পৃথিবীর সকল ভূখণ্ডেই ঝড়, তুফান, হারিকেন, টর্নেডো আঘাত হেনে প্রতিনিয়ত জানমালের ক্ষতি করে থাকে। যে ভূখণ্ড ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঝড়ের উৎপত্তি সাধারণত তার চেয়ে অনেক দূরে। আবহাওয়াবিদগণ ঝড়ের গতিপথ সম্পর্কে জনগণকে বারবার সতর্ক করে দেন, যাতে জনগণ পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি থেকে আত্মরক্ষা করে। তীব্র হারিকেন-টর্নেডোর জন্ম হয় সাগর, মহাসাগরে। সবচেয়ে প্রলংকরী ঝড় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্মস্থান হলো প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণ ভাগে- যেখানে সমুদ্র স্রোত ও তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে এল্ নিনো ও লা-নিনা অবস্থার সৃষ্টি হয়। আবহাওয়াবিদগণ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ঝড়ের পূর্বাভাস দিয়ে থাকেন।
প্রাকৃতিক ঝড় অপেক্ষা শত-সহস্র গুণ ক্ষতিকারক ঝড়ের নাম রাজনৈতিক ঝড়। এ রাজনৈতিক ঝড়ের কেন্দ্রে থাকে ব্যক্তি ও দলবিশেষের ক্ষমতার লোভ এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের দেশ দখল ও সম্পদ লুণ্ঠনের আকাংখা। বর্তমান এককেন্দ্রিক বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী মোড়লের নাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ দেশটি হতে বিশ্বের দেশে দেশে যে প্রলয়ংকরী ঝড় ধেয়ে আসে তারও একটি নাম দেওয়া যায়।পালাবদলের সাথে সাথে এর নাম পাল্টায়, কিন্তু চরিত্র পাল্টায় না, পাল্টানোর কোনো উপায়ও নেই। কেননা এই ঝড় নিজের ইচ্ছায় আসে না, এ ঝড়েরও একটি কেন্দ্র আছে যা দেখা যায় না।আমরা শুধু দেখি তার মুখটি এবং তার ধ্বংসলীলা। হ্যাঁ, এই ঝড়ের বা টর্নেডোর বর্তমান নাম ‘ওবামা’।আর তার কেন্দ্র হলো যায়নবাদী চক্র। এই টর্নেডো কোনো অবস্থাতেই কেন্দ্রকে অমান্য করতে পারে না।
বাংলাদেশের সকল উচ্চতর শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞান বইতে লেখা রয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রেসিডেন্ট। অথচ যারা মূল বিষয়টি জানেন তাদের দৃষ্টিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় প্রেসিডেন্ট। তিনি শুধুমাত্র যায়নবাদী ইহুদীচক্রের মাউথপিস ও সচিব মাত্র।ছোটবেলায় রূপকথার গল্পে শুনেছিলাম, এক রাজকন্যাকে বিশাল এক দৈত্য অপহরণ করে সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে বন্দি করে রেখেছিল। রাজকুমার উক্ত রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে দৈত্যপুরীতে গিয়ে হাজির হলো এবং দৈত্যকে হত্যা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। রাজকুমারী বিষয়টি জানতে পেরে রাজকুমারকে বলেন, দৈত্যের প্রাণ দৈত্যের দেহে নাই- অমুক জায়গায় গেলে দেখবেন সোনার খাঁচায় একটি কালো ভোমর আছে, উক্ত ভোমরকে হত্যা করলে দৈত্য মারা যাবে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে উক্ত গল্পের সত্যতা প্রত্যক্ষ করলাম। বিষয়টি এই-তখন ইসরাইল গাজায় নৃশংস হামলা পরিচালনা করছে, নিরাপত্তা পরিষদ এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব পাস করার জন্য জাতিসংঘে বৈঠকরত। হঠাৎ মার্কিন দৈত্য বুশের পিএস-এর মোবাইল বেজে উঠলো- অপর প্রান্তে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট। দৈত্যের পিএস জবাব দিলেন-প্রেসিডেন্ট গুরুত্বপূর্ণ সভায় বক্তৃতা দিচ্ছেন। ওলমার্ট পাল্টা ধমক দিয়ে বলেন, রাখো তোমার বৈঠক- এখনি আমার সাথে কথা বলতে বল। আশ্চর্য! বিরাট মার্কিন দৈত্য বৈঠক মুলতবী করে তার গডফাদারের নির্দেশ শুনলেন এবং নিরাপত্তা পরিষদ যাতে ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো প্রস্তাব গ্রহণ না করে তার ব্যবস্থা করলেন। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন যখন ফিলিস্তিনীদের প্রতি কিছুটা সহানুভূতি প্রদর্শনের চেষ্টা করেন তখনই তাকে মনিকা কেলেঙ্কারীতে জড়িয়ে হেনস্থা করা হয়। বর্তমান মার্কিন টর্নেডো ‘ওবামা’র গতিপথও নির্ধারণ করবে নেপথ্যের শক্তি যা সকল মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভাগ্যলিপি। মার্কিন জাতি, এর মানস ও নেপথ্যের পরিচালক সম্পর্কে ধারণা লাভ করলে ‘ওবামা’র গতিপথ কি হতে পারে তা আন্দাজ করা যাবে।
১৪৯২ সালের ১২ অক্টোবর স্পেনের নাবিক ও জলদস্যু কলম্বাস আমেরিকায় পদার্পণ করে। ১৫০২ সালে ইতালীর কসাই আমেরিগো ভেসপুচির নেতৃত্বে স্থলদস্যু-জলদস্যু, জেল পলাতক আসামী, নির্বাসন দণ্ডের আসামি, বেকার, ভবঘুরের দল আমাজন নদী অববাহিকায় পদার্পণ করে। পরবর্তীতে ইউরোপের বখে যাওয়া লোকেরা ভাগ্যান্বেষণে মার্কিন মুলুকে পৌঁছে। তারাই মার্কিন জনগোষ্ঠীর মূল অংশ। এরা পরবর্তীতে ১৪ মিলিয়ন আফ্রিকাবাসীকে দাস হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যায় এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে দাস হিসেবে অনেককে ধরে নিয়ে যায়। ১৪৯২ সাল থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত সাদা চামড়ার এই জনগোষ্ঠী সমগ্র উত্তর আমেরিকার আদিবাসীদের নৃশংসভাবে হত্যা করে তাদের নিকট থেকে তাদের দেশ ছিনিয়ে নেয়। ১৭৭৬ সালে ইতিমধ্যে স্থায়ী হওয়া মার্কিন অধিবাসীদের নিকট শাসন ক্ষমতা প্রত্যার্পণ করে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী নিজ দেশে চলে আসে। তখন থেকে ১৯০৩ সালের মধ্যে মার্কিন ভূখণ্ডের প্রকৃত নাগরিক রেড ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকে অঞ্চল ছিনিয়ে নেয়া, তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা ও তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করার মাধ্যমে বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অস্তিত্ব লাভ করে। মার্কিনীদের জাতীয় চরিত্র সম্পর্কে বিখ্যাত পশ্চিমা লেখক মেইল ভিল বলেন, “স্বাধীন আমেরিকা এমন একটি আত্মপূজারী দেশ, যার কোনো মূলনীতি নেই। তার ধরন চোর ও ডাকাতের ন্যায়- যার চাহিদা সীমাহীন। বাহ্যত আমেরিকা সভ্য হওয়ার দাবি করে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা একটি জংলী বর্বর দেশ। (সূত্র : বিশ্বায়ন : সাম্রাজ্যবাদের নতুন স্ট্রাটেজী, ইয়াসীর নাদিম, অনুবাদ : শহীদুল ইসলাম ফারুকী, পৃ. ৯৭)। এফ. হেনরী লিখেছেন, “মার্কিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরই রেড ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকে তাদের অঞ্চল ছিনিয়ে নিয়ে তাদেরকে বেছে বেছে হত্যা করা হয়েছিল।” (সূত্র : ঐ, পৃ. ৯৫)।
মার্কিন অর্থনীতি হলো যুদ্ধ অর্থনীতি-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সূচনাকাল থেকে এমন একটি বছরও পাওয়া যাবে না যখন তারা পৃথিবীর কোথাও না কোথাও যুদ্ধ ও লুটতরাজে লিপ্ত ছিল না। যুদ্ধ ও লুণ্ঠনের মাধ্যমেই মার্কিনীরা নিজেদের অর্থনীতিকে পরিপুষ্ট ও সচল রাখে। যুদ্ধ করার জন্য মার্কিনীরা একটি সম্পদপূর্ণ অঞ্চল বা দেশকে টাগেট করে, অতঃপর টার্গেটের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায় এবং এক পর্যায়ে হামলা ও লুটপাট করে। এ প্রসঙ্গে ২টি উপদাহরণ দেয়া হলো :
১. মার্কিন নীতিনির্ধারক ও বুদ্ধিজীবী স্যামুয়েল হান্টিংটন ১৯৯৩ এর জুন সংখ্যায় ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স’ পত্রিকায় লিখেন : “সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পশ্চিমা জগতের এক নতুন শত্র“র প্রয়োজন ছিল। কারণ যুদ্ধ কখনো থেমে থাকবে না।... নতুন শত্র“ ইসলামী বিশ্বও হতে পারে, চীনও হতে পারে।
২. ওবামার পূর্বসূরি বুশ ইহুদী-খ্রিস্ট ইউনিয়নের অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে বলেছেন, “আমরাই সে সকল দেশের বিরুদ্ধে যদ্ধু ছুড়ে দেব, যাদেরকে আমরা টার্গেট বানাব এবং আমরাই সে সকল দেশকে পুনঃনির্মাণ ও পুনর্গঠনের পূর্বে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন করে দেব।... আজ থেকে সব সময়ের জন্য আমেরিকাই এ ফায়সালা করবে- কবে, কোথায়, কিভাবে ও কেন যুদ্ধ করা হবে এবং কেন শান্তি প্রতিষ্ঠা করা হবে।” (সূত্র : The washington post, ১৩.০৫.২০০৩)
মার্কিন টর্নেডোর শক্তি কেন্দ্র, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মূলত যায়নবাদী ইহুদী (যারা সারা বিশ্বের মালিক ও শাসক হতে চায়) সম্প্রদায় দস্যু চরিত্রের মার্কিন জাতির ঘাড়ে চেপে বসে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে। ইহুদীরা সুকৌশলে তাদের ধর্মগ্রন্থ তালমুদ-এর শিক্ষা মার্কিনীদের মনমগজে ঢুকিয়ে দেয়। ফলে যায়নবাদী ইহুদী ও মার্কিন জাতির চিন্তা চেতনা একাকার হয়ে পড়ে। তাল্মুদের শিক্ষা হলো :
১. অন-ইহুদী মানুষের ধন সম্পদের কোনো মালিকানা নাই। ধন-সম্পদের প্রকৃত মালিক ইহুদীরা। অ-ইহুদীদের অর্জিত ধন সম্পদ ন্যায়তই ইহুদীগণ দখল করে নিতে পারে। (সূত্র : ইহুদী চক্রান্ত, সম্পাদনা : আবদুল খালেক, পৃ. ২০)।
২. অ-ইহুদী মানুষ ও তাদের ধন-সম্পত্তির উপর কর্তৃত্ব করার জন্য আল্লাহ ইহুদী জাতিকে মনোনীত করেছেন। (সূত্র : ঐ, পৃ. ঐ)। [উল্লেখ্য, উপরোক্ত কথাগুলো প্রায় একইভাবে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে রয়েছে।]
উভয় জাতির মানসিকতা ও লক্ষ্য উদ্দেশ্য একাকার হওয়ার পর ইহুদীদের পরিকল্পনায় যুক্তরাষ্ট্রে এমন কিছু সংগঠন, সংস্থা, থিংকট্যাঙ্ক জন্ম লাভ করে যে সংগঠনগুলো মার্কিন টর্নেডোর গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করে। উল্লেখ্যযোগ্য সংগঠনগুলো হলো :
New Conservative (নব্য রক্ষণশীল) বা নিউকন : কয়েকজন ইহুদী ১৯৬০-এর দশকে এ প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেন। ইসরাইলকে শক্তিশালী করা ও বিশ্বব্যাপী ইহুদী নীল-নকশা বাস্তবায়ন এর লক্ষ্য। মার্কিন খ্রিস্টানদেরকে সম্পৃক্ত করতে তারা তাদের লক্ষ্যের সাথে জুড়ে দেয়- “বিশ্বব্যাপী মার্কিন আদর্শবাদ (আগ্রাসন) সম্প্রসারণে যুক্তরাষ্ট্র নিজের সামরিক শক্তি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সব সময় স্বাধীন থাকবে।” নিউকনদের প্রকল্পের নাম ‘নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরী’। তারা নিউ ওয়ার্ল্ড এম্পায়ার প্রতিষ্ঠা করবে ও নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার প্রদান করবে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের গুরুত্বপূর্ণ ভাষণটিও এরা প্রস্তুত করে দেয়। উদাহরণস্বরূপ প্রেসিডেন্ট বুশের ২০০২ সালে প্রদত্ত State of Union ভাষণ প্রস্তুত করেন ইহুদী নিউকন সদস্য ডেভিড ফ্লাম। প্রথমবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশ নিউকনকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হন। এর পরই ঘটে টুইন টাওয়ার হামলা। এই হামলার পর নিউকনরা বুশকে হাতের পুতুলে পরিণত করে। ওবামা যদি নিউকনকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন তবে একই রূপ ব্যবস্থা নেয়া হবে। অবশ্য ওবামা এ পর্যন্ত নিউকনদের পক্ষেই কাজ করেছেন- উদাহরণ হলো :
১. ওবামা বোম্বে হামলার ব্যাপারে ত্বরিৎ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন কিন্তু গাজায় ইসরাইলী হামলার প্রতিবাদ করেননি।
২. ওবামা হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ নিয়োগ করেছেন ইহুদী রাহম ইমানুয়েলকে।
৩. নিউকন বান্ধব হিলারী ক্লিনটনকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও রবার্ট গেটসকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিয়োগ করেছেন এবং হিলারীকে নিজের সকল স্টাফ নিয়োগের স্বাধীনতা দিয়েছেন।
৪. ওবামা গুয়েনতানামো কারাগার বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন কিন্তু কাবুলের বাগরাম কারাগার আরও ৪০ একর সম্প্রসারণ করছেন ৬০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। (সূত্র : আল জাজিরা,২০.২.২০০৯)
৫. মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির জন্য সৌদি প্রস্তাবে ২টি বিষয় আছে। একটি হলো- ,Two nation state theory, অপরটি হলো ইসরাইলের সাথে সকল আরব দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ। ওবামা প্রস্তাবের প্রথম অংশ ইগনোর করেছেন, দ্বিতীয়টি মেনে নিয়েছেন। (সূত্র : দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২০.২.২০০৯; তথ্যসূত্র : নোয়াম চমস্কির সাক্ষাৎকার, প্রেস টিভি)।
৬. গাজা যুদ্ধ চলাকালীন মিসরের বর্ডার খুলে দেয়া ও টানেল বন্ধ করার জন্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিসা রাইস ও ইসরাইলী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিপি লিভনী যে চুক্তি করেছে তা ছিল সাম্রাজ্যবাদী উদ্ধত্য কেননা উক্ত চুক্তিতে মিসরকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। ওবামা উক্ত চুক্তি মেনে নিয়েছেন।
৭. আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ওবামা বুশের নীতি বহাল রেখেছেন।
৮. সিআইএ পরিচালিত জিবুতি, রুমানিয়া, থাইল্যান্ড, মরক্কো ও পোল্যান্ডের অবৈধ বন্দি শিবিরের ব্যাপারে ওবামার নীরব সম্মতি রয়েছে। AIPAC (America-Israel Public Affairs Commitee)
এটি ওয়াশিংটনের একটি গুরুত্বপূর্ণ লবি। এটি ইসরাইলী লবির অংশ। হাউস ও সিনেটের সদস্যগণ প্রায় নির্দ্বিধায় এর নির্দেশ পালন করে। কারণ তাদের জানা আছে এই সংগঠন ক্যাপিটাল হিলে এমন এক রাজনৈতিক শক্তির প্রতিনিধি, যা নির্বাচনের সময় তাদের সম্ভাবনাকে ওঠাতে ও নামাতে পারে। AIPAC সম্পর্কে কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ আমেরিকানের মন্তব্য নিম্নরূপ :
১. সাবেক কংগ্রেস সদস্য ম্যাক গ্লেসলি বলেছেন, “কংগ্রেসের উপর আইপ্যাক-এর ভয়াল ত্রাস ছেয়ে আছে।” (সূত্র : বিশ্বায়ন সাম্রাজ্যবাদের নতুন স্ট্রাটেজী, ইয়াসির নাদীম, ভাষান্তর : শহীদুল ইসলাম ফারুকী, পৃ. ১১০, তৎসূত্র : শিকনজা-ই-ইয়াহুদ, পৃ. ৫০-৫২, তৎসূত্র : They Dare To Speak out Senato Paul Fnndle.)
২. Washington Post পত্রিকার সহকারী পরিচালক স্টিফেন এম রুজেনফেল্ড এর ভাষায়- “আইপ্যাক এখন স্পষ্টভাবে আমেরিকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি।” (সূত্র : ঐ, পৃ. ঐ)।
৩. চারবার নির্বাচিত মার্কিন সিনেটর পল ফিন্ডলে মার্কিন রাজনীতিতে ইহুদীদের ভয়াল প্রভাবের বিষয়ে “They Dare To Speak out Senato Paul Fnndle” নামক একটি বই লিখেন। এ প্রসঙ্গে পল ফিন্ডলে লিখেন : “আমার এই গ্রন্থ প্রকাশ করতে অনেক কঠিন স্তর অতিক্রম করতে হয়েছে। দুই বছর লেগে যায় প্রকাশক খুঁজতে। এরপর দু জন প্রকাশক পাণ্ডুলিপির প্রশংসা করে প্রকাশের যোগ্য আখ্যা দিয়ে নিজেদের অক্ষমতা প্রকাশ করে বলেন, এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু খুবই স্পর্শকাতর। এই গ্রন্থ প্রকাশ করলে আমাদেরকে আভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত অনেক বিপদের সম্মুখীন হতে হবে। সুতরাং আমরা বিপদে পড়তে চাচ্ছি না। পরিশেষে অন্য একজন প্রকাশক এই জুয়া খেলতে প্রস্তুত হলেন।” (সূত্র: ঐ, পৃ. ১১১)।
বিল্ডার ব্রীজ : ১৯৪৫ সালে সুইডেনের ইহুদী পুঁজিপতি এ সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এর সদস্য সংখ্যা থাকে ১১৫ জন, তন্মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ থাকে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, দুইতৃ তীয়াংশ থাকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের অর্থনৈতিক, শিক্ষা ও শিল্প ব্যক্তিত্ব। এদের অধিকাংশ সদস্যই থাকে ইহুদী। ইউরোপ এবং আমেরিকায় কে নেতৃত্ব দেবে তা ঠিক করে এই বিল্ডার ব্রীজ। রোনাল্ড রিগান, জিমি কার্টার, জর্জ বুশ, বিল ক্লিনটন, টনি ব্লেয়ার এ সংগঠনের সদস্যপদ গ্রহণ করার পরবর্তী ৪-৫ বছরের মধ্যেই বিল্ডার ব্রীজের গোপন যোগসাজশে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান। এভাবে বিল্ডার ব্রীজ তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে অখ্যাত অবস্থা থেকে দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তায় পরিণত করেন। বারাক ওবামার ব্যাপারটিও এর চেয়ে ব্যতিক্রম বলে মনে হয় না। বিল্ডার ব্রীজের গোপন অধিবেশনে অংশগ্রহণকারী অনেকের জাতীয়তা পর্যন্ত জানা যায় না। কিন্তু এই অধিবেশনে অনুমোদনকৃত প্রস্তাবসমূহ বিশ্বের বিভিন্ন সরকার, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, বিশ্ব বাণিজ্য ও সম্পদের ওপর কার্যকর করা হয়।
রকফেলার ফাউন্ডেশন : যায়নবাদপরিকল্পিত নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের সময়কাল থেকেই এই ফাউন্ডেশন সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের অর্থের যোগানদাতা। এটি আমেরিকার সবচেয়ে বড় বাণিজ্য সংস্থা হওয়া সত্ত্বেও সেবামূলক সংগঠনের লেবেল লাগিয়ে ট্যাক্স প্রদান থেকে অব্যাহতি লাভ করেছে। এর অনেক অঙ্গ সংগঠন রয়েছে, যা বিভিন্ন নামে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মরত। বিল্ডার ব্রীজের বার্ষিক অধিবেশনের খরচ এ সংস্থা বহন করে।
মার্কিন গীর্জা মিশন : রকফেলার ফাউন্ডেশনের আর্থিক সাহায্যে ১৯০৮ সালে হেনরী ফুয়াড ও রুসিংস এ সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। নতুন বিশ্বব্যবস্থার রূপরেখা ও আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থার মূলনীতি এ সংস্থা প্রণয়ন করে, যা বিশ্বব্যাংক কর্তৃক বাস্তবায়ন করা হয়।
পররাষ্ট্র সম্পর্ক কমিটি (CFR) : রাহুডসসেপল (ইহুদী) ১৯০৯ সালে এর প্রতিষ্ঠা করেন। মার্কিন প্রশাসন পরিচালনাকারী সকল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সম্পর্ক এই সংগঠনের সাথে যারা ইহুদী স্বার্থ বাস্তবায়নে সদা তৎপর থাকে। এ সংস্থার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ধারণা পেতে নিমেড়ব কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হলো :
১. CFR সদস্য জন ফস্টার ডালেস (প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী), নেলসন রকফেলার, এডলাই ইস্টিউনসন মার্কিন প্রশাসনকে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন।
২. জন রকফেলার, বারনার্ড বাররুখ (যিনি অনিচ্ছুক প্রেসিডেন্ট উইলসনকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিতে বাধ্য করেন এবং যুদ্ধ শেষে স্বাক্ষরিত ভার্সাই চুক্তি রচনা করেন), এলিন ডালস (সাবেক সিআইএ ডিরেক্টর), ক্রিস্টিয়ান হারটার (সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী) সিএফআর সদস্য ছিলেন।
৩. মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান ও সিনিয়র বুশের দপ্তরের ৩১৩ জন কর্মকর্তা সিএফআর সদস্য ছিল। জুনিয়র বুশ প্রশাসনের ৩৮৭ জন অফিসার এ সংস্থা সরবরাহ করেছে। মার্কিন সরকারের বিভিনড়ব দপ্তরে যখনই কোনো কর্মচারীর প্রয়োজন হয় সঙ্গে সঙ্গে উক্ত দপ্তর সিএফআর-এর কেন্দ্রীয় দপ্তরে যোগাযোগ করে।
৪. ১৯২১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৮ জন অর্থমন্ত্রীর মধ্যে ১২ জন ছিল সিএফআর সদস্য, ১৬ জন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে ১২ জনকে সিএফআর সরবরাহ করে। ১৯৪৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৫ জন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ৯ জন সিএফআর সরবরাহ করে।
৫. ১৯৫২ সাল থেকে এ পর্যন্ত (১৯৬৪ সাল ছাড়া) উভয় রাজনৈতিক দল (ডেমোক্রেট ও রিপাবলিক) থেকে যত প্রার্থী প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন তাদের সবাই সিএফআর-এর সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। (তথ্যসূত্র: মাগরিবী মিডিয়া, পৃ. ৫৭-৯৯, বর্ধিত সংস্করণ)।
উপরোক্ত তথ্যাদির আলোকে যে কেউ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি দেশ, যার ঘাড়ে ও মাথায় চেপে বসে আছে ষড়যন্ত্রপ্রিয়, লুটেরা, রক্তপিপাসু ও বিশ্বশাসনের অভিলাসী যায়নবাদী ইহুদীরা। যে দেশের কংগ্রেস সদস্য হতে ইহুদীদের আশীর্বাদ অপরিহার্য, যে দেশের প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা নেই, যে দেশের প্রেসিডেন্টের নিজের অফিসের কর্মচারী বা নিজ সরকারের মন্ত্রী নির্বাচনের ক্ষমতা নেই, সে দেশের প্রেসিডেন্ট নিশ্চয়ই পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্বল প্রেসিডেন্ট অথবা ইহুদীবাদীদের পার্সোনাল সেক্রেটারী। মার্কিন প্রেসিডেন্ট কখন কি করবেন তার সিদ্ধান্ত দেবে ইহুদীরা, ভাষণ প্রস্তুত করে দেবেন ইহুদী সচিব বা উপদেষ্টারা। ইহুদীদের ইঙ্গিতেই মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন বিভিন্ন দেশে অভিযান পরিচালনা করে এবং তাদের ইচ্ছানুযায়ী ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্রনীতি তৈরি হয়। অর্থাৎ কল্কি সাজাবে অ-ইহুদীরা আর সুখটান দেবে ইহুদীরা। রক্ত ঝরবে অ-ইহুদীদের আর সম্পদের মালিক হবে ইহুদীরা। ইতিপূর্বে আমরা ইহুদী ধর্মগ্রন্থ ‘তাল্মুদ’-এর শিক্ষা, ইহুদী চরিত্র ও আখাংখা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। সুতরাং উক্ত যায়নবাদী ইহুদীরা তাদের আখাংখা বাস্তবায়নে ওবামার গন্তব্য নির্ধারণ করবে। অতীত ইতিহাস, বর্তমান পরিস্থিতি ও ইহুদী মানসের আলোকে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, মার্কিন টর্নেডো ‘ওবামা’র গন্তব্য সম্পর্কে। তদুপরি মার্কিন জাতির বিগত ৫০০ বছরের (১৪৯২-২০০৯) ইতিহাস হলো- অপরের ভূখণ্ড দখল, দখলীকৃত এলাকার জনমানুষকে নিশ্চিহ্ন করা ও সম্পদ লুণ্ঠন। উক্ত দখল-হত্যার জন্য মার্কিনীদের হাতে রয়েছে বিশাল-বিশাল অত্যাধুনিক অস্ত্র নির্মাণ কারখানা আর লুণ্ঠনের জন্য রয়েছে বহুজাতিক কোম্পানিসমূহ, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক।
ইহুদী-খ্রিস্ট অধিবেশনে (২০০২ সালে) প্রেসিডেন্ট বুশের প্রদত্ত ভাষণ থেকে আমরা মার্কিন আখাংখা সমূহ (যা মূলত যায়নবাদী আখাংখা) জানতে পেরেছি। উক্ত ভাষণে বুশ বলেছেন, তিনি ইরান,ইরাক ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ থেকে আমেরিকা পর্যন্ত সমুদ্র তলদেশ দিয়ে পাইপলাইন স্থাপন করে মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদ যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাবেন। উক্ত আখাংখার ন্যায় বুশের আর একটি আখাংখা ছিল মধ্য এশিয়ার সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশসমূহের তেল-গ্যাস আফগানিস্তান-পাকিস্তান হয়ে সমুদ্রপথে নিজ দেশে নিয়ে যাবেন। উক্ত আকাংখা বাস্তবায়নের জন্যই মূলত আমেরিকা আফগানিস্তান ও ইরাক দখল করেছে। কিন্তু বিধি বাম। কোথা থেকে ইসলামী জঙ্গিরা আল-কায়েদার রূপ ধরে যায়নবাদী ও মার্কিন আশা-আকাংখা নস্যাৎ করে দিয়েছে।
আফগানিস্তান দখল লাভজনক না হওয়ায়ক্ষতিপূরণে প্রেসিডেন্ট বুশ ইরাক দখল করেছে। এর পরের তালিকায় ছিল ইরান-সিরিয়া-লেবানন ও পাকিস্তান। ২০০৬ সালে ইসরাইলকে দিয়ে লেবানন-সিরিয়া-ইরান দখলের যুদ্ধ শুরু করা হয়েছিল কিন্তু সেখানে দেখা গেল ইসলামী জঙ্গি হিজবুল্লাহ অনঢ় অটলভাবে দাঁড়িয়ে আছে।২০০৮ সালের গাজা অভিযানও ব্যর্থ হয়েছে, তাও ইসলামী জঙ্গি হামাসের কারণে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, যেখানে ইসলামী জঙ্গি আছে সেখানে হামলা করে লাভ তো হচ্ছে না বরং লাভ করতে গিয়ে বর্তমানে নিজের অর্থনীতির বেহাল অবস্থা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অর্থনীতির অবস্থা এতই নাজুক যে, চীন ও সৌদি আরব নগদ সহায়তা না করলে কয়েক মাস চলার মতো অবস্থাও এ দেশের নেই। এমতাবস্থায় আল-কায়েদা, হামাস, হিজবুল্লাহ মুক্ত নিরীহ সম্পদশালী দেশ এবং গৃহযুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশসমূহ যুক্তরাষ্ট্রের সহজ শিকারে পরিণত হবে। নচেৎ বৃহৎ শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পতন ঘটবে এবং যুক্তরাষ্ট্র ভেঙে যাবে।
২৭ মার্চ ২০০৯ বিকেল পৌনে ৩টায় আল জাজিরা টিভি চ্যানেলের ‘Inside Story’ অনুষ্ঠানে বলা হয় : চীন ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে ৭৪০ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে এবং সম্পত্তি বন্ধক (Bond) বাবদ আরও ৫০০ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনকে আরও Bond কেনার অনুরোধ জানালে চীনা প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও বন্ডের নিশ্চয়তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। শুধু তাই নয়, চীন ডলারের দরপতন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে এবং চীনের রাষ্ট্রীয় রিজার্ভ তহবিলে জমাকৃত ২ ট্রিলিয়ন (২০০০বিলিয়ন) ডলার মুদ্রাকে অন্য মুদ্রায় রূপান্তরের ব্যাপারে চিন্তা করছে। আরও খারাপ খবর হলো,রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে ঋণ দেয়ার ব্যাপারে চীনকে নিরুৎসাহিত করেছে। তদুপরি চীন-রাশিয়া যৌথভাবে আইএমএফকে অনুরোধ করেছে, ডলারের বিকল্প হিসেবে অন্য মুদ্রা নির্ধারণ করতে। উল্লেখ্য, বর্তমানে আইএমএফ অনুমোদিত বিনিময় মুদ্রা হলো ডলার, পাউন্ড, ইয়েন ও ইউরো। এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র এবং সারা বিশ্ব ভয়াবহ মন্দায় পতিত হবে এবং বিশ্বের দেশে দেশে সামাজিক, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হবে।
বুড়ো বাঘ ও ওবামার গন্তব্য : বাঘ যখন বুড়ো হয় তখন হরিণের পেছনে দৌড়ায় না। কেননা হরিণ শিকার তখন তার পক্ষে সম্ভব হয় না। এমতাবস্থায় ছাগল, ভেড়া, গরু, আহত মেষ ও অন্যান্য নিরীহ প্রাণী শিকার করে বুড়ো বাঘ বেঁচে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থাও এখন অনুরূপ। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবল না হওয়া পর্যন্ত সম্পদশালী ও ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন দুর্বল দেশ, গৃহযুদ্ধ কবলিত দেশ বা অঞ্চল, রাজনৈতিক হানাহানিতে লিপ্ত দেশ দখল ও লুণ্ঠন এবং যায়নবাদীদের টার্গেটকৃত দেশে স্বীয় তৎপরতা সীমিত রাখবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এরূপ সম্ভাব্য দেশসমূহ হলো- মেক্সিকো, কলম্বিয়া, দারফুর, পাকিস্তান, বালুচিস্তান, বাংলাদেশ ও উত্তর কোরিয়া। এই পর্ব ব্যবসা সফল হলে পরবর্তী পর্বে আসবে ইরান, ভারত,সিরিয়া, সৌদি আরব, তুরস্ক ও লেবানন। অনেকে হয়তো ভারতের নাম দেখে আঁতকে উঠবেন, কেননা বর্তমান সময়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র গলায় গলায় ভাব। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র কেন বন্ধুর ঘাড় মটকাবে। দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎ শীর্ষক আলোচনায় এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। তবে এখানে শুধু একটি আভাস দিতে চাই। আর তা হলো, ভারতীয় কংগ্রেসের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের যতই বন্ধুত্ব থাক না কেন, যুক্তরাষ্ট্রের চরিত্রের সাথে সর্বাধিক মিল রয়েছে বিজেপির, আরএসএস-এর। বিজেপির মাধ্যমেই যুক্তরাষ্ট্র স্বীয় দক্ষিণ এশীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা সহজতর মনে করে। এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র ও যায়নবাদীরা পাকিস্তানের বেনজির হত্যাকাণ্ডের মতো কোনো অঘটন ঘটিয়ে হলেও আসন্ন নির্বাচনে (এপ্রিল-মে ২০০৯) বিজেপিকে ক্ষমতাসীন করবে। আর তখনি শুরু হবে দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎ রচনা।
দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যত
যায়নবাদী ইহুদীদের পরিকল্পনা হলো সমগ্র বিশ্ব শাসন করা। এ লক্ষ্যে তারা ইতিমধ্যে অনেকদূর অগ্রসর হয়েছে। তাদের সৃষ্ট জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, বহুজাতিক কোম্পানিসমূহ, আন্তর্জাতিক মিডিয়া মূলত বিশ্বের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসেবে বিরাজ করছে। এ অপশক্তি সমগ্র বিশ্বের প্রতিটি দেশে বর্ণে-বর্ণে, জাতিতে-জাতিতে, দেশে-দেশে সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, বর্ণবাদী,অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিভেদ সৃষ্টি করে পারস্পরিক সংঘাত-সংঘর্ষ জিইয়ে রেখে দেশ ও জাতিসমূহকে দুর্বলতর করছে, যাতে করে দুর্বলদের উপর নিজেদের আধিপত্য চাপিয়ে দিতে পারে।
মানবীয় সভ্যতার নিরীখে বর্বর এবং বস্তুবাদী সভ্যতার নিরীখে সবল ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াকে যায়নবাদীরা ইতিমধ্যে তাদের হাতের পুতুলে পরিণত করে বিশ্বের অপরাপর জাতিসমূহের ঘাড় মটকিয়ে রক্ত চুষে নিয়ে নিস্তেজ করার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। মূলত যায়নবাদীরা ইহুদী ব্যতীত অপর কোনো জাতি গোষ্ঠীর বন্ধু নয়। ইহুদী ব্যতীত অপর সকল জাতি গোষ্ঠীকে তারা বোকা গইম (শেষপাল) হিসেবে তাদের ষড়যন্ত্রের দলিল Protocol-এ উল্লেখ করেছে। এতদসত্ত্বেও ইতিহাসের বিভিনড়ব অধ্যায়ে বিভিনড়ব জাতির সাথে যায়নবাধীদের সখ্যতার কারণ হলো- নিজেদের রক্তপাত না ঘটিয়ে জাতিসমূহকে পারস্পরিক লড়াইয়ের মাধ্যমে বিনাশ করার প্রক্রিয়া। স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হওয়ায় পৃথিবীব্যাপী গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্রের লড়াই শেষ হয়ে গেলে যায়নবাদীরা ‘সভ্যতার সংঘাত’ তত্ত্ব দিয়ে দৃশ্যপটে হাজির হয়। তাদের নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক মিডিয়াসমূহ এই মর্মে প্রচার করতে থাকে যে, ‘পাশ্চাত্য সভ্যতার মূল শত্র“ হলো ইসলামী বিশ্ব। সুতরাং পাশ্চাত্য যদি টিকে থাকতে চায় তাহলে ইসলামকে ও ইসলামী বিশ্বকে নির্মূল করতে হবে।’ যায়নবাদীদের এ প্রচারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপ মুসলিম বিশ্ব দখল ও লুণ্ঠনের কর্মসূচি হাতে নেয়। এ দখল ও লুণ্ঠনের ধারাবাহিকতায় তারা মুসলিম বিশ্বের সাথে সুসম্পর্ক আছে এমন উদীয়মান শক্তি চীনকেও নিশানা করে আর দক্ষিণ এশিয়া চ্যাপ্টারে এসে তারা তীব্র মুসলিম বিদ্বেষী ও চীন বিদ্বেষী ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতকে নিজ দলে অন্তর্ভুক্ত করে। এখানেও তাদের একই পলিসি। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দুটি দেশকে যুদ্ধক্ষেত্রে মুখোমুখি করা সম্ভব হলে উভয় দেশই ধ্বংস হবে। এর মাধ্যমে যায়নবাদীরা উভয় দেশের সহায়-সম্পদ ও সার্বভৌমত্ব লুণ্ঠন করবে। দক্ষিণ এশিয়ার মূল শক্তি হলো চীন ও ভারত। আণবিক শক্তির অধিকারী হওয়ায় পাকিস্তানকেও হিসাবে রাখা হয়। যায়নবাদী ইহুদী, সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ও ভারতের দক্ষিণ এশিয়ায় বর্তমান শত্র“ হলো চীন ও পাকিস্তান। এই দুই দেশকে ধ্বংস করতে পারলে আমেরিক-ইসরাইল-ভারতের পক্ষে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ায় নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা সহজ হবে। এমতাবস্থায় দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যত শীর্ষক আলোচনায় আমাদেরকে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। উক্ত বিষয়সমূহ হলো-
১. আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ, ২.আফগানিস্তানে ভারতের স্বার্থ ও তৎপরতা, ৩.যুক্তরাষ্ট্রের ইরান পলিসি, ৪. পাকিস্তানকেন্দ্রীক ভারতের স্বার্থ, ৫. পাকিস্তানে মার্কিন স্বার্থ ও লক্ষ্য, ৬. ভারতের চীন ভীতির কারণ,৭.যুক্তরাষ্ট্রের চীন ভীতির কারণ, ৮. আমেরিকা-ইসরাইল-ভারত বনাম চীনা তৎপরতা এবং ৯.ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরে বৃহৎ শক্তির স্বার্থ ও লক্ষ্য।
আফগানিস্তানে মার্কিন এবং পশ্চিমা স্বার্থ
পশ্চিমা বিশ্বের নেপথ্য নেতৃত্বে রয়েছে যায়নবাদী ইসরাইল, প্রকাশ্য নেতৃত্বে আছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর ভারত-ইসরাইল জোটবদ্ধ হওয়ায় বর্তমানে ভারত পশ্চিমা জোটের অংশীদার। উপরোক্ত শক্তিসমূহ বর্তমান বস্তুবাদী সভ্যতার প্রধান শক্তি। এ সভ্যতায় দয়া, মায়া, মানবিকতা ও মানবাধিকারের ধারণা ভাববাদ অনুপস্থিত। বৈষয়িক লাভ বা অধিক মুনাফা অর্জনের পথে এ সভ্যতা পরিচালিত। এ সভ্যতার সংস্পর্শে এসে ইতিমধ্যে আফগানিস্তানে ৫০ লাখ মহিলা বিধবা হয়েছে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ দেশে-বিদেশে উদ্বাস্তু জীবনযাপন করছে। পর্দানসীন ধর্মপ্রাণ মুসলিম আফগান মহিলারা অবস্থার চাপে পড়ে বর্তমানে দেহ ব্যবসায় লিপ্ত রয়েছে। নিজেদের অর্থ-ক্ষুধা মেটাতে এমন কোনো কাজ নেই যা পশ্চিমা বিশ্ব ও ভারত করতে পারে না। এ জন্যই ফিলিস্তিনিদের ও কাশ্মিরীদের ৬২ বছরের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ নিয়ে এরা মাথা ঘামায় না; ইরাকে, আফগানিস্তানে বা পৃথিবীর অন্য কোথাও কতজন লোক আহতনিহত-পঙ্গু হলো, উদ্বাস্তু হলো তার প্রতি এদের ভ্রুক্ষেপ নেই। তাদের মূল টার্গেট হলো- অপরের সম্পদ লুণ্ঠন প্রক্রিয়া যাতে কোনোক্রমে ব্যাহত না হয়। তাদের আধিপত্য, শোষণ, লুণ্ঠন যাতে চিরস্থায়ী হয়- এটিই তাদের প্রত্যাশা। এক্ষেত্রেও ওবামার গতিপথ নির্ধারণ করবে যায়নবাদ ও পশ্চিমা স্বার্থ। পাশ্চাত্য সভ্যতার ধর্মনেতারা ধর্ম প্রচার করে আধিপত্য বিস্তারের জন্য, রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করে অপরের ঘাড় মটকিয়ে রক্ত পান করার জন্য, সামরিক বাহিনী যুদ্ধ করে প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে লুণ্ঠন করার জন্য, বুদ্ধিজীবীরা বুদ্ধি চর্চা করে নিজ জাতির আধিপত্য ও লুণ্ঠন কার্যক্রম স্থায়ী করার জন্য। প্রত্যেকের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য একরূপ হওয়ায় এ সভ্যতার বিভিন্ন সেক্টর সমন্বিতভাবে উক্ত লক্ষ্য পানে এগিয়ে যায়। আফগানিস্তানে পশ্চিমা স্বার্থ, লক্ষ্য- উদ্দেশ্য সম্পর্কে বুঝতে হলে তাদের মানসিকতা জানা জরুরি। আফগানিস্তান কোনো তেল-গ্যাসসম্পৃদ্ধ দেশ নয়, কৃষি কাজের জন্যও উর্বর নয়, এমতাবস্থায় আফগানিস্তান কেন দখল করা হলো তা জানতে আমাদেরকে এর ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে। এ দেশে স্থায়ী আসন গেঁড়ে বসতে পারলে এশিয়া ও ইউরোপে কর্তৃত্ব ও লুণ্ঠনবৃত্তি চালিয়ে যাওয়া সহজ। পাশ্চাত্যের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা বিশ্বব্যাপী স্বীয় আধিপত্য বজায় রাখা ও বিস্তার করার জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ও কর্মসূচি নিজ জাতিকে প্রদান করেছে। জাতির রাজনীতিকরা উক্ত প্রস্তাব ও কর্মসূচি অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করে দীর্ঘদিন নিজেদের আধিপত্য ও লুণ্ঠন অব্যাহত রেখেছে। বুদ্ধিজীবীদের উক্ত প্রস্তাব ও কর্মসূচির নাম The Grate Game. উক্ত গ্রেট গেম প্লান বাস্তবায়ন করা ও প্রতিপক্ষকে প্রতিরোধ বা নিশ্চিহ্ন করার প্রম ধাপ হিসেবে আফগানিস্তান দখল করা হয়। এই গেমের প্রধান লক্ষ্য হলো ‘ইউরোয়েশিয়ান হার্টল্যান্ড’ হিসেবে পরিচিতি অঞ্চলসমূহ দখল করা, লুট করা এবং চিরস্থায়ী আধিপত্য কায়েম করা। এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে চীন- আফগানিস্তান-পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়ার সংযোগস্থল ওয়াখান করিডোর দখল করা, সুয়েজখাল, জিব্রাল্টার প্রণালী, এডেন, হরমুজ ও মালাক্কা প্রণালীর উপর পশ্চিমা আধিপত্য বজায় রাখা, পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র দখল করা, বেলুচিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরাক থেকে ইরানে হামলা করে দখল করা অন্যতম। পাশ্চাত্য দেশসমূহের দীর্ঘদিনের অনুসৃত The Grate Game. সম্পর্কে এবং এ গেম প্রতিরোধ প্রচেষ্টা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-
দি গ্রেট গেম
ইউরোয়েশিয়ান হার্টল্যান্ড (উত্তরে রাশিয়া, দক্ষিণে ইরান, পূর্বে চীন এবং পশ্চিমে পূর্ব ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকা এলাকাকে ইউরোয়েশিয়ান হার্টল্যান্ড বলে) হিসেবে পরিচিত ভূ- ভাগের ঐক্যকে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের ন্যায় সমুদ্রে আধিপত্য বিস্তারকারী শক্তিসমূহ একটি ব্যাপক হুকমি হিসেবে দেখে থাকে। এ জন্য এ এলাকার দেশগুলোকে ছিন্নবিছিন্ন করা, ভেঙে দেয়া ও টুকরা টুকরা করা আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের স্থায়ী অনুসৃত নীতি। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন যৌথভাবে ইরান, সুদান, তুরস্ক, রাশিয়া, সার্বিয়া, চায়না ও ভারতকে টুকরা করতে অনবরত প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে জার্মানি ও রাশিয়া শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করলে ব্রিটেন-ফ্রান্স প্রমাদ গণে। তারা গোপনে উভয়পক্ষকে উস্কানি দেয়। তাদের কূটনৈতিক তৎপরতায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হয় এবং জার্মানি ও রাশিয়া যুদ্ধে লিপ্ত হয়। বর্তমানে তাদের ভয় রাশিয়া, চীন, ভারত ও ইরান যাতে এক হতে না পারে।
* প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর জার্মানিতে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়ার সৈন্যবাহিনী অবস্থান করা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানিকে শক্তিশালী করে গড়ে উঠতে সাহায্য করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল জার্মানি যদি অটোমান সাম্রাজ্য ও জারের রাশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করে তবে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র নিরাপদে থাকবে। পূর্ব ইউরোপকে রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করা, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যকে রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা ব্রিটেনের দীর্ঘস্থায়ী নীতি। বিংশ শতকের শুরুতে দার্শনিক Mackinder ব্রিটেনকে সতর্ক করেন যে, অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে রাশিয়া-চায়না-ইরান এবং ভারত যদি একটি একক অবস্থানে উপনীত হয় তবে সাগরের কর্তৃত্ব যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেন ও জাপানের নিকট থেকে উক্ত শক্তির অধীনে চলে যাবে। ম্যাকাইন্ডার আরো সতর্ক করেন যে, সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব জনসংখ্যার আধিক্যের উপর নির্শরশীল। সেক্ষেত্রে অধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত ইউরোয়েশিয়াকে বিভক্তকরণ, গ্রাসকরা ও শাসনকরার নীতি অবলম্বন না করলে কম জনসংখ্যা অধ্যুষিত পশ্চিম ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে দীর্ঘদিন আধিপত্য বজায় রাখা সম্ভব হবে না। ম্যাকাইন্ডার এবং অন্যান্য পশ্চিমা চিন্তাবিদরা আরো লক্ষ্য করেছেন যে, ইউরোয়েশিয়ার হার্টল্যান্ডে অবস্থিত দেশগুলোতে প্রায়ই ঐক্যের প্রবণতা দেখা যায়। এই স্বাভাবিক প্রবণতাকে প্রতিহত না করলে বিশ্ব আধিপত্য বজায় রাখা যাবে না। এ জন্যই প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেন জোট মধ্যপ্রাচ্য, মধ্যএশিয়া, পূর্ব ইউরোপ, ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অনেকগুলো জাতিসত্তাকে স্বাধীন হওয়ার সুযোগ দিয়ে বিভক্ত করেছে। নিকোলাস স্পাইকস ম্যানের রিমল্যান্ড থিওরি, হার্বাট স্পেন্সারের মতবাদ এবং হেনরি পাইরেনির থিওরি প্রায় একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছে। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পরও স্যামুয়েল হাস্টিংটন সভ্যতার সংঘাতের যে তত্ত্ব হাজির করেছেন তাও মূলত ‘ইউরোয়েশিয়ান হার্টল্যান্ড’ ভিত্তিক পশ্চিমাদের দীর্ঘদিনের ভাবনার ফসল। তিনি মূল ধারণাকে সভ্যতার সংঘাতের আবরণ পরিয়েছেন মাত্র। হাস্টিংটন তত্ত্বের মূল কথা হলো ইউরোয়েশিয়ান হার্টল্যান্ডে নয়টি ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতা অবস্থান করছে। এদের পরস্পরের মধ্যে সংঘাত লাগিয়ে দিয়ে এদের নিয়ন্ত্রণ ও গ্রাস করার জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ন্যাশন এস্টেট স্থাপন করলে পশ্চিমা আধিপত্য অক্ষুন্ন থাকবে।
ইতিমধ্যে পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় ইউরোয়েশিয়ান হার্টল্যান্ডের শক্তিশালী দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ কার্যক্রম এবং চিন্তাভাবনা শুরু করেছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টাসমূহ নিমড়বরূপ-
১. SCO (Shanhai Co-operation Organization) গঠন : EU এবং মার্কিন বাণিজ্য আধিপত্য মোকাবেলায় রাশিয়া, চীন ও মধ্য এশিয়ার সদ্যস্বাধীন মুসলিম দেশ কাজাখস্তান, কিরঘিজিস্তান, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তান মিলিত হয়ে SCO গঠন করেছে। ইরান এ সংস্থার পর্যবেক্ষক সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছে। বিশ্বের ১৫% তেল, ৫০% গ্যাস রিজার্ভ এবং বিশ্বের অর্ধেক লোক এ দেশগুলোতে বাস করে বিধায় এর রয়েছে বিশাল বাজার সম্ভাবনা।
২. ইউরোয়েশিয়ান ইউনিয়ন গঠন : যে ইউরোয়েশিয়া হার্টল্যান্ড কর্তৃত্ব বজায় রাখা পশ্চিমা বিশ্বের দীর্ঘস্থায়ী নীতি, সেখানে নিজেদের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য রাশিয়া ও কাজাকিস্তান ইউরোয়েশিয়ান ইউনিয়ন গঠনের লক্ষ্যে কাজ করছে। ইতিমধ্যে রাশিয়া, বেলারুশ ও কাজাখস্তানের মধ্যে সীমান্ত শুল্ক ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। ইউরোয়েশিয়ার সংহতি প্রতিষ্ঠার জন্য ইরান, রাশিয়া ও চীন প্রাচীনকালের বাণিজ্য ও যোগাযোগ মহাসড়ক সিল্ক রোড পুনরুজ্জীবিত করে প্রয়োজনীয় রেলওয়ে নেটওয়ার্ক, পরিবহন করিডোর, বৈদ্যুতিক সংযোগ ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করেছে। ফলে মধ্য এশিয়া বর্তমানে উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম করিডোরের মূল কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। মধ্য এশিয়ার প্রভাবশালী ত্রিশক্তি রাশিয়া, ইরান ও চীন ইতিমধ্যে ইউরোয়েশিয়ান ‘ট্রেড জোন’ স্থাপন করায় ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও ইউরোপের কিছু দেশকে এ জোনে আকৃষ্ট করা সম্ভব হয়েছে। ফলে ইইউ ও মার্কিন বাণিজ্য স্বার্থ হুমকির সম্মুখীন।
৩. SCO এবং ইউরোয়েশিয়ান ইউনিয়নের বিপরীতে ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, তুরস্ক, ইসরাইল ও সৌদি আরব সমন্বয়ে ‘ভূমধ্যসাগরীয় ইউনিয়ন’ গঠনে প্রচেষ্টা শুরু করা হয়েছে। কিন্তু সৌদি প্রস্তাব ‘Two Nation Theory’ বাস্তবায়নে ইসরাইল অস্বীকার করায় এই ইউনিয়ন গঠন এখনো পরিকল্পনায় সীমাবদ্ধ রয়েছে। এই ইউনিয়নটি মূলত EU ও Anglo-American Trade Zone-এর সহায়ক হিসেবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
উপরোক্ত ভূমধ্যসাগরীয় ইউনিয়নের প্রতিপক্ষ হিসেবে ইরান ‘ইসলামিক ইউনিয়ন’ প্রস্তাব নিয়ে অগ্রসর হয়। ভূমধ্যসাগরের তিনদিকে অবস্থিত মুসলিম দেশসমূহের সমন্বয়ে ইসলামিক ইউনিয়ন গঠিত হলে ফ্রান্স-ইতালি প্রস্তাবিত ‘মেডিটারেনিয়ান ইউনিয়ন’ গঠন দূরাশায় পরিণত হবে। ইরান প্রস্তাবিত ইসলামিক ইউনয়ন গঠিত হলে ‘ইউরোয়েশিয়ান ইউনিয়ন’-এর সহযোগী হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
তথ্যসূত্র :(The Great Game,Eurasia and the history of war,by Mahdi Darius Nazemroaya,LISA journal jan-march 08,Page 11-22)
ইউরোয়েশিয়ান হার্টল্যান্ড কার্যকরভাবে দখলকরা, লুণ্ঠন করা, বিশ্ব রাজনীতি ওঅর্থনীতিতে স্বীয় আধিপত্য বজায় রাখার লক্ষ্যে পশ্চিমা বিশ্ব ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ আফগানিস্তান দখল করেছে। আফগানিস্তানে স্থাপিত সেনা ছাউনি ও গোয়েন্দা ঘাঁটিগুলোতে মুসলিম যুবকদেরকে অস্ত্র-অর্থ-ট্রেনিং প্রদান করে জঙ্গি তৈরি করে ইউরোয়েশিয়ার দেশসমূহে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির কাজে ব্যবহার করছে। তাদের মূল টার্গেট হলো সন্ত্রাসী হামলার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে দুর্বল করে ফেলা যাতে উক্ত দুর্বল দেশগুলোকে সহজে গ্রাস করা যায়। বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্য ২৬.০৩.০৯ সালে পাকিস্তানি নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত পাকিস্তানের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আসলাম বেগের লিখিত প্রবন্ধটি যথেষ্ট সহায়ক হবে। পাঠকদের অবগতির জন্য উক্ত প্রবন্ধের সারসংেক্ষপ উল্লেখ করা হলো :
১. আফগানিস্তানে এংলো-আমেরিকান দখলদারিত্বের পর জাবাল-উস-সিরাজে CIA/RAW/MOSSAD/MI-6 (ব্রিটেন) এবং BND (জার্মান) গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ সুবিশাল ও অত্যাধুনিক গোয়েন্দা ঘাঁটি স্থাপন করে। উক্ত কেন্দ্র থেকে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে জঙ্গি তৎপরতা বিস্তারের লক্ষ্যে কান্দাহার, ফয়েজাবাদ, মাজার-ই-শরীফ ও হিরাত এ ৪টি অগ্রবর্তী ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। কান্দাহার ঘাঁটির প্রধান একজন ভারতীয়। এখানে প্রশিক্ষিত জঙ্গিদেরকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বালুচিস্তানে পাঠানো হয় জঙ্গি হামলা পরিচালনার জন্য। ফয়েজাবাদ ঘাঁটির দায়িত্বে আছে ৪০০ ভারতীয় মুসলিম সৈন্য, উর্দুভাষী ভারতীয় উলেমা, শ্রমিক ও প্রকৌশলী। এ ঘাঁটিতে সংগৃহীত ও প্রশিক্ষিত জঙ্গিদের চীন, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তানে পাঠানো হয় সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য। মাজার-ই-শরীফ ঘাঁটিটি যৌথভাবে পরিচালনা করে CIA/RAW/MOSSAD ও BND। এখানে সংগৃহীত ও প্রশিক্ষিত জঙ্গিরা তুর্কমেনিস্তান, চেচনিয়া, রাশিয়া, উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তানে কার্যক্রম পরিচালনা করে। হিরাত ঘাঁটি যৌথভাবে পরিচালনা করে CIA/RAW ও MOSSAD। ইরানে নাশকতা সৃষ্টির জন্য এ ঘাঁটি থেকে জঙ্গি সরবরাহ করা হয়। (তথ্যসূত্র : The India Doctrine,MBI Munshi,2nd Edition-2008,Page 602-603)।
উপরোক্ত তথ্যাদির আলোকে পাঠকবৃন্দ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পরিচালিত war on terror সম্পর্কে, terrorist দের পরিচালক ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে এবং যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান দখলের কারণ ও স্বার্থ সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে সক্ষম হবেন। ভয় দেখাইয়া ইউরোয়েশিয়ান হার্টল্যান্ড দখল ও বিশ্ব শাসনই বর্তমান war on terror-এর মূল লক্ষ্য। যে দেশগুলো বিক্ষুব্ধ মুসলিম যুবকদেরকে অস্ত্র-অর্থ-ট্রেনিং দিয়ে জঙ্গি বানায় তাদেরকে জঙ্গিবাদের গডফাদার ছাড়া আর কি বলা যায়?
আফগানিস্তানে ভারতের স্বার্থ ও তৎপরতা :
আফগানিস্তানে মার্কিন স্বার্থ হলো আফগানিস্তানকে স্প্রিংবোর্ড বানিয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে নিজের আধিপত্য ও শোষণ অব্যাহত রাখা। কিন্তু আফগানিস্তানে ভারতের স্বার্থ আরো ব্যাপক পরিসরে বিস্তৃত। এই স্বার্থসমূহ ঐতিহাসিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। নিম্নে সংক্ষেপে এ বিষয়ে আলোচনা করা হলো।
ক. ঐতিহাসিক স্বার্থ : ভারতের বর্তমান বর্ণবাদী ব্রাহ্মণবাদী শাসকগণ ভারতের ভূমিপুত্র নয়। বহিরাগত আর্যরা সংখ্যানুপাতে ভারতের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৯%। এতোদিন তারা বিভিন্ন অলৌকিক কাহিনী রচনা করে ভারতীয়দের উপর বর্ণবাদী শাসন চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে ছিল। কিন্তু বর্তমানে উন্নত তথ্যপ্রযুক্তি, ভারতীয় জনগণের শিক্ষার হার বেড়ে যাওয়া এবং কোটি কোটি ভারতীয় বিভিন্ন উপলক্ষে প্রবাসে অবস্থান করে বিশ্বের মানবগোষ্ঠী, মানবধর্ম, সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতি প্রত্যক্ষ করে ব্রাহ্মণদের চাপিয়ে দেয়া জোয়াল থেকে নিজেদের মুক্ত করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করায় ব্রাহ্মণ্যবাদীরা নিজ দেশের জনগণকে দমন করার জন্য একইরূপ বর্ণবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল ও পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সখ্য গড়ে তোলে। বর্তমানে ভারতীয় সেনাবাহিনী মূলত পাশ্চাত্য অস্ত্রে নিজ দেশের জনগণকে দমিয়ে রাখার জন্য যুদ্ধ করছে।
ভারতের দ্বিতীয় স্বার্থ হলো- নিজ দেশের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা হারানোর ভয়। ভারতীয় রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীরা গজনীর সুলতান মাহমুদ, মুহম্মদ ঘোরী, সম্রাট বাবর, নাদির শাহ ও আহমদ শাহ আবদালী কর্তৃক ভারত দখলের কথা ভুলে যায়নি। অতীতে ভারত প্রত্যক্ষ করেছে, ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী আফগানিস্তান বরাবরই ভারতের স্বাধীনতার জন্য হুমকি। এ জন্য ভারত সবসময় আফগানিস্তানের ঐক্যবদ্ধ হওয়া ও শক্তিশালী হওয়ার বিরুদ্ধে কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারিত্বের সময় ভারত রাশিয়ার পক্ষে ছিল, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে এবং সংখ্যালঘু তাজিক, উজবেকদেরকে পশতুনদের বিরুদ্ধে কাজে লাগিয়ে সংঘাত জিইয়ে রাখার লক্ষ্যে সংখ্যালঘু তাজিক ও উজবেকদের অস্ত্র-অর্থ- প্রশিক্ষণ দিয়ে শক্তিশালী করছে।
ভারতের তৃতীয় স্বার্থ হলো স্বীয় সাম্প্রদায়িক মানসিকতা। তীব্র মুসলিম বিদ্বেষী ভারতীয় শাসক সম্প্রদায় কখনো স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের অস্তিত্বকে মেনে নিতে রাজি নয়। এ জন্য ভারত ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে দুই টুকরা করেছে এবং বর্তমানে ইসরাইল ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের সহায়তায় পাকিস্তানের অস্তিত্ব ধ্বংসে কাজ করছে। পশ্চিমাদের ছত্রছায়ায় ভারত আফগানিস্তানে ও পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অসংখ্য গোপন ও প্রকাশ্য জঙ্গি প্রজনন ঘাঁটি স্থাপন করে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরান ও মধ্য এশিয়ার মুসলিম দেশে সহিংসতা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
রাজনৈতিক স্বার্থ
ভারত ইতিমধ্যে নিজ অপকর্মের মাধ্যমে সকল প্রতিবেশী দেশের সাথে স্থায়ী শত্রুতা স্থাপন করেছে। সে তার প্রতিবেশী পাকিস্তানের সাথে ৩ বার এবং চীনের সাথে ১ বার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। সীমান্তবর্তী ছোট দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ করে প্রতিবেশী দেশের জনগণের মন বিষিয়ে দিয়েছে। এতদসত্ত্বেও পাকিস্তান ও চীন অদ্যাবধি ভারতের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে রাজনৈতিক ময়দানে ভূমিকা রাখছে। এ জন্য ভারতের বর্তমান প্রচেষ্টা হলো পাকিস্তানের সাথে পশ্চিমাদের কৌশলগত মিত্রতাকে বিচ্ছিন্ন করা। এক্ষেত্রে ভারত অনেকটা সফল হয়েছে। ভারত ও ইসরায়েলের গোপন মিত্রতা ও কার্যকলাপ ইতিমধ্যে পশ্চিমাদের সাথে পাকিস্তানের বৈরিতা চরমে পৌঁছেছে। খুব সহসা এই বৈরিতার বাস্তব ফলাফল প্রত্যক্ষ করা যাবে। দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ায় ভারতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হলো চীন। জনসংখ্যা, সেনাসংখ্যা, অস্ত্রশস্ত্র, অর্থনীতিসহ সকল ক্ষেত্রে চীন ভারত অপেক্ষা অনেক অগ্রসর। চীনা কর্মকাণ্ডের কারণে ভারত স্বাধীনভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় ও মধ্য এশিয়ায় নিজ এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারে না। চীন ভারতের বাড়া ভাতে ছাই দেয়। চীনের কারণেই ভারত নেপাল ও বাংলাদেশকে হজম করতে সক্ষম হচ্ছে না এবং চীনের কারণেই ভারত এবং ভারতের পালিত তামিল টাইগাররা শ্রীলঙ্কায় নিশ্চিহ্ন হয়েছে। এমতাবস্থায় ভারত তার আফগান গোয়েন্দা প্রশিক্ষণ ঘাঁটি থেকে চীনের মুসলিম অধ্যুষিত ঝিনজিয়াং প্রদেশে জঙ্গি সরবরাহ করছে। ভারতীয় আধিপত্যের মোকাবেলায় চীন প্রধান প্রতিবন্ধক হওয়ায় ভারত সবসময় চীন ভীতিতে আক্রান্ত এবং এই ভীতিই ভারতের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা রাখে। ভারতের চীন ভীতির প্রধান প্রধান কারণসমূহ নিম্নরূপ :
১. দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ভারতের প্রভাব ক্ষুন্ন করছে। চীনা প্রভাব ও কার্যক্রমের ফলে India Doctrine মোতাবেক ‘অখণ্ড- ভারত’ গঠন সম্ভব হচ্ছে না।
২. ভারত অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত হওয়ায় কাংখিত গতিতে সম্মুখপানে অগ্রসর হতে সক্ষম হচ্ছে না। পক্ষান্তরে চীনের জাতীয় ঐক্য ও সংহতি অটুট থাকায় চীন দ্রুতগতিতে সুপার পাওয়ার আমেরিকার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়েছে।
৩. চীন রাশিয়ার সহযোগিতায় স্বীয় সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন করছে, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্টের সমকক্ষ হওয়ার চেষ্টা করছে।
৪. ১১.০১.০৭ তারিখে চীন ভূমি থেকে নিক্ষিপ্ত মিসাইল দিয়ে ৫৩৭ মাইল দূরবর্তী মহাকাশে অবস্থিত স্বীয় অকেজো আবহাওয়া উপগ্রহ ধ্বংসে সক্ষমতা অর্জন করায় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র বিচলিত হয়। ভারত আন্তর্জাতিক বিশ্বকে চীনের ভূমি, আকাশ, সাগর ও মহাকাশ সামর্থ্যরে ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়।
৫. শ্রীলঙ্কা-চীন ব্যাপক সহযোগিতা চুক্তি সম্পাদন এবং ভারতীয় সীমান্তের নিকটবর্তী শ্রীলঙ্কার বন্দরে চীনা যুদ্ধ জাহাজের অবস্থান ও জ্বালানি সুবিধা লাভ ভারতকে আতঙ্কিত করে।
৬. পাকিস্তানকে টুকরা করা এবং তেল- গ্যাসসমৃদ্ধ বালুচিস্তানকে দখল করার লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল-ভারত-ব্রিটেন-জার্মানি ও ফ্রান্স। ইতিমধ্যে অনেকদূর অগ্রসর হওয়ার পর দেখা গেল চীন বালুচিস্তানের গভীর সমুদ্রবন্দর গোয়াদরকে আধুনিকায়ন করে চীন থেকে কারাকোরাম মহাসড়ক হয়ে গোয়াদর পর্যন্ত যাতায়াত ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করছে। এমতাবস্থায় গোয়াদর বন্দর রক্ষার অজুহাতে চীনের সামরিক হস্তক্ষেপ অসম্ভব কিছু নয়।
৭. বর্তমানে চীন কাশ্মির উপত্যকার ৩৮০০০ বর্গ কিলোমিটার অংশ নিজ ভূখ- বলে দাবি করছে। নভেম্বর ২০০৬ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট হু জিন তাওয়ের ভারত সফরকালে ভারতে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অরুণাচল প্রদেশ চীনের অংশ। চীন বর্তমানে অরুণাচল প্রদেশের অধিবাসীদের চীনা ভিসা দিচ্ছে না।
৮. বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো খাতে চীনা বিনিয়োগ বৃদ্ধি ভারতের গোপন লক্ষ্যের পরিপন্থী।
৯. চীন দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সাথে জ্বালানি উন্নয়ন, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করছে। বিশেষ করে ভারত সীমান্তবর্তী ‘মিয়ানমার’কে উত্তরোত্তর সামরিকভাবে শক্তিশালী করছে।
আফগানিস্তানে ভারতের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ:
আফগানিস্তানে ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। এই গুরুত্ব যুগে যুগে সাম্রাজ্যবাদীদেরকে আফগানিস্তান দখলে প্ররোচিত করেছে। চীন-আফগানিস্তান পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়ার সংযোগস্থল ‘ওয়াখান করিডোর’ নিয়ন্ত্রণ করা ও নিয়ন্ত্রণে রাখা বর্তমানে ভারত ও তার পশ্চিমা মিত্রদের প্রধান লক্ষ্য। ইতিমধ্যে CIA/RAW/MOSSAD যৌথভাবে ‘ওয়াখান করিডোর’ সংলগ্ন আফগানিস্তানে অত্যাধুনিক গোয়েন্দা সরঞ্জাম সমৃদ্ধ সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে। মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে, বাংলাদেশ যেরূপ তিনদিকে ভারতবেষ্টিত, ভারতও তদ্রুপ চতুর্দিকে মুসলিম দেশ অঞ্চল ও চীন কর্তৃক বেষ্টিত। এমতাবস্থায় মুসলিম দেশ ও অঞ্চলসমূহে এবং চীনের ঝিনঝিয়াং ও তিব্বতে জঙ্গি সরবরাহ করে সংশ্লিষ্ট দেশসমূহে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিতে ভারত নিজের আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় মনে করে।
আফগানিস্তানে ভারতের অর্থনৈতিক স্বার্থ
ইতিমধ্যে বিশ্ববাসী জানতে পেরেছে যে, অজনপ্রিয় ও তাঁবেদার সরকারকে টিকিয়ে রেখে উক্ত দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করার জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি জাতিসংঘ বাহিনীর নামে সংশ্লিষ্ট দেশে ‘লুণ্টন নিরাপত্তা বাহিনী’ মোতায়েন করে। গরিব দেশগুলো উক্ত বাহিনীতে এই ভেবে সৈন্য পাঠায় যে, সৈন্যদের বেতন-ভাতা বাবদ লুণ্ঠিত সম্পদের ছিটেফোঁটা হলেও পাওয়া যাবে। একইভাবে ভারত আফগানিস্তানে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি প্রদত্ত ডলার আয় করার জন্য হাজার হাজার সামরিক-বেসামরিক লোক সরবরাহ করেছে। উক্ত সরবরাহকৃত জনবলের বেতন-ভাতা- অস্ত্র-রসদ বাবদ ভারত বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়ে লাভবান হচ্ছে।
আফগানিস্তানে ভারতের ধর্মীয় স্বার্থ : বর্ণবাদী ইসরাইল ও পশ্চিমা বিশ্বের সাথে মিলিত হয়ে ভারত অজেয় মুসলমানদের উপর ‘হাজার সালকা বদলা’ নিচ্ছে। পাশ্চাত্যের সহযোগী হয়ে ভারত নিজ দেশের, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়ার মুসলমানদের রক্ত ঝরিয়ে একেশ্বরবাদের বিরুদ্ধে বহু ঈশ্বরবাদী যুদ্ধ চালিয়ে মনের ঝাল মেটাচ্ছে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ভারতের বিজয় সম্পর্কে বিদেশী সাংবাদিকগণ নয়াদিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, এর মাধ্যমে তিনি এবং ভারতের জনগণ মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক হাজার বছরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েছেন।
দক্ষিণ এশিয়ায় পশ্চিমা স্বার্থ ও চীন
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারাবিশ্বে একক আধিপত্য কায়েম করে। শক্তিমদমত্ততায় বিশ্বজনমত ও মানবতাকে উপেক্ষা করে খোঁড়া অজুহাতে ইরাক ও আফগানিস্তানে হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে বিশ্বব্যাপী আগ্রাসী শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। উক্ত ২টি দেশ দখলের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক ক্ষেত্রে দেউলিয়াত্বের শেষপ্রান্তে উপস্থিত হয়েছে। এমতাবস্থায় বিশ্বের স্বাধীনতাকামী জনতা ও দেশসমূহ রাশিয়া এবং চীনের নেতৃত্বে ক্রমান্বয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হচ্ছে। ফলে বর্তমানে একমেরুর স্থলে দু’মেরুর বিশ্ব ক্রমান্বয়ে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত থাকার সময়ে রাশিয়া-চীন-ইরান ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী অবস্থানে উপনীত হয়েছে। ফলে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা আধিপত্যের বিরুদ্ধে চীন-রাশিয়া-ইরান-ভেনিজুয়েলার নেতৃত্বে একটি বিকল্প প্লাটফরম গড়ে উঠেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার শক্তিশালী এবং পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন তিনটি দেশ হলো ভারত,পাকিস্তান ও চীন। পাকিস্তান-চীন সখ্যতায় ভারত স্বীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে এবং অস্তিত্ব রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য মোকাবেলায় রুশ-চীন ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এমতাবস্থায় উভয় শক্তি দক্ষিণ এশিয়ায় বিদ্যমান আধিপত্য বজায় রাখা ও বিস্তৃত করার লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং একপক্ষ অন্যপক্ষকে ঘেরাও করার কর্মসূচি বাস্তবায়নে অগ্রসর হচ্ছে। বৃহৎ শক্তিসমূহের পরস্পরবিরোধী স্বার্থের দ্বন্দ্বই দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। পরস্পরবিরোধী স্বার্থসমূহ নিম্নরূপ-
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের স্বার্থসমূহ
১. ইন্ডিয়া ডকট্রিন বাস্তবায়ন বা অখণ্ড- ভারত গঠন।
২. স্বীয় আধিপত্য বজায় রাখা ও বিস্তৃত করা।
৩. নিজদেশে ও প্রতিবেশী দেশসমূহে ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসন-শোষণ অব্যাহত রাখা ও বিস্তৃত করা।
৪. বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর ও ভারত মহাসাগরে স্বীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা।
৫. স্বীয় লক্ষ্য অর্জনের প্রধান প্রতিবন্ধক চীনকে প্রতিহত করা।
দক্ষিণ এশিয়ায় পশ্চিমা স্বার্থ-
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে দীর্ঘকালব্যাপী দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় প্রতিটি দেশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বৃটিশ ও পশ্চিমাশক্তির দখলে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে শক্তিহীন হওয়ায় পশ্চিমা বিশ্ব উদ্দেশ্যমূলকভাবে সীমানা নির্ধারণ করে দেশসমূহকে স্বাধীনতা প্রদান করে। তাদের বিতর্কিত ও উদ্দেশ্যমূলক সীমানা নির্ধারণ দক্ষিণ এশিয়ার দেশে দেশে সংঘাত-সংঘর্ষ-অশান্তি অব্যাহত থাকে। উক্ত সংঘাত-সংঘর্ষের মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্ব নিজেদের পরোক্ষ শাসন-শোষণ বজায় রাখে। ইতিমধ্যে চীন শক্তিশালী হওয়ায় এবং পাকিস্তান পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী হওয়ায় পশ্চিমা ও ভারতীয় স্বার্থ হুমকির সম্মুখীন হয়। এ স্বার্থসমূহ হলো-
১. আধিপত্য বজায় রাখা ও সম্প্রসারণ করা।
২. আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ মালাক্কা প্রণালীতে আধিপত্য বজায় রাখা। উল্লেখ্য, সুয়েজ খালের কর্তৃত্ব বহাল রাখার জন্য পশ্চিমা শক্তি ইসরাইল রাষ্ট্রের পত্তন করেছে ও লালন করছে এবং মালাক্কা প্রণালীর কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য মালয়েশিয়াকে কেটে সিঙ্গাপুর রাষ্ট্রের জন্ম দেয়া হয়েছে এবং ফিলিপিনে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে ফিলিপাইনে মার্কিন ঘাঁটি নেই তদুপরি মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া মার্কিনবলয় থেকে বেরিয়ে চীনের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলায় যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে আধিপত্য বজায় রাখার জন্য সম্প্রসারণবাদী ভারতের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছে।
৩. দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব জিইয়ে রেখে অস্ত্র ও পণ্য বিক্রয় করা।
৪. বিদ্যমান সামরিক ঘাঁটিসমূহ বজায় রাখা।
৫. বিশ্বব্যাংক/আইএমএফের সুদী ব্যবসা অব্যাহত রাখা।
(উল্লেখ্য, ২০০৬ সালনাগাদ বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংক/আইএমএফের উপর নির্ভরশীলতা অনেকটা কমিয়ে এনে স্বনির্ভর অর্থনীতির দেশে পরিণত হচ্ছিল। এমতাবস্থায় ভারত-যুক্তরাষ্ট্র-পশ্চিমা বিশ্ব, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ প্রতিনিধিরা এদেশের একশ্রেণীর ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাঁধে সওয়ার হয়ে ১/১১ কাণ্ড- ঘটায় এবং দেশকে পুনরায় পশ্চিমা ঋণের জালে জড়ানোর ব্যবস্থা করে)।
৬. রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন অব্যাহত রাখা।
৭. খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ ও ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম দেশ ও অঞ্চল দখল অব্যাহত রাখার স্বার্থে একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর মুসলিম জাতিরাষ্ট্র পাকিস্তানকে টুকরা করা ও পারমাণবিক অস্ত্র অধিকার করা।
দক্ষিণ এশিয়ায় চীনা স্বার্থ : জোরজবরদস্তি করে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা বা ভারত ও পশ্চিমাদের মতো অন্যায়ভাবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা বর্তমান চীনের নীতি নয়। স্বীয় বাণিজ্যিক স্বার্থ ও রাষ্ট্রীয় সংহতি রক্ষার জন্যই চীন স্বীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে। এ জন্যই দেখা যায়, চীন আগ্রাসন পরিচালনা করে না বরং আগ্রাসী শক্তির পিছু নিয়ে আগ্রাসনকে থামিয়ে দিতে চায়। দু’একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি বোধগম্য হবে।
১. পাকিস্তানে চীনা কার্যক্রম : পশ্চিমা বিশ্ব ও ভারত ২০১৫ সালের মধ্যে পাকিস্তানকে তিন টুকরা করার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হওয়ার পর চীন পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা ও স্বীয় স্বার্থ রক্ষায় দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়। প্রকল্প দুটি হলো-
ক. চীন বেলুচিস্তানের জিন্নাহ নেভাল বেস ও গোয়াদরে যৌথভাবে নির্মাণাধীন অপর একটি সমুদ্রবন্দর ও নেভাল বেসে স্বীয় মনিটরিং স্টেশন স্থাপন করেছে। এছাড়াও বেলুচিস্তানের ছোট ছোট নৌবন্দরসমূহে চীনা নৌবাহিনীর জাহাজ অবস্থানের ব্যবস্থা করেছে। ফলে পশ্চিমা বিশ্ব ও ভারত স্বীয় নৌ এবং তেলস্বার্থ হুমকির সম্মুখীন বলে মনে করে।
খ. চীন থেকে সরাসরি বেলুচিস্তানের গোয়াদর বন্দর যাওয়ার জন্য চীন যৌথভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারগিল ও সিয়াচেন হয়ে রেলসড়ক নির্মাণ করছে।
গ. ০৫/০৩/০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে ACSA চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি মোতাবেক যুক্তরাষ্ট্র শান্তি মিশনে, মানবিক সাহায্য কার্যক্রমে এবং যৌথ মহড়ার সময় শ্রীলঙ্কার ভূখণ্ড- ও বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্র-শ্রীলঙ্কা চুক্তি স্বাক্ষরের পর চীন শ্রীলঙ্কার সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। উক্ত চুক্তি মোতাবেক চীন-শ্রীলঙ্কা যৌথভাবে হাম্বানটোটা হারবার উন্নয়ন কাজ শুরু করে। মূলত এ চুক্তির দ্বারা চীন শ্রীলঙ্কায় স্বীয় নৌঘাঁটি স্থাপন করছে। ভারতের অতি নিকটে নির্মিত এ ঘাঁটি ভারতকে রীতিমতো উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
ঘ. স্বাধীন পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতি অনুসরণ করার চেষ্টা করায় ভারত নেপালের প্রত্যেক গোষ্ঠীকে আলাদাভাবে ইন্ধন দিয়ে গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে এবং রাজা বীরেন্দ্র, রাজা জ্ঞানেন্দ্র ও প্রচন্দ-কে দৃশ্যপট থেকে অপসারণ করে। এতদসত্ত্বেও মাওবাদী নেতা প্রচন্দের স্বল্পকালীন সরকারের সময় চীন নেপালের সাথে ২টি চুক্তি স্বাক্ষর করে। তন্মধ্যে একটি হলো লাসা-কাঠমুন্ডু রেল ও সড়ক সংযোগ চুক্তি। চতুর্মুখী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র নেপালকে সিকিমের মতো গ্রাস করতে উদ্যত হলে ২০০৬ সালের জুনে নেপালে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত এই মর্মে সতর্ক করেন যে, ‘চীন নেপালে কোনো বৈদেশিক আগ্রাসন সহ্য করবে না। নেপালের সংহতি ও সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হলে চীন নেপালী জনগণের পাশে থাকবে।’ এই সতর্কবার্তার পর আগ্রাসী শক্তি নিজেদেরকে সংযত করতে
বাধ্য হয়।
ঙ. ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতাসীন থাকার সময় যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সামরিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে ভারত তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। এদেশের ভারতপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোও এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। ২০০২ সালের ডিসেম্বরে চীন-বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই ব্যাপক পরিসরের চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ভারত তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। ভারতীয় বিশ্লেষকরা এই চুক্তিকে নিজেদের আধিপত্যবাদী আকাংখার পথে প্রধান প্রতিবন্ধক মনে করে। কোনো কোনো ভারতীয় বিশ্লেষক এই মর্মে মন্তব্য করেন যে, এই চুক্তির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগর চীনা ‘লেক’-এ পরিণত হবে।
চীন-বাংলাদেশ চুক্তি সম্পাদিত হওয়ায় বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে চীনা সহযোগিতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকলে ভারত প্রমাদ গোনে। ভারতপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো দেশের প্রতিটি সেক্টরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং হরতাল-ধর্মঘট-জ্বালাও-পোড়াওয়ের মাধ্যমে দেশে চরম নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। ভারতীয় সরকারি-বেসরকারি প্রচার মাধ্যম সেদেশে অবৈধ বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ সমস্যা, বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গীবাদের উত্থানের সংবাদ প্রচার করে। ভারতের উগ্রপন্থী রাজনৈতিক নেতৃত্ব বাংলাদেশে ভারতীয় আগ্রাসনের জন্য ভারত সরকারকে আহ্বান করে। বাংলাদেশের ভারতপন্থী রাজনৈতিক, সুশীল সমাজ ও সংবাদমাধ্যম ভারতের সুরে সুর মিলিয়ে দেশবিরোধী প্রচারণা শুরু করে। চীন-বাংলাদেশ চুক্তির প্রেক্ষাপটে ভারত পশ্চিমা শক্তির সাথে হাত মেলায় এবং সবাই সম্মিলিতভাবে ১/১১ সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশের অগ্রগতি, সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বকে চরম হুমকির সম্মুখীন করে। ১/১১ যাদের আন্দোলনের ফসল বলে দাবি করেছে তারাই বর্তমানে ক্ষমতাসীন হয়ে ভারত, পশ্চিমা শক্তি, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত। দেশ ও জনগণের স্বার্থ এ সরকারের নিকট মূল্যহীন।
বাংলাদেশের একশ্রেণীর জনগোষ্ঠীর এরূপ দেশবিরোধী কার্যকলাপে চীন ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। চীন উপলব্ধি করেছে যে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি, সামরিক নীতি ও উন্নয়ন নীতিমালা স্থিতিশীল নয়। সরকার পরিবর্তনের সাথে এদেশের সকল নীতি পাল্টে যায়। এমতাবস্থায় চীন বঙ্গোপসাগর ও দক্ষিণ এশিয়ায় স্বীয় স্বার্থ সংরক্ষণে এবং পশ্চিমা ও ভারতীয় আধিপত্য মোকাবেলায় বার্মার সামরিক সরকারকে বিশ্বস্ত সহযোগী হিসেবে নির্ধারণ করে এবং বার্মাকে সকল ক্ষেত্রে সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছে।
আমার ধারণা- বাংলাদেশ যদি বর্তমানে অনুসৃত নতজানু পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিরক্ষানীতি অনুসরণ করে, ভারতীয় ও পশ্চিমা এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত থাকে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ও বঙ্গোপসাগরে চীনা স্বার্থ ক্ষুন্ন করা অব্যাহত রাখে তবে অচিরেই চীনের ইঙ্গিতে বার্মা বাংলাদেশকে স্থল-জল ও আকাশপাথে ব্যাপকভাবে আক্রমণ করবে। কেননা চীন স্বীয় ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে কখনো চাইবে না পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পরিবর্তে অন্য কোনো সেনাবাহিনী প্রবেশ করুক এবং চট্টগ্রাম বন্দর বা প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দর চীনবিরোধী শক্তিসমূহের করতলে সোপর্দ হোক। ইতিমধ্যে এই আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস আমরা পত্রপত্রিকায় লক্ষ্য করছি। অর্থাৎ মায়ানমার আরাকানের মুসলমানদেরকে চরম নির্যাতনের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে পরিখা খনন করছে, কাঁটাতারের বেড়া দিচ্ছে এবং নিজস্ব নৌবাহিনীর প্রহরায় বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভূ-রাজনৈতিক কারণেই বাংলাদেশ-চীন ও বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক উত্তরোত্তর অবনতির দিকে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে অস্ট্রেলিয়ার দৈনিক সিডনি হেরাল্ড জানিয়েছে, মিয়ানমার আগামী ৫ বছরের মধ্যে পরমাণু বোমা তৈরির লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পশ্চিমা স্বার্থ ও চীন
চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি। পশ্চিমা বিশ্ব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্বীয় প্রভাব ধরে রাখতে এবং চীনা প্রভাব প্রতিহত করতে স্বীয় মিত্রদেশসমূহের সাথে যৌথভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পশ্চিমা বিশ্বের মিত্রদেশসমূহ হলো- থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, পূর্ব তিমুর, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও জাপান। ভারত ও অস্ট্রেলিয়া এ অঞ্চলে পশ্চিমাদের সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। পশ্চিমাদের সাথে চীনের দ্বন্দ্ব আঞ্চলিক ও গ্লোবাল উভয়বিধ।
পশ্চিমাদের চীনভীতির কারণসমূহ সংক্ষেপে নিমড়বরূপ :
১. চীন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বের আধিপত্যের প্রতিবন্ধক।
২. চীন বিশ্বব্যাপী সাফল্যজনকভাবে তেল, গ্যাস ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিনিয়োগ করছে।
৩. মধ্যএশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও আমেরিকায় উত্তরোত্তর বাণিজ্য সম্প্রসারণ করছে।
৪. চীন ক্রমান্বয়ে অর্থনৈতিক উন্নতি করে প্রতিযোগিতার সামর্থ্য বৃদ্ধি করছে এবং সামর্থ্যরে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করছে।
৫. বিভিন্ন দেশ-জাতির সাথে পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র-গণতন্ত্র খেলায় (ব্যবসায়) চীন প্রধান হুমকি।
৬. বৈদেশিক বিনিয়োগ ও জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে চীন এশিয়ার পাওয়ার হাউজে পরিণত হয়েছে।
৭. অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম নির্মাণ ও বিক্রয়ের ক্ষেত্রে চীন পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
৮. চীনের সামরিক সক্ষমতা আঞ্চলিক ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্যের বিরুদ্ধে হুমকি সৃষ্টি করেছে।
৯. চীন-রাশিয়া কর্তৃক ২০০১ সালে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (SCO) গঠন ও এতে তেল-গ্যাসসমৃদ্ধ ও কৌশলগত দেশ কাজাখস্তান, কিরঘিজিস্তান ও উজবেকিস্তানকে অন্তর্ভুক্ত করায় পশ্চিমা বিশ্বের দি গ্রেট গেম প্লান ও মধ্যএশীয় স্বার্থ ক্ষুন্ন করছে।
১০. SCO কর্তৃক মধ্যএশিয়ায় পরিচালিত ধারাবাহিক সামরিক মহড়া যুক্তরাষ্ট্রকে পূর্ব এশিয়ায় মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম স্থাপনে বাধ্য করেছে।
১১. চীনা সরকারি দৈনিক পিপলস ডেইলি সেপ্টেম্বর ২০০৬ সালে পশ্চিমা বিশ্বকে এই মর্মে সতর্ক করে যে, ন্যাটো স্বীয় আত্মরক্ষার সীমা অতিক্রম করে যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল স্বার্থ রক্ষায় নিয়োজিত হওয়ায় চীনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই সতর্কতা নতুন করে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সূচনার ইঙ্গিতবাহী।
১২. আসিয়ানের সাথে চীনের কৌশলগত, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা এতদঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের একাধিপত্য খর্ব করেছে। এ জন্য ওবামা প্রশাসন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ক্ষেত্রে ইতিপূর্বেকার অনুসৃত নীতি ‘অপেক্ষা করো ও দেখো’ পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছে। বর্তমানে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের বিঘোষিত নীতি হচ্ছে- উন্নয়ন, জনকূটনীতি ও বেসরকারি পর্যায়ে মতবিনিময়। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্বীয় বিনিয়োগ দ্বিগুণ করছে। এ বছর (২০০৯) যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন আসিয়ান সম্মেলনে ‘Treaty of South-East Asian Amity And Co-Operation’ চুক্তি সই করেছে, যা East Asia Summit- এ যোগদানের পূর্বশর্ত। হিলারী ক্লিনটন মেকং নদী অববাহিকা উন্নয়নের ধারণা তুলে ধরে থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের সাথে পরিবেশ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও উন্নয়নের বিষয়ে আলোচনা করেছেন। জাপান জানুয়ারি ২০০৮ সালে মেকং নদী অববাহিকার ৫টি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের একটি সম্মেলন করেছে এবং মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামকে যুক্ত করে একটি অর্থনৈতিক করিডোর স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে। (তথ্যসূত্র : পিপলস ডেইলি, চীন- ০৩/০৮/০৯ইং)। মূলতঃ আসিয়ানকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনা প্রভাব খর্ব করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র-জাপানের উদ্বেগের অংশ হিসেবে এই মেকং নদী অববাহিকা উন্নয়নের স্লোগান উচ্চারিত হচ্ছে।
১৩. মধ্যপ্রাচ্যে চীনের জ্বালানি নীতি যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি ও নিরাপত্তার স্বার্থে হুমকি সৃষ্টি করেছে যা দু’দেশকে সাংঘর্ষিক অবস্থায় উপনীত করতে পারে।
১৪. হংকংয়ের মালিকানা চীনের নিকট হস্তান্তর করার পর পশ্চিমা বিশ্ব দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় নিজেদের প্রধান অবস্থান হারায়। তাইওয়ান-দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানকে অস্ত্রসজ্জিত করার পরও পশ্চিমা বিশ্ব হংকংয়ের বিকল্প কোনো ব্যবস্থা এখনো তৈরি করতে পারেনি।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্বার্থের দ্বন্দ্ব এবং এর পরিণাম
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর দুই মেরু বিশ্বের অবসান হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সমগ্র বিশ্বে স্বীয় আধিপত্যের জাল আরো বিস্তৃত করা, বিশ্বের সকল সম্পদ কুক্ষিগত করা এবং অপর কোনো শক্তি যাতে পশ্চিমা শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সামর্থ্য অর্জনে সক্ষম না হয় তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব সদা-সর্বদা সতর্ক থেকে সকল প্রকার অমানবিক ও নিষ্ঠুর দমননীতি বিশ্বের উপর আরোপ করতে সচেষ্ট রয়েছে। এতদসত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশ চীন খুব দ্রুত পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আবির্ভূত হয়েছে। রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক দিক থেকে চীনের এই অভাবনীয় উন্নতি সমগ্র বিশ্বে ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পশ্চিমা স্বার্থ এবং আকাঙ্ক্ষার প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায় চীনকে মোকাবেলা করার জন্য অপর এক বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশ ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্র- ইসরাইল-ই.ইউ একটি জোট গড়ে তোলে। এ জোটের প্রত্যেক দেশ নিজেদের স্বার্থে অপরের সর্বস্ব হরণে বিশ্বাসী এবং চরমভাবে মুসলিম বিদ্বেষী। উক্ত অশুভ জোটের মোকাবেলায় ইতিমধ্যে চীন-রাশিয়া-ভেনিজুয়েলা-ইরানসহ আরো কতিপয় স্বাধীনতাপ্রিয় দেশ অপর একটি অঘোষিত জোটে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।চীনের ব্যাপারে পশ্চিমা বিশ্বের মনোভাব নিম্নরূপ-
১. চলতি বছর প্রণীত (২০০৯) যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা কৌশলে মার্কিন ন্যাশনাল ইন্টিলিজেন্স ডিরেক্টর Dense Blair মার্কিন সরকারকে এই বলে আহ্বান করেছেন যে, “পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের উপর চীনের নিয়ন্ত্রণের পথ বন্ধ করার পাশাপাশি তার সামরিক বিভাগে নতুন নতুন অস্ত্র তৈরির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। চীনের সামরিক উন্নতির ফলে মার্কিন নৌবহর ও বিমানঘাঁটিগুলো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। (সূত্র : দৈনিক নয়াদিগন্ত, ১৫.১০.০৯ইং)।
২. যায়নবাদী ইহুদি কর্তৃক পরিচালিত মার্কিন নীতিনির্ধারক সংস্থা হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের প্রধান জন থাকিক বলেছেন, চীনের উদ্দেশ্য যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দখল করা এবং এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করানো।
পৃথিবীর বর্তমান আধিপত্যবাদী শক্তিসমূহ প্রধানতঃ সাগরসমূহে নিজেদের কর্তৃত্ব বহাল রাখতে বদ্ধপরিকর।সাগরসমূহ এবং গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ পথ বা প্রণালীসমূহে স্বীয় দখল বা কর্তৃত্ব বজায় রাখার মাধ্যমে আধিপত্যকে স্থায়ী করা হয়।
পৃথিবীর প্রধান প্রধান নৌ যোগাযোগ রুটসমূহ হলো সুয়েজ খাল, জিব্রালটার প্রণালী, এডেন উপকূল, হরমুজ প্রণালী, পানামা খাল ও মালাক্কা প্রণালী। উক্ত যোগাযোগ পথসমূহে নিজেদের কর্তৃত্ব বহাল রাখার জন্য বিশ্বশক্তিসমূহ যে কোনো প্রকারের ঝুঁকি নিয়ে থাকে অথবা আগ্রাসন পরিচালনা করে। এডেন উপকূল ও হরমুজ প্রণালী পাহারায় যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরে এবং ভারত মহাসাগরে শক্তিশালী নৌবহর মোতায়েন রেখেছে, সুয়েজ খালের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় পশ্চিমা শক্তি মধ্যপ্রাচ্যের বিষবৃক্ষ ইসরাইল প্রতিষ্ঠা ও লালন করছে এবং মিসরে দীর্ঘদিন যাবত উপনিবেশিক শাসন চাপিয়ে দিয়েছিল, বর্তমানে মিসরে তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে, জিব্রালটার প্রণালী দু’পাশের দেশ মরক্কো ও স্পেন পশ্চিমা শক্তির দোসর, পানামা খাল খনন পরিকল্পনা করার পরে কলম্বিয়ার প্রদেশ পানামাকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা দেশ করেছে এবং পানামায় তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ‘মালাক্কা-বান্দাহ আচেহ’ প্রণালীতে আধিপত্য ধরে রাখার জন্য এবং আগামীদিনের সম্ভাব্য প্রধান বিশ্বশক্তি চীনকে দমন করার জন্য পশ্চিমা বিশ্ব দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারতের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছে। নিজেদের সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী স্বার্থে ১৭৫৭ সালে ভারতের উচ্চবর্ণের হিন্দুরা ইউরোপের জলদস্যুদেরকে এদেশে ডেকে এনে ক্ষমতায় বসিয়ে এশিয়াকে রক্তাক্ত জনপদে পরিণত করেছিল, বর্তমানেও ভারতের বর্ণবাদী শাসকগোষ্ঠী শুধুমাত্র নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থে পশ্চিমা শক্তিকে ডেকে এনে এশিয়ায় রক্তবন্যা বইয়ে দেয়ার আয়োজন করছে।এমতাবস্থায় এশিয়ায় পশ্চিমা শক্তির বিপর্যয় ভারতকে অস্তিত্ব সংকটে নিমজ্জিত করবে। উপরোক্ত গুরুত্বপূর্ণ নৌরুটসমূহেরমধ্যে পানামা খাল যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্যে রয়েছে, জিব্রালটার প্রণালী এখনো পশ্চিমা শক্তির করায়ত্তে থাকলেও আফ্রিকার দেশসমূহের জ্বালানি ও প্রযুক্তি খাতে চীনের বিনিয়োগ এবং সুদান-জিম্বাবুয়ের সাথে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পশ্চিমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। সুয়েজ খালের কর্তৃত্ব অদ্যাবধি পশ্চিমা শক্তির রয়েছে, কিন্তু হামাস-হিজবুল্লাহ ও ইরানের উত্তরোত্তর অগ্রগতি, ইরান-রাশিয়া-সিরিয়া ও তুরস্কের পর্যায়ক্রমিক ঘনিষ্ঠতা, ইরাকে লজ্জাজনক পরাজয় পশ্চিমাদের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। এডেন উপসাগর ও হরমুজ প্রণালীতে এখন আর যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ব নেই। ইরানের সমরশক্তি, বেলুচিস্তানের গোয়াদর বন্দরে চীনা বিনিয়োগ এবং সামরিক উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্বকে খর্ব করেছে। বঙ্গোপসাগর-ভারত মহাসাগরের সংযোগস্থলের নিকটবর্তী গুরুত্বপূর্ণ মালাক্কা প্রণালীতে (যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রধান জ্বালানি ও বাণিজ্য রুট) এখন যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ব নেই। শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা হারবার উনন্ননে চীনা বিনিয়োগ এবং শ্রীলঙ্কার বন্দরে চীনা নৌবাহিনীর জাহাজের উপস্থিতি বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের একাধিপত্য খর্ব করেছে। বঙ্গোপসাগর উপকূলের দেশ বাংলাদেশে ভারত-মার্কিন-ইসরাইলি জোটের অনুগত সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও এদেশের জনগণের সিংহভাগ আগ্রাসী শক্তির বিরোধী তদুপরি বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ দেশ বার্মা চীনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ায় এবং বার্মার কোকো দ্বীপে চীনা নৌঘাঁটি স্থাপন বঙ্গোপসাগরে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্যকে হুমকির সম্মুখীন করেছে। অপরদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র জাপানে ক্ষমতার পালাবদলে চীন-জাপান সাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দুর্বল হয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর চুক্তির বদৌলতে যুক্তরাষ্ট্র জাপানকে সামরিকভাবে শক্তিশালী হতে দেয়নি, জাপান সরকারের উপর কর্তৃত্ব করেছে, চীন-জাপান দ্বন্দ্ব লাগিয়ে রেখে জাপানের নিকট অস্ত্র বিক্রি করেছে। জাপানের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল DPJ যুক্তরাষ্ট্রের তাঁবেদারী করতে রাজি নয়। DPJ প্রধান ও জাপানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী হাতোয়ামো পরমাণুমুক্ত জাপান, নিচুমাত্রার সামরিক বাহিনীর দেশ অথবা এলডিপির ন্যায় মার্কিন ছত্রছায়ায় থাকতে রাজি নন। দুর্বল ও ক্ষুদ্র উত্তর কোরিয়ার হুমকি-ধমকিতে জাপানিরা ক্ষুব্ধ। হাতোয়ামো যুক্তরাষ্ট্রের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন এবং জাপানের মার্কিন সেনাঘাঁটি অপসারণের আলোচনা শুরু করেছেন। তিনি দীর্ঘদিন লালিত জাপান-চীন দ্বন্দ্ব থেকে বেরিয়ে এসে চীনের সাথে সুসম্পর্ক গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন আধিপত্য ও স্বার্থ বর্তমানে চরম হুমকির সম্মুখীন। কেননা, জাপান যদি মার্কিন সেনাঘাঁটি প্রত্যাহারে যুক্তরাষ্ট্রকে বাধ্য করে তবে দক্ষিণ কোরিয়া ও ফিলিপিন একই ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র- ভারত-ইসরাইল-ইইউ জোট দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিজেদের কর্তৃত্ব হারানোর পূর্বেই চীনকে ঘেরাও করা ও চীন-ভারত যুদ্ধ লাগানোর কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। চীনের উপর হামলা করার পূর্বে চীনকে চতুর্পাশ থেকে ঘেরাও করার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অপরদিকে চীনও বসে নেই। চীন দ্রুত স্বীয় আত্মরক্ষার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে এবং পশ্চিমা আধিপত্যবিরোধী শক্তি ও দেশসমূহের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ও প্রশান্ত মহাসাগরে পশ্চিমা শক্তির দোসর বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়া, পূর্ব তিমুর, ফিলিপাইন, তাইওয়ান ও অস্ট্রেলিয়া। আসিয়ান জোট চীনের পক্ষে থাকায় সম্ভাব্য যুদ্ধে অস্ট্রেলিয়া ও ভারত ব্যতীত অপর কোনো দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবে বলে মনে হয় না। এমতাবস্থায় চীনভারত যুদ্ধের সূচনাস্থল হতে পারে ভারত-চীন সীমান্ত অথবা বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশ বার্মার উপকূল। বার্মাকে দিয়ে বঙ্গোপসাগরে যুদ্ধের সূচনা করে ভারত যুদ্ধের দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্ত থাকতে চায়। চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র বার্মা যুদ্ধ শুরু করলে একপর্যায়ে চীন এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হবে এবং ভারত ও পশ্চিমা বিশ্ব এতে জড়িত হবে। মিয়ানমারকে বলির পাঁঠা হিসেবে ব্যবহার করার ধারাবাহিক কার্যক্রম নিম্নরূপ-
পাশ্চাত্য শক্তি দীর্ঘদিন যাবত তেল ও খনিজসম্পদ সমৃদ্ধ মিয়ানমারে তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে। এর অংশ হিসেবে মিয়ানমারের জনপ্রিয় নেত্রী অং সান সুচির সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী পাশ্চাত্যের এহেন মনোভাব উপলব্ধি করে সুচিকে ক্ষমতাসীন হতে না দিয়ে দুই দশক যাবত গৃহবন্দী করে রেখেছে। কোনোভাবেই জান্তা সরকারকে বাগে আনা সম্ভব না হওয়ায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগে মিয়ানমারের উপর অবরোধ আরোপ করে। এ সুযোগে চীন মিয়ানমারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। মিয়ানমারের প্রতিরক্ষা ও খনিজসম্পদে চীনের রয়েছে বিশাল বিনিয়োগ। চীনের রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি দি চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বার্মার উপকূলে বন্দর নির্মাণ করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে মালাক্কা প্রণালী দিয়ে তেল আমদানি করে পাইপলাইনের মাধ্যমে মিয়ানমার হয়ে ইউনান প্রদেশে পাঠানোর কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। চীন-মিয়ানমার ঘনিষ্ঠ সামরিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করছে। চুক্তি অনুযায়ী চীন মিয়ানমারের কোকো দ্বীপে স্বীয় নৌঘাঁটি নির্মাণ করেছে। উক্ত চুক্তির শর্তানুযায়ী চীন যুদ্ধের প্রয়োজনে মিয়ানমারের ভূখণ্ড- ব্যবহার করে স্বীয় সৈন্য চলাচলের সুবিধা লাভ করেছে। বঙ্গোপসাগরে চীনের কর্তৃত্ব খর্ব করা এবং সম্ভাব্য চীন-ভারত যুদ্ধে মিয়ানমারকে নিরপেক্ষ রাখার জন্য ভারত স্বপ্রণোদিত হয়ে মিয়ানমারের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ায়। ভারত মিয়ানমারের সাথে গ্যাস ক্রয় চুক্তি সম্পাদন করেছে, মিয়ানমারের সমুদ্রসীমা জরিপের ব্যবস্থা করে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা দাবি করার জন্য তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করেছে। ২০০৫ সাল থেকে ভারত পর্যায়ক্রমে মিয়ানমারের সাথে সামরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। ২০০৫ সালে ভারতের তৎকালীন সেনাপ্রধান ভারত সফর করেছেন।
২০০৬ সালে ভারতের নৌবাহিনী প্রধান মিয়ানমার সফর করেছেন, একই সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের নৌবাহিনী প্রধান ভারত সফর করেন।২০০৫ সালে ভারত-মিয়ানমার যৌথ নৌমহড়া অনুষ্ঠিত হয়।২০০৯ সালের অক্টোবরে ভারত-মিয়ানমার মিলিটারি টু মিলিটারি সম্পর্ককে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল দীপক কাপুর তিনদিন মিয়ানমার সফর করেন এবং জান্তা সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনায় মিলিত হন।
যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিষয় শিকায় তুলে মিয়ানমারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজ স্বার্থে কোনো দেশকে শত্রু আবার কোনো দেশকে বন্ধু বানায়। যুক্তরাষ্ট্র চীনকে প্রতিহত করতে চায় মিয়ানমার ও তৎসংলগ্ন সাগরে। এ জন্য ওবামা প্রশাসন স্বপ্রণোদিত হয়েমিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের কার্যক্রম শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কার্ট ক্যাম্পবেল ২৯/০৯/০৯ তারিখে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের মিয়ানমার প্রতিনিধি এবং সে দেশের একজন মন্ত্রীর সাথে বৈঠক করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত মূলত মিয়ানমারকে চীনের কাছ থেকে সরিয়ে নিজেদের বলয়ে আনার চেষ্টা করছে। সেটি সম্ভব না হলে সমুদ্রসীমা বিরোধের পথ ধরে মিয়ানমারকে দিয়ে বাংলাদেশ আক্রমণ করানোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। কেননা ইরাক দখল ও নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। মার্কিন সরকারের উপদেষ্টা রিচার্ড পার্ল, ডগলাস ফেইথ, ডেভিড ওরমস যুক্তভাবে ‘এ ক্লিন ব্রেক : এ নিউ স্ট্রাটেজি ফর সিকিউরিং দি বিয়ালমস’ শিরোনামে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন ও ইরানের সরকার পরিবর্তনের নীলনকশা প্রস্তুত করে। উক্ত নীলনকশা বাস্তবায়নের কাজটিও শুরু করানো হয় মার্কিন মিত্র সাদ্দাম হোসেনকে দিয়ে। সাদ্দাম হোসেন ও বাগদাদের তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত এপ্রিল গ্লাসপাইয়ের মধ্যে দীর্ঘ বৈঠকের ৮ দিন পর সাদ্দাম কুয়েত দখল করেন। একইভাবে বার্মার সাথে বন্ধুত্বের ভান করে বার্মাকে দিয়ে বাংলাদেশ আক্রমণ করানো গেলে বার্মাও ইরাকের ন্যায় বলির পাঁঠা হবে।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের হঠাৎ গণতন্ত্র হত্যকারী ও মানবাধিকার দলনকারী মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সাথে সখ্যতা স্থাপন, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা দাবি করা, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া প্রদান, সীমান্তে সেনা সমাবেশ ইত্যাদি ঘটনাবলীতে মনে হচ্ছে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের কাঁধে বন্দুক রেখে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত বনাম চীন যুদ্ধ শুরু করতে চায়। কেননা মিয়ানমার যদি সর্বশক্তি দিয়ে বাংলাদেশ আক্রমণ করে তবে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে তা নিম্নরূপ-
১. ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী ও সামরিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর : বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই প্রতিবেশী দেশের সাথে যৌথ টাস্কফোর্স গঠন ও সামরিক সহযোগিতার কথা বলে আসছে। কিন্তু এদেশের ৭০-৮০% জনগণ এরূপ চুক্তির বিরোধী হওয়ায় সরকার দোটানার মধ্যে আছে। এরপরও ডিসেম্বর ২০০৯ সালের মধ্যে ভারত-বাংলাদেশ সামরিক সহযোগিতা চুক্তি সম্পাদনের কার্যক্রম এগিয়ে যাচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। উক্ত চুক্তির মডেল হবে ভারত- নেপাল মৈত্রী চুক্তির ন্যায়। উক্ত চুক্তির মূল কথা হলো-
১. একদেশের নিরাপত্তা সংকটে অপর দেশ সাহায্য করবে।
২. নয়াদিল্লির অনুমতি ছাড়া নেপাল তৃতীয় কোনো দেশ থেকে সামরিক সহযোগিতা গ্রহণ করতে পারবে না এবং কোনো সামরিক চুক্তি করতে পারবে না।
৩. উক্ত চুক্তির আওতায় ভারতীয় সেনা ও পুলিশ বাহিনী নেপালের যে কোনো এলাকায় প্রবেশ করতে পারে।
উক্ত চুক্তি নেপালকে ভারতের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত করেছে। নেপাল স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণের চেষ্টা করায় রাজা বীরেন্দ্র, জ্ঞানেন্দ্র এবং প্রচন্দ-কে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী গিরিজা প্রাসাদ কৈরালা ও রাজা জ্ঞানেন্দ্র রাশিয়া, ইইউ ও চীন থেকে উন্নত অস্ত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে ভারতের রোষানলে পড়েন। নেপালের জন্য Anti Air-craft Missile বহনকারী রুশ AN-12 বিমানকে ভারতের আহমেদাবাদে থামিয়ে দেয়া হয়। এমতাবস্থায় বার্মা যদি বাংলাদেশের উপর আক্রমণ করে তবে বর্তমান বাংলাদেশ সরকার দেশ উদ্ধারের অজুহাতে ভারতের সাথে নেপাল মডেলের সহযোগিতা চুক্তি সম্পাদন করার সুযোগ পাবে। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের সূত্রেই আমরা জানতে পেরেছি, ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য তৈরি হয়ে আছে। ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারির বিডিআর বিদ্রোহের সময় ভারতীয় নীতি-নির্ধারকরা হাসিনা সরকারকে রক্ষার জন্য সামরিক শক্তি ব্যবহারের প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছিল। উক্ত সময়ে আসামের বিমান ঘাঁটিতে যুদ্ধ বিমানসহ ৩০ হাজার ভারতীয় সেনা বাংলাদেশে প্রবেশের লক্ষ্যে হুকুমের অপেক্ষায় ছিল। বাংলাদেশের সাথে কোনো সামরিক চুক্তি না থাকায় ভারত সেনা পাঠাতে দ্বিধান্বিত ছিল।
২. চীনবিরোধী জোটের বাংলাদেশ উদ্ধারে বাংলাদেশ ও বঙ্গোপসাগরে আগমন : ভারত-ইসরাইল- যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ’র দক্ষিণ এশিয়ায় মূল টার্গেট হলো চীন। চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র ও সীমান্তবর্তী দেশ বার্মা যদি স্কেপগোট বাংলাদেশে আক্রমণ করে তখন স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের একান্ত বন্ধু যুক্তরাষ্ট্র সোফা চুক্তির সূত্র ধরে সদলবলে বাংলাদেশে এসে অবস্থান নেবে। ইরাকের কুয়েত দখল প্রতিহত করতে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে পারস্য উপসাগরে হাজির হয়ে অবস্থান নিয়েছে ঠিক তদ্রুপ এদেশে হাজির হয়ে অবস্থান নিয়ে কুয়েতের ন্যায় বাংলাদেশ উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রথমে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে এবং বার্মায় সক্রিয় ১৭টি সশস্ত্র গেরিলা গোষ্ঠী পশ্চিমা শক্তির ইন্ধনে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বার্মার স্থিতিশীলতা বিপন্ন করবে।
৩. চীন দৃশ্যপটে হাজির হবে : বাংলাদেশ আক্রান্ত হলে বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্রসমূহ বাংলাদেশ উদ্ধারে অগ্রসর হলে চীন বঙ্গোপসাগরে স্বীয় স্বার্থ রক্ষা, নিজের সীমান্তে পশ্চিমা শক্তির আগমন ঠেকাতে দৃশ্যপটে হাজির হতে বাধ্য হবে। এমতাবস্থায় পশ্চিমা জোটের বহুল আকাংখিত চীন-ভারত-যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে এবং সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যুদ্ধের দাবানল ছড়িয়ে পড়বে।
পশ্চিমা শক্তি ও চীনের বিগত দিনের কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে চীন ও পশ্চিমা শক্তির কার্যক্রম খরগোশ ও কচ্ছপের দৌড়ের ন্যায়। খরগোশ দ্রুতগতিতে দৌড়ানো সত্ত্বেও অবিরাম গতির কচ্ছপের নিকট হেরে যায়।
এমতাবস্থায় চীন নিশ্চয়ই বার্মাকে ভারত ও পশ্চিমা শক্তির ফাঁদে পা দেওয়া থেকে নিবৃত্ত রাখবে। ফলে পরিকল্পিত চীন ভারত-যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের জন্য অন্য অজুহাত ও অন্য ভূখণ্ড- ব্যবহারের প্রয়োজন হবে অথবা আগামী বছরে অনুষ্ঠিতব্য বার্মার নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করবে।
বিবদমান পক্ষসমূহের রণপ্রস্তুতি : দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রণদামামা বেজে উঠলে চীন-পাকিস্তান-ইরান-রাশিয়া ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়া-ভারত-অস্ট্রেলিয়া-ইসরাইল-ইইউ শক্তিজোট বিপরীত পক্ষে অবস্থান করবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানের বর্তমান সরকার ও জনগণ যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের বিরোধী হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র এ যুদ্ধকে বঙ্গোপসাগর- কেন্দ্রিক কেন্দ্রীভূত রাখার চেষ্টা করবে। আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারত পশ্চিমা জোটের পক্ষে থাকায় পশ্চিমা শক্তিসমূহ সর্বশক্তি দিয়ে চীনের প্রধান জ্বালানি রুট মালাক্কা প্রণালী অবরুদ্ধ করার চেষ্টা করবে। ফলে সম্ভাব্য যুদ্ধ স্থলের চেয়ে জলে ও আকাশে তীব্রতর হবে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশিরভাগ দেশ ও দেশের জনগণ চীনের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ায় যুদ্ধের ফলাফল চীনের অনুকূলে যাবে। কেননা যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে ভারতের তাঁবেদার প্রতিবেশী দেশসমূহের সরকার পরিবর্তন হতে পারে এবং ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজ্য ও গোষ্ঠীসমূহ অভ্যন্তরীণভাবে ভারতকে অস্তিত্বের সংকটে নিমজ্জিত করবে। দুর্বল ও ভঙ্গুর অর্থনীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র বেশিদিন এ যুদ্ধের ব্যয়ভার বহনে সক্ষম হবে না। বিবদমান প্রধান স্থানীয় পক্ষদ্বয় ভারত ও চীনের রণপ্রস্তুতি মোটামুটি নিম্নরূপ-
ভারতের রণপ্রস্তুতি
ভারতের সেনাসংখ্যা- ১২ লাখ
অত্যাধুনিক ট্যাংক- ৪ হাজার
জঙ্গি বিমান- ১ হাজারের অধিক এবং সংগ্রহ
তালিকায় রয়েছে ১০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের
১২৬টি।
পরমাণু সাবমেরিন- ১টি (৬ হাজার টন)
সংগ্রহের তালিকায় ৬টি
বিমানবাহী জাহাজ- ১টি
ডেস্ট্রয়ার- ৮টি, ফ্রিগেট- ৪০টি, সাবমেরিন-
১৬টি।
অস্ত্রখাতে ব্যয়
২০০৭ সালে ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার
২০০৮ সালে ৭.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার
২০০৯ সালে ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার
২০১০ সালে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
চীন-ভারত সীমান্তের দৈর্ঘ্য- ৩৫০০ কিলোমিটার। বর্তমানে ভারতের সীমান্ত চৌকি রয়েছে ১৪০টি। ২৩/১০/২০০৯ তারিখে নয়াদিল্লিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরাম আরো ৫০টি সীমান্ত চৌকি বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছেন।
ভারত অরুনাচল-চীন সীমান্তে বৃহৎ সড়ক নির্মাণ করছে, ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধে পরিত্যক্ত এয়ার স্ট্রিপ বিমান অবতরণ ক্ষেত্র, সংস্কার ও তথায় যুদ্ধ সরঞ্জাম সরবরাহের ব্যবস্থা করছে।
ভারতের দি টেলিগ্রাফ এবং ডেইলি টাইমসের খবর অনুযায়ী ভারত অরুণাচল সীমান্তে অতিরিক্ত ১৫ থেকে ৩০ হাজার সেনা মোতায়েন করেছে, মিয়ানমার-ভারত সীমান্তের মণিপুরে অতিরিক্ত ১ ডিভিশন সেনা মোতায়েন করেছে। ভারত ইতিমধ্যে চীন সীমান্তে ৩০টি নতুন সংযোগ সড়ক নির্মাণ করেছে এবং সর্বাধুনিক যুদ্ধ বিমান অবতরণ ক্ষেত্র ও গোলন্দাজ বাহিনী চলাচলের উপযোগী করে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ করছে।
তেজপুর বিমান ঘাঁটি, লাদাখ ও কারাকোরাম গিরিপথ সংলগ্ন এলাকায় যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করেছে।
দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ জানিয়েছে, ভারতীয় সেনাপ্রধান দীপক কাপুর ১১/০৯/০৯ তারিখে পূর্বাঞ্চলের সেনা কমান্ডারদের সাথে কলকাতায় জরুরি বৈঠক করেছেন।
ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পরমাণু চুক্তি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘গ্রেট সেন্ট্রাল এশিয়া পলিসির সাথে একাত্ম হয়ে চীন-রাশিয়ার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের Anti Ballastic Missile System- এর অংশীদার হয়েছে এবং ভারতের বন্দরে যুক্তরাষ্ট্রের রণতরী অবস্থানের চুক্তির ব্যাপারে অগ্রসর হচ্ছে।
চীনের রণপ্রস্তুতি
চীনের সেনাসংখ্যা- ২৩ লাখ
২০০৯ সালে চীনের প্রতিরক্ষা বাজেট ছিল- ৭১ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছর প্রজাতন্ত্র দিবসে চীন তার বিপুল সমরাস্ত্র প্রদর্শন করেছে যা ইতিপূর্বে কখনো জনসমক্ষে আসেনি।
চীন রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলে সকল প্রকার অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিজেই নির্মাণ করছে।
ভারতীয় মিডিয়ার খবর অনুযায়ী চীন লেহ থেকে অরুনাচল ও সিকিম সীমান্তে অতিরিক্ত সেনা সমাবেশ করেছে।
বঙ্গোপসাগরে স্বীয় কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য চীন বেলুচিস্তানের গোয়াদর বন্দরে শ্রীলঙ্কার বন্দরে ও হাম্বানটোটা হাবরারে এবং বার্মার কোকো দ্বীপে নৌঘাঁটি স্থাপন করেছে ও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে রণসাজে সজ্জিত করেছে।
বার্মার রণপ্রস্তুতি
সেনাসংখ্যা- ৪,৯২,০০০ জন
আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য- ৭২,০০০ জন
ব্যাটেল ট্যাংক- ১৫০টি
এলটি ট্যাংক- ১০৫টি
এপিসি- ৩২৫টি
টুয়ার্ড আর্টিলারী- ২৭৮
মর্টার- ৮০
এএ গান- ৪৬
কমব্যাট এয়ার ক্রাফট- ১২৫টি
ফাইটার গ্রাউন্ড এটাক- ২২টি
ফাইটার- ৫৮টি
পরিবহন বিমান- ১৫টি
হেলিকপ্টার- ৬৬টি
করবেটস- ৪টি
মিসাইল-১১টি
টর্পেডো- ১৩
ইনসোর রিভার ইন- ৪৭
ল্যান্ডিং ক্রাফট- ১১টি।
সূত্র : মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান, অন্য এক দিগন্ত, অক্টোবর ২০০৯।
ভারতের করণীয় : ভারত যদি এশিয়ায় শান্তি চায় তবে ভারতকে রাষ্ট্রীয়ভাবে যা করতে হবে তা হলো-
১. ইন্ডিয়া ডকট্রিন নামে খ্যাত পলিসি থেকে এবং প্রতিবেশীদের ঘরে আগুন লাগানো থেকে বিরত থাকতে হবে।
২. ১৯৪৭ সালের স্বীকৃত সীমানার অভ্যন্তরের সকল জনগোষ্ঠীর প্রতি সমান আচরণ করতে হবে।
৩. পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টিকারী আমেরিকা- ইসরাইল-ইইউ’র সাথে অশুভ আঁতাত থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করতে হবে।
৪. সামরিক বাজেট কমিয়ে নিজ দেশের ৭৬% গরিব জনগণের সামাজিক কল্যাণে উক্ত অর্থ ব্যয় করতে হবে।
৫. ভারত যদি আগ্রাসী মনোভাব বর্জন করে, পশ্চিমা অশুভ শক্তিকে সহযোগিতা না করে এশিয়ার উন্নতির লক্ষ্যে কাজ করে তবে বিশ্বের নেতৃত্ব হাতবদল হয়ে পাশ্চাত্য থেকে এশিয়ায় চলে আসবে।
চীনের করণীয়: বিশ্বব্যাপী পশ্চিমা শক্তির সামাজিক, রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে চীন প্রধান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। চীনের এই অর্জন অন্যের ক্ষতি করা অজর্ন নয়। চীন তার পুঁজির কর বাড়ানোর ব্যাপারে আগ্রহী, সাম্রাজ্য কিংবা আধিপত্য বিস্তারে আগ্রহী নয়, চীনের এই উত্থান এবং চীন-রাশিয়া মৈত্রী দ্বিমেরু বিশ্বের আগমনী বার্তা। অথচ পশ্চিমা শক্তি Unipolar বিশ্ব চায়। এ জন্যই চীনের অপরাধ না থাকা সত্ত্বেও চীনকে ধ্বংস করতে চায় এবং রুশ-চীন ঐক্যে ফাটল ধরাতে চায়।
চীনের করণীয় নিম্নরূপ :
১. ভারতের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করা যাতে ভারত পশ্চিমা শক্তিকে এশিয়ায় ধ্বংসযজ্ঞ করতে সহায়তা না করে।
২. জাপানের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করা যাতে জাপান যুক্তরাষ্ট্রের বলয় থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে নিরাপদ মনে করে।
৩. চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র উত্তর কোরিয়া ও মিয়ানমারের শাসক গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করা যাতে উক্ত ২ দেশের হঠকারী কার্যকলাপ চীনকে অন্তহীন সমস্যায় নিপতিত না করে। দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্বাধীনতাকামী রাষ্ট্র ও গোষ্ঠীকে সহায়তা করা যাতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এতদাঞ্চলের দিকে চোখ তুলে তাকাতে সাহস না পায়।
৪. আসিয়ানের সাথে আরো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং সংশ্লিষ্ট দেশসমূহকে শক্তিশালী করা।
৫. জিনঝিয়াং ও তিব্বতের ভিন্ন মতাবলম্বী শক্তিসমূহের সাথে আলাপ-আলোচনা ও ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা করা যাতে উক্ত দুই অঞ্চলের জনগণ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতের পুতুলে পরিণত হয়ে চীনের ক্ষতি করতে না পারে।
৬. আধিপত্যবাদী পশ্চিমা শক্তিকে প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং এশিয়ার নেতৃত্বের আসন অলঙ্কৃত করা।
৭. আফগানিস্তান থেকে দখলদার বাহিনী বিতাড়ন, দেশপ্রেমিক ও সাম্রাজ্যবাদ- বিরোধী তালেবান শক্তির সাথে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত। চীন নিশ্চয়ই অবগত আছে যে, যুক্তরাষ্ট্র- ইসরাইল-ভারত-জার্মানি-ফ্রান্স ও ব্রিটেন দখলকৃত আফগান ভূখণ্ড-কে জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পরিণত করেছে। উক্ত কেন্দ্র থেকে অস্ত্র-অর্থ-প্রশিক্ষণ নিয়ে ক্ষুব্ধ মুসলিম যুবকেরা চীনে, রাশিয়ায় ও মধ্যএশিয়ায় অশান্তির সৃষ্টি করছে। চীনা সহযোগিতা পেলে তালেবানরা খুব দ্রুত আফগানিস্তান থেকে বিদেশী বাহিনী প্রত্যাহারে পশ্চিমা শক্তিকে বাধ্য করতে পারবে। এতে ভারত ও পশ্চিমা শক্তির জঙ্গী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বিলুপ্ত হবে।
উপসংহার : দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে ধ্বংস করতে মার্কিন টর্নেডো ওবামার নেতৃত্বে আগ্রাসী শক্তি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে প্রচ-বেগে ছুটে আসছে। আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা ও লুণ্ঠন করা উক্ত আগ্রাসী শক্তির প্রধান কর্মসূচি। এমতাবস্থায় স্বাধীনতাকামী ও শান্তিকামী এশীয় নেতৃবৃন্দকে জনগণের সহায়হায় উক্ত ঝড় মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। আঘাত হানার পূর্বেই উক্ত ঝড়ের কেন্দ্রকে বিক্ষিপ্ত করে দিতে হবে। ভারত যেন পশ্চিমা শক্তির স্বার্থে নিজ দেশ ও এশিয়ার ক্ষতি না করে তার জন্য প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে আবহাওয়া বার্তা অনুধাবন না করার পরিণতি সলিল সমাধি।
এস, এম, নজরুল ইসলাম।
সম্পাদকঃমাসিক ইতিহাস অন্বেষা।