এই লেখা প্রকাশ হওয়ার
আগেই বিশ্ব মানচিত্রে নতুন একটি দেশের অভ্যুত্থান ঘটবে। যার নাম দক্ষিণ সুদান।
বিশ্বের প্রধান প্রধান গণমাধ্যমে এখন সুদানের গণভোট এবং দক্ষিণ সুদানের জনগণের
দুর্দশার চিত্র ফলাওভাবে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বের অনেক সচেতন মানুষও জানে
না কেন দক্ষিণ সুদানে গণভোট অনুষ্ঠানে বাধ্য করা হয়েছে এবং দক্ষিণ সুদানে কেন উন্নয়নের ছোঁয়া
লাগেনি। উভয় প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর এই যে, ১৮২১ খ্রিস্টাব্দ থেকে বৃটেন এবং পরবর্তীতে অপরাপর
পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহ সুদানকে উত্তর-দক্ষিণে ভাগ করার বীজ বপণ ও
পরিচর্যা করেছে এবং সাম্রাজ্যবাদের সরাসরি ইন্ধনে দক্ষিণ সুদানে কোনো উন্নয়ন কার্য বাস্তবায়ন
করতে দেয়া হয়নি। কোনো দেশের উন্নয়ন সাম্রাজ্যবাদের জন্য প্রয়োজনীয় নয়-সাম্রাজ্যবাদের জন্য
প্রয়োজন ভূগুরুত্ব সম্পন্ন ভূখণ্ড- ও এর সম্পদ। গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে কাংখিত ভূখণ্ড- জনশূন্য হলে,
অন্নুনত হলে, আন্তঃকোন্দলে লিপ্ত হয়ে দুর্বল হলে সাম্রাজ্যবাদীরা অতি
সহজেই নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনে সাফল্য লাভ করে। দক্ষিণ সুদানকে মূল ভূখণ্ড- থেকে আলাদা
করার জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ ১৮২১ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত
যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে একই পদক্ষেপসমূহ ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ থেকে গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে
আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে। আমাদের একশ্রেণীর রাজনীতিক ও সুশীল বাবুদের
সহায়তায় পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থাও পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানের মতো হওয়ার
সমূহ সম্ভাবনা বিদ্যমান।
সুদান : দেশ পরিচিতি
উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার দেশ
সুদান। এর আয়তন ২৫০৫৮১৩ বর্গকিলোমিটার, যা বিশ্বে দশম বৃহত্তম আয়তনের দেশ। ২০০৯ সালের গণনা অনুযায়ী এর লোকসংখ্যা ৪,৩৯,৩৯,৫৯৮ জন। মাথাপিছু আয় ২৪৬৪ ডলার। সুদানেরউত্তরে মিসর,
উত্তর পূর্বে লোহিত সাগর, পূর্বে ইরিত্রিয়া ও ইথিওপিয়া, দক্ষিণ পূর্বে কেনিয়া ও উগান্ডা, দক্ষিণ-পশ্চিমে কঙ্গো এবং মধ্য আফ্রিকা, পশ্চিমে শাদ, উত্তর-পশ্চিমে লিবিয়া। নীলনদ সুদানকে পূর্ব-পশ্চিমে ভাগ করেছে। প্রশাসনিকভাবে
উত্তর সুদানে ২৫টি রাজ্য ও ৮৭টি জেলা এবং দক্ষিণ সুদানে ১০টি রাজ্য ও ৮৪টি কাউন্টি।
উত্তরে সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নি মুসলমান। মুসলমানরা ২ ভাগে বিভক্ত।স্থানীয় (নুবিয়ান)
মুসলমান ও আরব বংশোদ্ভুদ মুসলমান। দক্ষিণে খ্রিস্টান ও
প্রকৃতিপূজারী।সুদান পেট্রোলিয়াম ও খনিজ তেল সমৃদ্ধ বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগামী
অর্থনীতির দেশ।চীন এবং জাপান সুদানী জ্বালানির বৃহত্তম ক্রেতা। সুদানে লোহা, ম্যাঙ্গানিজ, ম্যাগনেসাইড, স্বর্ণ, রৌপ্য, ক্রোমিয়াম, জিপসাম, মাইকা, দস্তা, টাংস্টেন এবং তামার খনি আছে।
খ্রিস্টপূর্ব আমলের সুদান : সুদানের ইতিহাস
ও সভ্যতা মিসরীয় সভ্যতার ইতিহাসের চেয়ে অনেক প্রাচীন। খ্রিস্টপূর্ব আমালের
বেশিরভাগ সময় মিসর সুদানের অংশ হিসেবে শাসিত হয়েছে। প্রতড়বতাত্ত্বিক নিদর্শন
মোতাবেক ৭০ হাজার বছর পূর্বে সুদানে সাম্রাজ্যের পত্তন হয়। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সন
থেকে সুদানকেন্দ্রীক সুবিয়া সাম্রাজ্যের পত্তন হয়। মিসর, সিরিয়া ও থীবস এ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।নাবাতীয়দের পর
মেরাবীয় বংশ খ্রিস্টপূর্ব ৭৫০ থেকে ৩৫০ পর্যন্ত সুদান শাসন করে। ৩৫০ খ্রিস্টপূর্ব
সনে আবিসিনিয়া (বর্তমান ইথিওপিয়া) সুদানি সাম্রাজ্য ধ্বংস করে এবং দখল করে। সুদান
সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপ থেকে পরবর্তীতে ৫০টি রাজ্যের জন্ম হয়। উক্ত৫০টি রাজ্যের
তিনটি ছিল যথাক্রমে নাবাতিয়া (বর্তমান মিসর) মাকুরিয়া ও আলাওয়া(বর্তমান খার্তুমের নিকটে এ
রাজ্যের রাজধানীছিল।)
সুদানে খ্রিস্টানিটি ও
ইসলাম : বাইজান্টাইন সম্রাজ্ঞী থিওডর স্বয়ং মিশনারীসহ আফ্রিকার উপকূলে উপস্থিত হন।
তাদের প্রচারণায় অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়। তন্মধ্যে
নাবাতিয়া, মাকুরিয়া ও আলাওয়াল
শাসকত্রয় খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে।তখন থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত আলাওয়া
খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের শাসনাধীন ছিল। হযরত উমর (রা.) খেলাফতের শুরুতে ৬৩৬
খ্রিস্টাব্দে মিসর বিজিত হয় এবং ইসলামী শাসন কায়েম হয়। পর্যায়ক্রমে উত্তর
আফ্রিকার জনগণ ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে ও উত্তর আফ্রিকায় মুসলিম জনগোষ্ঠী
সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। দীর্ঘ ৬১৪ বছর পর অর্থাৎ ১২৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে সুদানে
মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সেন্নার ও ফ্রুঞ্জ নামক ২টি
মুসলিম রাজবংশ ১৮২০ সাল পর্যন্ত সুদান শাসন করে।
সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে সুদানের স্বাধীনতার উত্থান-পতন
(১৮২১-১৯৫৬)
ওসমানীয় তুর্কী
সালতানাতের প্রতিনিধি হিসেবে মিসরে দায়িত্ব পালনরত মুহাম্মদ আলী পাশা ১৮২০ সালে
তাঁর ছেলে ইসমাইলকে পাঠিয়ে সুদান দখল করেন এবং সুদান তুর্কী সাম্রাজ্যের
অন্তর্ভুক্ত হয়। ইতোমধ্যে মিসর-ফ্রান্স সুয়েজখাল খনন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
গুরুত্বপূর্ণ সুয়েজখালের নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী
দেশসমূহ সুয়েজের দুই পাড়ে অবস্থান নেয় এবং ১৮৮২ সালে মিসরে বৃটেনের শাসন শুরু হয়।
১৮৭৯ সালে ইউরোপীয় শক্তি ইসমাইলকে সুদানের শাসন কর্তৃত্ব থেকে অপসারণ করে তদস্থলে
তার পুত্র তাওফীককে ক্ষমতাসীন করে।তাওফীকের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় ওরাবী
বিদ্রোহ শুরু হয়।দুর্বলচিত্তের তাওফীক শুধুমাত্র নিজের সিংহাসন রক্ষায় বৃটেনের
সাহায্য প্রার্থনা করেন। বৃটেন তাওফীককে নামমাত্র ক্ষমতায় রেখে সুদানে নিজেদের
একজন গভর্নর নিয়োগ করে। এভাবে পিতা-পুত্রর মধ্যে
দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি করে। উত্তম শাসককে সরিয়ে অদক্ষ ও দুর্নীতিবাজ শাসককে
ক্ষমতাসীন করে ইউরোপীয় শক্তি সুদানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং উক্ত বিশৃঙ্খলা থেকে
সুদানকে রক্ষার অজুহাতে সুদানের শাসক হিসেবে ইংরেজ গভর্নরের শাসন শুরুহয়।
দেশপ্রেমিক সুদানীরা আহমদ ইবনে আবদুল্লা (মাহদী)র নেতৃত্বে দখলদার বৃটিশ বিরোধী
সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে।এ যুদ্ধে সুদানে নিযুক্ত বৃটিশ গভর্নর জেনারেল
গর্ডন নিহত হয় এবং মাহদী ক্ষমতাসীন হন। টাইফয়েড রোগে পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে মাহদী
মৃত্যুবরণ করলে আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ ক্ষমতাসীন হন। তিনি নিজেকে খলীফা ঘোষণা করেন
যদিও তিনি ইসলামী শাসন অনুসরণ করেননি।
আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ
(মাহদী)র শাসনকাল (১৮৫৫-১৮৯৯)
সুদান পুনরায় স্বাধীন হলে
ইতোমধ্যে আফ্রিকায় জেঁকেবসা সকল ইউরোপীয় শক্তি সুদানের স্বাধীনতা হরণে তৎপরতা শুরু
করে।তখন মিসর ছিল বৃটেনের দখলে। ইকুইটোরিয়াল ঘানা ছিল বেলজিয়ামের দখলে। ইথিওপিয়ায়
ছিল খ্রিস্টান রাজা ইউহানড়বার শাসন। সুদান চতুর্দিক থেকে আক্রান্ত হয় তবুও সুদান শক্তিশালী ইথিওপিয়া দখল করতে সক্ষম হয়
কিন্তু ১৮৯৩ সালে ইতালীর আক্রমণে সুদানী সেনারা
ইথিওপিয়া ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ১৮৯৯ সালে বৃটেনের তাবেদার রাষ্ট্র মিসরের
সহযোগিতায় ওমদুরমান যুদ্ধে সুদান পরাজিত হয়ে বৃটেনের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়।
চুক্তি মোতাবেক মিসর কর্তৃক বৃটেনের পছন্দসই ব্যক্তিকে সুদানের গভর্নর নিয়োগ দেয়া
হলে সুদান বৃটিশ কলোনীতে পরিণত হয়।
সুদানে অনুসৃত বৃটিশ
পলিসি : বৃটিশ শাসকগোষ্ঠীর চিরাচরিত Divide
& Role পলিসির শিকার হয়ে
সুদানের ঐক্য বিনষ্ট হয়। ১৯২৪ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত বৃটিশ শাসকগোষ্ঠী সুদানকে
উত্তর-দক্ষিণ সুদানে বিভক্ত করে শাসন করে তদুপরি উত্তর সুদানের অংশ দারফুরকে আলাদা
প্রশাসনিক ইউনিটে বিভক্তকরে শাসন করে। বৃটিশ শাসনের সময়ে উত্তর-দক্ষিণ বিভেদেরবীজ
বপন করা হয়। উক্ত বিভেদের স্বরূপ ছিল
(১) দক্ষিণসুদানের ৮০০
বৃটিশ কর্মচারীর মধ্যে দক্ষিণ সুদানী ছিল ৪ জন বাকিরা ছিল উত্তর সুদানী।
(২) ম্যালেরিয়া রোগের বিস্তার
রোধের অজুহাতে উত্তর সুদানীদেরকে দক্ষিণ সুদানে এবং দক্ষিণ সুদানীদেরকে উত্তর
সুদানে বসবাসের অনুমতি না দেয়া।
(৩) উত্তর সুদানী দাস
ব্যবসায়ীদের দ্বারা দক্ষিণ সুদানী জনগণকে বহির্বিশ্বের দেশসমূহে দাস হিসেবে বিক্রির ব্যবস্থা করা।
(৪)উত্তর সুদানে উন্নয়ন কর্মসূচি
বাস্তবায়ন করা এবং দক্ষিণকে অন্নুনত রাখা।
(৫) দক্ষিণ সুদানের
প্রকৃতিপূজারী কালো লোকদেরকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা।
(৬) উত্তর-দক্ষিণ বিভেদের
কাল্পনিক ইতিহাস রচনা করা ইত্যাদি। খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ দক্ষিণ সুদানকে আলাদা করার
বৃটিশ পলিসিসমূহ টাইমবোমার ন্যায় কাজ করেছে, যা বর্তমানে বৃটেনের সহযোগী অপরাপর পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী
রাষ্ট্রের যোগসাজশে বাস্তবরূপ লাভ করে দক্ষিণ সুদান সম্ভবত চলতি ২০১১ সালে তথাকথিত
স্বাধীনতা লাভ করে আফ্রিকার হৃৎপিণ্ডে ইসরাইল ও পাশ্চাত্যের নতুন বাণিজ্যিক ও সামরিক ঘাঁটি
স্থাপনের সুযোগ করে দেবে। উত্তর সুদানের দারফুরে ও বৃটিশ রোপিত টাইমবোমা সদৃশ্য
বিষবৃক্ষ দ্রুত ডালপালা বিস্তার করছে। দারফুরের জনগণের ধর্মীয় ও ভাষাগত পার্থক্যকে
কাজে লাগিয়ে ইতোমধ্যে দারুফুরকে পূর্ব-পশ্চিমে বিভক্ত করার চক্রান্তে বাস্তবায়িত
হয়েছে। দক্ষিণ সুদান তথাকথিত স্বাধীন হওয়ার পর দারফুরেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি
ঘটবে।
সর্বশেষ স্বাধীনতা (১৯৫৬
ইং)-এর প্রাক্কালে সুদান : দীর্ঘদিনের ইতিহাসের আলোকে দেখা গেছে মিসর ও সুদান
ঐক্যবদ্ধ থাকলে উভয়ের স্বাধীনতা অক্ষুণড়ব থাকে। অপরদিকে বিচ্ছিনড়ব হলে উভয়ের
স্বাধীনতা বিপনড়ব হয়। এ জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি উভয়কে পৃথক রাখার জন্য
কার্যক্রমে পরিচালনা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৃটিশ শক্তি হীনবল হওয়ায় বিশ্বের
অন্যান্য দেশের ন্যায় মিসর ও সুদানেও স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়। তখন এক পক্ষ
অর্থাৎ যারা পূর্বেও সুদানের পৃথক স্বাধীনতার প্রশ্নে বৃটেনের পক্ষে কাজ
করেছিল সে মাহদী বংশের নেতৃত্বে সুদানে উম্মাহ পার্টি শক্তিশালী হয়ে উঠে। অপরদিকে
সৈয়দ ইসমাইল আজহারীর নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্য পার্টিও যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করে। তখন
(১৮৫৪-৫৫) সালে সুদানী রাজনীতির প্রধান ইস্যু ছিল মিসরের সাথে ঐক্যবদ্ধ অথবা পৃথক স্বাধীনতা।
ইতোমধ্যে ১৯৫২ সালে বৃটিশবিরোধী বিপ্লব ও সফল অভ্যুত্থানে মিসর স্বাধীনতা লাভ করে
কিন্তু সুদানে বৃটিশ শাসন বলবৎ থাকে। স্বাধীনতার পর মিসরে রাজতন্ত্র কায়েম হয় কিন্তু
বৃটেনের চক্রান্তে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং একনায়কতন্ত্রের যুগ শুরু
হয়। মিসরের তৎকালীন শাসক নাগীব মাহফুজ ঐক্যবদ্ধ মিসর ও সুদানের পক্ষে কাজ করেন
কেননা এতেই তিনি স্বাধীনতার রক্ষাকবচ খুঁজে পান। এমতাবস্থায়
সাম্রাজ্যবাদী বৃটেন সুদানের পূর্ববর্তী মাহদী রাজবংশের সাইয়্যিদ আবদুর রহমানকে
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক
সহায়তা দিয়ে মিসরবিরোধী আন্দালনে লিপ্ত করে। সদ্য স্বাধীন মিসর এতে দমে যায় এবং
১৯৫৪ সালে মিসর ও বৃটিশ সরকার ১ জানুয়ারি ১৯৫৬ সালে সুদানকে স্বাধীনতা প্রদানের
চুক্তিতে উপনীত হয়।চুক্তি মোতাবেক অনুষ্ঠিত গণভোটে বৃটেনের আকাক্সক্ষা বিরোধী
জাতীয় ঐক্য পার্টি বিজয় লাভ করে এবং ইসমাইল আজহারী সুদানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী
হিসেবে ক্ষমতাসীন হন।
গণভোটের ফলাফল
সাম্রাজ্যবাদী বৃটেনের চাহিদামাফিক না হওয়ায় ১৯৫৫ সাল থেকে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ।
সাম্রাজ্যবাদী মদদে খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ দক্ষিণ সুদান উত্তরের সাথে গৃহযুদ্ধে
লিপ্ত হয়।পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রধানমন্ত্রী আজহারী জুলাই, ১৯৫৬ সালে পদত্যাগ করেন এবং উম্মাহ পার্টির মহাসচিব
আবদুল্লাহ খলিল প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। এতদসত্ত্বেও উক্ত গৃহযুদ্ধ ১৯৭২ সাল
পর্যন্ত স্থায়ী হয়। ১৯৭২ সালে World Council of Church-এর মধ্যস্থতায় আদ্দিস আবাবা চুক্তির মাধ্যমে গৃহযুদ্ধ বন্ধ
হয়। চুক্তির শর্ত মোতাবেক দক্ষিণ সুদান স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। দক্ষিণ সুদানের জন্য
একটি স্থায়ী উচ্চতর নির্বাহী পরিষদ (উনিপ) গঠন করা হয়। ১৯৮২ সালের জুলাই মাসে
উনিপের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট যোশেফ লাগুকে সুদানের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করা হয়।
সুদানের (সামরিক জান্তা)
প্রেসিডেন্ট জাফর নিমেরী ক্ষমতায় এসে ‘সুদান সমাজতান্ত্রিক ইউনিয়ন’ নামে একদলীয় শাসন
চালু করার সময় দক্ষিণ নিশ্চুপ ছিল। কিন্তু ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নিমেরী
সুদানে ফেডারেল সরকার ও ইসলামী আইন চালু করতে উদ্যোগী হলে দক্ষিণ আবার বিদ্রোহী
হয়ে ওঠে। সেনাবাহিনীর প্রাক্তন কর্নেল এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষিত অর্থনীতিবিদ
জন গ্যারাং- এর নেতৃত্বে সুদানী জনগণের মুক্তি আন্দোলন (সজমা) ব্যাপক সশস্ত্র
হামলার মাধ্যমে দক্ষিণ সুদানের অর্থনৈতিক,অবকাঠামোগত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল করে দেয়। উক্ত গৃহযুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষে প্রায়
২০ লাখ লোক নিহত হয়। ১৯৮৫ সাল নাগাদ দক্ষিণের ২টি প্রদেশে সজমার কর্তৃত্ব
প্রতিষ্ঠিত হয়।দেশব্যাপী খরা ও দুর্ভিক্ষে নিমেরী সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন শুরু
হলে ৬ এপ্রিল ১৯৮৫ সালে এক রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানে নিমেরী ক্ষমাচ্যুত হন।
সেনাবাহিনী প্রধান ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল আবদুর রহমান সুয়ারেদ ক্ষমতা দখল
করেন। তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সামরিক পরিষদ গঠন করেন ও বিভিনড়ব গ্রুপের সাথে
আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ১৯৮৬ সালের ১-২ এপ্রিল সুদানে গণভোটের আয়োজন করেন। ২৬ এপ্রিল
১৯৮৬ সালে নতুন সংসদ অধিবেশন শুরু হলে জেনারেল রহমান বেসামরিক সরকারের নিকট ক্ষমতা
হস্তান্তর করেন। উম্মাহ পার্টির সাদিক আল মাহদী এ সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত
হন। গণভোট উপলক্ষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের মধ্যস্থতায় দক্ষিণ সুদানে
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। গনভোটের ফলাফল সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ও তাদের এজেন্ট
সুদানী গেরিলাদের অনুকূলে না আসায় Sudan Peoples
Liveration Army (SPLA)জন গ্যারাংয়ের
নেতৃত্বে পুনরায় উত্তরের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করে।জন গ্যারাং সাদিক আল
মাহদীর সরকারকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে ও বিদ্রোহ করে।
সুদানের গণতান্ত্রিক
সরকার উক্ত বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হয়। দেশব্যাপী অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, নিরাপত্তাহীনতা
দেখা দেয়। এরূপ পরিস্থিতিতে জুন ১৯৮৯ সালে কর্নেল উমর আল বশীর এক রক্তপাতহীন
সামরিক অভ্যুত্থানে সাদিক আল মাহদীর সরকারকে অপসারণ করে ক্ষমতা দখল করেন। তিনি
বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিল গঠন করে একনায়কসুলভ সরকার গঠন করেন। উত্তর সুদানে শরীয়া
আইন চালুর শর্তে ন্যাশনাল ইসলামী ফ্রন্ট (NIF) নেতা হাসান-আর-তুরাবী
ওমর আল বশীরের সরকারে যোগ দেন।দক্ষিণ সুদানের বিদ্রোহী নেতা রিয়েক মাশার ও বশীরের
সঙ্গে যোগ দেন। এতে সুদানে শক্তিশালী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। রিয়েক মাশার এর
সহযোগিতায় প্রেসিডেন্ট বশীর সমগ্র দক্ষিণ সুদানে স্বীয় কর্তৃত্ব সংহত করেন।
বিদ্রোহী ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের শক্ত হাতে দমন করার পর প্রেসিডেন্ট বশীর
অতিরিক্ত আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে চরম ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি দেশের সর্বময় ক্ষমতা
গ্রহণ করেন। সকল দল ও গ্রুপ নিষিদ্ধ করে দেন এবং দেশের একমাত্র দল হিসাবে ন্যাশনাল
কংগ্রেস পার্টি (NCP) গঠন করেন। প্রেসিডেন্ট
বশীরের এরূপ স্বেচ্ছাচারী পদক্ষেপের ফলে (NIF) সরকার থেকে বেরিয়ে যায়
এবং (SPLA)-এর সাথে
চুক্তিবদ্ধ হয়ে ২০০০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বয়কট করার আহ্বান জানান। এতে
আসনড়ব প্রেসিডেন্ট নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা হারায়। ক্ষিপ্ত বশীর দেশব্যাপী জরুরি
অবস্থা জারি করে এবং বিরোধী নেতৃবৃন্দকে আটক করেন। নিজ দেশে জনপ্রিয়তা হারানোর পর
পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ প্রেসিডেন্ট বশীরকে ও সুদানকে দুর্বল করার জন্য
মিসরের ইসলামী জিহাদ ও ওসামা বিন লাদেনের আল-কায়েদার সাথে সুদানে সম্পর্ক আবিষ্কার
করে এবং এ অজুহাতে বাণিজ্য অবরোধ আরোপ করে।জন গ্যারাং এর নেতৃত্বে গেরিলা যুদ্ধকে
আরও বিস্তৃত করা হয়।
চতুর্মুখী চাপে
প্রেসিডেন্ট বশির ও সুদান দুর্বল হয়ে পড়লে ২০০৩ সাল নাগাদ পুনরায় শান্তি আলোচনা
শুরু হয় এবং ৯/১/২০০৫ সালে ‘নাইরোবী
কমপ্রিহেনসিভ শান্তিচুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়।
চুক্তির শর্ত মোতাবেক
১. প্রেসিডেন্ট বশীরের
নেতৃত্বে সুদানে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। উক্ত সরকারের গঠন হলো ন্যাশনাল কংগ্রেস
পার্টি (NCP)র প্রেসিডেন্ট
বশীর, SPLM-এর সালভাকির মায়ারভিট ভাইস প্রেসিডেন্ট, ঘঈচ-এর আলী ওসমান তাহা ভাইস প্রেসিডেন্ট, সুদান লিবারেশন আর্মি (SLA)র মিন্নি মিন্নাউবি সাংবিধানিক
উপদেষ্টা এবং দুই কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা।
২. ২০১১ সালে দক্ষিণ
সুদানে গণভোট অনুষ্ঠানেরসময় ধার্য করা হয়, যা এখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
৩. জাতিসংঘনিরাপত্তা
পরিষদ চুক্তি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করবে।
৪. উত্তরও দক্ষিণ সুদান সমানভাবে তেলসম্পদের উপর অধিকার লাভ
করে। চুক্তি স্বাক্ষরের ৭ মাসের মধ্যে অর্থাৎ ০১/০৮/২০০৫ সালে বিমান দুর্ঘটনায় জন
গ্যারাং নিহত হলে পুনরায় গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এ যুদ্ধ দারফুর, লোহিত সাগর উপকূল ও ইক্যুইটোরিয়াল ঘানার সীমানা পর্যন্ত
ছড়িয়ে পড়ে। উত্তরের জানজাবিদ মিলিশিয়ার সাথে দক্ষিণের গেরিলা দল SPLA,
SLA ও JEM মধ্যে এ যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ সুদানের গেরিলা দলসমূহ
যেহেতু সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দাবার ঘুঁটি সেহেতু ২০১১ সালের
গণভোটের স্বার্থে উক্ত যুদ্ধ বন্ধ হয়। নির্বাচনের পর দেখা যাবে উক্ত গেরিলা দলসমূহ
পারস্পরিক যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের বলির পাঠা হবে।
সুদান ও সামরিক বাহিনী : সুদানের জনগণ
বাংলাদেশের জনগণের মতোই গণতন্ত্রপ্রিয়। যখনই তারা ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে তখনই
তারা দেশপ্রেমিকদেরকে নির্বাচিত করেছে। সাম্রাজ্যবাদীরা দেশপ্রেমিকদের সরকার ও
শাসনকে কখনও পছন্দ করে না। কেননা সৎ, জ্ঞানী ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তি ও দল ক্ষমতাসীন হলে সাম্রাজ্যবাদী সুযোগ-সুবিধা
সীমিত হয়ে পড়ে এবং সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন পরিকল্পনা থেমে যেতে বাধ্য হয়। এ জন্যই
দেখা যায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সামরিক অভ্যুত্থানের পিছনে এক বা একাধিক
সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কালো হাত সক্রিয় থাকে। গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ
ব্যাপারে সবচেয়ে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করে। সুদানের প্রতিটি সামরিক অভ্যুত্থানে
বৃটেন ও আমেরিকা জড়িত ছিল। তারা গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় বারবার সুদানকে বাধা
দিয়েছে এবং সামরিক শাসকদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। একই সাথে তারা সামরিক সরকারকে
চাপে রেখে নিজেদের স্বার্থ আদায়ে ও চক্রান্ত বাস্তবায়নে বিরোধী দলকে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে উস্কে
দিয়েছে এবং বিভিনড়ব গেরিলা দল সৃষ্টি করে উক্ত গেরিলা দলকে অর্থ, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ দিয়ে
দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। তাদের কাজ ফুরানোর পর তারা নিজেদের সৃষ্ট
ফ্রাংকেস্টাইনকে নিশ্চিহ্ন করেছে অথবা দৃশ্যপট থেকে বিদায় দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র-বৃটেনের মদদপুষ্ট পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের শেষ পরিণতি,
ইরাকী প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের পরিণতি এবং
জন গ্যারাংয়ের পরিণতি একই সূত্রে বাঁধা।দক্ষিণ সুদানের জনগণের স্বাধীনতা, স্বচ্ছলতা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাম্য নয়। তারা চায় খনিজ
সম্পদে বিপুলভাবে সমৃদ্ধ এবং আফ্রিকার হৃৎপিণ্ডে অবস্থিত দক্ষিণ সুদানের ভূখণ্ডে নিজেদের অবাধ
লুণ্ঠন ও বিচরণ। জন গ্যারাংয়ের ন্যায় অভিজ্ঞ ব্যক্তি দক্ষিণ সুদানের সরকার প্রধান
হলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অবাধ লুণ্ঠন বাধাগ্রস্ত হবে ভেবেই তাঁকে বিজয়ের
পূর্বক্ষণে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক সরকার কোনো
দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া শুরু করলে সেখানে দেশের স্বার্থবিরোধী সরকার অথবা সামরিক শাসক
চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।সামরিক শাসক কোনো দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা নিলে
সেখানে একনায়ককে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, রাজতন্ত্র দেশকে সম্মুখপানে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলে সেখানে গণতান্ত্রিক
বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে সামরিক সরকার চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এভাবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি
পৃথিবীর প্রতিটি উনড়বয়নশীল দেশে প্রধানত মুসলমান দেশে অশান্তি সৃষ্টি করে
মুসলমানদের অগ্রগতিতে বাধা দিয়েছে এবং পুতুল সরকারকে ক্ষমতাসীন করে নিজেদের অন্যায়,
অন্যায্য ও অবৈধ লালসা চরিতার্থ করেছে। সোভিয়েত
ইউনিয়ন পতনের পর থেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছে উদীয়মান
মুসলিম শক্তি। এ লক্ষ্যেই তারা মুসলিম দেশসমূহকে ভেঙে টুকরা করে শক্তিহীন করে
নিজেদের লুণ্ঠনকর্ম সম্পাদনের কার্যμম বাস্তবায়ন করছে। ইতোমধ্যে ইন্দোনেশিয়াকে ভেঙে পূর্ব তিমুরকে আলাদা করা
হয়েছে। সুদানকে ভেঙে উত্তর-দক্ষিণ সুদানে পরিণত করার কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে।
পাকিস্তান ভেঙে তিন টুকরা করার (বালুচিস্তান,পাখতুনিস্তান ও পাকিস্তান) কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ইরাককে
ভেঙে শিয়া-সুন্নি-কুর্দিস্থানে পরিণত করার সিংহভাগ অপকর্ম সম্পাদন করেছে।
সৌদি আরবকে ভেঙে ৬ টুকরা করার গোপন মানচিত্র প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ ভেঙে
পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা করার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। অথচ জাতিসংঘ প্রস্তাব থাকা সত্ত্বেও
কাশ্মীরের গণভোট অনুষ্ঠানে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আগ্রহী নয়। ভারত যদি মুসলিম শাসিত
দেশ হতো তবে অনেক বছর পূর্বেই ভারত ভেঙে কাশ্মীরকে ও সেভেন সিস্টার আলাদা করা হতো।
এই হলো মুসলিম বিদ্বেষী বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সত্যিকার পরিচয়।
গণভোট-পরবর্তী সুদান : সাম্রাজ্যবাদী
শক্তিসমূহ দক্ষিণ সুদানের গণভোটের ফলাফল সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে গণভোটের আয়োজন
করেছে। উত্তর সুদান যাতে এতে হস্তক্ষেপ করতে না পারে তার জন্য উত্তর সুদানের উপর
বাণিজ্য অবরোধ আরোপ করেছে। সুদানী প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশীরকে যুদ্ধাপরাধী আখ্যায়িত
করে আইসিসি কর্তৃক গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। সুদানকে জঙ্গীদের আশ্রয়স্থল
হিসেবে অপবাদ দিয়ে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। ফলে দক্ষিণ সুদানের স্বাধীনতা বর্তমানে
একটি বাস্তব সত্য। তবে সাম্রাজ্যবাদী কর্মকা- সম্পর্কে ওয়াকেবহাল মহল নিশ্চিতভাবে
জানেন, বাংলাদেশীরা যেভাবে ১৯৭১
সালে পাকিস্তানি শাসকদের হাত থেকে বেরিয়ে এসে ভারতীয়দের হাতে জিম্মী হয়েছে,
লুণ্ঠিত হয়েছে, দক্ষিণ সুদানীরাও তদ্রƒপ উত্তর সুদানীদের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন ও ফ্রান্সের কঠিন শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে লুণ্ঠিত হবে। সাম্রাজ্যবাদী
স্বার্থে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে নিঃশেষ হবে। নিজেদের পৈতৃক ভিটেমাটি ত্যাগ করতে
বাধ্য হবে অথবা নিজেদের রক্ত-মাংস দিয়ে সুদানের মাটিকে উর্বর করে সাম্রাজ্যবাদী
শক্তির আকাক্সক্ষা পূরণ করবে। অদূরভবিষ্যতে উত্তর সুদান থেকে পুনরায় দারফুরকে
আলাদা করার চক্রান্ত বেগবান হবে এবং তেল নিয়ে
উত্তর-দক্ষিণ লড়াই শুরু হবে। সমগ্র উত্তর সুদান অস্থিতিশীল হয়ে অস্তিত্বের সঙ্কটে
নিমজ্জিত হবে।
সুদানের ভাঙন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম পলিসি : উপরোক্ত আলোচনায় আমরা দেখেছি, ১৯২৪ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত সুদানে বৃটিশ শাসনের সময়
সুদানকে উত্তর-দক্ষিণ ভাগ (প্রশাসনিক) করা হয়। উত্তর-দক্ষিণ বিভেদের কাল্পনিক
ইতিহাস, কিংবদন্তী রচনা করা হয়,
ম্যালেরিয়া বিস্তারের অজুহাতে উত্তরের লোককে
দক্ষিণ এবং দক্ষিণের লোককে উত্তরে বসবাসের সুযোগ বন্ধ করা হয়। গেরিলা হামলা দ্বারা
দক্ষিণ থেকে উত্তর সুদানীদের বহিষ্কার করা হয়। দক্ষিণ সুদানকে অনুনড়বত রাখা হয়,
দক্ষিণ সুদানের প্রকৃতিপূজারী কালো লোকদেরকে
খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করে স্থায়ী বিভেদের দেয়াল রচনা করা হয়। ঠিক একইভাবে বৃটিশ
শাসক মহল ১৮৬০ সালে অখণ্ড- চট্টগ্রামকে ভেঙে পার্বত্য চট্টগ্রাম নামক আলাদা
প্রশাসনিক জেলা সৃষ্টি করা হয়। ১৮৮১ সালে পুলিশ Act প্রণয়নের
মাধ্যমে উপজাতীয় পুলিশ বাহিনী করা হয়। উক্ত পুলিশ বাহিনী জোরপূর্বক বাংলা
ভাষীদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বিতাড়িত করে। ১৯০০ সালে প্রণীত রেজুলেশনের
মাধ্যমে বাঙালীদের চট্টগ্রামে বসবাসের অধিকার হরণ করা হয়। ভূমি ক্রয়ের অধিকার থেকে বঞ্চিত
করা হয়। মিজোরাম, ত্রিপুরা, অরুনাচল ও আরাকান থেকে উপজাতিদের এনে পার্বত্য চট্টগ্রামে
পুনর্বাসন করা হয়। অ-উপজাতীয়দেরকে জোরপূর্বক পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বহিষ্কার
করার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৩৫ সালে প্রণীত Government of India Act-এর মাধ্যমে পার্বত্য
চট্টগ্রামকে কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে করদরাজ্যে পরিণত করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের
উপজাতিদেরকে বিপুল হারে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা হয় এবং বাংলাদেশের তাবেদার সরকার
কর্তৃক সাম্রাজ্যবাদের কাক্সিক্ষত শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করানো
হয়।সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ ২০০৫ সালের চুক্তির মাধ্যমে দক্ষিণ সুদানে যে গণভোটের
আয়োজন করেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র উক্ত কাজটি বাকি রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠতা আর কিছুটা কমাতে সক্ষম হলে অথবা
প্রতিবেশী দেশসমূহ থেকে উপজাতীয় লোকজন এনে লোকসংখ্যা আরকিছুটা বাড়াতে সক্ষম হলে
এখানেও গণভোটের আয়োজন করাহবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা করে সমগ্র বাংলাদেশের
স্বাধীনতা নস্যাতে টাইম বোমা স্থাপনের কাজ সমাধা করা হবে।
আমাদের করণীয়
১. সাম্রাজ্যবাদের পুতুল
সরকার ও এজেন্টদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা।
২. আমাদের শিক্ষা
ব্যবস্থা, সাহিত্য, নাটক এবং সিনেমার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী চμান্তের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া এবং দেশপ্রেমিক
নাগরিক সৃষ্টির কর্মসূচি গ্রহণ।
৩. জাতীয় ঐক্যের
মূলমন্ত্র ধর্ম, ধর্মীয় শিক্ষা ও
মূল্যবোধকে জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করা। সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত প্রতিহত করার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৪. বিদেশী সাংস্কৃতিক
আগ্রাসন থেকে জাতিকে রক্ষা করা এবংনিজস্ব সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের ব্যাপক প্রচার ও
প্রসার।মানসম্মত স্বদেশপন্থী পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংখ্যাবৃদ্ধি।
৫. কাক্সিক্ষত, মানসম্মত দেশপ্রেমিক নাগরিক সৃষ্টিকে দেশের অর্থনীতি ও
প্রতিরক্ষার চেয়ে অধিক গুরুত্ব দেয়া।
তথ্যসূত্র :
১. মুসলিম জাহান, সোহরাব উদ্দীন আহমেদ
২. উইকিপিডিয়া
লেখক: এস এম নজরুল ইসলাম,
সম্পাদক ও প্রকাশক;
০১৭১১৭২০৯২৩
মাসিকইতিহাস অন্বেষা
No comments:
Post a Comment