায়, পৃ. ১৬৭)।
উপরোক্ত অবস্থায়
বিশ্ব কবির স্বজাতি কারা, বিজাতি কারা বলার অপেক্ষা রাখে না। সর্বোপরি
বিশ্বকবির স্বজাতিদেরকে তৎকালে বলা হতো বাঙালী আর বিজাতিদেরকে বলা হতো মুসলমান।
রবীন্দ্রনাথের ধর্ম চিন্তা
রবীন্দ্রনাথের
দাদা দ্বারকানাথ ছিলেন ঠাকুর পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা,
যা ইতিপূর্বে আলোচনা করা
হয়েছে। উক্ত দ্বারকানাথের দীক্ষাগুরু ছিলেন তথাকথিত রাজা রামমোহন। রামমোহন
খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী ইংরেজদের খুশী করার জন্য খ্রীস্টান ধর্মের অনুকরণে এক নতুন
ধর্ম তৈরি করেন। উক্ত নতুন ধর্মে ঈশ্বর এক, সাকার পূজা নিষিদ্ধ, হিন্দু দেব-দেবী পূজা-অর্চনা ও পৈতে ধারণ নিষিদ্ধ করা হয়।
দ্বারকানাথও তাঁর গুরু রামমোহনের শিষ্যত্বের মাধ্যমে ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণের ঘোষণা
দেন। তবে এ ঘোষণা ছিল বাহ্যিক। দ্বারকানাথ নিজের ছেলে ও নাতিদের নামের
সাথে হিন্দুদের বড় দেবতা ইন্দ্রের নাম সংযুক্ত করেন এবং তাঁর বংশের সব মেয়ের নামের
সাথে যুক্ত হয় দেবী উপাধি। শুধু তাই নয়, ঠাকুর পরিবার ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী ঘোষণা দিলেও পরিবারের মেয়েদেরকে বিয়ে
দেন ব্রাহ্ম পাত্রদের পরিবর্তে হিন্দু পাত্রদের নিকট।
রবীন্দ্রনাথের
পিতা দেবেন্দ্রনাথও প্রকাশ্যে ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী ছিলেন কিন্তু বাস্তবে ছিলেন ঘোরতর
ব্রাহ্মণ্যবাদী। কয়েকটি উদ্ধৃতির মাধ্যমে বিষয়টি প্রমাণিত হবে।
১. “দেবেন্দ্রনাথকেও
দেখা যাচ্ছে, দুর্গো পূজার সময় পূজোর
সব ব্যবস্থা করে দিয়ে পূজোর কটা দিন সরে পড়তেন অন্য কোথাও।” (জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন স্মৃতি, বসন্ত কুমার চট্টোপাধ্যায়, . ৩৬)।
২. দেবেন্দ্রনাথ
ব্রাহ্ম হওয়া সত্ত্বেও তাঁর বাবার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান হিন্দু পদ্ধতিতেই করেন। তাঁর
যুক্তি ছিল, “মাতা, পিতা, স্ত্রী, পুত্রকে দুঃখ
দিয়ে স্বজাতি হইতে পৃ ক হওয়া কর্তব্য নহে।” (দেবেন্দ্রনাথের পত্রাবলী, পৃ. ৫০)।
৩. ব্রাহ্ম
ধর্মাবলম্বীদের পৈতে ত্যাগ করা জরুরী ছিল। দেবেন্দ্রনাথ নিজে পৈতে ত্যাগ করলেও
পুত্র রবীন্দ্রনাথের যথারীতি উপনয়ন অনুষ্ঠান করে পৈতে দেবার ব্যবস্থা করেছিলেন।
(রাজনারায়ণ বসুর
আত্মচরিত, পৃ. ১৯৯)।
৪. ব্রাহ্মদের
মধ্যে জাতিভেদ প্র া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এতদ্সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের উপনয়ন অনুষ্ঠান থেকে রাজনারায়ণ বসুকে
শূদ্র বলে অপমান করে বহিষ্কার করা হয়েছিল। (ঐ, পৃ. ১৯৯)।
৫. রবীন্দ্রনাথ
যখন পিতা হলেন তখন পুত্র রথীন্দ্রনাথের উপনয়নের ব্যবস্থা করা হয়। উপনয়নের সময়
রথীন্দ্রনাথকে হিন্দু নিয়মে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে ঘুরতে হয়েছিল এবং তিনদিন যাবত শুদ্র বা ছোটলোকের
মুখদর্শন থেকে বিরত রাখার জন্য ঘরে আবদ্ধ রাখা হয়েছিল। (ইতিহাসের নিরিখে
রবীন্দ্র-নজরুল চরিত, সরকার
শাহাবুদ্দীন আহমদ, পৃ. ১৩০)
৬. বাংলা ১৩১১
সালে দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যু হলে নোবেল পাওয়া কবি, ব্রাহ্ম ধর্মের গুরু রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম থেকে ব্রাহ্মণ হয়ে গেলেন এবং হিন্দু
ধর্মের নিয়মে স্বীয় সযতড়ব লালিত কেশ, দাড়ি, গোঁফ মুণ্ডন করলেন। (জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন স্মৃতি, ঐ, পৃ. ১৬৭)।
৭. ব্রাহ্ম
ধর্মের কবি রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মণ্যবাদের পক্ষে লিখলেন, “ভারতবর্ষে যথার্থ
ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়
সমাজের অভাব হইয়াছেÑ দুর্গতিতে আμান্ত হইয়া আমরা সকলে
মিলিয়াই শুদ্র হইয়াছি।” আরও লিখলেন, আমি ব্রাহ্মণ আদর্শকে
পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিবার সংকল্প হৃদয়ে লইয়া যথাসাধ্য চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইয়াছি। (এপ্রিলÑ১৯০২, ‘প্রবাসী’, পৃ. ৬৫৭)
৮. রবীন্দ্রনাথ
সাধারণ কোন ব্রাহ্ম ছিলেন না। তিনি ছিলেন আদি ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক। মুখে
ব্রাহ্ম হলেও তিনি ছিলেন কর্মে ব্রাহ্মণ। তাই তিনি লিখতে পারলেনÑ
“বেদ, ব্রাহ্মণ, রাজা ছাড়া আর
কিছু নাই ভবে
পূজা করিবার।” (পূজারিনী দেখুন)
উপরোক্ত অবস্থায়
কেউ যদি রবীন্দ্রনাথকে ভণ্ড-প্রতারক বলে অথবা কট্টর বর্ণবাদী বলে তবে তাঁর মুখ
বন্ধ করার যুক্তি কী?
রবীন্দ্র রাজনীতির স্বরূপ
রবীন্দ্র যুগে
এদেশ পরাধীন ছিল। তখন এদেশে অসংখ্য আন্দোলন-সংগ্রামে এদেশ আলোড়িত হয়েছিল।
যথাÑ স্বাধীনতার আন্দোলন, স্বরাজ আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন ও
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন। উক্ত আন্দোলনসমূহে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা কি ছিল তার
নিরিখেই আমরা বিচার করব রবীন্দ্র রাজনীতির স্বরূপ কি ছিল? লক্ষ্য- উদ্দেশ্য কি ছিল?
স্বাধীনতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ
১. রবীন্দ্রনাথ
স্বাধীনতা বা ফ্রীডমকে ভাল চোখে দেখেননি। পশ্চিমী রাষ্ট্রদর্শনে যাকে ফ্রীডম বলা
হয়, রবীন্দ্রনাথ তাকে চঞ্চল, ভীরু, স্পর্ধিত ও
নিষ্ঠুর আখ্যা দিয়েছেন। (রবীন্দ্র রচনাবলী, ভারতবর্ষ ও স্বদেশ, খণ্ড ১২, পৃ. ১০২৫)।
২. সমাজ বিরোধীরা
অন্যায়, খুন, জখম করে যেমন অপরাধী
হয়, রাজনৈতিক নেতাদের
স্বাধীনতার নামে হত্যা, লুটপাটকেও রবীন্দ্রনাথ ঐরকম সমান অপরাধ মনে করতেন।
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : দণ্ডনীতি, প্রবাসী, আশ্বিন ১৩৪৪)।
৩. ইংরেজ শাসনের
পক্ষে তিনি লিখেনÑ “রাগ করিয়া যদি বলি, ‘না আমরা চাই না’ তবুও আমাদিগকে চাহিতেই হইবে। কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা এক হইয়া মহাজাতি
বাঁধিয়া উঠিতে না পারি ততক্ষণ পর্যন্ত ইংরেজ রাজত্বের যে প্রয়োজন তাহা কখনোই সম্পূর্ণ হইবে না” (ড. অরবিন্দ
পোদ্দার, রবীন্দ্রনাথ :
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, পৃ. ১৩৩)।
৪. কবি আরও লিখেন, ইংরেজদের আহবান আমরা যে
পর্যন্ত গ্রহণ না করিব, তাহাদের সঙ্গে
মিলন যে পর্যন্ত না সার্থক হইবে, সে পর্যন্ত তাহাদিগকে বলপূর্বক বিদায় করিব, এমন শক্তি আমাদের নাই। যে ভারতবর্ষ অতীতে অঙ্কুরিত হইয়া
ভবিষ্যতের অভিমুখে উদ্ভিনড়ব হইয়া উঠিতেছে, ইংরেজ সেই ভারতের জন্য প্রেরিত হইয়া
আসিয়াছে। সেই ভারতবর্ষ
সমস্ত মানুষের ভারতবর্ষ
আমরা সেই ভারতবর্ষ হইতে
অসময়ে ইংরেজকে দূর করিব, আমাদের এমন কী অধিকার আছে, বৃহৎ ভারত বর্ষের আমরা কে? (ড. পোদ্দার, ঐ, পৃ.১৩৫)।
ইংরেজদের বশংবদ গোলাম রবীন্দ্রনাথের উক্তরূপ আরও বহু স্বাধীনতাবিরোধী মন্তব্য ও উক্তি রহিয়াছে। পাঠক মহলই বিবেচনা করে দেখবেন এই স্বাধীনতাবিরোধী সাম্রাজ্যবাদের গোলাম রবিবাবু স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের আদর্শ হতে পারে কিনা? ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের নিকট
আত্মসমর্পিত বাঙালীদের জন্যই
রবীন্দ্রনাথ আদর্শস্থানীয় হতে পারে, তার সাহিত্য
প্রেরণার উৎস হতে পারে।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ
প্রশাসনিক
সুবিধার্থে ব্রিটিশ সরকার যখন বৃহত্তর বঙ্গকে দুই ভাগ করে পূর্ব বাংলা ও আসামকে একটি
প্রদেশের মর্যাদা দিয়ে ঢাকাকে রাজধানী করে তখন বাঙালী বাবু সমাজ
ঐক্যবদ্ধভাবে বঙ্গভঙ্গ রদ করার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অথচ ১৭৫৭ সালের পলাশী
যুদ্ধের পর থেকে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা পর্যন্ত বাঙালী হিন্দু সমাজ কখনো
ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সামান্যতম প্রতিবাদও করেনি। অথচ উক্ত ১৪৮ বছর বাংলার ও ভারতের
মুসলমানগণ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অসংখ্য রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে, অগণিত মানুষ আহত, নিহত, পঙ্গু, দীপান্তর ও কারান্তরালে গিয়েছিলেন। মুসলমানদের এ সকল
আন্দোলনে বাঙালী হিন্দুরা বরাবরই প্রকাশ্যে ব্রিটিশের পক্ষে ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিল।
বঙ্গভঙ্গে বাঙালী হিন্দুদের স্বার্থে আঘাত লেগেছিল এবং মুসলমানদের উনড়বতির সম্ভাবনা
দেখা দিয়েছিল বিধায় তথাকথিত মানবতাবাদী কবি ব্রিটিশের গোলামীর পরিবর্তে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব
দেন।
১৯০৫ সালের ২৪ ও
২৭ সেপ্টেম্বরে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী দু’টি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল কলিকাতাতে। রবিবাবু উভয় সভার সভাপতি
ছিলেন।
কলিকাতার হিন্দু
সম্প্রদায় বঙ্গ বিভাগ দিবস ১৬ অক্টোবরকে ‘শোক দিবস’ হিসেবে পালন করে। কংগ্রেস শোক দিবস উপলক্ষে নিুোক্ত
কর্মসূচি পালন করে।
১. রাখী বন্ধন উৎসবÑ রবিঠাকুর এর প্রবক্তা।
হিন্দুদের ‘মঙ্গল সুতা’ বন্ধনের আদলে ঐদিন বাহুতে
রঙিন ফিতা বাঁধার ব্যবস্থা
করা হয়।
২. উপবাস ব্রত পালন- খুব সকালে উপবাস অবস্থায় খালি পায়ে হেঁটে আত্মশুদ্ধির জন্য
গঙ্গাসড়বানে যেতে হবে। এই শোক দিবসের গঙ্গাসড়বান অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ একটি
প্রার্থনা সঙ্গীত গাইলেন। সমবেত বাঙালী বাবুরা উক্ত গানটি উচ্চস্বরে
গাইলেন।
বাংলার মাটি, বাংলার জল
বাংলার বায়ু, বাংলার ফল
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক,পুণ্য হউক
হে ভগবান।
বাংলার ঘর, বাংলার হাট
বাংলার বন, বাংলার মাঠ
পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক
হে ভগবান।
বাঙালীর পণ, বাঙালীর আশা
বাঙালীর কাজ, বাঙালীর ভাষা
সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক
হে ভগবান।
বাঙালীর প্রাণ, বাঙালীর মন
বাঙালীর ঘরে যত
ভাই বোন
এক হউক এক হউক এক
হউক
হে ভগবান।
ভগবানের নিকট
প্রার্থনা শেষে রাখীবন্ধন অনুষ্ঠান করা হয়।
একই দিন বিকেলে
রবি ঠাকুর পার্শী বাগান মাঠে অখণ্ড বাংলার ‘বঙ্গ ভবন’ স্থাপনের উদ্দেশ্যে ফেডারেশন হলের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।
উক্ত অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তব্য ছিল-
“যেহেতু বাঙালী জাতির সর্বাঙ্গীন প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করিয়া পার্লামেন্ট বঙ্গের অঙ্গ ছেদন করিয়াছেন, সেহেতু আমরা
প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, বঙ্গের অঙ্গছেদের
কুফল নাশ করিতে, বাঙালী জাতির
স্বার্থ সংরক্ষণ করিতে আমরা সমস্ত বাঙালী আমাদের শক্তিতে যাহা কিছু সম্ভব তাহার সকলই প্রয়োগ করিব।” (আহসানুল্লাহ, অখণ্ড বাংলার স্বপড়ব, পৃ. ৮২০-৮৩)।
রবিঠাকুরের অন্য রূপ
বাংলায় এবং ভারতে
ব্রিটিশবিরোধী যত আন্দোলন হয়েছে রবি ঠাকুর সকল আন্দোলনে ইংরেজদের পক্ষে ছিলেন। ১৭৫৭ থেকে ১৯০৫
সাল পর্যন্ত ইঙ্গ-হিন্দু শাসন-শোষণে ভিক্ষুকে পরিণত হওয়া মুসলমানদের পক্ষে
তার কলম থেকে একটি শব্দও বের
হয়নি। কিন্তু আন্দোলন সংগ্রাম করেও যখন
বঙ্গভঙ্গকে ঠেকানো গেল না তখন তিনি মুসলমানদের সহানুভূতি লাভে কিছু কিছু ভালো ভালো কথা লিখার চেষ্টা
করেছেন।
গরজ বড় বালাই। রবিবাবুর জমিদারীর এলাকা ছিল খণ্ডিত পূর্ব বাংলায়। এমতাবস্থায় পূর্ব বাংলার মুসলমানদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করা বন্ধ করে কবি তাঁর লেখনীকে অসাম্প্রদায়িক করার চেষ্টা করেন। কিন্তু শত হলেও
তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণদের
চেয়েও গোঁড়া। তাই শব্দ চয়নে অসাম্প্রদায়িকতার পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করলেও ভাবের দিক
থেকে কবির লেখনী আগের মতই থেকে যায়। উদাহরণস্বরূপ এরূপ দু’টি জনপ্রিয় কবিতার বিষয় পাঠকদের অবগতির জন্য পেশ করছি। একটি পূর্বেই
উদ্ধৃত হয়েছে : যথাÑ
বাংলার মাটি
বাংলার জল ... .... ....
বাঙালীর কাজ
বাঙালীর ভাষা
সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক
হে ভগবান।
অসাম্প্রদায়িক
হওয়ার চেষ্টা করেও তিনি ‘জল’কে পানি বলতে পারেননি,
হিন্দু কালচারের ‘তিন সত্যি’কে আঁকড়ে ধরেছেন এবং ভগবান
শব্দের পরিবর্তে স্রষ্টা বা অন্যকিছু বলতে পারেননি।
অপর গানটি
বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আজীবন ফ্রীডম বা
স্বাধীনতা বিরোধী লেখকের কবিতা ও গান স্বাধীনতার চেতনা কতটুকু শাণিত করে তা আমি জানি না। তবে উক্ত গানটিও
যে কট্টর মুসলিম বিদ্বেষী বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম’ গানের আদলে রচিত হয়েছে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বঙ্কিমচন্দ্রের
আনন্দমঠের ‘বন্দে মাতরম’ কবিতাটিতে মায়ের বন্দনা করা হয়েছে। এই মা বলতে বঙ্কিম কি বুঝাতে চেয়েছেন পাঠকবৃন্দ লক্ষ্য
করুন : পশ্চিম বঙ্গের
প্রখ্যাত গবেষক ড. অরবিন্দু পোদ্দারের মতে,
“... বঙ্কিমচন্দ্র জাতীয়তাবাদকে একটা ধর্মীয় আধ্যাত্মিক আলোকে মণ্ডিত করেন। ভারতবর্ষ নামক যে
একটি ভৌগোলিক সত্তা, তাকে তিনি
মাতৃরূপে উপলব্ধি করতে চেয়েছেন, এই মাতৃ ভাবনা স্বর্গীয় দেবী ভাবনার সমতুল্য। ‘বন্দে মাতরম’ সঙ্গীতে তিনি দেশ জননীকে
দুর্গা, লক্ষ্মী ও স্বরস্বতীর সঙ্গে
একাত্ম বলে বর্ণনা করেছেন।... অন্য কথায়, হিন্দু রাজত্ব স্থাপন এবং তারই অনুপ্রেরণায় ভবিষ্যত ভারতকে নির্মাণ
করার আদর্শ তিনি (শ্রী অরবিন্দু) প্রচার করেছিলেন।... হিন্দু ঐতিহ্য আশ্রিত
সমস্ত লেখকের দৃষ্টিতেই... সৃজনধর্মী ও বুদ্ধিমার্গীয় উভয়ত:... শ্রীকৃষ্ণই হলেন
একমাত্র পুরুষ যিনি বর্তমানের পরাধীন ও শত লাঞ্ছনায় ছিনড়বভিনড়ব ভারতবর্ষকে এক শক্তিশালী প্রগতিশীল দুর্জয়
সত্তায় রূপান্তরিত করতে পারেন।... তাঁদের সুদূর বিশ্বাস কেবলমাত্র হিন্দু দার্শনিক
চিন্তা, জীবদর্শন এবং এর সংশেষবাদী ধর্ম
দ্বারাই অতীতে এই বিরাট ভূখণ্ড ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক ঐক্য অর্জিত ও সুরক্ষিত
হয়েছিল এবং ভবিষ্যতেও পুনরায় সেই আদর্শের শক্তিতেই নবভারতের
আবির্ভাব ঘটবে।” (রবীন্দ্রনাথ/ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব : ১৯৮২ ‘উচ্চারণ’ কলিকাতা)
হিন্দু ঐতিহ্য ‘মা’ বলতে কাকে বুঝায়, মায়ের কষ্টে
সন্তানদের কি করা উচিত তা ১৯০৮ সালের ৩০ মে কলিকাতার যুগান্তর পত্রিকায় লেখা
হয়েছিল:
“মা জননী পিপাসার্ত হয়ে নিজ সন্তানদেরকে জিজ্ঞেস করছে,
একমাত্র কোন বস্তু তাঁর
পিপাসা নিবারণ করতে পারে? মানুষের রক্ত এবং ছিনড়বমস্তক ব্যতীত অন্য কিছুই তাকে শান্ত
করতে পারে না। অতএব জননীর সন্তানদের উচিত মায়ের পূজা করা এবং তার ইপ্সিত বস্তু দিয়ে সন্তুষ্টি বিধান
করা। এসব হাসিল করতে যদি নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতে হয়, তবুও পশ্চাদপদ হওয়া উচিত হবে না। যেদিন গ্রামে গ্রামে
এমনিভাবে মায়ের পূজা করা হবে, সেদিনই ভারতবাসী স্বর্গীয় শক্তি ও আশীর্বাদে
অভিষিক্ত হবে” (ইবনে রায়হান : বংগভংগের ইতিহাস, পৃ. ৬-৭)।
* ‘বন্দে মাতরম’-এর খণ্ডিত ‘মা’কে অখণ্ড করার জন্য প্রাণ, অর্থ, বিদ্যা, মন, সংসারকে পণ করে যে
সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন শুরু হয়, তার সাথেও রবীন্দ্রনাথের
সম্পর্ক ছিল। (বাংলার বিপ্লববাদ, শ্রী নলিনী কিশোর
গুহ, পৃ. ৭৭, ৭৮)।
প্রিয় পাঠকবৃন্দ, উপরোক্ত
উদ্ধৃতিতে হিন্দু ঐতিহ্যের ‘মা’ কিন্তু ভক্তের
রক্ত ও ছিনড়ব মস্তকে খুশী নন।
তিনি ভক্তদেরকে মানুষ (মুসলমান নয় কি?) হত্যা করে উক্ত মানুষের রক্ত ও মস্তকের বিনিময়ে স্বর্গীয় শক্তি ও
আশীর্বাদের ওয়াদা করেছেন। এমতাবস্থায় বঙ্কিমের
মা, রবি ঠাকুরের মা এবং হিন্দু দেবী কি
এক ও অভিনড়ব নয়? মনে রাখা প্রয়োজন, উক্ত সময়ে উপমহাদেশে, বিশেষত: বাংলায়
হিন্দুরা মা কালীর নিকট শপথ নিয়ে
মুসলমান হত্যায় মেতে উঠেছিল। বাংলায় অসংখ্য গুপ্ত সমিতি গড়ে উঠেছিল।
উক্ত সময়ে
রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক রচিত হয়েছিল মাতৃবন্দনার গান :
আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায়
ভালবাসি
... .... ....
‘মা’ তোর বদনখানি মলিন
হলে আমি নয়ন
ও ‘মা’ আমি নয়ন জলে
ভাসি।
লক্ষণীয়, ১৯০৫-০৬ সালে
হিন্দু বাংলা ছিল সোনার বাংলা
কিন্তু মুসলিম বাংলা বা পূর্ব বাংলা ছিল ভিক্ষুকের বাংলা, অবহেলিত, লাঞ্ছিত নিপীড়িত, ম্লেচ্ছ, যবন ও অস্পৃশ্যদের
বাংলা। এমতাবস্থায় কবি কোন বাংলাকে উদ্দেশ্য করে গানটি রচনা করেছিলেন তা
সহজেই অনুমেয়।
অপরদিকে যুগান্তরে প্রকাশিত ‘মা’ ছিল পিপাসায় কাতর আর
রবীন্দ্রনাথের ‘মা’- এর বদনখানি মলিন।
মায়ের মলিন বদন দেখে কবির চোখ অশ্র“সজল। বঙ্গভঙ্গ না হলে নিশ্চয়ই কবির
চোখ অশ্র“সজল হতো না, কবি এত সুন্দর গান
রচনা করতেন না। এ জন্য অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য ব্রিটিশ রাজশক্তির, তাই পাঠকবৃন্দ সমস্বরে গেয়ে উঠুনÑ
‘জনগণ মন অধিনায়ক জয় হে ভারত ভাগ্য বিধাতা...”।
‘স্বরাজ’ আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ ‘
স্বরাজ’ আন্দোলনের
প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন উগ্র হিন্দুবাদী নেতা বালগঙ্গাধর তিলক। তিনি উচ্চবর্ণের
হিন্দুদেরকে মুসলমান ও নিমড়ববর্ণের হিন্দুদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন। কুখ্যাত দস্যু
সর্দার শিবাজীকে ভারতের জাতীয় বীর হিসেবে প্রতিষ্ঠাকল্পে তিনি গণপতি উৎসব ও
শিবাজী উৎসব প্রচলন করেন। তার প্ররোচনায় ভারতের দিকে দিকে প্রধানত বাংলায় প্রচণ্ড হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সূত্রপাত
হয়। তিলক হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার মাধ্যমে হিন্দুদেরকে সংগঠিত করে ভারতবর্ষে
রামরাজত্ব স্থাপন করতে চেয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ শুরু
থেকেই স্বরাজ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। শ্রী অমিতাভ চৌধুরী লিখেছেন, “তাতে দেখতে
পাচ্ছি তিলক তার দূত হিসাবে
রবীন্দ্রনাথকে ইউরোপে পাঠাতে চেয়েছিলেন এবং সে বাবদ রবীন্দ্রনাথকে ৫০
হাজার টাকা দিতে চেয়েছিলেন। শেষ মুহূর্তে কবি এ প্রস্তাবে রাজী হননি। মি. চৌধুরী আরও লিখেছেন, “আগেই বলেছি
তিলকের লক্ষ্য ছিল হিন্দু স্বরাজ। প্রশড়ব উঠতে পারে রবীন্দ্রনাথ কি করে এরূপ
লক্ষ্যধারী রজনৈতিক নেতার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। তিলকের সহিংস আন্দোলনে
দেশে অস্থিতিশীলতা দেখা দিলে ব্রিটিশ সরকার ১৮৯৭ সালে তিলককে গ্রেফতার করে। রবীন্দ্রনাথ নিজে উদ্যোগী হয়ে ‘তিলক’ মুক্তির জন্য
চাঁদা সংগ্রহ করে
পুনেতে পাঠান। (দ্র: ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ : শ্রী অমিতাভ চৌধুরী, ১৪০০ সাল, পৃ. ৬)
রবীন্দ্রনাথের
কর্মকাণ্ডে ব্রিটিশ সরকার নাখোশ হলে তিনি স্বরাজ আন্দোলনের সাথে
সম্পর্কচ্ছেদ করেন এবং লিখেনÑ “স্বরাজতো আকাশ কুসুম নয়, একটা কার্য পরম্পরার মধ্য
দিয়াতো তাহাকে লাভ করিতে হইবে। নতুন বা পুরাতন যে দলই হোন তাঁহাদের সেই কাজের তালিকা কোথায়? তাহাদের প্লান কি? তাহাদের আয়োজন কি? কর্মশূন্য
উত্তেজনায় এবং অক্ষম আস্ফালনে একদিন একান্ত ক্লান্তি ও অবসাদ আসিবেইÑ ইহা মনুষ্য স্বভাবের ধর্মÑ কেবল মদ যোগাইয়া আমাদিগকে
সেই বিপদে যেন লইয়া যাওয়া
না হয়।” (রবীন্দ্রনাথ/
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, পৃ. ১৪৬, ‘উচ্চারণ’ কলিকাতা)।
রবীন্দ্রনাথের মুসলিম বিদ্বেষ
জোড়া-সাঁকোর ঠাকুর পরিবার মূলত : By the British, of the British
& for the British empire. সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ কর্তৃক সৃষ্ট উক্ত
পরিবার বংশানুμমিকভাবে ব্রিটিশ
শাসন ও শোষণের অনুকূলেই সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। উক্ত পরিবারের উগ্রহিন্দুত্ব এবং সময়ে সময়ে মুসলমানদের
অনুকূলে ছিঁটেফোটা বক্তব্য প্রদানও মূলত: ব্রিটিশের স্বার্থেই নিবেদিত ছিল। রবীন্দ্রনাথের
চরিত্রও এর ব্যতিμম ছিল না। রবীন্দ্রনাথ কোন কোন সময় স্বীয় গোষ্ঠীস্বার্থে অথবা প্রভুর স্বার্থে পরস্পর বিরোধী যেসকল কর্মকাণ্ড
পরিচালনা করেছেন তা যথাস্থানে আলোচনা করা হবে। আলোচনার এই অংশে তাঁর মুসলিম
বিদ্বেষের ঐতিহাসিক তথ্যাদি উপস্থাপিত হলো।
১. “কবি রবীন্দ্রনাথ
মুসলমানদের পূর্ণ মুসলমান হয়ে থাকাটা বোধ হয় পছন্দ করতেন না। সেই জন্য তিনি
বলতেন, ‘মুসলমানেরা ধর্মে ইসলাম অনুরাগী
হলেও জাতিতে তারা হিন্দু। কাজেই তারা হিন্দু মুসলমান’।” (আবুল কালাম সামসুদ্দীন,
অতীত দিনের স্মৃতি, পৃ. ১৫০)।
২. মরহুম মোতাহের
হোসেন চৌধুরী শান্তি নিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনার লেখায় ইসলাম ও বিশ্বনবী সম্পর্কে কোন লেখা নেই কেন? উত্তরে কবি
বলেছিলেন, “কুরআন পড়তে শুরু করেছিলুম, কিন্তু বেশিদূর এগুতে পারিনি, আর তোমাদের রসুলের জীবন চরিতও ভাল লাগেনি”। (দ্র: বিতণ্ডা : সৈয়দ মুজিব উল্লাহ, পৃ. ২২৯)।
৩. মুসলমান
শ্রমিকদের ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে বিরক্ত কবি লিখলেন : “কিছুদিন হইল একদল ইতর
শ্রেণীর অবিবেচক মুসলমান কলিকাতার রাজপথে লোষ্ট্রখণ্ড হাতে উপদ্রপের চেষ্টা করিয়াছিল। তাহার মধ্যে বিস্ময়ের
ব্যাপার এই যে, লক্ষ্যটা বিশেষরূপে ইংরেজের
প্রতি। তাহাদের যথেষ্ট শাস্তিও হইয়াছিল।... কেহ বলিল মুসলমান বস্তিগুলো
একেবারে উড়াইয়া পুড়াইয়া দেওয়া যাক। (রবীন্দ্র রচনাবলী, ১০ম খণ্ড, পৃ. ৪২৮-৪২৯)। (অথচ কবিবাবু
হিন্দু সন্ত্রাসীদের বাড়িঘর উড়াইয়া পোড়াইয়া দেওয়ার কথা কখনও বলেননি)।
৪. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় কবিরবিরোধিতা : আমাদের দেশের একশ্রেণীর জ্ঞানপাপী, অন্ধ রবীন্দ্র ভক্ত অথবা ব্রাহ্মণ্যবাদের দালাল গোষ্ঠী উচ্চকণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের
প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তারা রবীন্দ্রনাথের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের কথাও ফলাও করে প্রচার
করেন অথচ এসকল প্রচারণার সাথে ঐতিহাসিক সত্যের কোন সম্পর্ক নাই। অনেক তথাকথিত বুদ্ধিজীবী বলেন, কবি ১৯০৬ সাল
থেকে মুসলমানদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল হয়ে তাঁর লেখনী পরিচালিত করেছেন কিন্তু ইতিহাস তা সাক্ষ্য দেয় না। সংক্ষেপে
রবীন্দ্র জীবনী পর্যালোচনা করলে ব্যাপারটি বুঝা যাবে।
“কবি কিশোর বয়স থেকে মুসলমান বিরোধী কবিতা/ গান রচনা করেছেন। বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পর কলিকাতার
সাম্প্রদায়িক নাট্য আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে একের পর এক মুসলিম বিরোধী কবিতা-গান রচনা
করেছেন। কবি উগ্র সাম্প্রদায়িক মুসলিম বিরোধী বালগঙ্গাধর তিলক, অরবিন্দ পাল ও লালা লাজপত রায়ের সাথে সμিয়ভাবে জড়িত
ছিলেন। বঙ্গভঙ্গের সূচনা থেকে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেছেন। কোনভাবেই
যখন বঙ্গভঙ্গ রদ করা সম্ভব হয়নি তখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে না গিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে মুসলমানদের সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টা করেছেন।
১৯০৫ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত কবি মুসলমানদের পক্ষ নিয়ে কথা বলেছেন এই জন্য যে, নতুন
পূর্ববঙ্গ-আসাম প্রদেশেই ছিল কবির জমিদারী। প্রজারা প্রায় সকলেই ছিল মুসলমান।
এমতাবস্থায় নিজ জমিদারীকে নির্বিঘড়ব করার জন্য এবং ইংরেজ প্রভুদেরকে খুশী করার জন্য তিনি
কিছুদিন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে দূরে ছিলেন। কিন্তু যখন ১৯১২ সালে ইংরেজ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করার
ঘোষণা দেয় তখনই কবি পুনরায় স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেন।
১. ১৯১২
খ্রিস্টাব্দের ২৮ মার্চ কলিকাতার গড়ের মাঠে এক বিরাট সমাবেশ করা হয়। তখন কবির বয়স ছিল ৫১
বছর। ঠিক তার দু’দিন পূর্বে আর একটি
গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হয়েছিল। সেখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, ঢাকায়
ইউনিভার্সিটি হতে দেওয়া যাবে না। ঐ গুরুত্বপূর্ণ সভায় বাঘা বাঘা হিন্দু নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
নতুন রাজ্য পুনর্গঠনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন কিনা? বা শিক্ষা বিষয়ে করণীয় কি? আলোচনার জন্য এক জনপ্রতিনিধিত্বপূর্ণ
সভা হয় কলকাতার টাউন হলে। উক্ত উভয় সভার সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। (কলকাতা ইতিহাসের দিনলিপি, ড. নীরদ বরণ
হাজরা, ২য় খণ্ড, ৪র্থ পর্ব)।
২. “তাহলে কি
রবীন্দ্রনাথ চাননি যে, তার জমিদারীর অন্তর্ভুক্ত মুসলমান কৃষক ও শ্রমিক সন্তান এবং
অনুনড়বতরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের আলো পেয়ে ধন্য হোক।... বলতে আরো লজ্জা হয় যে, কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি স্যার আশুতোষ মুখার্জীর নেতৃত্বে সেই সময়কার ভাইসরয়
লর্ড হার্ডিঞ্জকে (যাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় না হয় তার জন্য) ১৮ বার স্মারকলিপি
দিয়ে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। নীচতা এত নীচে নেমেছিল যে, তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিদ্রƒপ করে বলতেন মক্কা
বিশ্ববিদ্যালয়।” (তথ্য, জীবনের
স্মৃতিদ্বীপে : ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার, আবুল আসাদের ১০০ বছরের রাজনীতি থেকে উদ্ধৃত, পৃ. ৭২) (উলে-খ্য, উক্ত আশু বাবু
ছিলেন রবি ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়)
৩. ১৯১২ সালের ২৮
মার্চ কলকাতার গড়ের মাঠে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে হিন্দুরা প্রতিবাদ সভা ডাকে। প্রতিবাদ সভায় সভাপতিত্ব করেন
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। কারণ তিনি ছিলেন জমিদার। তিনি মুসলমান প্রজাদের মনে
করতেন গৃহপালিত পশু। (নীরদ চন্দ্র চৌধুরী, দি অটোবায়োগ্রাফী অব আননোন ইন্ডিয়া)।
৪. তখনকার
ষড়যন্ত্রের কারখানা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৩৬-এর ১১ সেপ্টেম্বর আরবি, ফার্সী মিশ্রিত
চলতি বাংলা ভাষার শব্দ ও বানান পরিবর্তন যজ্ঞে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখিত স্বীকৃতি দেন। রবিবাবুর স্বাক্ষরের তলায়
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও সই করেন। ( গোলাম আহমাদ মোর্তজা, এ এক অন্য ইতিহাস, পৃ. ১৬৬)।
৫. বিভাগ-পূর্ব ভারতের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার দাবি উঠলে
রবীন্দ্রনাথ এর প্রতিবাদ করে বলেন : “ভারতে স্বায়ত্তশাসন
প্রতিষ্ঠিত হলে মুসলিম শাসন কায়েম
হবে। সে জন্য হিন্দুদের মারাত্মক
ভুল হবে খেলাফত আন্দোলনে যোগ দেয়া।”... “মহাত্মা গান্ধীকে মুসলমানেরা
পুতুলে পরিণত করেছে। তুরস্ক ও
খেলাফতের সাথে হিন্দু শাস্ত্রের কোন সংশ্রব নেই। (সাপ্তাহিক সুলতান, ১৯২৩ সালের
জ্যেষ্ঠ সংখ্যা)।
যা বলছিলাম, রবীন্দ্রনাথ ১৯০৫
সালের আগে মুসলমানদের পক্ষে
একটি লাইনও লিখেননি, একটি কথাও বলেননি। ১৯০৬ সাল থেকে মাঝে মাঝে কিছু বলার
চেষ্টা করেছেন তবে যখনই দেখেছেন কোন কারণে মুসলমানরা লাভবান হচ্ছে তখনই তিনি
ভদ্রতার, মানবতার মুখোশ
ছুঁে ড় ফেলে স্বরূপে
আত্মপ্রকাশ করেছেন। তাঁর স্বরূপ কি ছিল তা সহজেই অনুমেয়। প্রমত তিনি ছিলেন একজন
মুসলিম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক হিন্দু কবি, দ্বিতীয়ত তিনি ছিলেন সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তির ভাড়াটিয়া
বুদ্ধিজীবী। বিদেশেও রবীন্দ্রনাথকে এরূপে চিহ্নিত করা হয়েছে।
১৯১৬ সালের ৬
অক্টোবর সানফ্রান্সিসকো একজামিনার পত্রিকায় লিখা হয়েছিলÑ বাংলায় “গতকাল নোবেল
প্রাইজ বিজয়ী হিন্দু কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে হত্যার চμান্তের সংবাদ পুলিশের নিকট
পৌঁছামাত্র প্যালেস হোটেলে তার এপার্টমেন্টে এবং কলম্বিয়া থিয়েটারে যেখানে বিকালে তার ভাষণ
দেবার কথা ছিল সেখানে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।” [পত্রিকাটি
রবীন্দ্রনাথকে ‘হিন্দু কবি’ বলেছে। সত্যি তিনি
হিন্দু কবি ছিলেন। মুসলমানের জন্য এক বর্ণও লিখেননি। মুসলমানের প্রতি ছিল তার তীব্র ঘৃণা।
(অধ্যাপক আহমদ শরীফের স্বীকারোক্তি।)]
(তথ্য : সরকার শাহাবুদ্দীন আহমদ, আত্মঘাতী রাজনীতির তিনকাল, পৃ. ৪৭১)
রবীন্দ্র চরিত্রের
বৈপরীত্য-
রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন একই
সরলরেখায় চলেননি। ১৯০৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন কট্টর সাম্প্রদায়িক এবং মুসলিম বিদ্বেষী।
চরমপন্থী তিলক, দস্যু সর্দার শিবাজী, উগ্রবাদী লালা লাজপত রায় থেকে আরম্ভ করে সকল সন্ত্রাসীদের পক্ষে এবং মুসলমানদের
বিরুদ্ধে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। প্রত্যেক সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে, মুসলিম স্বার্থবিরোধী
সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডের সূচনাতে এবং বিস্তার লাভ পর্যন্ত সময় তিনি উক্ত আন্দোলনে
যথাসাধ্য অবদান রাখতেন। কিন্তু উক্ত আন্দোলন যখন ব্রিটিশ সরকারের কোপানলে পড়তো তখন
কবিকে দেখা যেত বিপরীত ভূমিকায় অথবা নিষ্ক্রিয় ভূমিকায়।
উদাহরণস্বরূপ বলা
যায়, চরম মুসলিম
বিরোধী তিলকের নেতৃত্বে
সংগঠিত শিবাজী উৎসবে, গরুরক্ষা আন্দোলনে কবি সূচনাতে ছিলেন। বঙ্গভঙ্গ
আন্দোলনের সূচনা ও বিস্তার পর্যন্ত কবি নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন, ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতায় তিনি পুরোভাগে ছিলেন। বিশের দশকের খেলাফত আন্দোলন ও তিরিশের দশকের
স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনেও কবি খোলাখুলি হিন্দু স্বার্থের পক্ষে ও মুসলিম
স্বার্থের বিরুদ্ধে ভূমিকা
রেখেছেন। উক্ত আন্দোলনসমূহ যখন সরকারের স্থিতিশীলতা বিনষ্টের পর্যায়ে পৌঁছাত তখন কবির
অন্যরূপ দেখা যেত। ব্যাপারটি অনেকটা এরকম : “তিনি ভয়াবহ দাবানল সৃষ্টি করতেন এবং পরে দূরে বসে ভস্মীভূত
ছাইভস্মের পক্ষে কলম ধরতেন।” এটার আর একটা ব্যাখ্যা হতে পারে এই, “তিনি মনের তাগিদে
সাম্প্রদায়িক আগুন প্রজ্বলিত করতেন কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের ইচ্ছায় নিজেকে সংযত করতেন।” এর আরও একটি
ব্যাখ্যা হতে পারে আর তা হলো, “তিনি
পারিপার্শ্বিক প্রভাবে সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডে এগিয়ে যেতেন কিন্তু পরবর্তীতে এর
ভয়াবহ রূপ দেখে ভয়ে বা বিবেকের তাড়নায় পিছিয়ে আসতেন।”
উপরোক্ত
সিদ্ধান্তসমূহ ইতিহাসের আলোকে আমার নিজস্ব সিদ্ধান্ত। কেউ আমার সাথে একমত না হলে আমার
কোন দুঃখ নেই। বাংলাদেশের অসংখ্য রবীন্দ্রভক্তের শুভ দৃষ্টি লাভে আমি অনেক চেষ্টা করে দেখেছি রবীন্দ্রনাথের জীবনকে কয়েকটি
ভাগ করে অন্তত একটি ভাগকেও অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী বলা যায় কিনা? কিন্তু আমি হতাশ হয়েছি। আমার হতাশার কারণ
নিমড়বরূপ :
১. ১৯০৫ সালে
কবির বয়স ছিল ৪৫। অর্থাৎ তিনি তখন কোন আবেগতাড়িত তরুণ-যুবা ছিলেন না, তবু তিনি
শুধুমাত্র নিজ গোষ্ঠীস্বার্থে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন।
২. ১৯০৬ সাল থেকে
কবি কিছুটা ভিনড়বরূপে আবির্ভূত হলেন। ১৯০৬ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত দেখা গেল
তিনি তাঁর প্রবন্ধে হিন্দুমুসলিম বিরোধ সম্পর্কে নিরপেক্ষ মূল্যায়ন করছেন, উভয় সম্প্রদায়ের
সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য প্রবন্ধ লিখছেন, বক্তৃতা দিচ্ছেন। এ সময়টা ছিল বঙ্গভঙ্গের যুগ।
৩. কিন্তু ১৯১২
সালে যখন বঙ্গভঙ্গ রদ করা হলো এবং ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হলো
তখন কবি আবার ১৯০৪-০৫ এর
ভূমিকায় ফিরে এলেন। হিন্দু-মুসলিম সমতার কথা, সম্পর্ক বৃদ্ধির কথা ভুলে গেলেন। তিনি আবার কট্টর বর্ণ হিন্দুতে পরিণত
হলেন।
৪. ১৯১৪ সাল থেকে
কবি পুনরায় মুসলমানদের পক্ষে সহানুভূতিপূর্ণ দু’চারটা প্রবন্ধ, বাণী লিখতে শুরু
করলেন। আমরা ধরে নিলাম তাঁর বোধোদয় হয়েছে।
কিন্তু খেলাফত ও
অসহযোগ আন্দোলনকালে গান্ধীর নেতৃত্বে যখন হিন্দু-মুসলমান ঐক্যবদ্ধভাবে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন
কবি আবার সাম্প্রদায়িক বর্ণ হিন্দু হয়ে গেলেন এবং বললেন, “ভারতে স্বায়ত্তশাসন এলে
মুসলমান শাসন কায়েম হয়ে যাবে”। তিনি হিন্দুদেরকে
যৌথ আন্দোলন থেকে বিরত থাকার উপদেশ
দেন।
১৯৩৫ সালের ভারত
শাসন আইনেরও বিরোধিতা করেছেন কবি, কারণ মুসলিম ‘ফোবিয়া’। ১৯৩৬ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে ষড়যন্ত্রের কারখানা কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ে কবির নেতৃত্বে আরবিফাসীর্ মিশ্রিত চলতি বাংলা ভাষার শব্দ ও বানান পরিবর্তনের
সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
প্রবন্ধকার
রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধে কোন কোন সময় নিজেকে মুসলিম হিতৈষী হিসেবে প্রমাণ করেছেন, কিন্তু কাব্যে, নাটকে, উপন্যাসে তিনি ছিলেন বর্ণবাদী
হিন্দু। সমগ্র রবীন্দ্র সাহিত্য মূল্যায়ন করলে বলা কঠিন, তিনি আসলে কি ছিলেন? তিনি কি ব্রাহ্ম, নাকি হিন্দু, না বাউল, না সুবিধাবাদী। তবে
প্রত্যেকেই নির্দ্বিধায় বলতে পারবেন, কবি ব্রিটিশের এজেন্ট হিসেবে কোনরূপ বৈপরীত্য
দেখাননি। তবে হ্যাঁ এখানেও কথা থাকতে পারে। জীবনের সর্বশেষ বছরে তিনি দু-একটি
সত্য কথা স্বীকার করেছেন, আর তা হলো :
১. “আর মিথ্যা লেখার
প্রয়োজন নাই। এবার আমাদিগকে স্বীকার করিতেই হইবে হিন্দুমুসলমােনর মাঝখানে প্রকট বিরোধ আছে, আমরা যে কেবল
স্বতন্ত্র তা নয়Ñ আমরা বিরুদ্ধ।...
(রবীন্দ্র রচনাবলী, ১০ম খণ্ড, পৃ.৬২৮)। ঠাকুরের কথায় কেউ যদি প্রশড়ব করে এতদিন মিথ্যা
লেখার প্রয়োজন ছিল এখন হঠাৎ প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল কেন? এর জবাব কী?
২. “আজ আমি বলিতেছি, ভারতবর্ষের দীনতম, মলিনতম কৃষককে
আমি ভাই বলিয়া আলিঙ্গন করিব, আর ঐ যে রাঙ্গা সাহেব টম্টম্ হাঁকাইয়া আমার সর্বাঙ্গে কাদা ছিটাইয়া চলিয়া
যাইতেছে উহার সহিত আমার কানাকড়ির সম্পর্ক নাই।” (রবীন্দ্র রচনাবলী, ১২শ খণ্ড, পৃ. ৫৬)।
৩. “আমার পৃথিবীর
মেয়াদ সংকীর্ণ হয়ে এসেছে, অতএব আমাকে সত্য হবার চেষ্টা করতে হবে; প্রিয় হবার নয়।” (রাশিয়ার চিঠি, পৃ. ৫৯)।
অতএব বুঝা গেল
কবি এতদিন ব্রিটিশ সরকার ও বর্ণবাদী হিন্দুদের প্রিয় হওয়ার জন্য সত্য থেকে দূরে ছিলেন।
মৃত্যুর হাতছানি দেখতে পেয়ে একেবারে শেষ দিকে তিনি সত্য হওয়ার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছেন।
এতদ্সত্ত্বেও তিনি দীনতম, মলিনতম কৃষকদের উনড়বতির জন্য কিছু করেছেন এমন নজির নেই।
যথা-
১. “সমগ্র ঠাকুর
পরিবার কখনো প্রজার কোন উপকার করেনি। স্কুল করা, দীঘি কাটানো এসব কখনো করে
নাই। মুসলমান প্রজাদের ‘টিট’ করার জন্য নমঃশূদ্র প্রজা এনে বসতি স্থাপনের
সাম্প্রদায়িক বুদ্ধি রবীন্দ্রনাথের মাথা থেকেই বের হয়েছিল।” (অনড়বদা শংকর রায়, দৈনিক বাংলাবাজার, তাং ১৪/৪/৯৭ এবং ০১/০৫/৯৭)।
২. “চারিদিকে
নিষ্ঠুরতার এবং দুর্নামের প্রতিকূল বাতাসকে অনুকূল করতে রবীন্দ্রনাথের প্রাইভেট সেμেটারী অমিয় চμবর্তী একবার বিশাল জমিদারীর
একটি ক্ষুদ্র অংশ প্রজা সাধারণের জন্য দান করার প্রস্তাব করেছিলেন। ঠাকুর
মশাই ইজি চেয়ারে আধশোয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসে বলেছিলেন, “বল কি হে অমিয়, আমার রথীন (কবির একমাত্র
পুত্র) তাহলে খাবে কী?” (অনড়বদা শংকর রায়, ঐ)।
রবি ঠাকুরের আর
একটি বৈপরীত্যের বিষয় উল্লেখ করে এ প্রসঙ্গের ইতি টানছি।
আগেই উল্লেখ করা
হয়েছে, মুসলিম বিদ্বেষী বঙ্কিমচন্দ্র
মাটির দেশকে রক্ত মাংসের মা বানিয়ে তাতে দেবত্ব আরোপ করে রক্ত ও মস্তকভোজী দেবী বানিয়ে
হিন্দুদেরকে সহিংসতায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন এবং মাতৃবন্দনার গান ‘বন্দে মাতরম’ রচনা করে
সারাদেশে ভয়াবহ হিন্দুমুসলিম সংঘাত বাঁধিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ও
তাঁর দীক্ষাগুরু বঙ্কিমের ‘বন্দে মাতরম’ এর আদলে মাতৃবন্দনার গান ‘আমার সোনার বাংলা আমি
তোমায় ভালবাসি’ লিখে ফেললেন। কিন্তু
পরবর্তীতে তিনিই আবার এর বিরুদ্ধাচরণ করে লিখলেন-
১. “মাটির দেশকে মা
বানিয়ে নেওয়া হলো, আবার দেবীর মত মনে করে দেশ-মায়ের কাছে সাহায্য
চাওয়া হলো। কবির মতে, ওটা একটা নেশা ছাড়া কিছু নয়। তিনি লেখেন, কেননা, আমি এই বলি, দেশকে সাদাভাবে দেশ
বলেই জেনে, মানুষকে মানুষ বলেই শ্রদ্ধা করে, যারা তার সেবা করতে উৎসাহ পায় না,Ñ চিৎকার করে মা বলে, দেবী ব’লে, মন্ত্র পড়ে যাদের কেবলই সম্মোহনের দরকার হয়Ñ তাদের সেই ভালবাসা দেশের প্রতি তেমন নয়, যেমন নেশার প্রতি।
(ভারতে জাতীয়তা, আন্তর্জাতিকতা ও রবীন্দ্রনাথ; সংগ্রহেÑ অধ্যাপক দীপেন চট্টোপাধ্যায়, পৃ. ১২৭)।
২. কবি দেশকে মা’ মা’ বলে ডাকাকে প্রমে সমর্থন করেছিলেন এবং
সেইভাবে গান-কবিতাও লিখেছিলেন। কিন্তু নিজের ভুল নিজেই শুধরে নিয়ে স্পষ্টভাবে দেশের লোককে জানিয়েছেন (ক) “শুধু মা’ মা’ বলে দেশকে যারা ডাকাডাকি
করে তারা চিরশিশু। দেশ বৃদ্ধ শিশুদের
মা নয়, দেশ অর্ধ নারীশ্বর- মেয়ে পুরুষের মিলনে তার উপলব্ধি।”
(চার অধ্যায়,
১৯৩৪) (খ) বাংলাদেশের
মেট্রিয়ার্কী বাইরে নেই, আছে নাড়ীতে। মা’ মা’ শব্দে হাম্বাধ্বনি, তা আর কোন দেশের পুরুষ
মহলে শুনেছ কি? (ল্যাবরেটরী, ১৯৪০ দ্র:)
[সংগ্রহ ঐ, পৃ. ১৯- ২০]
৩. অধ্যাপক দীপেন
চট্টোপাধ্যায় কবির জন্য আরও লিখেছেনÑ “রবীন্দ্রনাথ ভাবাদর্শের দিক থেকে এই নগড়ব শক্তির উপাসনার বিরুদ্ধে ছিলেন। ভারতে
শক্তি উপাসনা হয়ে আসছে ভয়ংকরী মা কালীর মূর্তিতে। ধার্মিক বিভ্রান্তি হিসেবে
রবীন্দ্রনাথ সাধ্যমতো তা প্রত্যাখ্যান করেন। (ঐ, পৃ. ২০)।
(বাঙালীর কবি
রবীন্দ্রনাথ নিজের ভুল বুঝতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশী এলিটগণ এখনও মা’ মা’ শব্দের হাম্বাধ্বনির
মর্মার্থ বুঝে উঠতে পারেনি)।
রবীন্দ্র প্রতিভা
রবীন্দ্র প্রতিভা
সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি করতে হলে রবীন্দ্রনাথের সমকালকে অন্তরচোখে
উপলব্ধি করতে হবে। আমি অত্র প্রবন্ধের শুরুতে বলেছিলাম ব্রিটিশ শাসনের ১৯০ বছরের মেয়াদে
যোগ্যতার মাপকাঠি ব্রিটিশ শাসকদের সন্তুষ্টি অর্জনের পরিমাণের উপর নির্ভর ছিল।
শাসককুলের সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম ব্যক্তিগণকে জিরো থেকে হিরোতে পরিণত করা হয়েছিল
পক্ষান্তরে বিরুদ্ধবাদীরা যতই যোগ্যতাসম্পনড়ব হোক না কেন তাদেরকে দেশের কোন কর্মকাণ্ডে
জড়িত করা হয়নি, তদুপরি তৎকালীন ইতিহাসের
কোথাও তাদের নাম পর্যন্ত খুেঁ জ পাওয়া যাবে না।
ব্রিটিশ শাসকগণ
বাংলা এবং ভারতকে শাসন করার লক্ষ্যে প্রম ১২০ বছর বাঙালী হিন্দু সম্প্রদায় থেকে
এবং পরবর্তী ৭০ বছর হিন্দুমুসলমান ও অন্যান্য সম্প্রদায় থেকে কিছু লোককে বাছাই করে
নিজেদের শাসন-শোষণ পাকাপোক্ত করার জন্য। উক্ত বাছাইকৃত লোকগুলোই ছিল তৎকালীন ইতিহাসের বরপুত্র। তাদের মধ্যে
সমাজের সকল পেশার লোকই ছিল। এসব লোকদেরকে ইংরেজী ভাষা লিখতে পড়েত জানলেই চলতো। তাদের হুকুমসমূহ পড়তে পারা এবং
কাজ শেষে একটি রিপোর্ট প্রদান করতে পারাই যথেষ্ট ছিল। ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী যে
নিয়মে তাদের আজ্ঞাবহ চাকর সৃষ্টি করতো তা সাধারণত এইরূপ ছিল।
১. “বঙ্গবাসীকে দিয়ে
সারা ভারতবর্ষকে বশে আনতে হলে যাদেরকে নেতা বানানো হবে তাদের কিছুটা শিক্ষিত হতেই হয়। সেইজন্য কোলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হওয়ার আগে থেকেই বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বা তাদের গৃহভৃত্যের কাজ
দিয়ে বা ছোট ছোট স্কুলের মাধ্যমে শিক্ষিত করার ব্যবস্থা চালু ছিল। ঐ সময়কার তথাকথিত শিক্ষিত, যারা স্কুল ফাইনাল বা মেট্রিক পাস ছিল না, অথচ তাবেদারী, গোলামী ও বেঈমানীমূলক কাজ করতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সম্মত ও যোগ্য, তাদের জন্য ব্রিটিশ সরকার
ব্যবস্থা করে ফেলল, এবং ঠিক হলো যে, তারা মেট্রিক
পরীক্ষায় না বসেও ডিগ্রী পরীক্ষায় বসতে পারবে।” (তথ্য : কলিকাতা ইতিহাসের দিনলিপি, ড. নীরদ বরণ হাজরা, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৫)
২. “এইসব স্যার
উপাধিপ্রাপ্ত পণ্ডিতেরা সকলেই যে খুব পণ্ডিত ছিলেন তা নয়, এমন কিছু অপণ্ডিতও এই
স্যার’দের দলে ঢুকবার
সুযোগ পেয়েছেন যাঁরা
আসলেই মূর্খ। কিন্তু ব্রিটিশের বিশ্বাসভাজন হওয়া, বিশেষ করে বিপ্লবীদের দমিয়ে দেওয়া, লুকিয়ে থাকা বিপ্লবীদের ধরিয়ে দেওয়া, অকথ্য অত্যাচার
চালানো, অনাদায় কর আদায় করতে অকথ্য
নির্যাতন চালানোর বিনিময়েই হয়েছিল তাঁদের এই উপাধি।
এসব স্যারদের
পাণ্ডিত্যের দু-একটি নমুনা ব্যতীত কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না।
১. মহারাজা স্যার
প্রতাপ সিং ইংল্যান্ডে গিয়ে এক সম্ভ্রান্ত ব্রিটিশ মহিলাকে বলতে চেয়েছিলেন, প্রত্যেক
মুহূর্তেই এই ইংল্যান্ড আমার ভাল লাগছে। সুন্দর ঘাসের উপর সম্ভ্রান্ত ব্রিটিশ
পুরুষ
ও মহিলারা এই যে ঘোড়ায় চড়ে বেড়াচ্ছেন, এটাআমার খুবই ভাল
লাগছে। ইংরেজীতে উপরোক্ত কথাটা তিনি বলেছিলেন এইভাবে- Lekin, lady, I every
time happy this England, horses gentleman, ladies gentlemen, and grass is
gentleman.
২. সপ্তম
এডওয়ার্ডের অভিষেক উপলক্ষে দিল্লীর দরবারে লর্ড কার্জন ও তাঁর স্ত্রী হাতিতে চড়ে গিয়েছিলেন। এটা
স্যার প্রতাপের ভাল লাগেনি। তিনি বিনয়ের সঙ্গে প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, “You
eating knife and fork, I eating knife & fork. I not knowing this knife
& fork. Great Mogul he knowing how mount this elephant. You not knowing.
You sitting howdah in uniform with english lady. Great Mogul he mount properly.
He dressed in white Moslin and squat by himself on elephants back. You sitting
howdah, we laughing, you not knowing.” (বাঙলা ও বাঙালীর ইতিহাস, ধনঞ্জয় দাস
মজুমদার, প্রম খণ্ড, পৃ. ১২১)
৩. ত্রৈলোক্যনাথ
মুখোপাধ্যায়কে ডাকা হতো টি.এন. মুখার্জী বলে। লেখাপড়া বেশি জানতেন না। মাসিক পাঁচ টাকা মাইনের চৌকিদার ছিলেন। কর্মপটুতার জন্য হয়ে গেলেন উচ্চ পর্যায়ের পুলিশ কর্তা। মাইনে মাসিক
ছয়শত টাকা। স্যার
উইলিয়াম হান্টার তাকে কৃষি ও বাণিজ্য বিভাগের উচ্চকর্মী হবার সুযোগ করে দেন। পরে কলকাতা
মিউজিয়ামের সুপারিনটেনডেন্ট
পদে তাঁকে অধিষ্ঠিত করা হয়। তিনি তার সহোদর দাদা রঙ্গলাল বাবুর সঙ্গে সহযোগিতা করে
বিশ্বকোষ সৃষ্টি করেন। বেশি লেখাপড়া না জেনে ইংরেজী পুস্তক Art Manufacture of
India, Visit to Europe বইগুলো লিখে ফেললেন। (কলকাতা ইতিহাসের দিনলিপি, নীরদ বরণ হাজরা, পশ্চিম বঙ্গ
রাজ্য পুস্তক পর্ষদ)।
(উপরোক্ত উদাহরণগুলো দেখে অনেক পাঠক নিশ্চয় খুবই আফসোস করছেন কেন সে সময় দুনিয়াতে এলাম
না। যদি আসতাম তবে ইংরেজের দালালী করে চৌকিদার থেকে বিশ্বকোষ প্রণেতা হওয়া যেত আবার স্যার-নাইট খেতাবও অর্জন করা যেত।
বই না লিখেও গ্রন্থ প্রণেতা হওয়া যেত। উক্ত পাঠকবৃন্দের অবগতির জন্য বলছি, এখনও বাংলাদেশে
অনেক ঘোড়ার ডক্টরেট রয়েছে, টাকা খরচ করলে অথবা সাম্রাজ্যবাদের দালালী করলে হরেকরকম ডিগ্রী, খেতাব পাওয়া কোন ব্যাপার নয়।
আর বেশি নাম করতে চাইলে তসলিমা নাসরিনকে অনুসরণ করুন।)
৪. আর একটি কথা
বলে রাখা ভাল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রম তৈরি হয়েছিল ২টি উদ্দেশ্য নিয়ে। একটি হল
সিভিলিয়ান অফিসার ও ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা, আর দ্বিতীয়টি হলো
একটি প্রভুভক্ত অনুগত স্তাবকদল তৈরি করা। শান্তিনিকেতনের কোন শাখা প্রশাখা না
থাকলেও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল ব্রিটিশদের সহকারী কেন্দ্রÑ শান্তিনিকেতনকে
বস্তুত কলকাতার উপক্ষেত্র বলা যায়। বিশেষত: রবীন্দ্রকালে [ড. নীরদ বরণ হাজরা, কলকাতা ইতিহাসের
দিনলিপি, পৃষ্ঠা- ভূমিকা ৬।
ব্রিটিশ
শাসকগোষ্ঠী ঠ া ক ুর ব া ি ড়
ে ক একটি ষড়যন্ত্রের ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তুলেছিল। সেখানে
দেশী বিদেশী অনেক ভাষাভাষী অনুবাদক ও লেখক অবস্থান করত। তারা ব্রিটিশের ফরমায়েশ অনুযায়ী কবিতা, নাটক গ্রন্থ লিখত, অনুবাদ করত এবং
কোন না কোন বাঙালীর নামে
ছাপিয়ে দিত। বিখ্যাত কবি ইয়েটস ও মি. নেভিনসন ওরফে দীনবন্ধু এন্ড্রুজ কবিকে যথাসাধ্য
সাহায্য করতেন।
স্বামী বিবেকানন্দের
শিষ্য হয়ে যেমন মিস মার্গারেট নোবল অবিবাহিতা হয়ে আজীবন স্বামীজির পাশে ছিলেন ঠিক তেমনি দীনবন্ধু এন্ড্রুজ ৩৩ বছর
বয়সে ভারতবর্ষে আসেন এবং আজীবন ভারতবর্ষে থেকে যান। তাঁর প্রধান আবাসস্থল ছিল
শান্তিনিকেতন। উপরোক্ত মন্তব্যের সপক্ষে কয়েকটি প্রামাণ্য তথ্য উল্লেখ করা হলো :
১. কবির
শান্তিনিকেতনের শিক্ষক কর্মী সহযোগী ও বান্ধবের দল যারা ছিলেন তাঁরা অনেকে নানা ভাষার যোগ্য
অনুবাদকও ছিলেন। কবির প্রতিভা বিকাশের পূর্বে এতদিন যারা সূর্যের মতো উজ্জ্বল হয়ে ছিলেন তাঁরা বেশির ভাগই মুসলমান।
যেমন মাওলানা জালালউদ্দীন রুমী, শেখ সাদী, হাফিজ, ওমর খৈয়াম, হালি, মীর্জা গালিব, ফিরদৌসী প্রমুখ ভারতীয় ও
বহির্ভারতীয় কবি ও সাহিত্যিক। তাঁদের বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্য রচনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের লেখার বহু মিল দেখে কবি তাদের
ভাব চুরি করেছেন না লিখে কথাটা উল্টোভাবে লেখা হলো ‘সমাজ দর্পণে’। “কবির জন্মের পূর্বেই মধ্যযুগের সাধকেরা বিনা
স্বীকৃতিতেই চুরি করে নিয়েছেন। অদৃশ্য সিঁদ কাটবার কোথাও কোন একটি সহজ পথ
নিঃসন্দেহে আছে।” (সূত্র : ডেইলী পত্রিকা,
দৈনিক বাংলাবাজার, তারিখ ১/৫/১৯৯৭)।
২. “ঠাকুরবাড়ির ছেলে
ও মেয়েদের মধ্যে কবিতা, কাব্য, গান, চিত্রাঙ্কনের প্রতিভা অধিকাংশেরই ছিল।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাহা ছাড়া অর্থের জোরে বহু প্রতিভাবান ও প্রতিভাবতীদের তাঁরা পুষতে পারতেন, ইচ্ছামতো আনাতে
পারতেন ও পারতেন ইচ্ছামতো
কাজে লাগাতে।” (অমিতাভ চৌধুরী, ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ, পৃ. ২৩)।
৩. কিছু গবেষকের
ধারণা, রবীন্দ্রনাথকে
তৈরি করে নিয়েছেন
ব্রিটিশ, আর নোবেল প্রাইজও পাইয়ে দেয়া হয়েছে
তাকে। আমরা সকলে তাতে একমত হই আর না হই, কবির প্রখর প্রতিভা অনস্বীকার্য জেনেও তার পারিবারিক প্রারম্ভিক
আলোচনা করলে দেখা যাচ্ছে, যদিও তিনি কবিতা লিখতে পারতেন হঠাৎ একদিন তাঁর
ভাগেড়ব জ্যোতিপ্রকাশ মামাকে ডেকে বললেন, “তোমাকে কবিতা লিখিতে হইবে। ইহার পর চৌদ্দ অক্ষরে পয়ার কি করিয়া লিখিতে হয়
তাহাও শিখাইয়া দিলেন। তখন তাহাকে আর কে ঠেকাইয়া রাখে।” (আত্মঘাতী
রবীন্দ্রনাথ, নীরদ সি চৌধুরী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৯৩)
৪. “একটা কথা উড়িয়ে
অস্বীকার করা যাবে না যে, নোবেল প্রাইজ পাওয়ার
পূর্বে কবির বাজারদর ছিল খুব
নীচুমানের। মূল্য নির্ধারকেরা অনেকে
লিখেছেন, “ঠাকুর নোবেল প্রাইজ
প্রাপ্তির পূর্বে প্রায় অশিক্ষিত ব্যক্তি হিসাবে গণ্য হতেন। আমার ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার বাংলা প্রশড়বপত্রে ঠাকুরের একটি রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে সেটাকে বিশুদ্ধ ও সাধু বাংলায় লেখার নির্দেশ ছিল। এবং এটা ছিল ১৯১৪ সালে তাঁর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির এক বছর পরে।” (জাস্টিস আবদুল মওদুদ; মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ: সংস্কৃতির রূপান্তর, ১৮৯২, পৃ. ৪০৮)।
৫. “এই প্রেক্ষিতে
স্মরণ করা যাইতে পারে যে, ১৯০৭ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ
রবীন্দ্রনাথকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সঙ্গীতের উপর একটা ডিগ্রী দেবার প্রস্তাব করেন। কিন্তু অক্সফোর্ডের
তদানীন্তন চ্যান্সেলর লর্ড কার্জন এই প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গে বাতিল করে দেন। কার্জনের বক্তব্য
হলো, রবীন্দ্রনাথের
চেয়ে অনেক বেশি
খ্যাতিসম্পনড়ব গুণী ভারতবর্ষে আছেন।” (অধ্যাপক ডক্টর অরবিন্দ পোদ্দার, রবীন্দ্রনাথ :
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, পৃ. ১৪৮)।
৬. “১৯০০ সালে কবির
বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে তিনি লিখেছিলেন, ভাই, একটা কাজের ভার দেব?... আমার গ্রন্থাবলী ও ক্ষণিকা পর্যন্ত কাব্যের কপিরাইট
কোন ব্যক্তিকে ৬০০০ টাকায় কেনাতে পার? শেষের যে বইগুলি বাজারে আছে, সে আমি সিকিমূল্যে তার কাছে বিμি করবÑ গ্রন্থাবলী যা আছে, সে এক-তৃতীয়াংশ দামে দিতে পারব। (কারণ এটাতে সত্যের
(সত্যেন্দ্রনাথ) অধিকার আছে। আমি স্বাধীন নই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যে লোক কিনবে সে
ঠকবে না... আমার প্রস্তাবটা কি তোমার কাছে দুঃসাধ্য বলে ঠেকছে? যদি মনে কর, ছোটগল্প এবং বৌ-ঠাকুরানীর হাট ও রাজর্ষী কাব্য
গ্রন্থাবলীর চেয়ে খরিদ্দারের
কাছে বেশি সুবিধাজনক বলে প্রতিভাত হয় তাহলে তাতেও প্রস্তুত আছি। কিন্তু আমার বিশ্বাস, কাব্য
গ্রন্থগুলোই লাভজনক।” (সূত্র : ঐ, পৃ. ৭৯)।
(সুতরাং দেখা যাচ্ছে গ্রন্থের ব্যাপারে কবি স্বাধীন নন, তাতে অন্যের অধিকার আছে)।
৭. একমাত্র
কালীপ্রসনড়ব বিদ্যাবিশারদ তার ‘মিঠেকড়া’তে পরিষ্কার বলেই দিয়েছিলেন যে, “রবীন্দ্রনাথ
মোটেই লিখতে জানতেন না, স্রেফ টাকার জোরে
ওর লেখার আদর হয়। কিন্তু বরাবর
এতো নির্বোধের মত লিখলে চলে কখনো।” (জ্যোতির্ময় রবি, ও কালোমেঘের দল, সুজিত কুমার সেনগুপ্ত,
পৃ.
১১১)।
৮. “পাঁচকড়ি বাবু সত্যিই
বিশ্বাস করতেন যে,
রবীন্দ্রনাথের μমবর্ধমান জনপ্রিয়তা একটা হুজুগ মাত্র।... কারণ রবীন্দ্র সাহিত্য অনুরাগ বিশুদ্ধ ন্যাকামী ছাড়া আর কিছুই নয়। পাঁচকড়ি বাবু একথাও বহুবার স্পষ্ট বলে দিয়েছেনÑ রবীন্দ্রনাথের প্রায়
যাবতীয় সৃষ্টিই নকল। বিদেশ থেকে ঋণ
স্বীকার না করে অপহরণ।” (সূত্র : ঐ, পৃ. ঐ)।
৯. রবীন্দ্র
গবেষকদের বক্তব্য এই যে, রবীন্দ্রনাথের ভারততীর্থ কবিতাটি মধ্যযুগের পারস্যের কবি
মাওলানা জালালুদ্দীন রুমীর কবিতার নকল। যেটি পরে প্রমাণিত হয়েছে। যথা-
“বায্ আঁ, বায্ আঁ
হর আঁচে হাস্তী
বায্ আঁ।
গর কাফির গর গবর ওয়া
বোত পরস্তী বায্
আঁ।
ইদরগাহে মা
দরগাহে
না উম্মীত নীস্ত।
শতবার গর তওবাহ
শিকস্তী বায্ আঁ।”
রবীন্দ্রনাথ
লিখলেন-
“এসো হে আর্য,এসো অনার্য
হিন্দু মুসলমান,
এসো এসো আজ তুমি
ইংরাজ
এসো এসো
খ্রিস্টান।
মা’র অভিষেক এসো এসো
ত্বরা
মঙ্গলঘট হয়নি যে
ভরা
সবার পরশে পবিত্র
করা তীর্থ নীরে
এই ভারতের
মহামানবের সাগরতীরে।”
(দ্র: ডেইলী পত্রিকা, দৈনিক বাংলাবাজার, তাং ১/৫/১৯৯৭)
১০. “রবিঠাকুরের রচিত ‘চিত্রা’ কাব্যের ‘এবার ফিরাও মোরে’ এবং ‘মানসী’ কাব্যের ‘বধূ’ কবিতা দু’টির ভাব ও কাঠামো
ইংরেজ কবি মি. শেলী ও মি.
ওয়ার্ডস্ ওয়ার্থের কবিতার অনুরূপ বলে অনেক গবেষকের মত। নারায়ণ বিশ্বাস
প্রমে ধরে দেন ‘গোরা এবং ‘ঘরে বাইরে’ নকল। একথা অবশ্য আগে বলার চেষ্টা
করেছিলেন প্রিয়রঞ্জন সেন। তারপর পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত একটি মেয়ে ও ‘গোরা’ এবং ‘ঘরে বাইরে’র সাথে দু’টি ইংরেজী উপন্যাসের
সাদৃশ্যের কথা বলেছিলেন। এর বেশি বলতে সাহস পাননি। কালী মোহন ধরে দিয়েছিলেন
রবীন্দ্র কবিতার নকল।” (সূত্র : ঐ)।
১১. “এই রবীন্দ্রনাথই
ড. ডেভিডের মধ্যস্থতায় আন্ডারসনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ‘চার অধ্যায়’ লেখেন। এটা এখন
প্রমাণ হয়ে গেছে। শুধু তাই
নয়, ‘ঘরে বাইরে’ও তাঁকে টাকা দিয়ে লেখানো
হয়।” (সূত্র : ঐ)।
১২. “তিনি (দীনবন্ধু
এন্ড্রুজ) রবীন্দ্রনাথের ইংরেজী যেখানে উচ্চাঙ্গের বলিয়া মনে করিতেন না, উহাকে সাহিত্যিক
করিয়া দিতেন।...
রবীন্দ্রনাথের যেসব মত তাঁহার ভাল লাগিত না তাহা বদলাইয়া নিজের বিচার অনুযাযী
পরিবর্তন করিয়া দিতেন। অর্থাৎ তিনি রবীন্দ্রনাথকে যতটুকু সম্ভব
শ্রেষ্ঠ এনড্রুজ বলিয়া
দেখাইতে চাহিতেন।” (আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ,
নীরদ সি চৌধুরী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৯৩)।
১৩. অমিতাভ
চৌধুরী তাঁর ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ পুস্তকে লিখেছেন, “গীতাঞ্জলি নামটাই ধার করা। রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘদিন কাটিয়েছিলেন শিলাইদহের
কুমারখালী অঞ্চলে। কুমারখালীর বিশিষ্ট তান্ত্রিকের সঙ্গে পরিচিত হন। বাংলা ১২৯৫ অর্থাৎ ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যার্নব মশাই
একটি বই লিখেন। বইটির নাম ‘গীতাঞ্জলি’। কুমারখালীর মথুরানাথ যন্ত্রে মহেশচন্দ্র দাস মুদ্রিত করেন।”
“...‘গীতাঞ্জলি’ নোবেল প্রাইজ পাওয়ার
পর জনরবের কি ধুম- রবীন্দ্রনাথ কোন বাউলের খাতা চুরি করে ছেপে দিয়েছেন। ... শেষে অবশ্যি নামও জানা গেল। স্বয়ং লালন ফকির মহাশয়ের বাউল গানের খাতা চুরি করেই রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। আজ অবিশ্বাস্য শুনালেও একথা কিন্তু সত্য, সেদিন বহু ব্যক্তি
শান্তিনিকেতনের বিভিনড়ব কর্তাকে বলেছেন এবং লিখেছেন, রবিবাবু বড় কবি স্বীকার করি।... যাকগে, তা গীতাঞ্জলির খাতাটা এবার উনি ফিরিয়ে দিন। প্রাইজ তো পেয়েই গেছেন, অনেক টাকাও হাতে এসে গেছে, ওতো আর কেউ নিতে যাচ্ছে না, তা, গান লেখা খাতাটা উনি দিয়ে দিন।” (জ্যোতির্ময় রবি ও
কালো মেঘের দল, সুজিত কুমার
সেনগুপ্ত, পৃ. ১৬১)।
নীরদ বাবু
দেখিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’র যে কবিতাগুলো অনুবাদ করে বা করিয়ে তিনি
পেয়েছিলেন নোবেল প্রাইজ,সেগুলো ইংরেজ কবিদের নকল মাত্র। এটা তার ভিত্তিহীন দাবি
নয়। কবির ইংরেজী করা গীতাঞ্জলির ৬১, ২৬ ও ৮৬ নং কবিতাগুলোর পাশাপাশি ইংরেজ কবি ঝড়ষড়সড়হ এবং ঝঃ. ঋৎধহপরং-এর কবিতা
বা গান পরস্পর সাজিয়ে দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, রবীন্দ্রনাথের তৈরি করা কবিতার
সঙ্গে ইংরেজ কবিদের বহুলাংশেই মিল রয়েছে। অনেকের ধারণা, ভাব ও ভাষায় মিল রয়েছে প্রায় ৯০ শতাংশ। তাহলে কি তাঁদেরই
(ব্রিটিশদের) ইঙ্গিতে বিলেতের কবিদের ‘থীম’ তাঁকে পূর্বেই গোপনে পরিবেশন করা হয়েছিল?” (আত্মঘাতী বাঙালী, নীরদ সি চৌধুরী, ২য় খণ্ড)।
‘গীতাঞ্জলি’র গুপ্ত রহস্য বলতে গেলে আরও দু- একটি কথা জানানো প্রয়োজন। ‘গীতাঞ্জলি’ যারা দেখেননি তারা
অনেকে মনে করেন যে, মোটা ‘গীতাঞ্জলি’ বইখানার পুরো
ইংরেজী অনুবাদ বিলেতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আর তাঁর কবি প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাঁরা দিয়েছিলেন নোবেল প্রাইজ।
“ইহার পর ইংরেজী ‘গীতাঞ্জলি’তে রবীন্দ্রনাথের কোন কোন কবিতার অনুবাদ আছে বলা প্রয়োজন। ইহার
নাম ‘গীতাঞ্জলি’ হইলেও বইটিতে বাংলা
গীতাঞ্জলির সব গান (বা কবিতা) অনুদিত হয় নাই। বাংলাতে ১৫৭টি গান ছিল, উহার মধ্যে শুধু
৫৩টি মাত্র ইংরেজী করা হইয়াছিল, ইংরেজী ‘গীতাঞ্জলি’তে সবশুদ্ধ ১০৩টি কবিতা ছিল (বইটি বড় টাইপে মাত্র ১০১ পৃ. হইয়াছিল, দাম হইয়াছিল
মাত্র চার শিলিং ছয় পেন্স, আমাদের টাকায় তিন টাকা ছয় আনা)। বাকি ইংরেজীতে অনুদিত কবিতা আসিয়াছিল প্রধানত ‘নৈবেদ্য’ ও ‘খেয়া’ হইতে, অল্প কয়েকটি
সাময়িকপত্রে প্রকাশিত কবিতা হইতে।” (দ্র: ঐ, পৃ. ১৪২)।
বঙ্গভঙ্গ যখন রদ
হয় তখন ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাস। কত রক্তারক্তি, গুলি, জেল প্রভৃতির তাণ্ডবনৃত্য। কবি
তখন সপক্ষ-বিপক্ষ কোন পক্ষেই না গিয়ে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য খুবই কর্মব্যস্ত
ছিলেন। অর্থাৎ ঠিক ঐ সময়েও তিনি বিলেতে, বিলেতে একবার নয়Ñ বহুবার তাঁকে যেতে হয়েছে। এমন যে তাঁর প্রতিভার বিচার হয়েছে তার
লেখার উপর তারপর তাঁকে তাঁর প্রাসাদে থাকা অবস্থায় পুরস্কৃত করা হয়েছে। বরং
১৯১২তে বঙ্গভঙ্গ হয় আর ১৯১৩-তে তিনি দেশে ফেরেন অক্টোবরে। আর তাঁর পিছনে পিছনে
নভেম্বর মাসেই তাঁর নোবেল প্রাইজের সংবাদ পৌঁছাল, কোন শর্ত হয়েছিল কিনা? কোন রাজনৈতিক চμান্ত হয়েছিল কিনা? (কালান্তর, বিশ্বভারতী ১৩৫৫
সংস্করণ, পৃ. ১৬৯)।
‘জনগণমন’ তিনি লিখেছেন আশুতোষ চৌধুরীর পরামর্শে, ভারত সম্রাট পঞ্চম জর্জের অভিষেক উপলক্ষে। আশুতোষ
চৌধুরী ছিলেন তাঁর ভাইঝি জামাই, প্রমথ চৌধুরীর বড় ভাই। ব্রিটিশ সম্রাট পঞ্চম জর্জকে
তিনি ভারতের ভাগ্য বিধাতা আখ্যা দিয়ে লিখেছিলেন উক্ত গান। এর প্রম লাইনটি হচ্ছে : ‘জনগণমন অধিনায়ক
জয় হে ভারত ভাগ্য
বিধাতা’
উক্ত সময়ে নোবেল প্রাইজ প্রদান কমিটির প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন সম্রাট ৫ম জর্জ। অনেকের মতে সম্রাট ৫ম জর্জ খুশী হয়ে কবির জন্য নোবেল প্রাইজের ব্যবস্থা করেছিলেন।
রবীন্দ্র প্রতিভা
সম্পর্কে আমার নিজের কোন কথা নেই। উপরোক্ত মনীষীদের বক্তব্য-মন্তব্য থেকে পাঠক যা অনুমান
করবেন, আমার অনুমানও তাই।
রবীন্দ্র চরিত্রের বৈশিষ্ট্য
ইতিপূর্বে আমি যে
সকল তত্ত্ব ও তথ্য উপস্থাপন করেছি তাতে দেখা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশ রাজশক্তির মনোনীত
ব্যক্তি, ব্রিটিশ কর্তৃক
সৃষ্ট বিশ্বকবি এবং
আজীবন তিনি ব্রিটিশের পক্ষেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। এহেন সাম্রাজ্যবাদের
গোলাম নিশ্চয়ই কোন স্বাধীন ব্যক্তির ও জাতির আদর্শ হতে পারে না। এরূপ ব্যক্তির সাহিত্য
সাধনা স্বাধীনতার চেতনাকে শাণিত না করে ভূলুণ্ঠিত করে। এরূপ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর দেশ ও
জাতিদ্রোহী তৎপরতার কারণেই ব্রিটিশ শাসন ও শোষণ ভারতবর্ষে দীর্ঘায়িত হয়েছিল।
ব্রিটিশের মনস্কামনা পূর্ণ করতে এসব মেরুদণ্ডহীন বুদ্ধিজীবীগণ বাঙালী জাতীয়তাবোধের
চেতনাকে, গর্বকে, স্বকীয়তাকে বর্ণবাদী আর্য
সাম্রাজ্যের পদতলে বিসর্জন দিয়েছিল। ইতিহাস পাঠকগণ একটু লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন, ব্রিটিশ
শাসকদেরকে এদেশে ডেকে আনা, ক্ষমতায় বসানো, ভারতব্যাপী ব্রিটিশ সাম্রাজ্য স্থাপনসহ সবকিছুতেই বাঙালী বাবুদের
রক্ত-ঘাম-শ্রম সর্বোচ্চ মাত্রায় বিদ্যমান ছিল। কিন্তু
এ সকল নির্বোধ বুদ্ধিজীবীগণ কোন বাংলা ভাষাভাষী দেশনায়ক খুেঁ জ পাননি অথবা খোঁজার চেষ্টা না করে ব্রিটিশের প্রেসμিপশন মোতাবেক রাজপুত, মারাঠা ও শিখ জাতির ব্যক্তিদেরকে দেবতার
আসনে বসিয়েছিল। ফলে বাঙালী জাতীয়তার খাত
বদল হয়ে ভারতীয় জাতীয়তায় রূপান্তরিত
হয় এবং ভারতবর্ষের রাজধানী এবং
কর্তৃত্ব বাঙালীদের নিকট থেকে স্থানান্তরিত হয়ে দিল্লীতে এবং বর্ণহিন্দু আর্যদের নিকট চলে যায়।
তাহলে ফল দাঁড়াল
কি? ১৯৪৭ সালে
ব্রিটিশদের নিকট থেকে
স্বাধীনতা অর্জনের পর দেখা গেল, রাজধানী বা কর্তৃত্ব কোনটাই আর বাঙালীদের হাতে নেই।
বাঙালীরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার পর পরই বর্ণবাদী আর্য ভারতের কঠিন
শৃঙ্খলে আবদ্ধ হলো। যার অনিবার্য ফলশ্র“তি হলো আমাদের ভগড়ব-জরাজীর্ণ কোলকাতা শহর ও
দিল্লীর পশ্চাৎভূমি বা শোষণের ক্ষেত্র পশ্চিম বাংলা। আরেকটি ঐতিহাসিক শিক্ষা সকলের স্মরণে থাকা দরকার, তা হলো, পশ্চিমা মুসলমানেরা
পূর্ব বাংলার মুসলমানদেরকে প্রম
শ্রেণীর মুসলমান মনে করতো না এবং উত্তর ভারতের আর্য হিন্দুরাও তদ্রƒপ পশ্চিম বাংলার
হিন্দুরদেরকে দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর হিন্দু মনে করে। পূর্ব বাংলার মুসলমানগণ পশ্চিমা মুসলমানদের অহংকারকে ১৯৭১ সালে চূর্ণ করতে সক্ষম হলেও পশ্চিম বাংলার হিন্দুরা আর্য প্রাধান্যকে, প্রভুত্বকে ইতিহাসের শাস্তি
হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। ব্রিটিশ আমলে পূর্ব বাংলা ছিল রাজধানী কোলকাতার শোষণের ক্ষেত্র আর বর্তমানে কলকাতা হচ্ছে দিল্লীর শোষণের ক্ষেত্র।
তবে আশার কথা
হচ্ছে, ইতিমধ্যে পশ্চিম বাংলার
কিছুসংখ্যক স্বাধীনচেতা বুদ্ধিজীবী রবীন্দ্রগোষ্ঠীর অশুভ কার্যকলাপের স্বরূপ
উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে
এবং নিজেদের আশু কর্তব্য নির্ধারণ করেছে। বাঙালীদের স্বাধীনতার শত্র“- মিত্র চিহ্নিত
করতে সক্ষম হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, পশ্চিম বঙ্গের
বাঙালীরা এতদিন যেসকল বাঙালী বুদ্ধিজীবী যথা হরপ্রসাদ, বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথ গংকে
স্বাধীনতার অগ্রনায়ক হিসেবে সম্মান করেছিলেন তাদেরকেই অদূর ভবিষ্যতে বাঙালী স্বাধীনতার শত্র“পক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করবে এবং বাঙালী স্বাধীনতার সত্যিকার বীর পুরুষ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, শরৎ বসু, সুভাষ বসু, শেরে বাংলা, আবুল হাশিম ও
সোহরাওয়ার্দীকে স্বাধীনতার পক্ষের
শক্তি হিসেবে মর্যাদা দান করবে। যতদিন তা না হচ্ছে ততদিন পশ্চিম বাংলাকে আর্য হিন্দুদের গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ থাকতে হবে।
সুতরাং দেখা
যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের
রাজনৈতিক চিন্তাধারা কোন
স্বাধীন মানুষের আদর্শ হতে পারে না। এখন আমরা আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেব
তাঁর সামাজিক চিন্তাধারা আমাদের চলার পথে অনুকরণযোগ্য কিনা? সামাজিকভাবে তিনি
ছিলেন প্রজাপীড়ক বর্ণবাদী জমিদার। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন অবাধ যৌনাচার বা
ব্যভিচারের পক্ষে। কয়েকটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি বোধগম্য করা হলো:
১. “কবির সঙ্গে তার
(বৌদি) কাদম্বরীর অবৈধ প্রেমকে কেন্দ্র করে নাকি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সংঘর্ষ হয়েছিল।
সেটাকে কেন্দ্র করে ডক্টর নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্ত ‘পাপের ছাপে’ লেখায় কবি বিরুদ্ধ মতামত ব্যক্ত করেছেন। ঠাকুরবাড়ির
সুভোঠাকুর সম্পাদিত ‘ভবিষ্যত’ পত্রিকায় কবির বিরুদ্ধে লেখা বের হয়- পয়েট টেগোর কে হন তোমার জোড়াসাঁকোতেই থাকো/ বাবার খুড়ো যে হন শুনিয়াছি, মোর কেহ হয় নাকো।” (অধ্যাপক দীপন
চট্টোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩)।
২. “রবীন্দ্রনাথ
নিজেকেও বাউল বলে পরিচয় দিয়েছেন। ড. সুধীর বাবু এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “তাঁর কোন কোন
রচনাকে তিনি ‘রবীন্দ্র বাউলের রচনা’
বলে মেনে নিয়েছেন।” (দ্র: ‘দেশ’, পৃ. ৩৬, ডিসেম্বর ১৯৯১)।
৩. “বিশ্বভারতী
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর শ্রী ক্ষিতি মোহন সেন শাস্ত্রী বাউলদের সম্পর্কে লিখেছেন, “দেহের মধ্যেই
তাহাদের বিশ্ব। জাতি ও
সমাজের বন্ধন উভয়ের কাছেই অর্থহীন।” (বাংলার বাউল, শ্রী ক্ষিতি মোহন সেন শাস্ত্রী, পৃ. ২)।
৪. “মিথুনাত্মক
যোগসাধনা আধ্যাত্ম্যবাদী বাউল সম্প্রদায়ের সাধনার মূল পদ্ধতি। বাউলের সাধনা
দেহকেন্দ্রিক। ‘দেহমন্দিরে প্রাণের ঠাকুর’ অন্বেষণই বাউলের
সাধনার সার।” (দ্র: বসন্ত কুমার
পাল, মহাত্মা লালন
ফকির, পৃ.
অবতরণিকা-১০)।
সুতরাং পাঠকবৃন্দ
বুঝতেই পারছেন, আমাদের বাউল কবি রবি
ঠাকুর সুযোগ পেলেই ‘দেহমন্দিরে প্রাণের ঠাকুর’ খোঁজায় লিপ্ত
হতেন। এ বিষয়ে তিনি কোন
রাখঢাকের ধার ধারতেন না। দু-একটি উদ্ধৃতির মাধ্যমে পাঠকবৃন্দ বুঝে নিবেন :
১. “আমাদের ভারতীয়
সমাজে কথিত শিক্ষিত ও অশিক্ষিত বেশিরভাগ মানুষই অতিমানুষ, মহান মানুষ, প্রতিভাবান মানুষের প্রতি ভক্তির মাত্রা বাড়াতে
বাড়াতে তাঁকে বানিয়ে ফেলেন ঋষি-মহাঋষি, যোগী, মুণি, সাধকÑ সবশেষে ভগবান পর্যন্ত করে ফেলেন তাঁকে। অপরদিকে, চরিত্রহীন, লম্পট, সমাজবিরোধী, অসংযমী, ব্যভিচারী
প্রভৃতি লোককে সমাজের এত পরির্তন হওয়া সত্ত্বেও ভাল চোখে দেখা হয় না। কবির ব্যক্তিগত
ব্যবহারিক জীবনে নারীসঙ্গ, অবাধ মেলামেশা, যৌনতা বিষয়ে বিতর্ক আনবার কোন প্রয়োজন নেই।
কারণ রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়ে ছিলেন অত্যন্ত স্পষ্টবাদী।” (এ এক অন্য ইতিহাস, গোলাম আহমাদ
মোর্তজা)।
১৯২৮ সালের ১লা
ফেব্র“য়ারি তাঁর
সেড়বহধন্য দিলীপ কুমার
রায়কে কবি এক দীর্ঘ চিঠি লেখেন। বিষয়- নারীর ব্যভিচার। রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট ভাষায়
উল্লেখ করেছেন, “সমাজে যদি অশান্তি না ঘটে তাহলে ব্যভিচার-ব্যভিচারই হয় না। ব্যভিচারের ফলে যদি সন্তান সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে আজকাল
সেটাও সমস্যা নয়। কেননা কন্ট্রাসেপটিভ বেরিয়ে গেছে। নিবারণের উপায়গুলোও সহজ। সুতরাং গর্ভধারণ করতে হয় বলে দেহকে
সাবধান রাখার দায় আর তেমন নেই।... সমাজ নিজের প্রয়োজনবশত: স্বভাবকে ঠেকিয়ে রাখে।
ঠেকিয়ে রাখতে তার অনেক ছলবল- কৗশল অনেক কড়াকড়ি, অনেক পাহারার দরকার হয়। কিন্তু
প্রয়োজনগুলোই যখন আলগা হতে থাকে, তখন স্বভাবকে ঠেকিয়ে রাখা আর সহজ হয় না।
ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভোগের দৃষ্টান্ত দেখ না। আমার যখনই ক্ষিদে পায়, তখন আমার গাছে যদি ফল
না থাকে, তবে তোমার গাছ থেকে ফল পেড়ে
খেতে আমার স্বভাবতই ইচ্ছা হয়। কিন্তু যেহেতু ব্যক্তি সম্পত্তির সীমা রক্ষা করা সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার পক্ষে অত্যাবশ্যক, এজন্যই ফল পেড়ে খাওয়াটা চুরি। এই চুরি সম্পর্কে
সমাজ আমাদের মনে যে সংস্কার দৃঢ় বদ্ধমূল করে দিয়েছে সেটা নিজের ব্যবস্থা রক্ষা
করবার উদ্দেশ্যে।... বস্তুত: চুরি না করার নীতি শাশ্বত নীতি নয়। এটা মানুষের মনগড়া নীতি। এ
নীতিকে পালন না করলে সমাজে যদি অশাস্তি না ঘটে, তবে পরের দ্রব্য নেওয়া চুরিই নয়। এই কারণে তুমি দিলীপ কুমার রায় যদি
আমি রবীন্দ্রনাথের লিচু বাগানে আমার অনুপস্থিতিতে লিচু খেয়ে যাও, তুমিও সেটাকে চুরি বলে
অনুশোচনা কর না। আমিও সেটাকে চুরি বলে খড়গহস্ত হই না। ব্যভিচার সম্বন্ধে এই
কথাটাই খাটে। এর মধ্যে যে অপরাধ সেটা সামাজিক। অর্থাৎ সমাজে যদি অশান্তি ঘটে, তবে সমাজের
মানুষকে সাবধান হতে হয়। যদি না ঘটে, তাহলে ব্যভিচার-ব্যভিচারই হয় না। (দ্র: অমিতাভ
চৌধুরী, ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ)।
প্রিয় পাঠকবৃন্দ!
উপরোক্ত উদ্ধৃতিসমূহ পড়ে নিশ্চয়ই পুলকিত হয়েছেন এবং অনুভব করতে সক্ষম হয়েছেন কেন
আমাদের দেশে রবীন্দ্রভক্ত এত বেশি এবং বিখ্যাত লেখিকা তসলিমা নাসরীন রবীন্দ্র
ভক্ত বুদ্ধিজীবীদের নামে ‘ক’ ‘খ’ লিখতে বাধ্য হয়েছেন। রবীন্দ্র ভক্তরা কি ঋষি কবিকে ভক্তি করেন, নাকি রক্ত মাংসে
গড়া ষড়রিপুর দাস বাউল
কবি রবীন্দ্রনাথকে বেশি ভালবাসেন?
রবীন্দ্রকাব্যে প্রকৃতি
(‘রবীন্দ্রকাব্যে প্রকৃতি’ এই অংশটি আমার ছাত্রজীবনে রচিত, যখন আমি বিশ্বাস করতাম,
রবীন্দ্রনাথের নামে
প্রকাশিত কাব্যসমূহ তাঁর মৌলিক রচনা)
প্রাচীন যুগ থেকে
বর্তমান পর্যন্ত বাংলা কবিতায় প্রকৃতি বিপুল এবং ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আমাদের
ভাষার সর্বকালের কাব্যে প্রকৃতির উপর কবিদের নির্ভরতা লক্ষণীয়। তাঁরা যে শুধুমাত্র
প্রকৃতির বর্ণনা দিয়েছেন তাই নয় বরং প্রকৃতির সঙ্গে জীবনকে সম্পর্কিত করেছেন এবং প্রমাণ
করেছেন যে, প্রকৃতির কোন উপাদান থেকে মানুষ বিচ্ছিনড়ব নয়।
প্রাচীন
চর্যাপদের মানুষের বসবাস ছিল প্রকৃতি নির্ভর এবং তৎকালীন কবিদের রূপকের বিন্যাসের সম্বলও
ছিল প্রকৃতি, যদিও রূপকের মাধ্যমে তত্ত্ব প্রচারই চর্যাপদের মূল লক্ষ্য ছিল। শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে ও বৈষ্ণব পদাবলীতে নারীর প্রণয় লিপ্সার
বিভিনড়ব প্রকাশকে প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত করে প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রাচীন ও
মধ্যযুগের সময় যা সত্য ছিল রবীন্দ্রনাথের কালেও তা সত্য রয়েছে বরং বলা যায়, অধিকতর সত্য
হয়েছে। আমাদের কবিতায় প্রকৃতিকে অধিকতর ব্যবহারের কারণ সম্ভবতঃ এই যে, আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জীবন ভূমির সাথে সম্পর্কিত এবং গ্রামের সঙ্গে
নিবিড়তম ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ।
রবীন্দ্রনাথের
কবিতায় আমরা প্রকৃতির বিচিত্র ব্যবহার প্রত্যক্ষ করি। গ্রামের সঙ্গে
রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নিবিড়তর হবার ফলেই তিনি প্রকৃতির উদার দাক্ষিণ্যের সঙ্গে পরিচিত
হয়েছিলেন। পৈত্রিক জমিদারীর দায়িত্বভার পেয়ে তিনি বর্তমান কুষ্টিয়ার শিলাইদহের সদর কাচারীতে দীর্ঘদিন অবস্থান
করেন। এ স্থানটি পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত। তিনি পদ্মা নামক নৌকায় আরোহণ করে
জমিদারী তদারকির উদ্দেশ্যে এখান থেকে কুষ্টিয়া, কুমারখালী, শাহজাদপুর ও অন্যান্য স্থানে গমন করতেন। এভাবে নদীপথে বারবার ভ্রমণের
ফলে পল্লী বাংলার বিচিত্র প্রকৃতির সাথে তিনি একাত্ম হয়ে পড়েন। প্রকৃতির বিচিত্র
শোভা তাঁর দৃষ্টিকে আপ্লুত করেছিল, হৃদয়কে উদ্বেল করেছিল। ফলে জীবনের শেষ দিন
পর্যন্ত তিনি কবিতার চিত্রকল্প নির্মাণে প্রকৃতিকে নানাভাবে ব্যবহার করেছেন। রবীন্দ্রনাথ
প্রকৃতিকে অবলম্বন করে জীবন সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব বোধকে প্রকাশ করতে সচেষ্ট ছিলেন।
বলাকা কাব্যগ্রন্থের চঞ্চলা কবিতাটি এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। এই কবিতায় গতির একটি উপলব্ধি
ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তিনি নদীর চিত্রকল্পের মাধ্যমে সে উপলব্ধিকে ব্যক্ত করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ
স্বীয় অনুধ্যান, উপলব্ধি ও নিভৃত চিন্তাকে প্রকাশ করার জন্য প্রকৃতিকে ব্যবহার করেছেন। কখনও দৃশ্যপটে এনেছেন প্রকৃতির স্থায়ী সম্পদ নদী, পাহাড়, প্রান্তর, সমুদ্র আর কখনও এনেছেন ভূমি
থেকে উদ্গত বৃক্ষ ও তৃণলতা। এছাড়াও পরিবেশ পরিস্থিতি উপস্থাপনে তিনি ঝড়, বাতাস, রৌদ্রের মতো প্রাকৃতিক μিয়াকাণ্ডকে ব্যবহার করেছেন। রবীন্দ্রনাথের
পূর্বে অন্য কেউ এত সূক্ষ্মভাবে প্রকৃতির ব্যবহার করেনি এবং এত বিচিত্রভাবে মানুষের অনুভূতি
কবিতায় ব্যক্ত হয়নি।
রবীন্দ্রকাব্যে
সকল বোধ প্রকাশের অবলম্বন ছিল প্রকৃতি। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধিকে প্রকৃতির সত্যতার
সঙ্গে সম্পর্কিত করে উপস্থাপন করেছেন। চিত্রা কাব্যগ্রন্থের ‘চিত্রা’ নামক উন্মোচনী কবিতায়
কবি বলেছেন, ‘অজস্র আলোকছটা নীল
আকাশকে উজ্জ্বল করেছে’। সুখ কবিতাটিতে তিনি চিত্তের প্রসনড়বতাকে প্রকৃতির
প্রসনড়বতার উপর নির্ভরশীল করেছেন। সিড়বগ্ধ বায়ু প্রবাহ, ধীর কল্লোলে নদী প্রবাহ, ঘনছায়াপূর্ণ
বৃক্ষগুল্ম, আম্রমুকুলের গন্ধ ও বিহঙ্গের কলগুঞ্জনের অবতারণা করে তিনি প্রসনড়বতার
পটভূমি নির্মাণ করেন। প্রেমের অভিষেক কবিতায় কবি প্রেমের যে অমরাবতীর বর্ণনা দিয়েছেন, সে অমরাবতী
নির্মিত হয়েছে প্রকৃতির সাহায্যে।
প্রকৃতি ব্যবহারে রাবিন্দ্রীক স্টাইল
প্রকৃতির উপর
মানব স্বভাবের গুণাবলী আরোপ করা যায় আবার প্রকৃতির গুণাবলী মানুষের উপর আরোপ করা যায়।
উভয়ের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। কবি যখন বলেন বিষণড়ব নদীতীর, তখন মানব চিত্তের
বিষণড়বতা নদীতীরের উপর আরোপ করেন। রবীন্দ্রনাথ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানব স্বভাবকে
প্রকৃতির উপর আরোপ করেছেন।
প্রকৃতিকে আবার
ভিনড়বভাবেও উপস্থাপন করা যায়। এক্ষেত্রে প্রকৃতির বিশেষ পরিচয়লিপি মানুষের উপর আরোপ
করে মানুষকে বিশেষভাবে
চিহ্নিত করা যায়। শেক্সপীয়র শীতের পাতাঝরা গাছের সঙ্গে একজন বয়স্ক ব্যক্তির তুলনা
করে প্রকৃতির বিশেষ পরিচয়লিপি মানব জীবনের উপর আরোপ করেছেন।
শেলী যে অর্থে
একটি আদর্শ পরিমণ্ডল নির্মাণ করার জন্য প্রকৃতিকে বিশেষ রূপে আবিষ্কার করার কথা
ভেবেছিলেন, রবীন্দ্রনাথও তেমনি তার মানস সুন্দরীকে, জীবনদেবতাকে অথবা অলৌকিক সৌন্দর্যকে আবিষ্কারের জন্য আরোপিত বিশেষ
বিশেষ স্বভাবে অলংকৃত করে প্রকৃতিকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। রবীন্দ্রনাথের
উদ্দেশ্য ছিল একটি অলৌকিক সৌন্দর্যের সত্তাকে প্রকাশ করা, প্রকৃতি সেই প্রকাশের
ক্ষেত্রে কবির সহায়ক হয়েছে। এ জন্য রবীন্দ্র কাব্যে প্রকৃতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য
প্রকাশিত হয়নি, প্রাকৃতিক
চিত্রগুলি বিশেষ প্র াবদ্ধ সাধারণ চিত্রে বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ জাগতিক বস্তু কবি চেতনার
প্রতীক হয়ে প্রকাশিত হয়েছে, জাগতিক বস্তুর দিকে কবির প্রধান লক্ষ্য কখনও ছিল না।
মানস সুন্দরী
কবিতার মর্মবস্তু হচ্ছে, মানস সুন্দরী রূপিনী কবির যে প্রেরণা অথবা যে সৌন্দর্য
কবিচিত্তে একটি উপলব্ধি নির্মাণ করেছে সে অন্তর্চেতনাকে উপস্থিত করা। এই অন্তর্চেতনাকে
কবি উপস্থিত করেছেন প্রকৃতির বর্ণনার মধ্য দিয়ে। এ বর্ণনায় কবি ২টি চিত্র উপস্থিত করেছেন।
প্রমতঃ শ্রান্ত রূপসীর মতো বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দেহকে প্রসারিত করে সায়াহ্ন আলোকে যে পদ্মা
জেগে আছে, সে পদ্মার উপমা। দ্বিতীয়তঃ
সন্তর্পণে নদীতীরে সন্ধ্যার পদার্পণের সিড়বগ্ধ রূপকল্প। এ কবিতায় কবি প্রকৃতি বর্ণনার
মধ্য দিয়ে নির্জনতাকে এবং প্রশান্তিকে সর্বত্র প্রবাহিত করে পৃথিবীর বুকে
যে রাত্রি নেমে
এসেছে তার বিবরণ দিয়েছেন। এর মাধ্যমে কবি মানবচিত্তের বিভিনড়ব অবস্থার
বিকল্প হিসেবে প্রকৃতির
চিত্তকে উন্মোচন এবং তার মাধ্যমে মানবচিত্তের বিভিনড়ব অবস্থাকে প্রকাশ করার চেষ্টা
করেছেন।
চৈতালী কাব্যের
ভূমিকা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যে মন্তব্য করেছেন তার সারকথা হচ্ছে, চতুর্দিকে তিনি যে দৃশ্য
দেখেছেন সে দৃশ্যের কোন কোনটি তার নিকট অভাবিত মনে হয়েছে এবং সে অভাবিত অংশের
খণ্ড খণ্ড অংশ তিনি চৈতালী কাব্যে উপস্থাপন করেছেন। চৈতালীতে তিনি শুধুমাত্র
নির্জনতা ও শ্রান্ত শ্রীর বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন, প্রকৃতির গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করেননি।
মধ্যাহ্ন
কবিতাটিতে কবি দুপুরের একটি সুষুপ্ত অবস্থার পরিচয় অংকন করেছেন। প্রকৃতিকে অবলম্বন করে
মধ্যাহ্নের আবহ নির্মাণই কবির মূল লক্ষ্য ছিল। এ অবস্থাটি কবির অন্তর্লোকের। প্রভাত
কবিতাটিতেও আমরা একই আবহের নির্মাণ কৌশল লক্ষ্য করি। সেখানে পরিচ্ছনড়ব ঊষার সিড়বগ্ধতা
এবং শীতলতাকে কবি প্রভাতকালের আবহ নির্মাণে ব্যবহার করেছেন।
রবীন্দ্র বিশ্বাস : রবীন্দ্রনাথ বিশ্বজগতের সুষম সংগতিতে বিশ্বাসী
ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন বিশ্বজগত একটি মৌলিক সংগতিতে সংরক্ষিত। বিভিনড়ব কবিতায়
তিনি এই সংগতির সাথে একাত্ম হতে চেয়েছেন।
মহুয়া
কাব্যগ্রন্থের বোধন কবিতায় আমরা দেখতে পাই যে, কবি নির্দয় নবযৌবনের ভাঙ্গনের কথা বললেও তাঁর নিকট সে ভাঙ্গনটা হচ্ছে একটি
আনন্দের নতুন পট উন্মোচনের মতো। দায়মোচন কবিতায় কবি লিখেছেন,
প্রেমেরে বাড়াতে
গিয়ে মিশাব না ফাঁকি
সীমারে মানিয়া
তার মর্যাদা রাখি।
যা পেয়েছি তাই
মোর অক্ষয় ধন,
যা পাইনি সেই বড়ো
নয়।
চিত্ত ভরিয়া রবে
ক্ষণিক মিলন,
চিরবিচ্ছেদ করি
জয়।
এ কবিতায় কবি সকল
অবস্থার শৃঙ্খলিত সীমাবদ্ধতায় বিশ্বাসের কথা ঘোষণা দিয়ে একটি শান্তি ও নিশ্চিন্ততাকে কামনা করেছেন।
‘পরিচয়’ কবিতায় কবি দুর্যোগের মধ্যেও নৈরাশ্যজয়ী একটি পটভূমির কল্পনা করেছেন। কবি লিখেছেন,
সে দুর্যোগে
এসেছিনু তোমার বৈকালী,
কদম্বের ডালি।
বাদলের বিষণড়ব
ছায়াতে,
গীতহারা প্রাতে।
নৈরাশ্যজয়ী সে
ফুল রেখেছিল কাজল প্রহরে,
রোদ্রের স্বপন
ছবি রোমাঞ্চিত কেশরে কেশরে।
আছি, যাত্রী, দুর্দিনে, দুয়ার প্রভৃতি
কবিতায় কবির মূল কথা হলো- “পৃথিবীতে আঘাতের অন্ত নেই কিন্তু বিপুল শান্তি তবুও অক্ষুণড়ব
থাকে।”
‘রবীন্দ্রকাব্যে
প্রকৃতি’ বিষয়ক আলোচনার সমাপ্তিপর্বে কবির ‘রূপ-বিরূপ’ কবিতার আলোচ্য বিষয়
স্মরণযোগ্য। এ কবিতায় কবি এই অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন যে, তিনি সমগ্র জীবনব্যাপী প্রকৃতির
বিচিত্র ভাষা পাঠ করার চেষ্টা করেছেন। সে ভাষার স্বরূপে ভিনড়বতা ছিল। কোথাও তা ছিল রহস্যঘেরা অরণ্যের ছায়াময় ভাষা, কোথাও তা কুসুম
প্রগলভ রূপকের ভাষা, কোথাও তা ছিল প্রাচীন পর্বতের ধ্যানমৌনতার ভাষা। কবির বক্তব্যে যে প্রগলভতা, রহস্য এবং ধ্যানমৌনতার কথা বলা
হয়েছে তা মূলত কবিচিত্তের রহস্য
প্রবণতা, প্রগলভতা ও ধ্যানমৌনতার
অনুভূতি।
এক কথায় বলা যায়, রবীন্দ্রকাব্যে
প্রকৃতি উপাদান মাত্র- প্রকৃতি চর্চাটা এখানে মুখ্য নয়।
আদর্শ হিসেবে রবিন্দ্রনাথঃ
এ পর্যায়ে আমি দ্ব্যর্থহীন
কণ্ঠে বলতে চাই, রবীন্দ্রনাথ কখনো পশ্চিম বাঙলার বাঙালীদের এবং পূর্ব বাংলার বাংলাদেশীদের
আদর্শ হতে পারেন না। তাঁর জীবনালেখ্যে আমরা যা পাই তা হলো :
১. তিনি ছিলেন
সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্টি এবং সাম্রাজ্যবাদের চাহিদা মিটাতেই তিনি আজীবন প্রচেষ্টা
চালিয়েছেন।
২. তিনি এবং তাঁর
সতীর্থরা কোন বাঙালী বীরকে আদর্শস্থানীয় হিসেবে নিজ সাহিত্যে স্থান দেননি। ফলে জাতীয়তাবোধ বাংলার সীমানায় কেন্দ্রীভূত
থাকেনি।
৩. তিনি বাঙালী
জাতিসত্তাকে আর্যভারতীয় জাতিসত্তার পদপ্রান্তে বিসর্জন দিয়েছেন।
৪. তিনি সাধারণ
বাঙালীদের কল্যাণার্থে কখনও কিছু করেননি, লেখেননি।
৫. তাঁর
প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতন, শ্রীনিকেতন ব্রিটিশ প্রভুদের গোলাম সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত ছিল, বাংলার উত্থানের
কাজে নিয়োজিত হয়নি।
৬. তিনি বাংলার
এবং ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে কখনও একটি বাক্য উচ্চারণ করেননি বা একটি লাইনও
লিখেননি। তদুপরি ভবিষ্যত স্বাধীন ভারতের আন্তঃপ্রাদেশিক ভাষা হিসেবে পছন্দ করেছিলেন হিন্দী ভাষা, বাংলা নয়।
রবীন্দ্রনাথ কখনো
বাংলাদেশের জনগণের অনুকরণীয় হতে পারেন না। তার কারণসমূহ নিমড়বরূপ :
১. ব্রিটিশ আমলে
হিন্দুরাই বাঙালী ছিল মুসলমানরা নয়। দু’টি উদাহরণ দেখুন:
ক. “তিনশত বৎসরের
মধ্যে বাঙালী ধর্ম রক্ষার্থে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মাথা তুলিয়া দাঁড়ায় নাই।” (বাঙ্গালার ইতিহাস, রমেশচন্দ্র মজুমদার)।
খ. “ইস্কুলের মাঠে
বাঙ্গালী ও মুসলমান ছাত্রদের ফুটবল ম্যাচ।” (শ্রীকান্ত : ১ম পর্ব, ১ম অধ্যায়, ২য় পৃষ্ঠা)।
২. রবীন্দ্রনাথ
বাঙালী হিন্দুদের কবি ছিলেন, মুসলমানদের নয়। যথা- “বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের
বিশ্বভারতীয় আকাশে কতবার শরতের চন্দ্রোদয় হয়েছে,
তাতে শারদীয় পূজায় ‘আনন্দময়ী মা’ কতবার এসেছে গিয়েছে, কিন্তু একদিনের
তরেও সে বিশ্বের আকাশে ঈদ-মোহররমের চাঁদ উঠেনি। সে চাঁদ উঠাবার ভার ছিল নজরুল ইসলামের উপর। এতে দুঃখ
করার কিছুই নেই। কারণ এটা স্বাভাবিক। কাজেই কঠোর সত্য।” (বাংলাদেশের
কালচার, আবুল মনসুর আহমদ, পৃ. ১০৩)।
৩. রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট, তাঁর সাহিত্যও
সাম্রাজ্যবাদের পক্ষের সাহিত্য। সুতরাং তার অনুসরণে এদেশের স্বাধীনতার চেতনা ভূলুণ্ঠিত হয়ে সাম্রাজ্যবাদের নিকট আত্মসমর্পণে বাধ্য হবে।
৪. রবীন্দ্র
সাহিত্য হিন্দু সংস্কৃতি নির্ভর এবং বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতির বিপরীতে অবস্থিত। সুতরাং
এরূপ সাহিত্যে বাংলাদেশের কোন কল্যাণ নেই। যথা- “দেশের প্রাণ প্রকৃতিকে উপেক্ষা করে মনগড়া অথবা পরদেশী সংস্কৃতি বা সাহিত্যের
প্রবর্তনে পৃথিবীর কোন জাতির কখনোই মঙ্গল হয়নি। মূল বৃক্ষের ন্যায় সংস্কারকেও
একেবারে মাটির অন্ধকার ফঁেু ড় উঠতে হবে।” (শ্রী সজনী কান্ত দাস, দীপালী উৎসব, পৃ. ১৩৯)।
৫. শুধু রবীন্দ্র
সাহিত্য নয়। সাম্রাজ্যবাদেরএজেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী কোন কবি-লেখকের
সাহিত্য স্বাধীন বাংলাদেশের সাহিত্য হতে পারে না। এ বিষয়ে বিশিষ্ট লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও
আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন বুদ্ধিজীবী আবুল মনসুর আহমদ লিখিত বাংলাদেশের ‘কালচার’ নামক অতি মূল্যবান বই থেকে
উদ্ধৃতি পেশ করছি।
“পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলা ও আসামের সাহিত্য বলতে আজ আমরা যা বুঝি তা বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমচন্দ্র
থেকে রবীন্দ্র-শরৎচন্দ্র যুগের সাহিত্যিকদের সাহিত্য। এটা খুবই উনড়বত সাহিত্য। বিশেষতঃ
রবীন্দ্রনাথ এ সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে স্থান দিয়ে গেছেন।
তবু এ সাহিত্য
পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য নয়, কারণ এটা বাংলার মুসলমানের সাহিত্য নয়। এ সাহিত্যে
মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য কোন দান নেই, শুধু তা নয় মুসলমানের প্রতিও এ সাহিত্যের কোন
দান নেই। অর্থাৎ এ সাহিত্য থেকে মুসলিম সমাজ কোন প্রেরণা পায়নি এবং পাচ্ছে না। এর
কারণ আছে, সে কারণ এই যে, এই সাহিত্যের
স্রষ্টা মুসলমান নয়, এর বিষয়বস্তুও মুসলমান নয়,
এর স্পিরিটও মুসলমান নয় এবং
এর ভাষাও মুসলমানের ভাষা নয়। প্রমত এ সাহিত্যের স্পিরিটের কথা ধরা যাক। এ সাহিত্য
হিন্দু-মনীষীর সৃষ্টি। সুতরাং স্বভাবতই হিন্দু সংস্কৃতিকে বুনিয়াদ করেই তাঁরা সাহিত্য সৃষ্টি
করেছেন। ঠিকই করেছেন তাঁরা। নইলে ওটা জীবন্ত সাহিত্য হতো না।...
ত্যাগের আদর্শ, বৈরাগ্যের আদর্শ, ভক্তিবাদের আদর্শ, প্রেমের আদর্শ
সমস্তই উঁচু দরের আদর্শ। এইসব আদর্শকে বুনিয়াদ করে নারী প্রেমকে কেন্দ্র করে
হিন্দু শিল্প-মনীষা যে সাহিত্য রচনা করেছে সে সবই হয়েছে উচ্চাঙ্গের সাহিত্য এবং তা পড়ে অপর সকলের
মতই মুসলমান রস পিপাসুরাও পিপাসা নিবারণ করে থাকে।
কিন্তু সত্য কথা
এই যে, ঐ সাহিত্যকে মুসলমানরা তাদের জাতীয়
সাহিত্য মনে করতে পারে না। কারণ ত্যাগ-বৈরাগ্য-ভক্তি-প্রেম যতই উঁচু দরের আদর্শ হউক, মুসলমানের জীবনাদর্শ তা নয়। হিন্দুর ধর্ম যেমন ত্যাগ-বৈরাগ্য ও মুণি ঋষির ধর্ম
মুসলমানের ধর্ম তেমনি হক-ইনসাফ ও জেহাদ-শহীদের ধর্ম। প্রতীকবাদী সুন্দর পূজারী আর্টবাদী
হিন্দু সংস্কৃতি যেমন ব্যক্তিকেন্দ্রিক, মুসলিম সংস্কৃতি তেমন ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়। হক-ইনসাফবাদী কল্যাণমুখী, মুসলিম সংস্কৃতি
তাই সমাজকেন্দ্রিক।...
এ জন্যই বর্তমান
বাংলা সাহিত্য মুসলিম সমাজ মনে কোন প্রেরণার স্পন্দন জাগাতে পারেনি। তাই রাধা-কৃষ্ণের
প্রেমে প্রতিবেশী হিন্দু ভাইকে আনন্দে নৃত্য করতে দেখেও মুসলিম সমাজমে নর একটি তারও
ঝনাৎ করে উঠেনি। বিশ্ব-কবির ‘মাথানত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে’র অত বড় আবেদনে
একটি মুসলমানের মাথা
এক ইঞ্চি হেঁট হলো না।
তার বদলে যেদিন
এক অচেনা-অজানা বালক হঠাৎ জিকির দিয়ে উঠলো : ‘বল বীর উনড়বত মম শির’ সেদিন রিক্ত, ক্লান্ত, ঘুমন্ত ও জীবনমৃত মুসলমান ধচমচ করে জেগে উঠে চোখ রগড়াতে রগড়াতে হুংকার দিয়ে উঠলো- ‘উনড়বত মমশির’। কারণ এ যে তারই
অন্তরের ঘুমন্ত শিশুর চিৎকার। এ যে তারই জীবনের কথা। তাই নজরুল ইসলামের
আকস্মিক আবির্ভাব মুসলিম সমাজ মনকে এমন করে আলোড়িত করতে পেরেছে।
মুসলমানের বিবেচনায় মানব জীবনের সুখ-দুঃখ আলো-আঁধার, হাসি-কানড়বা, তাদের দেবত্ব-পশুত্ব, তাদের হীনতা-ক্ষুদ্রতা,
তাদের সংগ্রাম-সাধনা এ
সবই সাহিত্যের বুনিয়াদ এবং নজরুল ইসলাম এই জীবনকে কেন্দ্র করেই সাহিত্য সৃষ্টি
করেছেন। শুধু এই কারণেই নজরুল ইসলাম পূর্ব পাকিস্তানের প্রম জাতীয় কবি।
সাহিত্যের
বিষয়বস্তু সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “সাহিত্যের নায়ক-নায়িকা যদি আমরা না হলাম, সাহিত্যের পটভূমি
যদি আমার কর্মভূমি না হলো, তবে সে সাহিত্য আমার সাহিত্য হয় কিভাবে? আমার ঐতিহ্য, আমার ইতিহাস, আমার কিংবদন্তী, আমার উপকথা যে
সাহিত্যের উৎস নয়, সে সাহিত্য আমার
উৎস হবে কেমন করে। রাম-লক্ষ্মণ, ভীম-অর্জুন,
সীতা-সাবিত্রী, রাধা-কৃষ্ণ,
মথুরা-অযোধ্যা, উজ্জ্বয়িনী-ইন্দ্রপ্রস্থ, হিন্দুর মনে যে স্মৃতি
কল্পনা ও রস সৃষ্টি করে, যে ‘আইডিয়া অব এসোসিয়েশন’ জাগায়, মুসলিম মনে কি তা করতে পারে? তেমনি আবার আলীহামযা, সোহরাব-রুস্তম, শাহজাহান-আলমগীর, হাযেরা-রাবিয়া-চাঁদ
সুলতানা, সিরাজ-কাসেম, ঈশা খাঁ-মুসা খাঁ, গৌড়-সোনারগাঁ, মুসলিম মনে যে স্মৃতি-কল্পনা ও
রস সৃষ্টি করে বা ‘আইডিয়া অব এসোসিয়েশন’ জাগায় হিন্দুর মনে
তা করতে পারে না। এটা
শুধু মুসলিমের কথা নয়। তামাম দুনিয়ায় সকল জাতি সম্বন্ধেই এ কথা সত্য। সব জাতির জাতীয় চেতনাই জাগে তার ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে। যতদিন সে ঐতিহ্যকে বুনিয়াদ করে সাহিত্য রচিত না হবে ততদিন সে সাহিত্য থেকে কোন জাতি প্রেরণা পাবে না।” বাংলার মুসলমানও তেমনি রবীন্দ্রনাথকে নকল করে বড় হতে পারবে না। তাকে বড় হতে হবে তার স্বকীয়ত্বের উপর দাঁড়িয়ে, নিজের কৃষ্টিকে বুনিয়াদ করে।
রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সতীর্থদের লিখিত সাহিত্য অনুকরণ ও অনুসরণের অনিবার্য পরিণাম বাঙালীত্বের মৃত্যু, একইভাবে উক্ত সাহিত্যের অনুকরণ ও অনুসরণ বাংলাদেশীত্বের মৃত্যু ঘটাবে। মূলত: বাংলাদেশী জাতিসত্তার মৃত্যু ঘটাতেই আর্যভারতীয় সাম্রাজ্যবাদী চμ এদেশে রবীন্দ্র ভক্তের
চাষাবাদে বিপুল অর্থ ব্যয় করছে।
উপসংহার
ঐতিহাসিক
নিরীক্ষকের প্রয়োজন হয় পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সার্থক ব্যবহার, ভক্তের চোখ ও কান থাকাই যথেষ্ট আর
অন্ধ ভক্তের শুধু কান থাকলেই চলে। অতিভক্তি যে সব সময় সুখকর হয় না তা রবীন্দ্রনাথ
বুঝতে পেরেছিলেন মৃত্যু যন্ত্রণার পর পরই।
“ভক্ত, অভক্ত না অতিভক্ত- নির্ধারণ করা মুশকিল। প্রচুর বাঙালী দর্শক এসে প্রতীক্ষা করছেন তাঁর মরদেহ
দেখার। জয়ধ্বনি হচ্ছিল জোরে জোরে। ভক্তির প্রাবল্যে ঠাকুরবাড়ির কোলাপসিবল গেট
ভেঙ্গে ফেলল জনতা। ভক্তরা কবির মরদেহ সাজানো খাট থেকে তুলে নিয়ে চলে গেলেন
জনস্রোতের মাঝখানে। কবি নিষেধ করে গিয়েছিলেন তবুও ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি জয়’ ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনিত হতে লাগলো বারে বারে। বাঙালী রবি ভক্তদের এতই ভক্তির আধিক্য যে, কবির স্মৃতি
বাড়িতে রাখার জন্য প্রায় সারা জীবন ধরে তাঁর সযতেড়ব সংরক্ষিত মাথাভর্তি শুভ্র কেশ, চিত্তাকর্ষক দাড়ি অনেকে ছিঁড়ে নিয়ে যেতে লাগলেন। শেষে দেখা গেল, শ্মশানে যাওয়ার
পূর্বে কবির চেহারাই বদলে দিয়েছেন অতি ভক্তের দল।
যখন মুখাগিড়ব করা
হয়, তখন
রবীন্দ্রনাথের মুখমণ্ডল বিকৃত। জনতার এতই রবি অনুরাগ যে, স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে তাঁর মাথার চুল ও মুখের
দাড়ি সব উপড়ে নিয়ে
যাওয়া হযেছে। এই হলো গিয়ে কবির প্রয়াণের শেষ দৃশ্য। (অমিতাভ চৌধুরী, ইসলাম ও
রবীন্দ্রনাথ, পৃ. ১৩৬-৩৭)।
ঠাকুরবাড়ি
৪৩টি বেশ্যালয়ের
মালিক, মাদক ও দাস ব্যবসায়ী, লবণের এজেন্ট এবং
নীলকর দ্বারকানাথ ওরফে
প্রিন্স দ্বারকানাথ ছিলেন ঠাকুরবাড়ির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। রাজ্যবিহীন রাজা রামমোহনের
সাগরেদ দ্বারকানাথ ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম দোসর বা গোলাম। ভারতবর্ষে
ব্রিটিশ রাজত্ব প্রতিষ্ঠা এবং শাসন-শোষণ দীর্ঘস্থায়ী করার লক্ষ্যে প্রণীত বহুল পরিচিত
ডিভাইড এন্ড রুল পলিসির সূতিকাগার হিসেবে ঠাকুরবাড়িকে নির্বাচিত করা হয়েছিল।
ঠাকুরবাড়ি সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা লাভের জন্য কয়েকটি উদ্ধৃতি প্রদত্ত হলো।
১. “অনেকের মতে, হিন্দু-মুসলিম
বিভেদের বীজ অঙ্কুরিত
হয়েছিল ঐ ‘হিন্দুমেলা’ ও জাতীয় সভা থেকে।
এ মেলার পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়নে ঠাকুরবাড়ির আর্থিক ও মানসিক সাহায্য আর সমর্থন খুবই গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করে। মেলার কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন ঠাকুরবাড়ির
সদস্য। প্রম দিকে মেলার সম্পাদক ছিলেন গনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। পঞ্চম অধিবেশনের অন্যতম
সম্পাদক ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ষষ্ঠ ও সপ্তম অধিবেশনের সম্পাদকও ছিলেন তিনি। অষ্টম অধিবেশনে
তিনি হন সহ-সভাপতি। অষ্টম অধিবেশনের সহ-সম্পাদক ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। সত্যেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ এ
মেলার কর্মকর্তা নির্বাচিত হননি বটে, কিন্তু মেলার কাজে তাঁরা সμিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা
রচনার মাধ্যমে। তথ্য : যোগেশ চন্দ্র বাগল, হিন্দুমেলার ইতিবৃত্ত,
পৃ. ৬ এবং ৪৮)।
২. রবীন্দ্রনাথের
সম্পূর্ণ জীবনালেখ্য যদি খুব খুঁটিয়ে দেখা যায় তাহলে অন্ধভক্ত ও স্বপক্ষীয়দের বাদ
দিলে আরো দু’টি পক্ষ থাকে, একটি বিপক্ষ এবং
অপরটি নিরপেক্ষ। এই শেষ
দু’টি পক্ষের অনেকের একথা বলা
অস্বাভাবিক নয় যে, ব্রিটিশের হাতে ভারতকে তুলে দেওয়ার চμান্তে যে দলটি সμিয়ভাবে কাজ করেছে
তার মধ্যে ছিলেন ঠাকুরবাড়ির
অনেক পুরুষ ও মহিলা। প্রকাশ্যে
এবং অপ্রকাশ্যে অনুগত ভারতীয়দের সঙ্গে ইংরেজদের পরামর্শ, পরিকল্পনা গ্রহণ, মদ-মাংস, ইন্দ্রিয়পরায়ণতা, ব্যভিচার বা
ইন্দ্রিয় রসের ছড়াছড়ি করিয়ে দেওয়ার মূল কারখানা যে ক’টি ছিল ঠাকুরবাড়ি তার শ্রেষ্ঠতম না হলেও শ্রেষ্ঠতর
হওয়ার দাবিদার। এই সাংঘাতিক ধারণার সাথে আমরা সহজে একমত হতে পারব না, কিন্তু এই দাবিকে খুব সহজে উড়িয়ে দেওয়ার স্পর্ধাও নেই আমাদের। কারণ
এঁদের পক্ষে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে বিশ্ববিখ্যাত স্বামী বিবেকানন্দও
আছেন। স্বামী বিবেকানন্দ মনে করতেন, বাঙালী জাতির সর্বনাশ করেছে ঠাকুরবাড়ি। বাঙালী জাতির পৌরুষ সৃষ্টিতে সহায়ক
না হয়ে ক্ষতিকারক হয়েছে ঐ ঠাকুরবাড়ি। এক কথায় ঠাকুর বাড়ির কালচার সম্পর্কে
স্বামীজীর মনোভাব ছিল অত্যন্ত কঠোর। (দ্র: গোলাম আহমাদ মোর্তজা, এ এক অন্য ইতিহাস, পৃ. ১৯০)।
৩. “কিন্তু স্বামীজী
ঠাকুরবাড়ির কালচার সম্পর্কে কঠোর মনোভাব পোষণ করতেন। তিনি মনে করতেন, ঠাকুরবাড়ির
প্রভাব বাঙালী জীবনের পক্ষে ক্ষতিকর। তাঁর মত ছিল, ঠাকুরবাড়ির সাহিত্য, দর্শন বাঙালীর সমাজে পৌরুষ সৃষ্টিতে সাহায্য করবে না। তিনি রুঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, এই পরিবার
ইন্দ্রিয় রসের বিষ বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দিয়েছে। তাঁর তীব্র মন্তব্য, আমার জীবনোদ্দেশ্য রামকৃষ্ণ নয়, বেদান্ত নয়, আর কিছুই নয়- শুধু জনগণের মধ্যে পৌরুষ আনা।” (দ্র: পবিত্র কুমার ঘোষ, সাপ্তাহিক বর্তমান পত্রিকা, ১ ফেব্র“য়ারি, ১৯৯৭)।
“দূরদর্শী স্বামী
বিবেকানন্দ ঊনবিংশ শতাব্দীতে যা বুঝেছিলেন বাঙালী বুদ্ধিজীবীরা তার সত্যতা মেনে নিয়েছেন বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে আর বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবীরা সম্ভবত এখনো বয়োঃপ্রাপ্ত হয়নি।”
আমার দৃঢ় বিশ্বাস
ঠাকুরবাড়ি সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দের উপলব্ধি যেদিন সকল চিন্তাশীল বাঙালীর মনে
ছড়িয়ে পড়বে সেদিন হলওয়েল মনুমেন্টের মতো, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু-পরবর্তী কেশরাশির মতো, ঠাকুরবাড়ির সকল
স্থাপনা জনতা সমূলে উপড়ে
ফেলে বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করবে। সেদিনই বাঙালী ও বাংলাদেশীদের মিলনের সদর দরজা উন্মুক্ত হবে। কেননা
ঠাকুরবাড়ি ও তার সমগোত্রীয় অন্যান্য ঋষিবাড়িতে ব্রিটিশ রোপিত সাম্প্রদায়িক
বিষবৃক্ষসমূহের ফল ও রস অমৃতজ্ঞানে গ্রহণ করার ফলেই উপমহাদেশে দ্বিজাতিতত্ত্বের
সূচনা ও বিকাশ ঘটেছে।
এস. এম. নজরুল ইসলাম
প্রকাশক ও সম্পাদক, মাসিক ইতিহাস অন্বেষা
১ম প্রকাশ, ইতিহাস-অন্বেষা, আগস্ট ২০০৫
[লেখকের ‘জাতির উত্থান-পতনের সূত্র’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া]