আমরা কি স্বাধীন? আমাদের দেশ কি স্বাধীন?-এ দুটি প্রশ্নে চিন্তা করার, জিজ্ঞাসা করার, সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া বর্তমান সময়ের দাবি।ব্যক্তিক ও সামষ্টিক পর্যায়ে আমাদের বর্তমান অবস্থা মূল্যায়ন করলেই আমরা সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারব। ব্যক্তি স্বাধীনতার শর্তাবলী হলো- স্বাধীনভাবে চলাফেলার স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা, লেখার স্বাধীনতা, সম্পদ অর্জন ও রক্ষার স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা, চাকরি পাওয়ার স্বাধীনতা। ধর্মীয় স্বাধীনতা,রাজনীতি করার স্বাধীনতা ও আত্মরক্ষার স্বাধীনতা। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার শর্তাবলী হলো রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব অটুট থাকা, গোষ্ঠীগত স্বাধীনতা, নিজ দেশের সীমান্তে নিরাপদে বিচরণের স্বাধীনতা, আমাদের সীমান্ত আমাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা, পররাষ্ট্র নীতির স্বাধীনতা, স্বাধীন অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের স্বাধীনতা, স্বাধীন প্রতিরক্ষা নীতি ও আগ্রাসন প্রতিরোধের স্বাধীনতা। উপরোক্ত শর্তাবলীর বর্তমান অবস্থা হলো-আমরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে সক্ষম হচ্ছি না। কেননা রাষ্ট্রীয় আস্কারাপ্রাপ্ত ছিনতাইকারী, মলম পার্টি, ঝাপটা পার্টি, খুনি ও দস্যুরা সদা-সর্বদা আমাদের জানমালের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করছে। সরকারের পুলিশ বাহিনী যখন-তখন, কারণে-অকারণে গ্রেফতার করে বিনা বিচারে আটক রাখার ক্ষমতাপ্রাপ্ত, রিমান্ডের নামে প্রাণসংহারী অত্যাচার করতে সিদ্ধহস্ত, গ্রেফতার-বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ আদায়ে লাইসেন্সপ্রাপ্ত, সরকারের বিশেষ বাহিনীসমূহ যে কোনো নাগরিককে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করার অধিকারপ্রাপ্ত,সিভিল পোশাকের বিশেষ বাহিনী একজন নাগরিককে ধরে নিয়ে গুম বা পঙ্গু করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত। আমাদের চিন্তার স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা, লেখার স্বাধীনতা ও সরকারি দমন নীতিতে বিপর্যস্ত। সত্য কথা বলা, দেশের স্বার্থের পক্ষে বলা, দেশের শত্রুদের বিরুদ্ধে কথা বলা বা লেখা সরকারের দৃষ্টিতে অমার্জনীয় অপরাধ। এ জন্য লেখককে ও সাংবাদিককে প্রতিনিয়ত জানমালের নিরাপত্তাহীনতায় কালাতিপাত করতে হয়। বৈধভাবে সম্পদ অর্জনেও আমরা স্বাধীন নই। কেননা সম্পদ অর্জনের প্রচেষ্টায় দলীয় ও আমলাতান্ত্রিক বাধা। সরকারি, বেসরকারি চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজের অত্যাচার-নির্যাতন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। অর্জিত সম্পদ রক্ষায়ও আমরা স্বাধীন নই। চোর, ডাকাত, মাস্তান, লুটেরা ও একশ্রেণীর সরকারি লোক প্রতিনিয়ত অর্জিত সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে তৎপর থাকে। দলীয়করণ, আত্মীয়করণ, বিভিন্ন কোটা পদ্ধতি,আঞ্চলিকতা দুষ্ট নীতি ও দুর্বৃত্তের শাসনে জনগণ অন্ন-বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত। যোগ্য ব্যক্তির যোগ্য পদে চাকরি পাওয়ার ও প্রমোশন পাওয়ার স্বাধীনতা নেই। বর্তমানে সরকারি চাকরি পেতে হলে প্রথমত সরকারি দলের লোক হতে হয়,দ্বিতীয়ত ঘুষ দিতে হয়, প্রমোশন পেতে হলে শাসকদলের নিঃশর্ত আনুগত্য করতে হয় ওসকল অন্যায্য কাজে সহযোগিতা করতে হয়।সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দেশে ইসলাম ধর্মপালনের স্বাধীনতা নেই। বোরকা পরার অপরাধে শরীফ মহিলাদেরকে লাঞ্ছিত করে জঙ্গি অপবাদ দিয়ে জেলে পাঠানো হয়।নামাজী ছাত্রদেরকে মৌলবাদী অপবাদ দিয়ে হত্যা, নির্যাতন, গ্রেফতার, মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়। পবিত্র কোরআন-হাদীসকে জেহাদী বই আখ্যা দিয়ে রক্ষককে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। সৎ ধার্মিক ও নামাজী ব্যক্তিকে চাকরি থেকে ওএসডি/বরখাস্ত করা হয়। রাজনীতি করার স্বাধীনতাও বর্তমানে একেবারে সংকুচিত। শাসক দল ব্যতিত আর কেউ মিছিল/ মিটিং/ মানববন্ধন/ প্রতিবাদ সভা/ দলীয় সভা করতে সমর্থ নয়। রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনীকে/বিশেষ বাহিনীকে ভিন্মমতের রাজনীতি দমনে সকল অন্যায় পন্থা অবলম্বনের লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের নামে যে কাউকে জেল-জরিমানা করার অধিকার প্রদান করা হয়েছে। বর্তমানে সরকারি দল ব্যতীত অন্যান্যদের আত্মরক্ষা করার অধিকারও নেই। শাসক দল কাউকে হামলা করলে আত্মরক্ষার্থে কিছু করা যাবে না। কেউ যদি আত্মরক্ষার চেষ্টা করে তবে সে সরকারি বাহিনীর হামলার শিকার হবে, কর্তব্য কাজে বাধাদানের মামলার আসামি হবে, জেল-জুলুম-নির্যাতন-রিমান্ড, ক্রসফায়ারের সম্মুখীন হবে। এর জন্য আদালতে বিচার চাওয়া হবে আরও মারাত্মক। রাজনৈতিক মামলা হিসেবে গণ্য করে আক্রমণকারীকে মুক্তি দেয়া হবে, পুরস্কৃত করা হবে। যাতে সে দ্বিগুণ উৎসাহে পুনরায় হামলা পরিচালনা করে।রাষ্ট্রীয়ভাবেও এখন আমরা স্বাধীন নই। বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপে আমাদের পার্লামেন্ট স্বীয় সার্বভৌমত্ব হারিয়েছে, নিম্নমানের দলীয় লোককে বিচারপতি করে বিচার বিভাগকে বিতর্কিত-পঙ্গু ও আজ্ঞাবহ করা হয়েছে। আমাদের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নিকট সমর্পিত। সীমান্তে একতরফা কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আমাদের সীমান্তের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে প্রতিবেশী ভারত। আমাদের সেনাবাহিনী, বিডিআর ধ্বংস করা হয়েছে।আমাদের প্রতিরক্ষানীতি-পররাষ্ট্রনীতি ভারত-ইসরাইল-মার্কিন জোটের নিকট সমর্পিত। আমাদের অর্থনীতি, শেয়ারবাজার, ক্ষুদ্র-বৃহৎ শিল্প কারখানাকে পঙ্গু করা হয়েছে। আমাদের তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ-বন্দর-সীমান্ত-সমুদ্র-নৌপথ, নৌবন্দর, মহাসড়ক ও নিরাপত্তা আগ্রাসী শক্তির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। আমাদের মস্তক, দেহ, আত্মা সাম্রাজ্যবাদের জালে বন্দী। শুধু তামাটে দুটি চোখ এখনও উন্মুক্ত আছে, যা দিয়ে আমরা নিজেদের শবযাত্রাপ্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হচ্ছি।
উপরোক্ত আলোচনায় দেখা গেল আমরা এখন স্বাধীন নই। তবেকি আমরা ১৯৪৭ সালে ও ১৯৭১ সালে স্বাধীন হইনি। আমাদের বাপ-দাদারা বলে গেছেন, তারা দীর্ঘ ১৯০ বছর ইঙ্গ-হিন্দু শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করে কয়েক কোটি শহীদের বিনিময়ে আমাদেরকে বর্তমান ভূখণ্ডের মালিকানা প্রদান করেছেন। আমরা অহরহ বলছি আমরা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আমরা ১৯৪৭-এর স্বাধীনতার কথা, ১৪ আগস্টের কথা ভুলেও উচ্চারণ করতে রাজী নই। কেউ উচ্চারণ করলে তার টুটি চেপে ধরছি। তবে কি আমাদের বাপ-দাদারা-পরদাদারা মিথ্যুকছিলেন? উক্ত মিথ্যুকদের ঘরে আমরা কি ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির? একথা কি সত্য নয় যে, আমাদের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, শেখ মুজিবুর রহমানসহ অসংখ্য রাজনীতিবিদ ১৯৪৭-এর স্বাধীনতার মাধ্যমে অর্জিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন? পরাধীন কেউ কি দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী,গভর্নর, শিল্পমন্ত্রী হতে পারে? যদি না পারে তবে আমরা ’৪৭কে কেন ভুলে গেলাম? যে জাতি ১৯০ বছরের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ভুলে যায় সে জাতি কি স্বাধীন থাকতে সক্ষম? অথবা সে জাতির কি স্বাধীন থাকা উচিত? এমতাবস্থায় আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, ব্যক্তিক ও রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার শর্তাবলী মোতাবেক আমরা এখন স্বাধীন নই। তবে ১৯৪৭ থেকে ২০১১ সাল সময়কালের মধ্যে যেসময়ে আমাদের ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার রক্ষাকবচসমূহ বজায় ছিল সে সময়ে আমরা স্বাধীন ছিলাম। আমাদের সীমান্ত সুরক্ষিত ছিল, স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি ছিল, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ ছিল, আইনের শাসন ছিল।
আমাদের পরাধীনতায় নিমজ্জিত হওয়ার কারণসমূহ
১৭৫৭ সালের পলাশী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা আমাদের হাতছাড়া হওয়ার পর খুব দ্রুত ইঙ্গ-হিন্দু ও ক্ষমতালোভী মুসলমানদের ষড়যন্ত্রে ভারতবর্ষের মুসলিম শাসন ভেঙে পড়তে শুরু করে। দিল্লীতে থেকে শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী এ পতনের কারণ চিহ্নিত করেন ও উত্থানের রূপরেখা প্রণয়ন করে তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত দিল্লী মাদ্রাসার সিলেবাসকে নিজের রূপরেখা অনুযায়ী যুগোপযোগী করেন। তাঁর পরিচালিত মাদ্রাসার ছাত্ররাই পরবর্তী ১০০ বছর যাবত আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন। বাঙালী হিন্দু, শিখ, মারাঠা ও গুর্খাদের অসহযোগিতা ও ব্রিটিশদের পক্ষাবলম্বন করায় ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা হেরে যাই এবং চূড়ান্ত ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হই। পরবর্তীতে ধ্বংসস্তূপ থেকে মুসলমানদের উদ্ধার করার কর্মসূচি গ্রহণ করেন স্যার সাইয়েদ আহমদ খান ও মাওলানা কাসেম নানুতুবী। আমাদের প্রথম শক্তিকেন্দ্র দিল্লী মাদ্রাসার পতনের পর ধ্বংসস্তূপের মাঝে গড়ে উঠে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় ও দেওবন্দ মাদ্রাসা। ১৮৫৭-১৯৪৭ সময়কালে আমাদের নেতৃত্ব প্রদান করেন উক্ত দুই পাওয়ার হাউজের ছাত্র-শিক্ষকবৃন্দ। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হওয়ায় উক্ত দুইটি পাওয়ার হাউসকে সুকৌশলে আত্মিকভাবে নিষ্ক্রিয় করে ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকগণ। ১৯৪৭ সালে নতুন রাষ্ট্রের মালিক হয়ে আমাদের শাসকবৃন্দ ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বেখবর হয়ে পড়েন। ফলে আমাদের পাওয়ার হাউজ আমাদের জাতির জন্য শক্তি উৎপাদন না করে আমাদের জাতিসত্তা ধ্বংসের কাজে ব্যবহৃত হয়। এ চক্রান্তেই আমাদের ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা দ্বিখণ্ডিত ও শক্তিহীন হয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের পর থেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তাদের এদেশীয় দোসরগণ আমাদের জাতীয় পাওয়ার হাউজসমূহে অরাজকতা-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বর্তমানে দেশবিরোধী ও জাতিবিরোধী কাজে ব্যবহার করছে আমাদের জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ। ফলে জাতীয়ভাবে বর্তমানে আমরা নিষ্প্রাণ ও মৃত। আমাদের চোখের সামনে আমাদের স্বাধীনতা,সার্বভৌমত্ব, অস্তিত্ব, মর্যাদা,ভূখণ্ড - কেড়ে নিতে দেখেও আমরা চুপচাপ চেয়ে চেয়ে দেখছি।আমাদের সেনাবাহিনী এখন পঙ্গু। বিডিআর ধ্বংসপ্রায়। অন্যান্য বাহিনীসমূহকে আমাদের নিজেদের বাহিনী মনে করতে কষ্ট হয়।আমাদের রাজনীতিকগণ ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ ও পারিবারিক স্বার্থে নিমগ্ন। দেশের স্বার্থের প্রতি তারা উদাসীন। ক্ষমতা পেতে ও টিকে থাকতে তারা এখন মীরজাফরের পথ অনুসরণ করছে। আমাদের বিচারকগণ নিজেদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। আমাদের সংসদ অদূরদর্শী, অযোগ্য, দুর্নীতিবাজ ও অভদ্র ব্যক্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে মাছের বাজারে পরিণত হয়েছে। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের মস্তক সাম্রাজ্যবাদীদের নিকট বিক্রি করে দিয়েছেন। আমাদের ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে প্রবেশ করে রাজনীতিকে ব্যবসা-সফল করতে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে কুণ্ঠিত নন। দেশ না থাকলে যে ব্যবসা ও সম্পদ রক্ষা করা যাবে না সেকথা চিন্তা করার সময় বা যোগ্যতা তাদের নেই। আমাদের ধর্মনেতারা জিহাদ ভুলে গেছেন। তারা জালেম শাসককে আল্লাহর চেয়ে অধিক ভয় করে এবং ধর্মকে রুটি-রোজগারের মাধ্যমে পরিণত করেছে। এ জন্যই জাতীয় সংসদ প্রকাশ্যে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস’ মুছে দেওয়ার প্রকাশ্য কুফরী ঘোষণা দেওয়ার পরও আমাদের ধর্ম নেতাদের মধ্যে লক্ষ্যণীয় কোনো প্রতিবাদ নেই। এরূপ অবস্থায় স্বাধীন থাকার সকল যোগ্যতা হারিয়ে আমরা সর্বহারায় পরিণত হয়েছি। ফলে ১৭৫৭-১৯৪৭ সময়কালে আমাদের পূর্বপুরুষগণ যে কারণে লড়াই-সংগ্রাম করেছিলেন, ১৯৭১ সালে আমরা যে অধিকারের দাবিতে লড়াই-সংগ্রাম করেছিলাম বর্তমান পরিস্থিতি তার চেয়ে অধিক ভয়াবহ হওয়ার পরও আমরা প্রতিবাদ পর্যন্ত করছি না।
জাতীয় মানস বিভ্রান্ত ও নিস্তেজ হওয়ার কারণসমূহ
১. অস্তিত্বের মূল কারণ অস্বীকার করা :
আমাদের বর্তমান ভূখণ্ডটি দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা সূত্রে পাওয়া সত্ত্বেও আমরা ১৯৪৭কে ভুলে গেছি। ফলে ১৭৫৭-১৯৪৭ সময়কালের বন্ধুদের বন্ধুত্ব, শত্রুদের শত্রুতা, আমরা ভুলে গেছি। শত্রুদের শত্রুতা ভুলে গিয়ে আমাদের জাতশত্রু-স্বাধীনতার শত্রুকে বুকে টেনে নিয়ে আমরা আত্মহত্যা করেছি।
২. মিথ্যা বিকৃত ও খণ্ডিত ইতিহাস রচনা ও শিক্ষাদান :
বিগত ৬৪ বছর যাবত আমরা ইঙ্গ-হিন্দু রচিত মিথ্যা ইতিহাস, বিকৃত ও খণ্ডিত ইতিহাস পড়ছি। সরকারের তরফ থেকে কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে ইঙ্গ-হিন্দু রচিত উদ্দেশ্যমূলক ইতিহাসের মিথ্যা জঞ্জাল অপসারণের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। আমাদের পেশাদার ঐতিহাসিকগণ অনুবাদের মাধ্যমে মিথ্যা ইতিহাসের প্রসার ঘটিয়েছেন কিন্তু সঠিক ইতিহাস অনুসন্ধান করে তা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করেননি। ফলে মিথ্যা ও ভেজালের উপর আমাদের জাতীয় মানস গঠিত হয়েছে। বর্তমানে আরও একটি উপসর্গ এতে যুক্ত হয়েছে, আর তা হলো শাসক দলের ইচ্ছানুযায়ী ইতিহাস পরিবর্তন করা। ফলে জাতি আজ বিভ্রান্ত ওবহুধাবিভক্ত।
৩. যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু না করা :
আমরা বিগত ৬৪ বছরেও জাতির জন্য কোনো বাস্তবধর্মী, যুগোপযোগী ও
প্রাগ্রসর চিন্তার শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে সক্ষম হইনি।ঔপনিবেশিক আমলের শিক্ষা ব্যবস্থার অনুকরণ ও সাম্রাজ্যবাদী প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের মাধ্যমে আমরা জাতিকে সাম্রাজ্যবাদী ফাঁদে আটকে ফেলেছি। ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থা ও সাম্রাজ্যবাদ নির্দেশিত শিক্ষা ব্যবস্থা যে স্বনির্ভর দেশ ও জাতিগঠনের অন্তরায় এবং স্বাধীন মানস গঠনের প্রতিবন্ধক তা চিন্তা করার সময়, সুযোগ ও যোগ্যতা আমাদের তথাকথিত নেতৃবৃন্দের নেই।
৪. ধর্ম, ইতিহাস/সাহিত্য/রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান শিক্ষাকে
গুরুত্ব না দেয়া :
আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও শিক্ষাবিদগণ সঠিক ইতিহাস পাঠের গুরুত্ব, ধর্মজ্ঞানের গুরুত্ব, জাতির মানস গঠনোপযোগী কবিতা, সাহিত্য, নাটক, সিনেমা রচনা ও প্রদর্শনের গুরুত্ব, সঠিক রাজনীতি শিক্ষার গুরুত্ব ও সমাজেরগতিপ্রকৃতি নির্ধারণে সমাজবিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব সম্যক উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন, উদাসীন থেকেছেন অথবা অদৃশ্য কারণে অবহেলা করেছেন। ফলে স্বাধীন দেশের উপযোগী নাগরিক সৃষ্টিতে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে। তদুপরি উপরোক্ত ৫টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের শিক্ষার্থীরা ব্যবহারিক জীবনে সীমাহীন অবহেলার শিকার হয়। ফলে মেধাবীরা উক্ত বিষয় থেকে দূরে থাকে। অথচ ধর্ম, ইতিহাস, সাহিত্য, রাজনীতি ও সমাজ বিজ্ঞানের সঠিক জ্ঞান ব্যতীত অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষিত ব্যক্তিরা স্ব স্ব বিষয়ে কর্মসম্পাদনের রোবট ব্যতীত অন্য কিছু নয়। আমাদের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের অবস্থা আরও করুণ। এসব প্রতিষ্ঠান শিক্ষাদান অপেক্ষা শিক্ষা ব্যবসাকে গুরুত্ব দিয়েছে এবং নিজেদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসব বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করেনি।ফলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে কিছু রোবট তৈরি হচ্ছে, দেশপ্রেমিক সুনাগরিক তৈরি হচ্ছে না। দেশপ্রেমিক নাগরিক সৃষ্টিতে উক্ত ৫টি বিষয় অপরিহার্য। সর্বনাশের এখানেই শেষ নয়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ও সিলেবাসকে যুগোপযোগী করা হয়নি। ফলে শিক্ষার্থীরা আধুনিক ও প্রাগ্রসর যুগের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ। একটি মাত্র উদাহরণ দিলে বিষয়টি সুস্পষ্ট হবে। উদাহরণটি হলো- আমাদের স্নাতক পর্যায়ের রাজনীতি বিজ্ঞানে রয়েছে, “মার্কিন প্রেসিডেন্ট পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি।” অথচ বাস্তব জ্ঞানের অধিকারীরা জানেন,“মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদী লবির পুতুল মাত্র। এই দুই শক্তির অনুমোদন ব্যতীত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা প্রয়োগে অক্ষম।” এমতাবস্থায় আমাদের শিক্ষার্থীরা ভুল ও অনুপযোগী শিক্ষা লাভ করে জাতির বোঝায় পরিণত হচ্ছে। আমাদের রাজনীতি বিজ্ঞানের ছাত্ররা বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তারকারী ইহুদী ষড়যন্ত্র ‘Protocol of the Elders of the Zion.’, মনরো ডকট্রিন, আইসেন হাওয়ার ডকট্রিন, ইন্ডিয়া ডকট্রিন সম্পর্কে জানে না এমনকি অনেকে এ সকল শব্দ সম্পর্কেও অজ্ঞ। এমতাবস্থায় সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত সম্পর্কে তারা নিজেরাও জানে না, জাতিকে সজাগ করবে কিভাবে? আমাদের রাজনীতিকদের অবস্থাও একইরূপ। ফলে সাম্রাজ্যবাদ আমাদের চতুর্দিকে কঠিন বেষ্টনী তৈরি করার পরও জাতি হিসেবে আমরা বেখবর ও নীরব দর্শক।
১৭৫৭ ও বর্তমান অবস্থা একই হলেও পরিণাম ভিন্ন হবে-
১/১১’র পর পর বিভিন্ন বক্তৃতায় ও প্রবন্ধে আমি ১/১১কে পলাশী চক্রান্তের পুনরাবৃত্তি ও মইন-উ-আহমদকে হিডেন মীরজাফর আখ্যা দিয়েছিলাম। কিন্তু তখন অনেকে আমার কথা বিশ্বাস করেননি।মাত্র কয়েক বছর পরেই এ দেশের প্রায় সবাই চলমান ঘটনাবলীকে পলাশী ষড়যন্ত্র বলা শুরু করেছেন। বাস্তবে যে সকল শক্তি মুসলমানদের হাত থেকে ভারতবর্ষের সিংহাসন কেড়ে নেয়ার জন্য ১৭৫৭ সালের পলাশী ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়ন করেছিল একই শক্তির উত্তরসূরিরা ২০০৭ সালে ১/১১ ষড়যন্ত্র করেছে মুসলমানদের হাত থেকে বাংলাদেশের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে ইসলামবিদ্বেষী মুসলমান নামধারী ও হিন্দুদেরকে ক্ষমতাসীন করার জন্য। তারা আপাতত সফল হলেও দীর্ঘমেয়াদে বা চূড়ান্ত পর্যায়ে তাদের বর্তমান চক্রান্ত ব্যর্থ হবে। এর কারণ এই যে, ১৭৫৭ সময়কালে বিশ্বব্যাপী মুসলিম শক্তির পতনের সূচনা হয়েছিল, মুসলমানরা বিভিন্ন কুসংস্কারে নিমজ্জিত হয়ে নিজেদের স্বকীয়তা হারিয়েছিল এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতায় এক দেশের মুসলমানদের বিপদে অন্য দেশের মুসলমানরা সহযোগিতা করতে সক্ষম ছিল না। তদুপরি ১৭৫৭ সালের ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তি ও ইউরোপীয় শক্তি ছিল উদীয়মান শক্তি; পক্ষান্তরে বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আমেরিকা, ইসরাইল ও ইইউ ক্ষয়িষ্ণু শক্তি। আফগান, ইরাক ও ফিলিস্তিনের রণাঙ্গনে তারা পরাজিত হয়েছে। অন্য কোনো রণাঙ্গনেও তাদের বিজয়ের আশা ক্ষীণ। বরঞ্চ যুদ্ধের ব্যয় মেটাতে গিয়ে তাদেরকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাগ্য বরণ করতে হবে। এমতাবস্থায় পতনোম্মুখ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বর্তমান দোসর ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতকে তার বর্তমান মিত্রদের ভাগ্য বরণ করতে হবে।পক্ষান্তরে বিশ্বব্যাপী মুসলিম শক্তি এখন উদীয়মান।আফগানিস্তানে, ইরাকে, ফিলিস্তিনে, লেবাননে তারা বিশ্বশক্তিকে হারিয়ে নিজেদের সামর্থ ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। তিউনিশিয়া ও মিশরে সাম্রাজ্যবাদের দালাল সরকার উৎখাতে সক্ষম হয়েছে।পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ শক্তি হয়েও ক্ষুদ্র চেচেন মুসলিম জাতির নিকট রাশিয়া অদ্যাবধি নাকানি-চুবানি খাচ্ছে। সর্বক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, সঠিক নেতৃত্বের আহ্বানে মুসলিম যুবকরা পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত হতে এসে জড়ো হয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। মুসলমানদের বর্তমান বিশ্বভ্রাতৃত্ব বোধের নিকট পৃথিবীর অপরাপর আগ্রাসী জাতিসমূহ পরাজিত হতে বাধ্য। সুতরাং ১৭৫৭ সালে ষড়যন্ত্রকারীরা যা করতে পেরেছিল, বর্তমানে তা করা সম্ভব নয়। বরং বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদীরা যা করতে চাইছে তার পরিণাম তাদের জন্য বুমেরাং হবে। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশে আগ্রাসন পরিচালনা করলে পেন্ডোরার বাক্স খুলে যাবে, কোটি কোটি মুজাহিদ তৈরি হবে, বর্তমান নেতৃত্ব ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে এবং নতুন নেতৃত্ব জাতিকে সংগঠিত করে আগ্রাসী শক্তির শক্তিকেন্দ্রে আঘাত হেনে চুরমার করে দেবে। সমগ্র ভারতে আমরা পুনরায় স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করব। ভারতবর্ষের নির্যাতিত, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত মুসলমান, হরিজন ও দলিত জনগোষ্ঠী আমাদের স্বাগত জানাবে।
চট্টগ্রাম, ২৪ জুন ২০১১
সম্পাদক মাসিক ইতিহাস অন্বেষা
০১৭১১৭২০৯২৩
No comments:
Post a Comment