দৃশ্যপট-১
মহাজ্ঞানী ঈশপের গল্প দিয়েই শুরু করছি। গল্পটি হলো- বনে বাস করত এক কাঠুরিয়া, তার ছিল এক অপরূপ সুন্দরী কন্যা। পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে বাস করত এক বাঘ। এক সময় কাঠুরিয়ার সুন্দরী কন্যাকে বিয়ে করার লোভ জাগলো তার মনে। একদিন সে ভালো সাজার ভান করে কাঠুরিয়ার দুয়ারে এসে কাঠুরিয়ার সুন্দরী কন্যার পাণিপ্রার্থী হলো। কাঠুরিয়া দেখল- হিংস্র বাঘকে না করলে প্রাণহানির শঙ্কা রয়েছে। এমতাবস্থায় সে মনে মনে বুদ্ধি এঁটে বাঘকে বলল- তোমার নিকট আমার মেয়েকে বিয়ে দিতে কোনো আপত্তি নেই তবে আমার মেয়ে তোমার তীক্ষ্ণ দাঁত ও ধারালো নখকে ভয় করে। তুমি যদি তোমার দাঁত ও নখকে ফেলে দাও তবে আমি আমার মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিব। লোভী ও অপরিণামদর্শী বাঘ কালবিলম্ব না করে নিকটস্থ পাথুরে পাহাড়ে গিয়ে নিজের প্রধান ২টি অস্ত্র দাঁত ও নখকে পাথরের সাথে আঘাত করে করে উপড়ে ফেলে কাঠুরিয়ার মেয়ের পছন্দসই অবয়বে কাঠুরিয়ার বাড়িতে এসে কাঠুরিয়াকে বলল- “আব্বাজান, আপনার কথামতো আমি আমার দাঁত ও নখকে উপড়ে ফেলেছি। সুতরাং এখন আপনার মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিন।” কাঠুরিয়া ঘরের ভিতরে ঢুকে মস্ত বড় এক কুঠার নিয়ে বেরিয়ে এসে বাঘের উপর হামলা করল। দন্ত-নখরহীন বোকা বাঘ অল্পক্ষণের মধ্যেই ভবলীলা সাঙ্গ করল।
দৃশ্যপট-২
১৭৫৭ সালে শুধুমাত্র সিংহাসনের লোভে বোকা লোভী ও অদূরদর্শী মীরজাফর দেশপ্রেমিক সিরাজকে অপসারণ ও হত্যা করে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসন দখল করে। সিংহাসন দখলের পর কাঠুরিয়ারূপী ইঙ্গ-হিন্দু চক্রান্তকারীদের পরামর্শে ও সহযোগিতায় সিরাজের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ভেঙে দেয় এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিকদের হত্যা-বন্দী ও বিতাড়ন করে ইঙ্গ-হিন্দুদের পুতুলে পরিণত হয়। নিজ সম্প্রদায়কে নিঃশেষ করে, নিজ জনগণকে নির্যাতন করে জনগণের আস্থা হারায়।এমতাবস্থায় তার সহযোগী ও কন্যা জামাতা মীর কাশিম ইংরেজদেরকে প্রচুর ঘুষ দিয়ে এবং হুগলি ও চট্টগ্রাম বন্দর দেওয়ার গোপন ওয়াদা করে শ্বশুরের স্থলে নিজে সিংহাসনে আরোহণ করেন। কাজ সমাধা হওয়ায় ইংরেজরা বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরকে টয়লেট পেপারের মতো ছুড়ে ফেলে দেয়।১৭৬০ সালে তথাকথিত নবাব মীর কাশিম ক্ষমতাসীন হয়ে গোপন ওয়াদা মোতাবেক চট্টগ্রাম ও হুগলি বন্দর ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়। চট্টগ্রামের দখল বুঝে নেওয়ার পর ইংরেজরা দেখল- চট্টগ্রাম শহরের পাঠানটুলির পাঠানগণ ইংরেজদের অধীনতা মেনে নিতে রাজি নয়। এমনকি পাঠানদের এলাকায় কোনো ইংরেজ ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে পথ চলতেও সক্ষম ছিল না। পাঠানদের এলাকা অতিক্রম করার সময় তাদেরকে ঘোড়া থেকে নেমে পায়ে হেঁটে চলতে হতো। ২-৩ বছর পর চট্টগ্রামের ইংরেজ শাসক অত্যন্ত বিনয়ের সাথে পাঠানদেরকে তাদের বড়দিনের উৎসবের ভোজসভায় দাওয়াত করে। সকল পাঠান পুরুষ উক্ত ভোজসভায় অংশ নিতে চট্টগ্রামের চকবাজারস্থ প্যারেড ময়দানে স্থাপিত প্যান্ডেলে যায়। পাঠানরা প্যান্ডেলে ঢুকতেই ইংরেজদের বাবুর্চি, খানসামা, টেবিল বয়রা দিগ¦বিদিক ছুটোছুটি করে পালিয়ে যায়। ইংরেজ কর্তৃপক্ষ তখন পাঠানদেরকে জানায়, আপনাদেরকে সশস্ত্র অবস্থায় দেখে আমার কর্মচারীরা ভয়ে পালিয়েছে। আপনারা যদি আপনাদের সাথে থাকা অস্ত্রশস্ত্র প্যান্ডেলের বাইরে রিসিপশনে জমা রাখেন তবে বাধিত হবো। পাঠানরা সরল মনে নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র রিসিপশনে জমা রেখে প্যান্ডেলের ভিতর প্রবেশ করে। পর মুহূর্তেই ইংরেজ সেনারা নিরস্ত্র পাঠানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রত্যেককে নৃশংসভাবে হত্যা করে। একই সময়ে তাদের বসতবাড়ি পাঠানটুলিতেও অপর একদল ইংরেজ সেনা হামলা করে নারী-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সবাইকে হত্যা করে। এতদসত্ত্বেও এক গর্ভবতী পাঠান গৃহবধূ পালিয়ে হাটহাজারীগিয়ে আত্মগোপন করে। তাঁর গর্ভে একপুত্রসন্তান জন্ম নেয়। বর্তমান পাঠানটুলিরপাঠানগণ উক্ত সন্তানের ওলি-ওয়ারিশ।
দৃশ্যপট-৩
দীর্ঘ ১৯০ বছর আমাদের পূর্ব পুরুষগণ ইঙ্গ-হিন্দু ষড়যন্ত্রকারীদের শাসন শোষণ ও আক্রমনে আহত নিহত পঙ্গু ও দীপান্তরিত হয়ে বিশাল ভারতের দুই প্রান্তে দুই ভূখণ্ডের মালিকানা অর্জনকরে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেনের দোসর ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতীয় শাসকগণ কখনো আমাদের উক্ত স্বাধীনতাকে মেনে নেয়নি।মুসলমানদের অবিসংবাদিত নেতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে ১৫ই আগস্ট ১৯৪৭ সালেই হত্যা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। মি. জিন্নাহ ও লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন পূর্বাহ্নেই বিষয়টি জানতে পারায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ফলে কোনো অনাকাংখিত ঘটনা ছাড়াই মি. জিন্নাহ পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রথম গভর্নর জেনারেল হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। এরপর শুরু হয় নতুন নিয়মে পুরাতন খেলা। নবপ্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের শুরু থেকে ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারত কিছু সংখ্যক অর্থ ও ক্ষমতালোভী পাকিস্তানীদের দিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করে। উক্ত রাজনৈতিক দলটি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের এদেশীয় সদস্যদেরকে নিজেদের দলে আত্মীয়করণ করে।মুসলিম স্বার্থের রক্ষাকবচ পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা তুলে দেয়া হয়।এরপর শুরু হয় পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল ও দুর্বল করে টুকরো করার খেলা। কাঠুরিয়া যেভাবে সুন্দরী মেয়ের লোভ দেখিয়ে বাঘকে শক্তিহীন করেছিল ঠিক তদ্রুপ ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তি এ দলটিকে বাংলার সিংহাসনের লোভ দেখিয়ে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা সামর্থ্য ধ্বংস করার কাজে লাগায়। এদের কারণেই সংসদে স্পিকার নিহত হয়, এর অজুহাতে সেনাশাসক আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে। এ দলটি সূচনালগ্ন থেকেই দ্বিমুখী আচরণে অভ্যস্ত। এরা দিনের বেলায় সামরিক শাসনবিরোধী বক্তৃতা দিত আর রাতের আঁধারে সামরিক শাসক আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়া খানকে সাহায্য করত। এ দলটিই এরশাদের ক্ষমতা দখলকে অভিনন্দন জানিয়েছে, জেনারেল নাসিমকে ক্ষমতা দখলে উস্কানি দিয়েছে এবং জেনারেল মইন উ আহমদকে দিয়ে ১/১১-এর মাধ্যমে এ দেশকে সাম্রাজ্যবাদের পদতলে বলি দেয়ার আয়োজন করেছে এবং বাংলার সিংহাসনে আসীন হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। তাদের লক্ষ্য সিংহাসন- দেশ ও জনগণ নয়।
<b>দৃশ্যপট-৪</b> ১৯৭১ সালে বাংলার সিংহাসনের লোভ দেখিয়ে পাকিস্তান ভাঙা হলো। পূর্ব পাকিস্তান হলো বাংলাদেশ। পাকিস্তানের ২৪ বছরে অর্জিত সম্পদ ভারতে পাচার হয়ে গেল। দেশব্যাপী দুর্ভিক্ষ ও অরাজকতায় লক্ষ লক্ষ লোক আহত নিহত ও পঙ্গু হলো। নতুন দেশকে ৭ দফার রশি ও ২৫ দফার রশি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে ফেলা হলো। সিংহাসন লোভী শাসনকর্তাকে পরামর্শ দেয়া হলো- কাশ্মীরের ফারুক আব্দুল্লাহর মতো বংশানুক্রমিক ক্ষমতায় থাকতে চাইলে তোমার আমার বিরোধী শক্তিকে উপড়ে ফেলতে হবে। তবেই তোমার আমার বন্ধুত্ব ও মিত্রতা ষোলকলায় পূর্ণ হবে। দেশপ্রেমিক বাঘদের দন্ত-নখর উপড়ে ফেলার জন্য রক্ষীবাহিনী গঠন করে হাজার হাজার দেশপ্রেমিককে হত্যা-নির্যাতন বন্দি করা হলো। দেশ শক্তিহীন ও মুমূর্ষু অবস্থায় উপনীত হলো। কোনোমতে প্রাণটি টিকে রইল।
<b>দৃশ্যপট-৫</b>
২৪ বছরে পাকিস্তান ভাঙা সম্ভব হলেও ৩৪ বছরেও বাংলার বাঘদের দমন করা গেল না। তদুপরি ২০০১ সালে পুনরায় বাঘকুল ক্ষমতাসীন হলো। চানক্যবাদীরা মহা ফাঁপরে পড়ল। তারা দেখল এ চীজ একা হজমযোগ্য নয়। সুতরাং ১৭৫৭-এর পলাশী থেরাপী প্রয়োগ করা হলো। ইউরোপ-আমেরিকা-ইসরাইল-অস্ট্রেলিয়াকে দলে ভিড়ান হলো। অর্থ ও সিংহাসনলোভী দলটিকে বিপুল অর্থ দিয়ে বলা হলো-তোমার দেশের দাঁত উপড়ে ফেলতে পারলে তোমাকে সিংহাসন দেয়া হবে। সিংহাসন পাওয়ার পর তোমার দেশের নখসমূহ উপড়ে ফেলতে হবে এবং ১৭৬০ সালে মীর কাশিম যেভাবে সড়ক-বন্দর-বাণিজ্য ইংরেজদের প্রদান করেছিল তেমনি আমাকে উক্ত বস্তুসমূহ প্রদান করতে হবে। তবেই তুমি সিংহাসনে চিরস্থায়ী হতে পারবে এবং তোমার-আমার বন্ধুত্ব ষোলকলায় পূর্ণ হবে।বলাবাহুল্য ২০০৬ সাল পর্যন্ত আমাদের ৩টি শক্তিশালী দাঁত ছিল এবং বেশ কয়েকটি ধারালো নখর ছিল। উক্ত দাঁতসমূহ হলো আমাদের সেনাবাহিনী, সংবিধান ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ। আর নখরসমূহ হলো- আমাদের জাতির সাহসী, সৎ ও অভিজ্ঞ রাজনীতিকগণ।বর্তমানে আমাদের দাঁতসমূহ উপড়ে ফেলা হয়েছে আর নখরসমূহ বন্দি-আহত এবং নির্বাসনে। এমতাবস্থায় কাঠুরিয়ার হস্তে নিহত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।
সিংহাসনের স্বপ্ন এবং রাজনীতির শবযাত্রা
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন প্রধানত ৪টি টিমে বিভক্ত। প্রমটি ‘এ’ টিম, ২য়টি ‘বি’ টিম, তৃতীয়টি জে-১ টিম, ৪র্থটি জে-২ টিম। উক্ত ৪টি টিমের কার্যকলাপে দেশ ও দেশের রাজনীতি বর্তমানে শ্মশানে মুখাগ্নির অপেক্ষায় অপেক্ষমান। দেশের জনগণ শোকাহত ও নীরব শবযাত্রী। এ-টিম বংশানুক্রমে সিংহাসন ধরে রাখার স্বপ্নে বিভোর, বি টিম নিকট ভবিষ্যতে সিংহাসন পাওয়ার খোয়াব দেখছে এবং জে-১ টিম সিংহাসনের আশপাশে স্থান পাওয়ার দিবাস্বপ্ন দেখছে আর জে-২ টিমকে অতীতের দুঃস্বপ্ন তাড়া করছে। প্রত্যেকের কার্যকলাপ ব্যক্তি ও দলকেন্দ্রিক দেশ ও জনগণকেন্দ্রিক নয়। প্রত্যেক টিমের বর্তমান কার্যকলাপ নিম্নরূপ :
এ-টিম : এই টিমটি জন্মলগ্ন থেকেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আশীর্বাদপুষ্ট। এই টিমটি সূচনালগড়ব থেকেই অর্থ ও ক্ষমতালোভী নীতি-নৈতিকতাহীন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত। সাম্রাজ্যবাদীরা বিগত ৬০ বছর যাবত দলটিকে গোপনে ও প্রকাশ্যে সহায়তা দিয়ে দেশে অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, অন্যায়-অপকর্মের বিস্তার ঘটিয়ে বর্তমানে দেশকে অস্তিত্বের সংকটে নিমজ্জিত করেছে। এ দলটির দ্বারা দেশের শান্তি, স্থিতিশীলতা, উনড়বয়ন, সমৃদ্ধি, মর্যাদা ও প্রতিরক্ষা সামর্থ ধ্বংস করা হয়েছে। <b>যা কিছু দেশের জন্য উত্তম এরা তার বিরুদ্ধাচরণ করে ও আক্রমন করে ধ্বংস করে। বর্তমানে এদের চতুর্মুখী আক্রমনে দেশের বিচার ব্যবস্থা, সংবিধান, প্রশাসন, সেনাবাহিনী, বিডিআর ও পুলিশ বাহিনী ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। এ দলের রাজনীতিক, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, অধ্যাপক, ডাক্তার, কবিরাজ, শিক্ষক, ছাত্র, আমলা, পুলিশ, সেনাকর্মকর্তা ও সুশীল সমাজের চরিত্রের মধ্যে ও আচরণের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এরা প্রত্যেকেই স্ব-স্ব পেশার লোকদেরকে ভীতসন্ত্রস্ত ও আতঙ্কিত করে দেশের সর্বনাশ সাধন করছে। এদের অন্যায় কার্যকলাপে দেশের ও সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধি অপসৃত।
দেশের সীমান্ত ও সার্বভৌমত্ব অপসৃত প্রায়।</b> এ দলটি বর্তমানে নিজেদের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার স্বপ্নে বিভোর। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদেরকে চিরস্থায়ীভাবে সিংহাসন দখলে রাখার খোয়াব দেখাচ্ছে। ফলে সাম্রাজ্যবাদের গোপন ইশারায় এরা দেশের প্রতিরোধ সামর্থকে, সৎ যোগ্য দেশপ্রেমিক ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে ধ্বংস করার কাজে লিপ্ত রয়েছে। লোভী ও বোকা বাঘ যেভাবে নিজের প্রতিরক্ষা সামর্থ্য দাঁত ও নখকে উপড়ে ফেলে কাঠুরিয়ার কুঠারের খাদ্যে পরিণত হয়েছিল এরাও তদ্রুপ নিজ দেশের সামর্থ্য ও সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে বোকা বাঘের পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
বি-টিম : এই টিমটির জন্ম হয়েছিল ‘এ’ টিমের দেশবিরোধী কার্যকলাপের প্রতিবাদের মাধ্যমে। এ টিমের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দেশপ্রেমিক, সৎ ও দূরদর্শী ব্যক্তিত্ব। তাঁর অবর্তমানে যারা এ দলের হাল ধরেছেন তারা প্রতিষ্ঠাতার নাম ভাঙিয়ে দীর্ঘদিন দেশের মানুষের ভালোবাসা পেয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, এ দলের নেতাকর্মী বা শীর্ষ ব্যক্তিদের মাঝেও প্রতিষ্ঠাতার চরিত্র, আদর্শ ও দূরদর্শীতা নেই। প্রতিষ্ঠাতার আদর্শের কথা বলে এরা গর্ব করে কিন্তু আদর্শ কি ছিল- আপনাদের সাথে উক্ত আদর্শের বাস্তব সম্পর্ক আছে কি-না প্রশ্ন করলে এদের বলার মতো কিছু থাকে না। এমতাবস্থায় জনগণের দৃষ্টিতে এরা দেউলিয়াপ্রায়। জনগণ দেখছে এরা ব্যক্তি ও পরিবারের স্বার্থকে দেশের স্বার্থের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। তাদের চোখের সামনে ‘এ’ টিম দেশের সকল সম্পদ ও সম্ভাবনা সাম্রাজ্যবাদের নিকট তুলে দিচ্ছে দেখেও এরা নিশ্চুপ। সম্ভবত এরা এই খোয়াব দেখছে যে, সাম্রাজ্যবাদ যেভাবে এ টিমকে বাংলার সিংহাসন পাইয়ে দিয়েছে তদ্রুপ তাদেরকেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সিংহাসনটি পাইয়ে দেবে। তারা একবারও চিন্তা করছে না যে- সাম্রাজ্যবাদের পুতুল হয়ে সিংহাসন পেলেও ক্ষমতা পাওয়া যায় না, রাজ্য পেলেও রাজত্ব করা যায় না, দেশ ও জনগণের উনড়বতি করা যায় না।‘বি’ টিমের প্রতিষ্ঠাতা দেশের সকল সেক্টর থেকে, দল থেকে দেশপ্রেমিকদের জড়ো করে দল গঠন করেছিলেন, দলের নেতাকর্মীদের আদর্শের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দলকে ও দেশকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান নেতৃত্ব বাছবিচারহীনভাবে দল বড় করেছেন, টাকার বিনিময়ে নমিনেশন ও দলীয় পদবি বিক্রি করে দলকে অস্ট্রেলিয়ান গাভীর ন্যায় বড় করেছে কিন্তু শক্তিশালী করার পরিবর্তে দুর্বল করেছেন। এ দলের বর্তমান নেতৃত্ব সাম্রাজ্যবাদের আশীর্বাদপুষ্ট ব্যক্তিদেরকে নিজের চারপাশে দেখতে পছন্দ করেন- স্বাধীনচেতা-দূরদর্শী ও যোগ্য নেতৃবৃন্দকে বৃত্তের বাইরে রাখতে পছন্দ করেন। বি টিমের বর্তমান নেতৃত্ব স্বজনপ্রীতিআত্ম ীয়করণ আঞ্চলিকীকরণের মাধ্যমে দলকে ও দেশকে দন্ত-নখরহীন বাঘে পরিণত করেছেন। ফলে এ দলটি বর্তমানে বাঘের মতো হুংকার দিতে পারলেও শিকার করতে পারে না।
জে-১ টিম : ‘এ’ টিম নিজ দেশে জনপ্রিয়তা হারিয়ে বিপর্যস্ত হলে একই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি জে-১ টিম গঠন করে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও জে-১ টিম এর সহযোগিতায় ‘এ’ টিম শক্তিশালী হলে জে-১ টিম পরিত্যক্ত হয়। তখন থেকে এই টিমটি নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতার আশপাশে থাকার প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। দেশ, দেশের জনগণ ও দেশের স্বার্থ এ দলের বিবেচনার মধ্যে আছে বলে মনে হয় না। এ দলের প্রধানের চরিত্র ও আদর্শ তরল পদার্থের ন্যায়- যখন যে পাত্রে রাখা হয় তখন সে পাত্রের আকার ও রং ধারণ করে। দেশের স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখা এ দলের নিকট থেকে আশা করা যায় না।
জে-২ টিম : এটি বাংলাদেশের আদর্শিক টিম হিসেবে পরিচিত। এদের কর্মসূচি কর্মপদ্ধতিতে আদর্শিক ছাপ রয়েছে কিন্তু আদর্শের পরিপূর্ণ বিকাশ নেই। এরা আল্লাহ সর্বশক্তিমান বলে প্রচার করে কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ ও অবিচল আস্থাসমৃদ্ধ কার্যক্রম এরা গ্রহণ করে না। এরা সর্বদাই অপরের উপর নির্ভরশীল হয়ে লতার মতো বাঁচতে চায়। নিজের পায়ে দাঁড়াবার মতো সাহস হিম্মত ঈমানী দৃঢ়তা এদের মধ্যে দেখা যায় না। ঈমানী চেতনা সম্পন্ন জিহাদী বক্তৃতায় এরা পারদর্শী কিন্তু বাস্তব জিহাদ থেকে নিজেদের দূরে রাখতে সদাসর্বদা তৎপর। সকল ক্ষেত্রে এরা হিকমত অবলম্বনের কথা বলে। হিকমত করতে করতে এরা নিজেদের দলকে ঢোঁড়া সাপের মতো নির্বিষ করে ফেলেছে, পিছাতে পিছাতে নিজেদেরকে ব্ল্যাকহোলের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। দেশের স্বার্থে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত তারা নেয় কিন্তু নিজেরা সম্মুখ সারিতে থাকতে রাজি নয়। সৎ যোগ্য দূরদর্শী সাহসী লোককে এরা পছন্দ করে কিন্তু নিজ দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে এ ধরনের লোককে সম্পৃক্ত করতে এরা দ্বিধাগ্রস্ত। এখানেও নাকি তাদের কায়েমী স্বার্থ রক্ষার হিকমত ক্রিয়াশীল। এ দলের বিভিন্ন ইউনিটের দায়িত্বশীলদের দেখলে করুণা হয় এবং ছোটবেলায় পড়া সুকুমার রায়ের কবিতাটি মনে পড়ে যায়। কবিতাটি হলো-
“বাবুরাম সাপুড়ে
কোথা যাস বাপুরে
আয় বাবা দেখে যা
দুটো সাপ রেখে যা।
যে সাপের সিং নেই- চোখ নেই
ছোটে নাকো হাঁটে না- কাউকে যে কাটে না
করে নাকো ফোঁস ফাঁস- মারে নাকো ঢসুঁ ঢাস।
সেই সাপ জ্যান্ত- গোটা দুই আনতো,
তেরে মেরে ডাণ্ডা- করে দেব ঠাণ্ডা।”
বিদ্যমান নেতা যৌক্তিক-অযৌক্তিক যা বলেন, তাই অবনত মস্তকে মেনে নেয়ার জন্যই নাকি তাদের এরূপ নির্বীষ সাপ পছন্দ। অথচ ইসলামের ২য় খলিফা হযরত উমর বলতেন- যখনই আমি কোনো অযৌক্তিক কথা বলব অথবা ভুল সিদ্ধান্ত নেব তখনই আপনারা (জনগণ) প্রকাশ্যে আমাকে সতর্ক করবেন এবং ভুল শুধরে দেবেন। এ শিক্ষার ফলেই একদিন হযরত উমর (রা.) মসজিদে খুতবা দিতে দাঁড়ালে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলেন-“আমরা সবাই যে পরিমাণ কাপড় বায়তুল মাল থেকে পেয়েছি আপনি তার দ্বিগুণ কাপড় কিভাবে পেলেন? আমার এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আপনি খুতবা শুরু করবেন না।” পক্ষান্তরে এ টিমের নেতার বক্তৃতা কোনো কর্মী যদি থামিয়ে দেয়ার দুঃসাহস করে তবে নির্ঘাত উক্ত কর্মীকে সাথে সাথে বহিষ্কার করা হবে। দুর্বল ও ভীরু সেনাপতির নেতৃত্বাধীন বিশাল সেনাবাহিনী যেরূপ দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থ রক্ষায় অক্ষম- তদ্রুপ এই টিমের বর্তমান অবস্থা। এই টিমটির মানসিক অবস্থা এমন যে, তারা বাংলার সিংহাসনের আকাংখা স্বপ্নেও দেখে না। অতীতের দুঃস্বপ্ন তাদেরকে তাড়িয়ে ফিরছে। তারা বুলন্দ আওয়াজে এ সত্য কথাটি বলতে সক্ষম নয় যে, অতীতে আমরা দেশের অখণ্ডতার পক্ষে ছিলাম এই জন্য যে, দেশ খণ্ডিত হলে আমরা দুর্বল হয়ে পড়ব এবং সাম্রাজ্যবাদী শকুনের খাদ্যে পরিণত হবো। তদুপরি উক্ত অখণ্ড- দেশটি আমাদের মহান পূর্ব পুরুষদের ১৯০ বছরের রক্ত-ঘাম ও শ্রমের ফসল। দীর্ঘ ৪০ বছর পর আমাদের সন্দেহ ও আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হতে চলেছে। সুতরাং আমাদের অতীতের ভূমিকা সঠিক ছিল এবং দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সমৃদ্ধি মর্যাদা ও অখণ্ডতার পক্ষে ছিল। উপরোক্ত আলোচনায় আমরা দেখতে পেলাম বাংলাদেশের রাজনীতিকদের ‘এ’ টিম বাংলার সিংহাসনে বংশানুক্রমিকভাবে অধিষ্ঠিত থাকার জন্য দেশের সকল সম্পদ ও সম্ভাবনাকে সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের পদতলে বলি দিচ্ছে এবং দেশের প্রতিরোধ শক্তিকে ধ্বংস করছে। ‘বি’ টিম নিকট ভবিষ্যতে সিংহাসন পাওয়ার লোভে ‘এ’ টিমের দেশবিরোধী কার্যকলাপের যথাযথ প্রতিবাদ/প্রতিরোধ করছে না, জে-১ টিম ক্ষমতার আশপাশে থেকে সুবিধা নেয়ার লোভে নিশ্চুপ রয়েছে এবং জে-২ টিমটি অতীতের দুঃস্বপেড়ব আতঙ্কিত হয়ে যথাযথ ভূমিকা পালন থেকে বিরত রয়েছে। এ জন্যই আমাদের সকলের চোখের সামনে মনমোহন সিং আমাদের জান কবজা করতে আসা সত্ত্বেও ঢাকা এবং সমগ্র দেশ ছিল নিরুত্তাপ ও নির্জীব। কোনো মিছিল সমাবেশ, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ এমনকি কোনো কালো পতাকা প্রদর্শিত হয়নি। উক্ত ৪টি টিমের অবহেলা, অদূরদর্শিতা ও অবিমৃশ্যকারীতায় আমাদের ছাত্র যুবসমাজ এখন নিষ্প্রাণ-নির্জীব ও নির্বীষ। অপরাজনীতি-অপসংস্কৃতি ও মাদক আমাদের তরুণ সমাজকে মরণঘুমে নিমজ্জিত করেছে।
প্রিয় পাঠকবৃন্দ, এই হলো আমাদের দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সার্বিক অবস্থা। এমতাবস্থায় দেশ ও জনগণের স্বার্থ রক্ষায় সকল দলের দেশপ্রেমিকদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি প্লাটফরম গঠন করতে হবে। ১৯৪৭ ও ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার চেতনাকে ধারণ করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে ধর্মীয় ঐক্যই আমাদেরকে ১৯৪৭ সালে এই ভূখণ্ডের মালিকানা প্রদান করেছিল। তাই ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন ও ইতিহাস সচেতন দেশপ্রেমিকদের ঐক্যই দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে পুনরুদ্ধার ও পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে।
সম্পাদক মাসিক ইতিহাস অন্বেষা
০১৭১১৭২০৯২৩
ঢাকা, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১১
No comments:
Post a Comment