Sunday, December 25, 2011

স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত মুসলিম বিশ্ব স্থিতিশীল সরকারের শর্তাবলী (প্রথম প্রকাশ মাসিক ইতিহাস অন্বেষা মার্চ ২০১১)



তিউনিসিয়ায় শিক্ষিত বেকার যুবক কর্মসংস্থান ও ন্যায়বিচার না পেয়ে আত্মাহুতি প্রদানের মাধ্যমে যে ভয়াবহ রাজনৈতিক ভূমিকম্প জন্ম দিয়েছে তাই বর্তমানে সুনামির রূপ ধরে সমগ্র উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সব তাঁবেদার সরকারদের ভাসিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করেছে। আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে এ সুনামির প্রতিক্রিয়া বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়াটা অস্বাভাবিক নয়। সেক্ষেত্রে বিশ্বের তাবৎ তাঁবেদার সরকার, অত্যাচারী সরকার, জনবিরোধী সরকারসমূহের পায়ের তলার মাটি সরে যাবে নিঃসন্দেহে। ফরাসী বিপ্লবের জোয়ারে সমগ্র ইউরোপ ভেসে গিয়ে যেরূপ নবউদ্যমে, নবশক্তিতে বলীয়ান হয়ে বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল ঠিক তদ্রুপ তিউনিসিয়ায় উত্থিত রাজনৈতিক ভূমিকম্পও মুসলিম বিশ্বের দেশে দেশে প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যবাদের গোলাম শাসকদেরকে নিকটস্থ সাগরে নিক্ষেপ করবে এবং মুসলমানদের হারানো গৌরব আবার ফিরে আসবে যদি আমাদের চিন্তাশীল নেতৃবৃন্দ এ অপার শক্তি ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারেন। বিশ্বের বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের পাপের বোঝা কানায় কানায় পূর্ণ হয়েছে, তাদের সহযাগী তাঁবেদার সরকারসমূহ, একনায়ক স্বৈরাচারী শাসকসমূহকে অচিরেই নিজেদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। তাদের আচরিত জোর যার মুল্লুক তার নীতি, অমানবিক বস্তুবাদী সভ্যতা ও রক্তশোষক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা অচিরেই বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাবে। কেননা অন্যায়, জুলুম ও মানবতাবিরোধী কার্যকলাপ দীর্ঘদিন অপ্রতিহত গতিতে চলতে পারে না, চলার ইতিহাস নেই। প্রত্যেক ক্রিয়ার যেমন সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে ঠিক তদ্রুপ ঢিলটি মারলে পাটকেল খেতে হয়। উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশ পর্যায়ক্রমে সুনামিতে আক্রান্ত হচ্ছে তাদের মধ্যে তিন শ্রেণীর দেশ রয়েছে-
 প্রথম শ্রেণী হিসেবে আমরা চিহ্নিত করতে পারি সৌদি আরব, বাহরাইন ও মরক্কোকে। এই তিন দেশের শাসকশ্রেণী সাম্রাজ্যবাদের আশীর্বাদে ক্ষমতার মসনদ দখল করেনি বরং নিজেদের পূর্বপুরুষদের যোগ্যতায় স্ব-স্ব দেশে ক্ষমতাসীন হয়েছিল।
দ্বিতীয় শ্রেণীতে যারারয়েছে তাদের বেশির ভাগই যথা- আলজেরিয়া, মিসর, তিউনিসিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়ার বর্তমানে বিতাড়িত শাসকগণ শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন হওয়ার জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ইন্ধনে জনপ্রিয় সরকারকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করে ক্ষমতাসীন হয় এবং সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদার হিসেবে দেশ, জাতি ও ধর্মবিরোধী ভূমিকায় লিপ্ত হয়।
তৃতীয় শ্রেণীর বর্তমান শাসক হিসেবে আমি তাদেরকে চিহ্নিত করব যারা নিজ জাতি ও ধর্মের বিরুদ্ধে গিয়ে ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধে তুর্কী সালতানাতের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে মুসলিম খেলাফত ধ্বংসে সাহায্য করার বিনিময়স্বরূপ সাম্রাজ্যবাদের আশীর্বাদে এক একটি দেশের শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে স্বীয় দেশ-জাতি ও মুসলিম উম্মাহর অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করেছে। এরূপ দেশের শাসকরা হলো- বর্তমান কুয়েত, কাতার, জর্দান, ইরাক ও ইরানের বর্তমান ও প্রাক্তন শাসকগণ। উক্ত তিন শ্রেণীর তাঁবেদার শাসকগণের কারণেই বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী ভূখণ্ড, বিশাল জনগোষ্ঠী ও ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের অধিকারী ভূখণ্ডের মালিক হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম উম্মাহ আজও পরাজিত, হতদরিদ্র, দ্বিধাবিভক্ত ও লাঞ্ছিত। এসব তাঁবেদার শাসকবৃন্দের কারণেই ওআইসি, আরব লীগ ও ওপেক বিশ্বমঞ্চে কোনো শক্তি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি।এসব তাঁবেদার শাসকদের গোপন সহযোগিতা ও সম্মতি পেয়েই ফিলিস্তিনি মা-বোনেরা দীর্ঘ ৬০ বছর যাবত নিজ দেশে পরবাসী, ঘৃণ্য ইহুদীদের অমানবিক নৃশংস অত্যাচারে লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, অত্যাচারিত, ধর্ষিত ও বস্তুচ্যুত। এসব তাঁবেদার শাসকদের কারণেই মুসলমান দেশ ইরাক, আফগানিস্তান, বসনিয়া, চেচনিয়া সাম্রাজ্যবাদী দানবের হিংস্র হামলায়, আহত নিহত বাস্তুচ্যুত ও বিধ্বস্থ। এসব গোলাম ও ক্ষমতালোভী শাসকরাই বিশ্বের তাবৎ মুসলমানদের বর্তমান দুর্দশার জন্য প্রধানত দায়ী।


<b>বর্তমান রাজনৈতিক সুনামির আবির্ভাবেরকারণসমূহ</b>
এ সুনামির দৃশ্যমান কারণ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, তীব্র বেকারত্ব, অর্থনৈতিক, সামাজিক বিশৃঙ্খলা শোষণ ও বৈষম্য এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকা হলেও এর অন্তর্নিহিত আরও অনেক কারণ রয়েছে। এ কারণসমূহের অন্যতম হলো-
<b>ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরায়েলের জুলুম :</b> বিগত প্রায় ৬০ বছর যাবত সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইসরাইল নিরস্ত্র, নিরপরাধ ফিলিস্তিনীদের উপর যে অত্যাচার-নিপীড়ন পরিচালনা করছে তা মিডিয়ার কল্যাণে প্রত্যেক মুসলমানের হৃদয়ে প্রতিনিয়ত রক্তক্ষরণ হচ্ছে। দীর্ঘদিনের এ রক্তক্ষরণ মুসলমানদের মনে ইহুদীবাদী ইসরাইল, ইসরাইলের আশীর্বাদপুষ্ট সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ এবং সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদার মুসলিম শাসকদের প্রতি পুঞ্জীভূত ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। আগেড়বয়গিরির লাভা যেভাবে দীর্ঘদিন উত্তপ্ত হয়ে এক সময় সবকিছু ধ্বংস করার লক্ষ্যে জেগে ওঠে, ঠিক তেমনি তিউনিসিয়ায় উত্থিত রাজনৈতিক আগেড়বয়গিরির লাভা প্রমত সাম্রাজ্যবাদের তল্পীবাহক দেশের শাসকদের দিকেই ধাবিত হবে। সিরিয়া-ইরান বা তুরস্কের দিকে নয়।
<b>মিথ্যা অজুহাতে ইরাক-আফগানিস্তান দখল :</b> মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদ লুণ্ঠন, ইসরাইলকে নিরাপদ করা এবং ইরাকী আরবদেরকে চরিত্রহীন, মদ্যপ ও ধর্মচ্যুত করে সমগ্র আরব বিশ্বে বেলেল্লাপনা, মাদকাসক্তি ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে আরব চরিত্র ও সংস্কৃতি ধ্বংস করার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইরাক দখল করা হয়। সাদ্দামের নিকট নিষিদ্ধ অস্ত্র আছে এই অজুহাতেই ইরাক দখল করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেল ইরাক দখলের অজুহাত সর্ববৈ মিথ্যা। অথচ এই মিথ্যা অজুহাতের আক্রমণে লাখ লাখ ইরাকী আহত নিহত ও পঙ্গু হয়েছে। ইরাকী মা-বোনেরা অব্যাহতভাবে ধর্ষিত হয়েছে, ক্ষুধার অনড়ব মেটাতে বেশ্যাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে এবং ৫০ লক্ষাধিক ইরাকী বাস্তুচ্যুত ও বিতাড়িত হয়েছে। ধর্ম ও সভ্যতার পীঠস্থান বিধ্বস্ত হয়েছে। এতদসত্ত্বেও সাম্রাজ্যবাদের তল্পীবাহক শাসকবৃন্দ কোনোরূপ প্রতিবাদ, প্রতিরোধের চেষ্টা করেনি। অপরদিকে ওসামা বিন লাদেন কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলা করার অজুহাতে গরীব দেশ আফগানিস্তানে হামলা করে আফগানিস্তানকে বিধ্বস্ত করা হয়েছে। অথচ পরবর্তীতে বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, পাকিস্তানকে আণবিক অস্ত্রমুক্ত করা, মুসলিম যুবকদেরকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে মুসলমানদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করে মুসলিম দেশসমূহ একে একে দখল করা এবং মধ্য এশিয়ার তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ লুণ্ঠন করার জন্যই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব আফগানিস্তানে হামলা করে দেশটিকে বিধ্বস্ত করেছে। শিক্ষিত সচেতন মুসলিম যুবকরা এ জন্য স্ব-স্ব দেশের পদলেহী শাসকদেরকে উৎখাতের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ইতিমধ্যে বিশ্ববাসী জানতে পেরেছে যে, যায়নবাদী ইসরাইলের নেপথ্য পরিকল্পনায় টুইন টাওয়ার বিধ্বস্ত করা হয়েছিল।
<b>যুক্তরাষ্ট্রের দু’মুখো নীতি :</b> যুক্তরাষ্ট্র মুখে যা বলে কার্যত তার বিপরীত কাজ করে। সে সমানাধিকার, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলে। অথচ বিশ্বের দেশে দেশে অত্যাচারী স্বৈরশাসকদেরকে ক্ষমতাসীন করে, মদদ দেয়। মানবাধিকারের কথা বলে কিন্তু অসংখ্য আফগান, ইরাকী, পাকিস্তানি, ফিলিস্তিনিসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশের মেধাবী যুবকদেরকে নিজ দেশ থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে গোপন নির্যাতন কেন্দ্রে অমানবিকভাবে অকথ্য অত্যাচার-নির্যাতন চালাচ্ছে এবং বিনা বিচারে আটক রেখেছে। নিজ নিজ দেশের তাঁবেদার সরকারসমূহ এহেন অপকর্মের সহযোগী হিসেবে ভূমিকা রাখছে। আধুনিক শিক্ষিত মুসলিম যুবকরা এরূপ তাঁবেদার সরকার উৎখাতে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। গণতন্ত্রের ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্র দু’মুখো নীতি অনুসরণ করে। এর চারটি উদাহরণ হলো-
১. আলজেরিয়ার সাধারণ নির্বাচনে ইসলামীক সালভেশন ফ্রন্ট জয়ী হলে পাশ্চাত্যের মদদে সে দেশের সেনাপ্রধান ক্ষমতা দখল করে এবং বিজয়ী দলকে নিষিদ্ধ করে। পাশ্চাত্য এখনও উক্ত জান্তাকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিচ্ছে।
২. পাশ্চাত্য কর্তৃক আয়োজিত নির্বাচনে ফিলিস্তিনে হামাস জয়ী হলে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইলসহ পশ্চিমা বিশ্ব হামাসের ক্ষমতাসীন হওয়াকে প্রতিরোধ করে এবং গণতন্ত্রের বুলি ভুলে যায়।
৩. একটানা ১৫ বছরের গণতান্ত্রিক শাসনের অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলার সময় যুক্তরাষ্ট্র, পাশ্চাত্য ও ভারত বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা নস্যাত করার লক্ষ্যে এ দেশের সেনাপ্রধানকে ব্যবহার করে গণতন্ত্র ধ্বংস করে।
৪. ইরানের গণতান্ত্রিক ইসলামী সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র অব্যাহতভাবে ইরানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কার্যক্রম পরিচালনা করছে, গণতন্ত্রবিরোধী শক্তিকে অস্ত্র অর্থ সম্পদ দিচ্ছে।


<b>বিপ্লব সংরক্ষণে সতর্কতা</b>
সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদার সরকার উৎখাত এবং তদস্থলে দেশপ্রেমিক সরকারকে ক্ষমতাসীন করার পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, যায়নবাদী ইহুদী ও তাদের তল্পীবাহক সরকার, ভাবশিষ্য ও এজেন্টগণ সর্বশক্তি নিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করবে। এ প্রতিরোধে যে সব পন্থা অবলম্বন করতে পারে তা হলো-
১. আন্দোলনকারীদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করা : সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ জাতিগত, গোত্রীয় ও ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে, মতাদর্শগত বিরোধ উস্কে দিয়ে, মৌলবাদের ভয় দেখিয়ে ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে অথবা চরিত্রহীন ক্ষমতালোভীদের ক্ষমতাসীন করার প্রলোভন দিয়ে আন্দোলনকারীদের মধ্যে অনৈক্য, বিশৃঙ্খলা, সংঘাত-সংঘর্ষের আয়োজন করতে পারে।
২. উৎখাত হওয়া পতিত স্বৈরাচারী শাসকের প্রাক্তন সহযোগীরা আপাতত আন্দোলনকারীদের বন্ধু সেজে বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে। বন্ধুত্বের ভান করে পিছন থেকে ছুরিকাঘাত করতে পারে। সাম্রাজ্যবাদের সাথে দীর্ঘদিন সহায়তাকারী সেনাবাহিনী দেশ রক্ষার অজুহাতে পুনরায় ক্ষমতা দখল করতে পারে।
৩. সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ আন্দোলনের সপক্ষের বিভিন্ন গোত্র ও গোষ্ঠীকে আলাদাভাবে মদদ দিয়ে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত করাতে পারে। যাতে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত জাতি নিজেরা শক্তিহীন হয়ে সাম্রাজ্যবাদী জালে ধরা দিতে বাধ্য হয়। এ বিষয়ে ইরাকের চলমান ঘটনাবলী আমাদের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে। আমেরিকা বেসরকারি ইরাকী শিয়া-সুন্নি ও কুর্দিদেরকে আলাদাভাবে অস্ত্রসজ্জিত করে এক পক্ষকে দিয়ে অপর পক্ষের উপর হামলা করাচ্ছে। প্রথম কয়েক বছর ইরাকীরা বিষয়টি সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল। ফলে তখন শিয়াদের মিছিলে হামলা হলে শিয়ারা সুন্নিদের উপর প্রতিশোধ নিতো। কিন্তু বর্তমানে সব পক্ষ মার্কিন চালাকী ধরতে পারায় যাচাই বাছাই না করে কেউ কারো উপর হামলা করে না। ফলে বর্তমানে আমেরিকা এরূপ হামলার কাজে বেসরকারি সিকিউরিটি গ্রুপের খুনিদের ব্যবহার করে। পাকিস্তান-আফগানিস্তানেও আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এরূপ অপকর্ম পরিচালনা করছে।
৪. যেহেতু সাম্রাজ্যবাদীরা বিশ্ব অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম সেহেতু তারা তাদের অপছন্দের নতুন শাসকের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করতে পারে। সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনীতি ধ্বংসে কার্যকলাপ পরিচালনা করতে পারে। এমতাবস্থায় নতুন সরকারকে অবশ্যই জনগণের সাথে প্রতিনিয়ত সুখ, দুঃখ শেয়ার করতে হবে, সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তসমূহ দেশবাসীকে অবহিত করতে হবে যাতে দেশবাসী সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তপ্রসূত দুর্ভোগ মোকাবেলায় মানসিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে। এছাড়াও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তি ইরান, সিরিয়া, তুরস্ক, চীনসহ অন্যান্য দেশের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।
৫. সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এজেন্টদেরকে চিহ্নিত করা: ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, সমাজতন্ত্রী,নৈরাজ্যবাদী, লায়ন-রোটারী ক্লাবের মতো সাম্রাজ্যবাদ পরিচালিত বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা,সাম্রাজ্যবাদী অর্থে পরিচালিত এনজিও কর্মী, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, আমেরিকান সিটি ব্যাংক, বহুজাতিক সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেশির ভাগই ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে কাজ করে। এ জন্য নতুন সরকারকে অবশ্যই এ শ্রেণীর সংস্থার লোকদের প্রতি সজাগ থাকতে হবে, এরূপ সংগঠনকে দেশ থেকে বিতাড়িত করতে হবে। তদুপরি ধর্ম ব্যবসায়ী-বিদ্আতী পীরসাহেবগণও মূলত সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে থাকেন। এ জন্য এসব মতলবাজ-ফেরকাবাজ বিদআতী ধর্ম ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট দেশে বসবাসরত ইহুদীদের প্রতিও সজাগ থাকতে হবে।


<b>স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠার শর্তাবলী</b>
বিগত ৩০০ বছর যাবত বিশ্ববাসী বহু প্রকারের শাসক প্রত্যক্ষ করেছে। বহু মতবাদের অনুসারী শাসক দেখেছে, বহু প্রকারের শাসন পদ্ধতি দেখেছে। কিন্তু স্থিতিশীল, দক্ষ ও ন্যায়পরায়ণ কল্যাণ রাষ্ট্র দেখেনি। ন্যায়পরায়ণ ও কল্যাণ রাষ্ট্রই যদি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না হয় তবে বর্তমান শাসকগোষ্ঠীকে অপসারণ করার কোনো হেতু আছে কি? ন্যায়পরায়ণ শাসক ও কল্যাণ রাষ্ট্র প্রত্যক্ষ করতে হলে আমাদেরকে ইতিহাসের আরো পিছনে যেতে হবে। আমাদের বিগত ১৪০০ বছরের ইতিহাস খুঁজে দেখতে হবে ইতিহাসের কোন সময়ে আমাদের ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিল, কল্যাণ রাষ্ট্র ছিল। উক্ত শাসকের বৈশিষ্ট কি ছিল, উক্ত শাসন ব্যবস্থার স্বরূপ কি ছিল? এরূপ পর্যালোচনায় আমরা দেখতে পাব। ইসলামের সূচনালগেড়ব আমাদের শাসকের চারিত্রিক গুণাবলী ও শাসন পদ্ধতি কি ছিল। উক্ত শাসক ও শাসন প্রণালী থেকে আমরা পর্যায়μমে দূরে সরে এলাম কেন, এ দূরে সরে যাওয়ায় আমরা লাভবান হয়েছি- না ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি, সুখী হয়েছি না দুখী হয়েছি। সমৃদ্ধ হয়েছি না পতিত হয়েছি। এরূপ বিশ্লেষণের পরেই আমরা সিদ্ধান্ত নেব আমাদের কাংখিত স্থিতিশীল সরকারের ও শাসকের বৈশিষ্ট্য কিরূপ হবে?
ইসলামের প্রারম্ভে রাসুল (সা.)-এর নেতৃত্বে মদীনা রাষ্ট্র কায়েম হয়েছিল। সেখানে রাষ্ট্রের প্রধান ছিলেন একজন। তিনি অন্যদের সাথে পরামর্শ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। আল্লাহর আইনে বিচার ফয়সালা করেছেন। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক কর্মকাণ্ডে পরিচালনা করেছেন এবং এভাবে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর অনুকরণে হযরত আবু বকর, ওমর, ওসমান ও আলী (রা.) একইভাবে কল্যাণ রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। শেষোক্ত দুইজনের সময়ে দেশব্যাপী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণ ছিল ইহুদী থেকে মুসলমান হওয়া আবদুল্লাহ বিন সাবাহর সাবাই আন্দোলন। এই সাবাই আন্দোলনে খেলাফত বিলুপ্ত হয়ে আমীর মুয়াবিয়া (রা.)-এর নেতৃত্বে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর চরিত্রহীন ছেলে ইয়াজীদের নেতৃত্বে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর উমাইয়া ও আব্বাসীয় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে মিসর, তুরস্কে, ভারতে রাজতন্ত্র স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদাধিকারী ব্যক্তি যখন সৎ ও অভিজ্ঞ হয় তখন রাজতন্ত্রের অধীনেও কল্যাণ রাষ্ট্র কায়েম হয়েছে, জনগণ সুখে শান্তিতে সমৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে জীবন যাপন করতে সক্ষম হয়েছে। এরূপ রাজতান্ত্রিক সময়েও আমরা অনেক যোগ্য শাসক পেয়েছিলাম, যারা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রজাহিতৈষী শাসক হিসেবে ইতিহাসে অমর অক্ষয় হয়ে আছেন। রাজতান্ত্রিক শাসক হয়েও তাদের বেশির ভাগ ব্যক্তি বিচার ফয়সালা করতেন ইসলামী আইনে ফলে জনগণ ন্যায় বিচার পেত। চার খলিফার পরে ওমর ইবনে আবদুল আজিজ, হারুনুর রশীদ, মামুনুর রশীদ, সুলতান সালাউদ্দীন আইয়ুবী, তুর্কী সুলতানগণ, আকবর ব্যতিত ভারতবর্ষের সুলতানী আমল ও মোগল আমলের শাসকগণ কল্যাণ রাষ্ট্র কায়েম করেছিলেন। আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, পৃথিবীর ইতিহাসে অপর কোনো ধর্মের কোনো শাসক আমাদের খলিফা হারুন, সালাউদ্দীন আইয়ুবী বা আওরঙ্গজেব আলমগীরের ন্যায় কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। এমতাবস্থায় বর্তমানে আমরা কেমন শাসককে ক্ষমতাসীন করব এবং কেমন সরকার গঠন করব তা ঠিক করার জন্য অন্য জাতির মুখাপেক্ষী হব কেন? যায়নবাদী ইহুদীদের রচিত সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্রের বই পড়তে হবে কেন, তাদের উদ্দেশ্যমূলক গণতন্ত্র- সমাজতন্ত্রের পথে যাব কেন? বিগত ৩০০ বছর যাবত আমাদের শাসকগণ যায়নবাদীদের রচিত এসব তন্ত্র-মন্ত্রের শাসন দ্বারা কোনো কল্যাণ রাষ্ট্র স্থাপন করতে পেরেছে কি? যদি না পারে তাহলে আবার ওমুখো হবো কেন?
আমি মনে করি, প্রত্যেক দেশ জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বর্তমানে আমাদের প্রয়োজন একদল ধার্মিক, সৎ, অভিজ্ঞ ও সাহসী ব্যক্তিবর্গ, যারা নিজেদের মধ্য থেকে সবচেয়ে যোগ্যতম ব্যক্তিটিকে রাষ্ট্র প্রধান করে দেশ পরিচালনা করবে এবং স্ব-স্ব দেশকে কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করবে। রাষ্ট্রের প্রকৃতি খেলাফত, রাজতান্ত্রিক বা গণতান্ত্রিক হওয়া শর্ত নয়। শর্ত হলো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক ও নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী হবেন একজন মাত্র ব্যক্তি, যিনি নিজে পরিকল্পনা প্রণয়ন করবেন ও বাস্তবায়নে দিক নির্দেশনা দিবেন। যিনি হবেন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রভাবমুক্ত ও স্বাধীন। যিনি হবেন নির্লোভ, চরিত্রবান ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ধারক ও বাহক। তাঁকে আলেম হওয়ার দরকার নেই, ইরানী প্রেসিডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার আহমদিনেজাদের মতো সৎ ও জ্ঞানী হলেও চলবে। এক্ষেত্রে বর্তমানে প্রধান বাধা হবে সাম্রাজ্যবাদী চμান্ত, দ্বিতীয় বাধা হবে সাম্রাজ্যবাদের স্বদেশী এজেন্টগণ, তৃতীয় বাধা হবে সার্বজনীন ভোটাধিকারের নির্বাচন। অজ্ঞ, মূর্খ, অসচেতন জনগণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তার ভোটাধিকার দ্বারা ভাল লোক বাদ দিয়ে খারাপ লোককে নির্বাচিত করে। এমতাবস্থায় জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে এবং সার্বজনীন সুশিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী শাসক ও শাসক দল এবং নীতি ও মূল্যবোধের ব্যাপারে আপোসহীন দেশপ্রেমিক জনগণই স্থিতিশীল সরকার ও সমৃদ্ধ দেশ গড়তে সক্ষম।




এস, এম, নজরুল ইসলাম।
সম্পাদক ও প্রকাশক
০১৭১১৭২০৯২৩
মাসিক ইতিহাস অন্বেষা



No comments:

Post a Comment